তোমার পরিনীতা – ১৫
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
“প্রীতি…. ”
“শ্রাবনদা আমায় ডাকছিলে? ”
“তোর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে? ”
শ্রাবণের কথা শুনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছিলো প্রীতি।
“বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে এতো খুশি তোর?” শ্রাবণ অবাক হয়ে জানতে চাইলো। ও মনে করেছিলো প্রীতি লজ্জা পাবে, কিন্তু এখন তো ঘোর কলিকাল তাই বোধহয় এসব শিষ্টাচার একরকম উঠে যাচ্ছে।
“এমা ছি… তা নয় শ্রাবনদা। দাদার বকা শুনে বিয়ে ভেস্তে গেছে,” প্রীতি হাত দিয়ে মশা তাড়াবার ভঙ্গিতে কথাটা বললো।
“ওহ তাই বল,আমি ভাবলাম তুই বুঝি বিয়ের খুশিতে নাচছিস।”
“ধুর… আমার আগে সুমনদি আছে না? আর দাদা তো মাকে এতো বকেছে যে, সহজে মা আর আমার বিয়ের নাম নিবে না।”
“হমমম ” শ্রাবণ হাসলো। এই মঞ্জুমামীর কাজই হলো সব কিছুতে ভেজাল পাকানো।
“আমি এবার যাব শ্রাবন দা… দেরী হলে মা আবার বকবে।”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে তুই যা।”
কিন্তু প্রীতি চলে যাবার পরেও, ‘আমার আগে সুমনদি আছে না?’ কথাটা পিছু ছাড়লো না শ্রাবণের।
“ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি”
অরুনিমারদির কন্ঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে সুমনের কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। অরুনিমাদি, চারুর পিসতুতো বোন।
সুমন ভেবে পাচ্ছিলো না এতো চমৎকার করে মানুষ গান গায় কি করে? কি দরদ ঢেলেই যে গানটা গাইলো অরুনিমাদি, সুমনের মনে হচ্ছিলো ওর মনের কথাগুলোই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
“আদিত্য কাল আমাদের থিয়েটারে নাটক দেখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছে অরুনিমা, তুই যাবি আমাদের সাথে?” মনোরমা জানতে চাইলেন। অরুনিমা বহুদিন পরে বেড়াতে এসেছে মামাবাড়ি।
” না গো মামী, আমার সামনের সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, নাটক দেখতে গেলে শেষকালে পরীক্ষায় পাশ করাই হবেনা।”
“কি যে বলিস… একবেলা নাটক দেখলে বুঝি কেউ ফেল করে?”
অরুনিমা হাসে, সত্যি বললে কি আর মামী ওকে ছাড়বে, কাল সারাদিন রাজীবের সাথে ঘুরবে ও, বেচারা ওকে খুব মিস করছে।
মনোরমার কথা শুনে সুমন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসার জন্য উঠে দাড়াল। মন ভালো ছিলো না বলে ও দুপুরে খেয়েই আজ চারুর সাথে গল্প করতে চলে এসেছিলো। শ্রাবনদাকে যতোটুকু পারে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে ও এখন। কষ্ট হয়না তা না কিন্তু ওর কষ্ট শ্রাবণদার খুশির চেয়ে দামী নয় এই যা।
সুমনকে উঠতে দেখেই মনোরমা ওর হাত চেপে ধরলেন,” অ্যাই তুই কোথায় ছুটছিস… বোস একটু। আমি আজ পায়েশ করেছি সবার জন্য, খেয়ে তারপর যা।”
সুমন আবার বসে পড়লো। ও যেখানে বসে আছে সেখান থেকে শ্রাবণদাদের বাড়ির ছাদটা স্পষ্ট দেখা যায়। সুমনের মনে হলো লম্বা মতো কেউ একজন ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে এ দিকেই তাকিয়ে আছে। বুকটা ভীষন জোরে ধ্বক করে উঠলো সুমনের…অন্ধকার হলেও ওটা যে শ্রাবনদাই সেটা বুঝতে সমস্যা হলো না সুমনের। কিন্তু পর মুহূর্তে নিজেই নিজেকে খুব করে বকলো সুমন। শ্রাবনদার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নাই যে ওখানে এসে দাড়িয়ে থাকবে ওকে দেখার জন্য, তাও এই সন্ধ্যেবেলায়। স্বপ্ন দেখা ভালো কিন্তু সেটাও সীমার মধ্যেই দেখা উচিত।
“কিরে সুমন টেবিলে আয়, মা পায়েশ খেতে ডাকছে।”
“আসছি,” সুমন আর বাইরে তাকালো না। প্রতিটি
মুহূর্তে ও প্রার্থনা করে যেন শ্রাবণদার কথা ভুলেও আর মনে না আসে কিন্তু পোড়ার চোখদুটো যেদিকে তাকায় সেদিকেই শুধু ঐ মুখটাকেই খোঁজে।
“তোর কি তাহলে ঐ মেয়েটাকে পছন্দ? ” নির্মলা বড় ছাপবাক্সটা খুলে শীতের কাপড় গোছাচ্ছিলেন।
“কোন মেয়েটাকে? ” শ্রাবণ অবাক হয়ে জানতে চাইলো। মা কোন মেয়ের কথা বলছে!
