#তোমায়_দিলাম_কফির_নিমন্ত্রণ
By #Arifa_Afroze
#পর্ব_৭ ((শেষ পর্ব))
.
.
.
আজ ২৯ মে,বাইরে বৃষ্টি নেই,ক্যাফের মোটা কাঁচে খেলা করছেনা কোনো স্বপ্ন রাজ্য।তবুও বসে আছি চুপচাপ এখনো কোনও বৃষ্টির অপেক্ষায়।আবার কবে এখানে আসা হবে জানিনা।তাই স্মৃতিটুকু এখানেই রেখে যাই,সেই পুরাতন ক্যাফে তে।
আজ হাসপাতালের শেষ ডিউটি ছিল।কাল থেকে নতুন কর্মস্থল বিসিএস এর পোস্টিং।বড্ড বেশি মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে এই জায়গায়টা আর এখানকার মানুষগুলো।এখানকার প্রত্যেকটা করিডোরে আমার বিকশিত হওয়ার গল্প লেখা,প্রতিটা বেডের সাথে নতুন কিছু শেখার অভিজ্ঞতা,আর ওটি ছিল আমার স্বপ্নপূরণের জায়গা।ক্যান্টিনের ধোঁয়াতোলা গরম চায়ের সাথে টা হিসেবে রাজ্যের গল্প,কলিগদের সাথে ট্যুর এর আনন্দ,আর…আর আছে আমার প্রথম প্রেমের গল্প,প্রথম অপূরণীয় প্রেমের গল্প।
●●●
–দোস্ত মিস করি তোকে অনেক,কতদিন হল তোকে দেখিনা।
–প্রীতি,তুই প্রত্যেকবার ফোনে একই কথা বলিস,মাত্র এক মাস হইল এখানে আসার।চিন্তা করিস না কিছুদিনের মধ্যেই দেখা হবে আবার।
–ও,জানিস রেশাদ ভাই এম আর সি এস পাস করে ফেলছে।
এক মাস…
সময় খুব দ্রুত চলে যায়।নতুন কর্মস্থল, নতুন পরিবেশ,নতুন মানুষ আর নতুন অভিজ্ঞতা।সব নতুনের মাঝে আমার সেই পুরাতন শুন্যতা একবার উঁকি দিল।সেই লাইব্রেরীতে শেষ দেখা।এরপর আর হাসিমুখ আগন্তুকের দেখা পাইনি।একসময় ওটি টেবিলের পাশে সার্জন হিসেবে থাকা আমি সেই টেবিলেই কোনোদিন রোগী হিসেবে থাকব বুঝতে পারিনি।রেশাদ ভাইকে ভোলার চেষ্টায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি ভাবা আমি নিজের শরীরের অসুস্থতার ভাষা বুঝিনি।তাই একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে হার মানলাম।সেদিন খুব দ্রুত আমার কলিগদের সহায়তায় সার্জারির ব্যবস্থা হয়েছিল।খুব নরমাল এই অপেরেশন এ যেখানে আধা ঘন্টা লাগে আমার ক্ষেত্রে সেটা গিয়ে ঠেকেছিলো দেড় ঘন্টায়।পেটের ভেতর এপেন্ডিক্স বার্স্ট হয়ে খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছিল।সেসব কিছুই আমার মনে নেই,শুধু মনে আছে অপারেশন শেষে স্বপ্নে আমি রেশাদ ভাই কে দেখেছিলাম,এনেস্থেসিয়ার ঘোরে।
–কিরে আরুশি,শুনতে পাচ্ছিস?
ভিডিও কলে বসে রেশাদ ভাই এর নাম শুনেই আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম।এবার প্রীতির ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম,
–হুম শুনতে পাচ্ছি বল।
–বলছিলাম রেশাদ ভাই পাস করেছে ।
–ও।
–ও মানে?কংগ্রেটস জানা।
–আমার কংগ্রেটস জানানো আর না জানানোয় কি এসে যায়?
–কি এসে যায় মানে?তোর জন্য রেশাদ ভাই যা করল তার পর ওনাকে এইটুকু উইশ তো করা উচিত তোর।
–কি করল মানে?বুঝলাম না।
–আরে তোর ওটির সময় কোথা থেকে ভাইয়া হঠাৎ চলে এলো।এর পর ওটি থেকে শুরু থেকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড এ সারারাত তো ভাইয়াই পাহারা দিল।অবশ্য তোর কেস টা জটিল ছিল একটু।স্যার রাও তাই ভাইয়াকেই ভরসা করেছিল।আর ভাইয়া ছিল জন্য আমাদের কারো টেনশন ই করতে হয়নি।
–তুই আগে বলিস নাই কেন আমাকে এসব?
