#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(০৮)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)
হুম তুমি যাকে ভাবছো তিনি ই! রূপক হোসাইন। তোমার একমাত্র ভাই।
এতটুকু বলে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে রিক্সায় উঠে চলে গেল রাহা। নজরাত খানিকক্ষণ সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল গাড়ি না আসা পর্যন্ত।
যখন মতিন মিঞা গাড়ি নিয়ে এলেন তখন নজরাত গাড়িতে বসে পুনরায় সাতকাহন বইটা হাতে নেয় পড়ার জন্য। দুই লাইন পড়ে মনোযোগী হতে পারলো না বার বার রাহা’র বলা কথা গুলো ভাবাচ্ছে তাকে। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সারাক্ষণ, সেদিন রূপক হুট করে বিয়ের প্রস্তাব কেন দিল? এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন না কারণ আছে।
নজরাত এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বহুদিন পর কলেজে আসলো। ক্লাসের সকলে তাকে পেয়ে ঘিরে বসে। নতুন কিছুর জন্য শুভকামনা জানাচ্ছে। শোভা ক্যান্টিনের এক কোনায় বসে রা’গে ফুঁসছে। নজরাত এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো শোভা বহু দূরুত্ব বজায় রেখে বসে আছে। তাই সবাই কে আসছি বলে শোভার পাশে বসে বলল,
—” কি হয়েছে মহারানীর?
শোভা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
—” একদম আমার সাথে কথা বলবি না। আমার কোন বান্ধবী নাই। তুই পুরো ক্লাসের বান্ধবী আমার না।
নজরাত এবার বুঝতে পারলো আসল ঘটনা। সে অন্যদের সাথে মিশেছে বলে শোভার হিং’সে হচ্ছে। এটা বাস্তবিক অর্থেই ঘটে। আমরা আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড দের অন্য কারো সাথে মেলামেশা পছন্দ করি না, সহ্য করতে পারি না। মনে হয় বেস্টুকে হারিয়ে ফেলবো।
নজরাত শোভা কে জরিয়ে ধরে বলল,
—” তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই তো তোর সাথে রোজ রোজ কথা হয় আমার। কিন্তু ওদের সাথে তো হয় না।
—” যতোই কথা হোক তবুও আমার সহ্য হয় না। তুই কেন ওদের কে এতো প্রায়োরিটি দিবি?
নজরাত হতাশ গলায় বলল,
—” এভাবে বলতে হয় না শোভা। হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করো না, হিং’সা করো না, ষড়যন্ত্র করো না ও সম্পর্ক ছিন্ন করো না। তোমরা পরস্পরে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[1]
ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছে মানবতাকে হত্যাকারী কয়েকটি দুরারোগ্য ব্যাধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইসলামী সমাজকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। এখানে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হলেও তা মূলতঃ একটি থেকে উৎসারিত। আর তা হ’ল ‘হিং’সা’। এই মূল বিষবৃক্ষ থেকেই বাকীগুলি কাঁটাযুক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ডাল-পালার ন্যায় বেরিয়ে আসে।
শোভা আমরা কি পারি না এই ছোট ছোট গুনাহ গুলো থেকে নিজেদের রক্ষা করতে?
শোভা নজরাত এর কথায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে। তাকে দেখতে একদম বাচ্চাদের মত লাগছে। নজরাত মুচকি হেসে বলল,
—” ওলে বাবুটা কান্না করে না। তুই যে বুঝতে পেরেছিস এই অনেক। চল এবার ক্লাসে যাই?
—” আচ্ছা চল?
_______
কলেজে ক্লাস করে বাসায় ফিরতে ফিরতে তিনটা বাজতে চললো। নজরাত প্রথমে বাসায় ফিরে সালাত আদায় করে নিল। মনে মনে খুব হাঁসফাঁস করছে এতো দেরি করে সালাত আদায় করার জন্য। জায়নামাজে বসেই তাসবিহ পড়ছিল তখন রূপক কল করে বলল,
—” রাজকন্যা রু…. আর কতকাল না খাইয়ে বসিয়ে রাখবেন আপনার ভাইটাকে? তার যে ক্ষিদে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। আপনি প্লিজ নিচে নেমে আপনার ভাইটাকে কৃতার্থ করেন।
ভাইয়ের এহেন কথায় না হেসে পারলো না নজরাত। ফোন রেখে জায়নামাজ গুছিয়ে, নিচে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসে। সাজ্জাদ হোসেন অসুস্থ মানুষ তাই সময় মতো খাবার খেতে হয় বলে তিনি খেয়ে নিয়েছেন।
নজরাত কোমরে হাত রেখে বলল,
—” কতোবার বলেছি ভাইয়া আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকবে না। কেন বুঝতে চাও না?
রূপক উঠে এসে বোনকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে পাশের চেয়ারে বসে বলল,
—” দেশে থাকাকালীন তোকে ছাড়া ঠিক কতো বেলা খাবার খেয়েছি বল তো?
—” সেটাই তো, কেন করো এমন পাগ’লামী? নিশ্চয়ই ভীষণ খিদে পেয়েছে? চাও না খেয়ে বসে থাকবে?
—” যতদিন পাশে থাকিস ততো দিন ই তো সুযোগ পাই বল? তাছাড়া তো শ্বশুরবাড়ি থাকিস নয়তো আমি ই দেশে থাকি না। এবার কথা বন্ধ করে হাঁ কর তো দেখি?