“ঐ যে মৌমিতা বলে তোর যে তোর বান্ধবী, ওই মেয়েটা।”
“মা… মৌমিতা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুমি এর মধ্যে এসব আজেবাজে চিন্তার রসদ কোথা থেকে পাও বলতো? ” শ্রাবণ এমনিতেই আজকাল মহা বিরক্তিকর সময় কাটাচ্ছে, তার উপর মা যে কোথা থেকে এসব উদ্ভট জিনিস যোগাড় করে সেই জানে।
“বারে তাহলে তুই বিয়ে ভাঙ্গলি কেন? ”
“আশ্চর্য আমি কখন বিয়ে ভাঙ্গলাম, মেয়ে পক্ষই তো পিছিয়ে গেল।”
“তো যাবে না তো কি… তোমাদের মেয়ে বন্ধুরা সব এসে তোমাদের গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে, তো এতে মেয়ের মামার আর কি দোষ ? ” নির্মলা হেসে হেসে টিপ্পনী কাটলেন।
“মা এসব কিন্তু অতিরিক্ত হচ্ছে। কে কখন আমার গলা ধরে চুমু খেল?”
“আমি সামনে ছিলাম বলে খেতে পারেনি নইলে ঠিক খেত। ”
শ্রাবণ দাঁতে দাঁত চাপলো। এই মুহুর্তে মাথা ওর ট্রেনের ইঞ্জিনের মতোই গরম। তার মধ্যে মা এসে ইচ্ছে করে এসব মজা করছে।
“তাহলে কি তোর ঐ লাবণ্য মেয়েটাকে পছন্দ? মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর করে কথা বলে। কপালে কি সুন্দর টিপ দেয়…. ভারী মিষ্টি দেখতে।”
” টিপ তো সুমোও দেয়,” কথাটা মুখ ফস্কে বলেই চুপ হয়ে গেলো শ্রাবণ। মুখটাও আজকাল বেঈমান হয়ে গেছে সুমোর মতো। তাই এক রকম পালিয়ে চলে এলো শ্রাবণ মায়ের ঘর থেকে। নির্মলা অবশ্য শ্রাবণের কথাটা তেমন আমলে নিলেন না। ও দুটো সারাদিন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকে আর গোল বাঁধায়, ভাগ্যিস দুটো জমজ ভাইবোন হয়নি…. হলে গলায় দড়ি দিতে হতো নির্মলার।
আজকাল শ্রাবণের ঘরে মোটে আসেই না সুমো, এমনকি ঘরও গোছায় না। শুধু মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে পরিচিত কন্ঠটা শুনতে পায় শ্রাবণ, কিন্তু এরকম হলে শ্রাবণ রাগ দেখাবেটাই বা কাকে, সুমো ছাড়া আর কারও উপর তো ওর রাগ ফলানোর অভ্যাস নেই।
অসহায় রাগটা ততক্ষনে আবারো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো থেকে থেকে চমকাচ্ছে শ্রাবণের মনের ভিতরের ছোট্ট খুপরিতে। এই অসহ্য অশান্তিটুকু উগরে দিতে না পারা পর্যন্ত শ্রাবণের শান্তি নেই আর রাগ ঢালবার পাত্রীরও কোন খোঁজ নেই। সে দিব্যি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। শ্রাবণের কোন খোঁজ রাখারই তার দায় নেই আজকাল, একদম অকৃতজ্ঞ একটা মেয়ে। কিন্তু সুমোটা যে এরকম করছেই বা কেন… কতবার করে নানা কায়দায় তো মাফ চাইলো শ্রাবণ। তারপরও শুধু শুধু জেদ ধরে বসে আছে….. শয়তান একটা মেয়ে।
শ্রাবণ, প্রীতিকে তখন বার বার বলে দিয়েছিলো সুমন বাসায় আসলে অবশ্যই যেন আজ ওর সাথে দেখা করে অথচ সে আসেনি, চারুদের বাড়ি গিয়ে বসে আছে। আদিত্যর সাথে গল্প না করলে আজকাল সুমোর পেটের ভাত হজমই হতে চায়না, ভর সন্ধ্যাতেও তাই আজকাল ও বাড়িতেই আঠার মতো লেগে থাকে।
শব্দ করে ঘরের মধ্যে আলো জ্বলে উঠতেই কেঁপে উঠলো সুমন। ইশশ… কি অপদস্তটাই না এখন হতে হবে। কথাটা আসলেই একশ ভাগ সত্যি, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। তা না হলে ও তখন দিব্যি শুনে এলো যে, মা আর ছেলেতে মিলে দিব্যি বিয়ের আলোচনা চলছে অথচ ও আলমারি খুলে জিনিসটা সরিয়ে নিতে পারলনা অমনি সে এসে হাজির।
শ্রাবন লাইটটা জ্বালিয়ে চিৎকার করতে যেয়ে থেমে গেল। কে ওটা আলমারির সামনে?