–আরে তোর অপারেশন এর ঠিক পরদিন থেকেই তো ভাইয়া দৌড়াদৌড়ি শুরু করল নেক্সট টিকেট এর জন্য।এর মাঝেও একবার তাকে হাসপাতালে এ দেখেছিলাম তোর রুম থেকে বের হতে।ভেবেছিলাম তুই জানিস ভাইয়ার কথা।আর আমি তো তোর ডিসচার্জ এর আগেই এখানে চলে আসলাম জয়েন করতে,তাই এই বিষয়ে কিছু বলার কথা খেয়াল ছিলনা আমার।
●●●
ফোন কাটার অনেক্ষন পর্যন্ত তব্দা মেরে বসে রইলাম।
রেশাদ ভাই,আমার জন্য ফিরে এসেছিল?না না নিশ্চয়ই আমার মন যা ভাবতে চাইছে তা সত্যি না।হতেই পারেনা।আরেকবার আমি ভুল বুঝে আমার অনুভূতির ইঞ্জিন চালু করতে পারবোনা।সারারাত মোবাইল হাতে নিয়ে রেশাদ ভাই এর প্রোফাইল এ ঘুরলাম,পুরানো অভ্যেস,সেই প্রথম থেকে।কখন তিনি অনলাইনে আসেন,কবে কোন প্রোফাইল পিকচার দেন সব আমার মুখস্থ।কেও জানলে আমাকে টিপিক্যাল ষ্টকার ভাববে।ভাবতেই মুখে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল।বারবার মেসেঞ্জার এর ঐ সবুজ আলো টায় চোখ চলে যাচ্ছিল।অনেকবার অনেক কথা টাইপ করে ডিলিট করার ইতিহাসের সাক্ষী এই মেসেঞ্জার।ভাবতে ভাবতে আর ভাবনার কথা টাইপ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।
●●●
পরদিন…
অনেক ভোরে উঠে এক কাপ লেবু চা খাওয়া একটা অভ্যেস হয়ে গেছে,কি জানি কাওকে স্মরণ করে এই কাজ করি কিনা।চা হাতে কোয়ার্টার এর জানলার কাছে আসতেই আমরা মন খারাপের সকল মেঘ ভর্তি আকাশ দেখতে পেলাম।আজ হয়ত বৃষ্টি হবে।সকাল থেকেই কারেন্ট নেই,মোবাইল এর চার্জ ও শেষ।এই অবস্থাতেই ডিউটি তে গেলাম।আজ কোনোভাবেই কাজে মন বসাতে পারছিনা,রেশাদ ভাই এর চিন্তা মাথা থেকে সরাতে পারছিনা।যাকে ভোলার এত আয়োজন সেই যেন বারবার নেমন্তন্ন দেয় মনে করার।ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল আজ ডিউটি থেকে।ফ্রেশ হয়ে আসতেই কারেন্ট চলে এলো।মোবাইল টা চার্জ এ দিয়ে কফি তৈরির সরঞ্জাম রেডি করছিলাম।আজ কফি খেতে খেতে বৃষ্টি দেখব সেই প্ল্যান আমার।ঠিক সেই সময় কোয়ার্টার এর দারোয়ান এসে বলল,
–ম্যাডাম আপনার গেস্ট আসছে নিচে ।
একটু অবাক হলাম,এই প্রত্যন্ত এলাকায় আমার পরিচিত বলতে শুধু আমার কলিগ রা,কিন্তু তাদের মধ্যে এই সন্ধ্যেবেলা কারোর তো আসার কথা না।তাই পানির চুলাটা বন্ধ করে এবার নীচে নেমে এলাম।তৃতীয়বারের মত আমার মুহূর্ত থমকে গেল,
–রেশাদ ভাই!!!!!!
আমার পায়ের শব্দ পেয়েও না তাকিয়ে জানালার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রেশাদ ভাই বলে উঠলেন,
–মিস আরুশি,বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।এক কাপ কফি পাওয়া যাবে?