নিজ হাতে ভাত মাখিয়ে লোকমান মুখের সামনে ধরল রূপক। ভাইয়ার এমন ভালোবাসা দেখে কেঁদে দেয় নজরাত। রূপক বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
—” আমার কলিজার টুকরো বোন কাঁদে না। আ’মৃত্যু আমাদের এই বন্ধন অটুট থাকবে ইনশা আল্লাহ।
নজরাত মাথা নাড়িয়ে ভাত চিবোয়।
_______
আসরের সালাত আদায় করে নজরাত কফি হাতে রূপক এর রুমের দরজায় কড়াঘাত করে। রূপক এর কফি দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। আগে আগে কফি নিয়ে মগে চুমুক দিয়ে বলল,
—” আহ্ কি শান্তি। এই কনকনে শীতের মাঝে এক কাপ কফির গরম উষ্ণতা শরীরকে চাঙ্গা করতেই যথেষ্ট বুঝলি বোনু?
নজরাত মিছে মিছে রা’গ দেখিয়ে বলল,
—” আচ্ছা তাহলে কি আমি চলে যাবো?
রূপক বিচলিত হয়ে বলল,
—” এই না না, আমি তো মজা করছিলাম বোনু।
তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে বেডে বসিয়ে দিল নজরাত কে। দুজনে গল্প জুড়ে দিলো। গল্পের মাঝে নজরাত জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল,
—” তুমি রাহা কে আগে থেকেই চিনতে তাই না ভাইয়া?
রূপক কিছু তটস্থ, কিছু অপ্রতিভ। তার চুপ করে থাকা কেই ইঙ্গিত করে দিচ্ছে যে সে আগে থেকেই রাহা কে চিনতো।
________
রাতে রাদ শাহমাত এ বাসায় এলো! নজরাত কখনোই তাকে আশা করেনি। ভীষণ চমকায় যখন কেউ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুকনো কাশি দিয়ে তার উপস্থিতির জানান দেয়। আর নজরাত তার নোট প্যাড বন্ধ করে দৌড়ে গিয়ে দেখে রাদ শাহমাত দাঁড়িয়ে আছে। তখন রাদ ভাঙা গলায় বলে,
—” মা বলল আপনাকে নিয়ে যেতে তাই এলাম।
নজরাত আড়ালে তাচ্ছিল্যের সাথে ক্ষীণ হাসে। শ্বাস ফেলে বলে,
—” কিন্তু আমি তো যাবো না আপনার সাথে।
—” কেন যাবেন না?
—” যাবো তবে আগামীকাল ইনশা আল্লাহ।
রাদ আর কথা বাড়াল না। নজরাত ও নিজের কাজে ব্যস্ত হল, পড়ার টেবিলের সাথে রকিং চেয়ারে বসে কি যেন লিখতে মনোযোগী হল।
পূর্ব চেনা অনুযায়ী রাদ বাথরুম গেল ফ্রেশ হতে। ফিরে এসে দেখল তার জন্য শ্বশুর মশাই কাজের লোক দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাত অনেক হয়েছে তাই রুমেই পাঠালেন। সারাদিন অফিস করে দুপুরে কি না কি খেয়েছে তার কোন ঠিক নেই। তাই খাবার খেতে বসল। খাওয়ার আগে মনে হল, নজরাত খেয়েছে কিনা একবার জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন। তাই ক্ষীণ স্বরে বলল,
—” আপনি খেয়েছেন?
রাদ এর এতটুকু কথায় নজরাত একটু ভরকালো, দমে যাওয়া কন্ঠে বলল,
—” আলহামদুলিল্লাহ খেয়েছি। আপনি খেয়ে নিন।
রাতটা দুজনের দুই প্রান্তে কাটলো। নজরাত রকিং চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়ে। আর রাদ বিছানায়। সকাল বেলা নাস্তা সেরে অফিসে চলে যায় রাদ। এর মাঝে সৌজন্য মূলক সাক্ষাৎ করে রূপক এর সাথে।
গতকাল রাতে রাহা জানতে পারে তাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে আগামীকাল। সেই থেকে সারারাত স্তব্ধ ঘরে কেঁদে কেটে ভাসিয়েছে। কিন্তু যখন পাত্র হিসেবে রূপক কে দেখতে পেল তখন বিষ্ময় তার আকাশ সম। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রাহা সম্মুখে উপস্থিত সকলের সামনে বলে দেয় সে এই বিয়ে করতে রাজি নয়! এ কথা শুনে রূপক অপমানে, রা’গে ফেটে পড়ে। পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য হয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে,
—” আপনার মতো মেয়েদের থেকে এর বেশি আশা করাটাই ভুল। আপনার মতো মেয়েরা হারাম সম্পর্ক কে ভালোবাসে। তারা পবিত্র বন্ধনের যোগ্য নয়!
উপস্থিত সকলের মুখ থমথমে হয়ে যায়। রাহা শক্ত হয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। নজরাত ছাড়া অন্যরা ঘটনার কিছুই অবলোকন করতে পারে না। শেষে রূপক চাপা রা’গী গলায় বলল,
—” আব্বু আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাইছি না। তুমি চাইলে আসতে পারো?
তারপর সাজেদা চৌধুরীর দিকে চেয়ে দৃষ্টি নত করে বলল,
—” বেয়াদবি মাফ করবেন খালামণি।
তারপর সালাম দিয়ে হনহন করে চলে গেল রূপক। রাহা সেদিকে ছলছল চোখে চেয়ে থেকে দৌড়ে উপরে চলে গেল। আর সবকিছুর মাঝে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নজরাত….
_______
রেফারেন্স:-
[১] বুখারী হা/৬০৭৬; মুসলিম হা/২৫৫৯; মিশকাত হা/৫০২৮।
_______
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।
(