“কি চুরি করতে এসেছিলি শুনি?” সুমনের পেছনের হাতটা জোরে চেপে ধরলো শ্রাবণ।
“আমি কিছু চুরি করিনি শ্রাবনদা, বিশ্বাস কর।”
“বললেই হলো তুই হলি ঘাঘু চোর, কি নিয়েছিস বল?”
“এই ওষুধ দুটো নিতে এসেছিলাম,”সুমনের মুখটা পিচের চেয়েও কালো হয়ে গেল। প্রীতির সেই ভাঙ্গা জায়গার ব্যাথাটা আবার কেন যেন বেড়েছে। আসলে আমাবস্যা- পূর্নিমায় এসব ব্যাথাগুলো কেন যেন বাড়ে। সুমন তাই দুুটো ব্যাথার ওষুধ নিতে এসেছিলো, কিন্তু এভাবে চোরের মতো ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি।
শ্রাবণ তখনও সুমনের হাতটা শক্ত হাতে ধরে রেখেছে। শীতে গাছে পাতা না থাকলে যেমন ন্যাড়া লাগে, সূর্যটা মেঘের আড়ালে লুকালে মনটা যেমন ভারী হয়ে আসে, সকাল সকাল মায়ের বকুনিটা না খেলে যেমন মনে হয় কি যেন খাওয়া হলো না, ওর শক্ত হাতে ধরে রাখা এই মেয়েটা না থাকলেও ঠিক তেমনি ওর ঘরটায় কোন প্রান থাকে না… বুক ভরে শ্বাস নিয়েও শান্তি লাগে না। কিন্তু এখন ঘরটা আলোতে ভরে গেছে… অন্যরকম আলোয়, শ্রাবণ আলোটার নাম জানেনা। কিন্তু ওর ভালো লাগছে, অদ্ভুত এক স্বস্তিতে মনটা ভরে গেছে।
“আমি খুব অন্যায় করেছি… আর কোনদিন তোমায় না বলে তোমার ড্রয়ার ছোঁব না।”
শ্রাবন উত্তর না দিয়ে কান্নাভরা চোখদুটো মনযোগ দিয়ে দেখছিলো, কতদিন এই বড় বড় চোখদুটো ও এতো কাছ থেকে দেখেনি, কাউকে বকেনি, কানদুটো মলে দেয়নি। এই কতদিনটা কতদিনের? শ্রাবণতো ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছিল ওকে না পেয়ে, অথচ এই হতচ্ছাড়ি পাঁজি মেয়েটার একবারও ওর বকা খেতে ইচ্ছে হয়নি!
“কেন? ”
“কি কেন?”
“বলছি আমার আলমারির ড্রয়ারের হিসেবটা তো বরাবর তোর কাছেই থাকে, তাহলে ওতে হাত দিবি না কেন? ”
“আমার হিসেবে খুব গোলমাল হয় শ্রাবণদা, এখন থেকে তুমি নিজে হিসেবটা রাখলে ভালো হয়।”
“আমার ওসব ফালতু হিসেব রাখার সময় নেই… তুই পারবি কিনা সেটা বল।”
“কিন্তু বাড়ির কাজের লোক হয়ে এতোবড় দায়িত্ব নেওয়াটা কি ঠিক হবে, না বুঝে যদি তোমার ক্ষতি করি।”
“আর ক্ষতি… যে অপূরনীয় ক্ষতিটুকু করেছিস তা তো আর কোনদিন পূরন হবেনা, তবে আর যেন ক্ষতি না হয় সে জন্য এখন থেকে মনযোগ দিয়ে কাজ করবি।”
“কাজ! ”
“হুমম… তুই তো বললি তুই বাড়ির কাজের লোক। তাই আমি ঠিক করেছি তোকে আমার ম্যানেজার বানাবো।”
“মানে? ”
“মানে আপাতত আমার এই আলমারির দায়িত্ব তোর। প্রতিদিন সকালে উঠে আর সন্ধ্যায় বাড়ি এসে যেন দেখি তুই আমার সামনে উপস্থিত। প্রতিদিনের হিসেব প্রতিদিন দিবি মনে থাকে যেন।”
“প্রতিদিন সকাল- সন্ধ্যা! আর আমি যদি এই চাকরি না করি, আমার সামনে পরীক্ষা… সব সময় আসা সম্ভব না।”
“না করলে আমার আলমারি থেকে যা টাকা- পয়সা, ওষুধ, চকলেটের পয়সা, এমনকি তোকে যে এতো বছর ফ্রীতে পড়িয়েছি সেটা কড়ায় গন্ডায় তোকে ফিরিয়ে দিতে হবে।”
“কি! ”
“হ্যাঁ, সিম্পল। গিভ অ্যান্ড টেক। এই হাত দিয়ে নাও আর এই হাত দিয়ে দাও।”
সুমন মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। শ্রাবণদা কেন শুধু শুধু আবার ঝামেলা পাকাচ্ছে। বেশ তো ছিলো ও দূরে দূরে, আবার কেন কাছে ডাকা? চিৎকার করে কাঁদতে চাইলো সুমন কিন্তু এভাবে সঙ সেজে মানুষকে দেখানোর কোন শখ নেই ওর। কান্নাটা তাই গিলে ফেললো সুমন।
সুমন খুব দুঃখ পাচ্ছে ওর কথায় বুঝতে পারছে শ্রাবণ, কিন্তু ওর কিছু করার নেই। ইনফ্যাক্ট ওর হাতে কিছুই নেই। শ্রাবণ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, জরুরী ভিত্তিতে ওর ওষুধ চাই আর সুমো ছাড়া অন্য কোন ওষুধের নাম ওর জানা নেই। তাই সুমোকে কিছুটা দুঃখ দিয়ে হলেও শ্রাবণকে বাঁচতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা এই আদিত্যর কাছ থেকে না সরালে ওর সুমো বেদখল হবার সম্ভাবনা আছে। সুমো শুধু শ্রাবণের ব্যাস…. ডিসিশন ফাইনাল আর আদিত্যকে এটা মানতে হবে।
“আমি কি এবার যাব?”