●●●
কফির কাপে চুমুক দিয়েও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রেশাদ ভাই।আমার রুমের সামনের বারান্দায় বসে আমরা দুজন,সামনে কফি কাপ।অনেক্ষন চুপ থেকে কফির কাপে বৃত্ত আঁকা শেষে প্রশ্নটা করেই ফেললাম,
–ভাইয়া আপনি এখানে?
–হুম,আমি পাস করেছি শুনেছ?
–শুনেছি,কংগ্রেটস।
–থ্যাংক ইউ।নেক্সট মান্থ এ আবার ইংল্যান্ড এ যাব।জি এম সি রেজিস্ট্রেশন কমপ্লিট করলেই জব এ ঢুকব।এবার প্রবাবলি আর ফিরবোনা।
এবার চোখের কোণে জল জমতে শুরু করল আমার,লুকানোর জন্য তাড়াতাড়ি কফির মগ টা তুলে নিলাম।রেশাদ ভাই তখনও বলে চলেছেন,
–তাই বাবা মা চাচ্ছিলেন একবারে বউ নিয়ে যেন যাই।
–ও,তো বিয়ে করছেন কবে?
চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বেলকনির রেলিং ধরে বলে উঠলাম।টুপ করে হাতে পানির ফোটা পড়ল,বৃষ্টির নাকি আমার চোখের বুঝতে পারলাম না।
–সেইজন্যই তো এলাম,পাত্রীর ছুটি কবে আছে জানতে।
–সেটা জানতে এখানে কেন?রায়া আপু কে জিজ্ঞেস করেন।আপু তো আর এখানে নেই।
–কিন্তু রায়া কিভাবে জানবে তোমার ছুটি কবে?
বলতে বলতে আমার পাশে এসে দাঁড়াল এবার রেশাদ ভাই,এত কাছে যে আমার হৃদস্পন্দন শুনতে পাবে।ভয়ে এক পা পিছনে যেতে চাইলে আমার হাত টা ধরে কাছে টেনে বললেন,
–ঐ হৃদস্পন্দন তো আমার কাছে নতুন না,অনেক আগে থেকেই শুনতে পাই।এখন আর পালানোর চেষ্টা করে কি হবে?
এবার আমার অবাক হবার পালা।কি শুনছি,সত্যি না মেঘে ভেসে আসা কোনো রংধনু স্বপ্ন,বৃষ্টি শেষে খানিক দেখা দিয়ে উধাও হবে আবার আকাশে।এত কাছাকাছি রেশাদ ভাই যে এখন ওনার নিঃশাস এর শব্দ ও আমি শুনতে পাচ্ছি।আমার বিস্ময়ের দৃষ্টি উপেক্ষা করে আবার বলে উঠেলন,
–কিন্তু আমার হৃদস্পন্দন টা কেন শুনতে পাওনা বলোতো?
বাইরে প্রচন্ড জোরে বাজে পড়ার শব্দের সাথে সাথে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম,একটু দূরে গিয়ে বলে উঠলাম,
–কিন্তু রায়া আপু?
–রায়া আপু কি?
–আপনার গার্লফ্রেন্ড।
এবার চোখে চোখ রেখে বললাম।সাথে সাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল রেশাদ ভাই।বলে উঠলেন,
–কে বলল তোমাকে ‘ও’ আমার গার্লফ্রেন্ড?
–ইউনিট এর সবাই তো তাই বলল।
–সবাই বললেই সত্যি হয়ে যায় নাকি?
–সেদিন রায়া আপুও তো বলল তিন বছর পর সে আপনাকে প্রপোজ করেছিল?
–হুম,করেছিল।আমি কি বলেছি আমার উত্তর ‘হ্যাঁ’ ছিল??প্রপোজ তো তুমিও আমাকে করেছ।
চোখেমুখের অসীম আনন্দ ঢেকে কিভাবে রাখতে হয় জানিনা।সেই মুখশ্রী নিয়েই কপট অভিমানে এবার বলে উঠলাম,
–তো এখন এসেছেন কেন?আমাকেও তো আপনি ‘না’ বলেছেন।
–তোমাকে আমি কখনোই ‘না’ বলিনি।শুধু ভেবেছি কোনো সঠিক পরিস্থিতি তে ‘হাঁ’ বলব।তার আগেই তো তিয়াসের সাথে দেখলাম তোমায়,তুমি ওকে ভালোবাসি বললে।তাই অভিমানে নিজেই কিছুটা দূরে সরে গেলাম।কিন্তু যখন জানলাম সব আমার ভুল ধারণা তার আগেই তুমি পালিয়ে চলে এলে।তাই কাল দ্বিতীয়বার তোমার নেমন্তন্ন দেখে এক মুহূর্ত আর দেরি করিনি।
–আমার নেমন্তন্ন মানে?