“কাল সকাল সকাল বই খাতা নিয়ে চলে আসবি।”
“কিন্তু আদিত্যবাবু তো… ”
“আমি পড়িয়ে দিব। ”
“কিন্তু তুমিই বলেছিলে আর পড়াবে না ।”
“সেই আমিই তো বলছি যে আবার পড়াবো , তোর প্রবলেমটা কোথায় বলতো সুমো? না মানে আমি ভালো পড়াই না এটা বলতে চাইছিস।”
“এমা.. না.. না তা বলবো কেন? ” মনে মনে নিজের কপাল চাপড়ালো সুমন। তোমার কোন দোষ নেই শ্রাবনদা। তুমি তো সবসময়ই ভাল পড়াও, সব দোষ আমার। তুমি যতক্ষন কথা বলো আমিতো সবই শুনি… শুধু বুকটা ইদানিং এতো ধুকপুক করতে থাকে যে কথাগুলো কান দিয়ে ঢুকে যে কোথায় হারিয়ে যায় তা শুধু আমার মন জানে।
“হমম.. তাহলে কাল থেকে নিয়ম করে এঘরে পড়তে আসবি।”
“আচ্ছা। ”
“কথার কোন নড়চড় যেন না হয়।”
“হবেনা। ”
“ঠিক আছে যা। আর প্রীতিকে এই ওষুধের সাথে গ্যাসের ওষুধ দিস দয়া করে, নাহলে শুধু ব্যাথার ওষুধ গিলিয়ে শেষে উকিলের ঘাড়ে সব দোষ দিবি। এখনতো আবার একজন দিগগজ পন্ডিত মশাই আছে তোদের।”
সুমন, শ্রাবণের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে এক ছুটে সোজা বাসায় চললো। দিগগজ পন্ডিত… হাসতে হাসতে নিজের ঘরে ঢুকলো সুমন, আদিত্য বাবুর কপালে ভালো একখানা নাম জুটলো। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মন ভারী হয়ে এলো সুমনের, কাল সকাল থেকে আবার নতুন কি তান্ডব শুরু হবে কে জানে?
শ্রাবন অনেকদিন পর একা একাই প্রান খুলে হাসলো,” সুমো তুই এতো সাফাইয়ের সাথে চুরি কবে শিখলিরে, আমার মনটা কখন চুরি হয়েছে আমি টেরই পাইনি। এখনতো তুই বাড়ির কাজের লোক না হতে চাইলেও তোকে ওই পদে নিয়োগ করবো। আমার এখন চব্বিশ ঘন্টা তোকে চাই চোখের সামনে। ”
…..চলবে
তোমার পরিনীতা – ১৬
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
“আমি কি এবেলার টাকার হিসেবটা এখন একটু দিয়ে যাব? ” শ্রাবণের ঘরের ভিতরে গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইলো সুমন। সকালে প্রায় দশপাতা পড়া দাগিয়ে দিয়েছে শ্রাবণ আজ ওকে, তার বেশিরভাগ গুলোই সুমনের মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। আরো বেশ কয়বার না পড়লে ওগুলো ওর মাথায় কিছুতেই ঢুকবে না।
বড় আয়নাটার সামনে দাড়িয়ে নিজের চুলগুলো নিয়ে নানা কায়দায় আচড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিল শ্রাবণ। কিন্তু কোনটাই ওর বিশেষ পছন্দ হচ্ছে না। আজ সেলুনে গিয়ে নতুন কায়দায় চুল কেটেছে সে, কিন্তু এখন সেগুলো বাগে আনতে যেয়ে ভীষন কষ্ট পোহাতে হচ্ছে ওর। ধ্যাত্তেরি…. .
“শ্রাবণদা….. ” আগের চেয়ে জোরে প্রায় খানিকটা চেঁচিয়েই বললো সুমন। সেই কখন থেকে নিজের চুলগুলো নিয়ে মেয়ে মানুষের মতো করছে শ্রাবনদা, সুমনের ভারি রাগ হচ্ছে। সামনের ওই চুলগুলো লাল ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলে বেশ হতো।
“ওহ এসে গেছিস। আয় তো দেখি এখানে…. আমাকে একটু ভাল করে গুছিয়ে দেতো,” শ্রাবণ চিরুনী রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
“আমি!” সুমন বড় বড় চোখ করে তাকাল। শ্রাবনদার কি আজকাল অ্যামনেশিয়া হয় নাকি যখন তখন, ও কি করে শ্রাবনদাকে গুছিয়ে দিবে… ডাব্বুর মতো ছোট আট-নয় বছর বয়সী ছেলে হলে না হয় আলাদা কথা ছিল।
“হ্যাঁ, তুই… আলমারি থেকে ভাল দেখে একটা স্যুট বের কর দেখি আমার ৷ রাতে কিছু পুরানো ফ্রেন্ড মিলে একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদারের ব্যাবস্থা করেছি। বন্ধুদের সাথে ওদের ফ্যামিলিও থাকবে, বলা যায়না বিয়ের জন্য আমাকে কারও পছন্দ হয়েও তো যেতে পারে।”
হাসি হাসি মুখ করে বললো শ্রাবণ।
সুমন, শ্রাবণের দিকে এক পলক তাকিয়েই অন্য দিকে চোখ ফেরালো। শ্রাবণদার যতো আজগুবি কথা… তাকে কারও পছন্দ হয়েও যেতে পারে, ঢঙ… ওদিকে নিজে কোন মেয়ের প্রতি গরজ দেখায়না… না হলে এতোদিনে কবে বিয়ে হয়ে যেতো। ওই মৌমিতাদি তো মৌমাছির মতো ঘুরতেই থাকে, তবু বাবুর চোখ খোলে না।
“নে নে তাড়াতাড়ি কর,” শ্রাবণ তাড়া দিল সুমনকে।
সুমন ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাপড় বের করার জন্য চাবিটা হাতে নিল, তারপর আলমারির দরজা খুলে সেখানে ঠায় দাড়িয়ে রইলো।
“কি হলো বের করে আন ” শ্রাবণ প্যাকেট থেকে নিজের জন্য কেনা নতুন জুতাজোড়া বের করলো। শ্রাবণ জুতা আর বেল্টের ব্যাপারে ভীষন চুজি, ব্ল্যাক ওর অল টাইম ভেফারিট। কিন্তু এবার ব্রাউন কিনেছে… সুমোর ব্রাউন কালারের প্রতি উইকনেস আছে জানে শ্রাবণ।
আসলে আজ অব্দি শ্রাবণ জামা জুতো ম্যাচ করে পরতো বাইরের লোক বাহবা দিবে বলে, কিন্তু এখন সেই লোকগুলো পাল্টেগিয়ে একজন মানুষে হয়ে দাড়িয়েছে…. সুমোর চোখে ভাল না লাগলে পুরো চেষ্টাটাই বরবাদ।
“তুমি কোনটা পড়বে সেটা আমি কি করে জানবো, তুমি বলো আমি দিচ্ছি,” সুমন উষ্মার সাথে জানাল। কিন্তু আসলে সুমন নিজেও জানে যে, শ্রাবন এমন ভয়ঙ্কর কিছু বলেনি ওকে যে ওর বিরক্ত হতে হবে। শ্রাবনের কাপড়- চোপড় বরাবরই ওর তত্বাবধানেই থাকে। মাঝখানের কটা দিন হয়তো একটু এদিক সেদিক হয়েছে। কিন্তু সেটা এমন কোন দোষের কিছু নয়।
“না আমি বলবো না…. আজ তুই ঠিক করে দে। দেখি তোর সৌন্দর্যবোধ কেমন,” শ্রাবন ফিচেল একটা হাসি দিল।
শ্রাবণের কথায় কেন… কে বলবে… বিছুটি পাতা গায়ে লাগার মতো জ্বালা করে উঠলো সুমনের অন্তর্আত্মা পর্যন্ত। কিন্তু জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হলে যদি এ অশান্তি শেষ হতো তাহলেও বোধহয় কিছুটা শন্তি পেত সুমন কিন্তু সেখানেও কোন আশার আলো নেই। সুমন জোরে জোরে শ্বাস ফেলে অভিমান দমনের বৃথা চেষ্টা করলো।
“আমার মনের কোন সৌন্দর্যবোধ নেই শ্রাবনদা তাছাড়া আমার অভিজ্ঞতারও যথেষ্ট অভাব আছে। আমার উপর ভরসা করে কাপড় পরলে লোক হাসানোর মতো পরিবেশ তৈরী হতে মোটেই সময় লাগবেনা। তারচেয়ে তুমিই বলো কোনটা পরবে, আমি বের করে দিচ্ছি।”
একেবারে টান টান উত্তর সুমনের। কোথাও কোন দুর্বলতা নেই, আবার প্রয়োজনের চাইতে বাড়তি অহংও নেই…. কিন্তু কি যেন একটা…. দুর্ভেদ্য দেয়ালের মতো যেটা সুমনকে, শ্রাবণের থেকে আলাদা করে ফেলছে।
সুমনের কথায় শ্রাবণ কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কথাগুলো কি সুমোই বললো! মাত্র কয়টা দিন.. এর মধ্যেই কি এতোটা বদলে যেতে পারে কোন মানুষ! কৈ ওর কাপড় তৈরীর সময় তো সুমো মানা করেনি কোনদিন, উল্টো ওর কাপড়ের হিসাব দর্জি ওর চাইতে সুমোর কাছে বেশি দেয়। তাহলে?