–হুম,কাল রাতে এই আমার মেসেঞ্জার এ তোমার নিমন্ত্রনের মেসেজ।
দশম আশ্চর্য হিসেবে রেশাদ ভাই এর মোবাইলে এ আমার মেসেজ দেখতে পেলাম,
“কফি না খান,আমার কফি খাওয়ার সঙ্গী হবেন?”
ঘুমের ঘোরে কখন এই লেখা সেন্ড করে দিয়েছি জানিনা।তবুও সেই অভিমানের লেশ ধরে আবার বলে উঠলাম,
–তার মানে আমার মেসেজ না পেলে আসতেন না,তাইতো?
এবার রেশাদ ভাই রেলিং ধরে হাত পেতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,
–আমার অপেক্ষা ছিল সঠিক পরিস্থিতির।কিন্তু কাল তোমার মেসেজ পাওয়ার পর বুঝলাম,তোমার কথাই আসলে ঠিক।কোন পরিস্থিতি কোন মানুষের জন্য ঠিক সেটা আমি বিচার করার কেও না।যে গল্পে তুমি মুখ্য সেখানে পরিস্থিতির মত গৌণ কারণে আমি পিছিয়ে গেছি বারবার।
কথাগুলো শুনতে শুনতে লজ্জায় টমেটো হয়ে যাওয়া আমার মুখটা আলতো ছুঁয়ে দিয়ে এবার রেশাদ ভাই কাছে এসে বলল,
–অনেক হয়েছে কফির নেমন্তন্ন।এবার আসল কথাটা বলো দেখি।
–আসল কথা মানে?
–বাহ রে ‘ভালোবাসি’ বলবেনা?
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ভুবন ভোলানো হাসির কিছুটা দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম,
–ভালোবাসি,ভালোবাসি ভালোবাসি আমার হাসিমুখ আগন্তুক তোমায়,হয়েছে?
বলেই জড়িয়ে ধরলাম রেশাদ ভাই কে,মুহূর্তেই লজ্জা পেয়ে ছেড়ে দিয়ে বললাম,
–এবার আপনার পালা।
–আমার মানে?
–মানে আপনি বলবেন না??
দুস্টুমি আমার চোখে মুখে।তাই দেখে রেশাদ ভাই বলে উঠলেন,
–মেয়ে,তোমার জন্য জীবনে প্রথমবারের মতন এই বিদঘুটে কফি খাওয়া শিখেছি এই ক’ মাসে,শুধু তোমার নেমন্তন্নে তোমার সঙ্গী হয়ে কফি খাবো বলে।এর পর ও বলতে হবে ‘ভালোবাসি’!!!!!!!!!!!!!!
তবে শোনো…
‘ভালোবাসি’
‘ভালোবাসি’
‘ভালোবাসি’
বৃষ্টির ছন্দে ছন্দে বহুদূর ছড়িয়ে যাচ্ছে শব্দ গুলো ।।।
********** সমাপ্ত **********
●●●
(পরিশিষ্ট::
১৪ই ফেব্রুয়ারির শেষ অংশ…
কেও একজন ক্যাফের মোটা কাঁচের ড্রিম ক্যাচারওয়ালা দরজাটা সজোরে খুলল,টুং টাং শব্দ হল।বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া শার্ট,হাতা গুটানো,চোখের চশমায় বৃষ্টির পানি,হাতে গীটার।জোরে জোরে শ্বাস নেয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে দৌড়ে এসেছে।ওভাবেই সবার চোখের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে ভিতরে ঢুকে পড়ল সে।
চোখ ঘুরছে এদিক ওদিক,কোনো এক বেগুনি কুর্তির চশমাওয়ালা সেই উদাস চোখে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার খোঁজে,যার ক্যাফের সেই কাঁচের দেয়ালের দিকে বিষণ্ন দৃষ্টি দেখেই সেদিন গেয়েছিল ছেলেটি,
‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে’।)
………………….
সমাপ্ত