অভিমান… টুং করে কানের গোড়ায় কেউ ঘন্টি নেড়ে বলে দিয়ে গেল শ্রাবণের। বেশ করে আরো হাঁকিয়ে হাঁকিয়ে বলো কাজের মানুষ। বেশ হয়েছে… এতোকাল বিনি পয়সায় সেবা পেয়ে এসেছ আর এখন হেদিয়ে মরোগে যাও।
আরে তা হবে কেন.. আমি মোটেও বিনি পয়সায় কোন কাজ করাইনি কখনো সুমোকে দিয়ে বরঞ্চ ওর সমস্ত খরচ এতোকাল ধরে টেনে আসছি। নিজেই নিজেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল শ্রাবণ।
হাবা গঙ্গারাম… ভালোবাসার মানুষের পিছনে পয়সা খরচ করলে তার হিসেব নিতে আছে! পয়সা সেতো আদিত্যও নেয়নি, তাহলে কি দাড়ালো আগে থেকে পরিচয় থাকলে আদিত্যও সব ফ্রিতেই পড়িয়ে দিতো সুমনকে… তাহলে তো আদিত্যও, সুমনের জন্য সুপাত্র কি বলো?
উফফফফ……… এতো জটিল কেন সব। শ্রাবণের মনে হলো ওর মগজ গলছে এই সব অসুস্থ তুলনা করে করে। কে কার কি করেছে, কাকে ফ্রিতে খাইয়েছে, কাকে ফ্রিতে পড়িয়েছে তার হিসেব করতে গেলে ওর পাগল হতে দুই সেকেন্ড সময় লাগবে। তার চেয়ে সোজা রাস্তায় চলা ভাল। সুমো শুধু শ্রাবনের এই হলো শেষ কথা.. সে এ জন্মে হোক আর পরজন্মে। অন্যকারো হাতে সুমোর হাত সহ্য করা দূর… মেহমানদারি করতে দেখলেও শ্রাবণের গা জ্বলে যায়, এর চেয়ে স্পষ্ট করে ভালোবাসার প্রতি অধিকার বোধ ওর আগে কখনো হয়নি। লাবণ্যর প্রতি সূক্ষ্ম একটা আগ্রহবোধ ছিলনা সেটা বললে মিথ্যে হবে, কিন্তু ভালোলাগা আর ভালোবাসায় একটা বিশাল ফারাক আছে মৌমি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে সেটা জানতেই পারত না শ্রাবণ। লাবণ্য সব দিক দিয়ে সুমোর চেয়ে এগিয়ে… হোক সে সৌন্দর্য, শিক্ষা- দীক্ষা বা পারিবারিক অবস্থান। কিন্তু তারপরও এই শ্যামলা মেয়েটার মুখ না দেখলে শ্রাবণের দিন শুরু হওয়ার আগে শেষ হয়ে যায়। এই জিনিস হাজার লাবণ্য এসেও পূরন করতে পারবেনা… শ্রাবন তাই মনে মনে ঠিক করেছে লাবণ্যর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে ও নিজের এতোবড় নির্বুদ্ধিতার জন্য। সাথে মৌমিতাকে ধন্যবাদ দিবে ওর চোখের সামনের পর্দাটা তুলে দেবার জন্য। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি যেটা সেটা হলো এখন এই কঠিন সত্যটা সুমোর মাথায় ঢোকানো।কিন্তু সুমো ওকে সেভাবে ভালোবাসেতো?
খানিকটা ইতস্তত করেও শেষে পর্যন্ত সুমনের হাত দুটো ধরে ওকে নিয়ে বিছানায় বসাল শ্রাবণ। নরম স্বরে জানতে চাইলো
” তোর হয়েছেটা কি সুমো? ”
শ্রাবণের কথা আর কাজ দুটোই আজ পাল্লা দিয়ে এতো অস্বাভাবিক যে… দ্রুত শ্রাবণের হাত থেকে নিজের হাত দুটো টেনে সরিয়ে নিল সুমন,” কি আবার হবে,কিছু হয়নি তো।”
“কেন অভিনয় করার চেষ্টা করিস সুমো… তোর হাসির কোনটা আসল, কোনটা নকল আমার চেয়ে বেশি কেউ চেনে? তুই একবার বল সমস্যাটা আসলে কোথায়.. আমার ভুল হলে আমি সেটা শুধরে নিচ্ছি।”
শ্রাবণের কথাটা সুমনের কচি মনের কোথায় গিয়ে ধাক্কা মারল একমাত্র বিধাতা জানেন। দুঃখগুলো আসলে বড়ই অবিবেচক… জাত-পাত, ধনী- গরীব কিছুই মানেনা। ভূমিকম্পের লাভার মতোই সুমনের ভিতরের দুঃখগুলো তাই হালকা সমবেদনা পেতেই ছিটকে পড়ে পুরো এলাকাকে কাঁপিয়ে একদম তচনচ করে দিতে লাগলো।
শ্রাবণ এমন দৃশ্য যে আজ প্রথম দেখলো তা কিন্তু নয়। কিন্তু তার মনের পট পরিবর্তন বিশাল এক তারতম্যের সৃষ্টির কারন হয়েছে এখন। আগে যেখানে সুমনকে কাঁদতে দেখলে একরাশ বিরক্তি এসে ভর করতো সেখানে আজকাল থেকে থেকে নাম না জানা এক ব্যাথা যেন ঘিরে ধরে ওকে। খানিকটা সময়ের জন্য নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় শ্রাবণ। মন, শরীর কোনটাই তখন আর সঙ্গ দিতে চায়না। প্রিয় মানুষটাকে দুঃখ পেতে দেখলে মানুষ এতোটা আলোড়িত হয়… এতো আবেগপ্রবন হয়, আগে জানা ছিলনা শ্রাবণের। সুমনের চোখের পানির প্রতিটা ফোঁটাও আজকাল হীরার চেয়ে দুর্লভ লাগে
শ্রাবনের, সুমনের হাসির তুলনাটা না হয় তোলাই থাক। কিন্তু ওর কারনেই ভালোবাসার মানুষটা দুঃখ পাচ্ছে এর কি প্রতিকার করা যায় সেটাই প্রতিনিয়ত শ্রাবনকে এখন পোড়াচ্ছে।
ইচ্ছে হলো সুমোকে ভীষন জোরে জড়িয়ে ধরে, চোখের পানিগুলো এক নিমেষে শুষে নেয়… কিন্তু ভাবা যতো সহজ করাটা কেন যেন তার চাইতে অনেক অনেক গুন কঠিন। জড়িয়ে ধরা দূরে থাক, আগের মতো সহজ ভাবে মারার জন্যও এখন আর হাত উঠেনা শ্রাবণের। কোথায় যেন একটা বড় ধরনের গোলমাল হয়ে গেছে। এখন সুমনের অনুমতি ছাড়া কোনটাই শ্রাবণের অধিকারে নাই… মায়ের ইঙ্গিতপূর্ন যে কথাগুলো নিয়ে ভীষন রাগ হয়েছিল সেদিন… সেইসব পুরুষের দল আজকাল শ্রাবণকেও বড্ড ভাবায়। পরপুরুষ থাকলে তার বিপরীতে নিজের পুরুষ বলেও একটা শব্দ জন্মগত ভাবে থাকবে। সুমোর জীবনে সেই পুরুষটি কে? সে নিজে না আদিত্য নামের অচেনা কেউ… শ্রাবন জানেনা।
কতটা সময় সুমনের দিকে অপাঙ্গ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল জানেনা শ্রাবণ। কিন্তু দেয়াল ঘড়িতে ঢং করে শব্দ হতেই নিজেকে দ্রুত সামলে নিল সে।
আজকাল সুমোকে চুরি করে দেখতেও বেশ লাগে শ্রাবনের, কেমন বুক ঢিপঢিপ করে। প্রথম প্রেম… আনকোরা অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে যায়।
সুমনের মুখটা এই মুহুর্তে ঠিক কিসের সাথে তুলনা করা যায়… মিল খুঁজছিলো শ্রাবণ। পাহাড়ের চূড়ায় যখন সন্ধ্যা নামে, মেঘের দল যখন সেই রঙটা শুষে নেয়…. অপার্থিব, মনলোভা কৃষ্ণচূড়ার মতো। সুমোকে ঠিক সন্ধ্যার গোধূলি বেলার মতো লাগছে যেখানে হেলান দিয়ে শ্রাবণ ডুবতে চায় ক্লান্ত হয়ে, কিন্তু সুমোটা কেন যে বুঝতে চাইছে না।
“নাহ এমন করে কাঁদলে আর আজ আমার কোথাও যাওয়া হলো না, ” শ্রাবণ মাথা নাড়ে। ওর দিকে কোন মনযোগই নেই সুমোর। একমনে তানপুরার সুর তুলে কাঁদছে।
“না.. না.. তা কেন? তুমি বলো কোন রঙেরটা পরবে আমি এক্ষুনি নামিয়ে দিচ্ছি।”
“তোর মনের রঙেরটা ”
“মানে? ”
“মানে তোর মনটা এখন কুটকুটে কালো হয়ে আছে তেমন একটা।”
সুমন ভিতরে ভিতরে ভিতরে চমকে উঠে। ওর মনের রঙ আজকাল দেখতে পায় নাকি শ্রাবণদা।
“যাহ.. আর জুতো অমন খয়েরী! ”
“হ্যাঁ, ভালো লাগবে না? ” খানিকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে নিজের রাগ ঝারল শ্রাবণ। এই মেয়ে ওকে সারাজীবন জ্বালাবে। ওর… ওর পিন্ডি চটকে খাবে….
“কি যে সব বলো “শেষ পর্যন্ত উঠে গিয়ে একটা ক্রীম কালারের স্যুট বের করলো সুমন। “ওই জুতা পরলে এটা মানাবে। কালো তো সবসময়ই
পরো।
“দে… “একটানে সুমনের হাত থেকে স্যুটটা নিয়ে বিছানায় ফেললো শ্রাবণ।
“আমার তোয়ালটা একটু ভিজিয়ে আনতো সুমো.. বাথরুম থেকে।”
সুমন তোয়ালের কোনটা ভিজিয়ে হালকা নিংড়ে নিয়ে ঘরে পা দিতেই থমকে গেল। শ্রাবনদা পুরো শার্ট খুলে দাড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। সুমন আস্তে করে তোয়ালেটা চেয়ারের উপর রেখে কেটে পড়তে চাচ্ছিলো কিন্তু ফেঁসে গেল।
“এই তুই কোথায় যাচ্ছিস? আমার পিঠটা ভালো করে মুছে পাউডার দিয়ে যা।”
“আ….. মি! ”
“হ্যাঁ, কেন, কোন সমস্যা? ”
“শ্রাবনদা আমার অনেক কাজ…. মামী বার বার বলেছে খেয়ে থালা বাসনগুলো সব ধুয়ে ফেলতে কিন্তু আমি না করেই চলে এসেছি।”
“তো ঠিক আছে চলে যা… কিন্তু তুইতো আমাকে এবেলার হিসাবটাই দিসনি, সাথে ছোট্ট একটা কাজ দিলাম সেটাও করলিনা আবার বললিও না আমার অপরাধটা কী? এটা কি ঠিক সুমো? তোর সমস্যাটা কি সেটাতো অনন্ত আমাকে বলা যায় নাকি? ”
“না মানে,” সুমন আবারো ঢোক গিললো। ওর সমস্যার কথা কি করে শ্রাবনদাকে বলবে সুমন…. আজকাল শ্রাবনদাকে খালি গায়ে দেখলে ওর গা কেমন শিরশির করে, হাত পা কাঁপে, গলা শুকিয়ে আসে অথচ দুই মাস আগেও এরকমটা হতো না। শ্রাবনদা পিঠে চুলকে দিতে বললে উল্টো মনমতো খামচি দিয়ে চলে যেত উপরি খাটানোর জন্য।
“কি হলো ওরকম হিক্কা তুলছিস কেন? ” শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো।
“কি… কিছু না… তু.. তুমি আমাকে সেদিন কাজের লোক বলে অপমান করেছ.. আমি তোমার কোন কাজ করে দেবনা ব্যাস। আমি এখন চললাম।”
“আশ্চর্য কাজের লোক বলেছি তাতে রাগ হচ্ছে…. তাহলে কি অকর্মার ঢেঁকি বললে খুশি হতি? আজকাল ভালো মানুষের কথার কোন দাম নেই, যারা শুধু গাল ভরা কথা বলে চাটুকারিতা করতে পারবে তাদের জয়জয়কার।”
“সে করুক তারপরও তারা তোমার মতো আমার সাথে ঝগড়া তো করেনা। তুমি একটা ঝগড়ুটে।”
“সুমো বেশি হচ্ছে কিন্তু। অনেকদিন মারিনা বলে আর কোনদিন মারবনা তার কিন্তু কোন গ্যারণ্টি নেই।”
“পারবেনা কেন…. তুমি তো কেবল ওই পারো”
“আচ্ছা ইচ্ছে করে ঝগড়া কেন বাধাচ্ছিস বলতো ? আমি কতবার করে বলছি আমার অনেক বড় ভুল হয়েছিল , এ জন্মে আর তুই কাজের এ কথা আমি মুখ দিয়েও বের করবনা।”
“শ্রাবনদা…. ”
“কী… ”
“আজ সকালে একশ টাকার পাখির খাবার আনা হয়েছে আর বলাইদা বিশটা টাকা নিয়েছিল বিড়ি খাবে বলে। এই খরচ হয়েছে,আমি গেলাম এখন।”
“সু.. সুমো… আরে শোন.. ভালো দেখে কাপড় পরে চলে আয়, আজ তোকে ফুচকা খাওয়াবো।”
কিন্তু সুমন ততক্ষণে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেছে। ফুচকা….. কাল সকালের আগে ও আর এবাড়ি মুখো হচ্ছে না।
চলবে……