তোমার পরিনীতা – ২৯
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
নির্মলা ভেবে পাচ্ছিলেন না… নাতিকে তিনি কি দিয়ে বরন করে নিবেন?
আসলে আজ শান্তনুর ছেলেকে হাসপাতাল থেকে সরাসরি চৌধুরী বাড়ি নিয়ে আসা হবে।
সমস্ত বাড়িতে তাই সাজ সাজ রব পরে গিয়েছে। স্বয়ং রামনাথ চৌধুরী নিজে গিয়ে দধি ও মিষ্টি ভান্ডার থেকে আধামন মিষ্টি কিনে নিয়ে এসেছেন সবাইকে পাঠাবেন বলে। তার বংশের প্রথম বাতি বলে কথা, বন্দনার বাবা মাকেও অনেক অনুরোধ করে তবে রাজি করিয়েছেন রামনাথ.. নাতি সহ বৌমাকে এ বাড়িতে আনতে।
নির্মলা তার গয়নার বাক্স থেকে মোটা একটা সোনার চেইন খুঁজছিলেন নাতির মুখ দেখে দেয়ার জন্য। কিন্তু কোনটাই তার তেমন পছন্দ হচ্ছিলো না।
” কি খুঁজছো মা? ”
নির্মলা শ্রাবনকে ঘরে ঢুকতে দেখে একরকম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
“ছোট একটা উপকার করতো বাবা।”
“কি উপকার মা? ”
“দেখতো খোকা এখান থেকে দাদুভাইকে কোনটা দেয়া যায়? এমনটা দিবি যেন বিয়ের পর ওর বউ পরতে পারে।”
“ওরেব্বাপ… বিয়ের পরে বউ! মা তাহলে এই বয়সে দেয়ার কি দরকার?
“আছে দরকার আছে সে তুই বুঝবি না। এখন পরার জন্য অনেকে অনেক কিছুই দেবে উপহার। তাছাড়া ওর মায়ের বাড়ি থেকেও পাবে।বাচ্চা মানুষ ক আনা আর লাগবে চেইন গড়াতে কিন্তু আমি যদি ওর বিয়ে পর্যন্ত না বাঁচি তখন? এটা দিলে আমার দাদুর বৌয়ের জন্য আশীর্বাদটা থেকে যাবে আর এতো বড় গহনা ওর মা ভাঙ্গার সাহস করবে না।”
শ্রাবন মায়ের কথা শুনে মিট মিট করে হাসতে লাগলো। একেই কি বলে নিজ রক্তের জন্য টান? কবে কোথায় এই বাচ্চা বড় হবে, বিয়ে করবে আর সেই মেয়ের জন্য ওর মায়ের একবুক ভালোবাসা.. হাহ।
“আচ্ছা মা… আমাদের পিচকুর বউয়ের জন্য যদি এতো এলাহি কারবার তাহলে আমাদের বউগুলো এতো হতভাগি কেন? বেচারিগুলোর জন্য ঠাকুমা একটা আধটা গয়না অন্তত রেখে গেলে পারতো।”
“ছি সেকি কথা ছোট.. তুই না জেনেশুনে গুরুজনের সম্মন্ধে এ কেমন কথা বলিস? তোর জন্মের আগেই তোর ঠাকুমা ওপারে চলে গেলেন,”
নির্মলার চোখ দুটো আবেগে ছলছল করে উঠলো।
“কিন্তু ঠিকই তোর আর শান্তনুর বউয়ের জন্য গহনা রেখে গেলেন।”
“কিন্তু ঠাকমা তো আমায় দেখেনই নি… আমার বউয়ের জন্য গয়না রেখে গেলেন কি করে?” শ্রাবন অবাক।
” উনি যখন গেলেন তখন তুই পেটে..মা বললেন নিমু এগুলো তোর কাছে দে মা। যত্ন করে রাখিস, যদি মেয়ে হয় তাহলে সে পরবে আর যদি আমার রামনাথ আবার ছেলের বাবা হয় তবে আমার ছোট নাতবৌকে এগুলো দিবি।” নির্মলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অনেক ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিলো নির্মলার, শাশুড়ি আদর করে হাতে ধরে কাজ না শেখালে সংসার করাই কষ্ট হয়ে যেতো তার।
“আহা তবে তো ভারি লস হলো… মেয়ে হলে কেমন সুন্দর গয়না গুলো পরতে পারতাম।”
“সে তোকে মুখেভাতের দিন পরিয়ে ছিলাম, কেঁদে কেটে তুই বাড়ি মাথায় তুলেছিলি… কেবল মুকুটটা একটু সময় পরানো গিয়েছিলো,” নির্মলা সেদিনের কথা মনে করে হাসলেন।
“তাহলে আমি সত্যি সত্যি ছেলেমানুষ বলো… ওসব মেয়েদের জিনিস পরিনি কোনদিন,” শ্রাবন মায়ের গহনার বাক্স খোঁচাখোঁচি করতে লাগলো।
নির্মলা তাড়াতাড়ি হম বললেন। ছেল তার জাদরেল উকিল… কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাবে বোঝা মুশকিল।
“মা… আমার বউয়ের গয়নাগুলো কোথায় ?”
“আছে, ওগুলো আলাদা বাক্সে তোলা আছে।”
“কোথায় দেখি।”
“আ মরন এখন এক কাজের মধ্যে তুই এসে গোল করিসনে তো বাপু… এমনি আমি বড় খোকার ছেলের জন্য চেইন ঠিক করতে পারছিনে।”
নির্মলা মুখ ঝামটা দিলেন,তিনি সত্যি স্থির করতে পারছেন না কোনটা দিয়ে নাতির মুখ দেখবেন।
“আমি খুঁজে দেই দাও কিন্তু সেজন্য আমার পারিশ্রমিক চাই,” শ্রাবন এবার বাক্স টেনে সব গয়না বিছানার উপর ঢেলে দিলো।
“পারিশ্রমিক… সে আবার কি?”
“আমার বউয়ের গয়নাগুলো দেখাও,আমি দেখবো।”
“সে যখন তুই বিয়ে করবি তখন দেখিস এখন যাতো আমায় যন্ত্রনা দিসনে।”
“মা প্লিজ দাও না… প্লিজ প্লিজ।”
“এই কি এক পিলিজ পিলিজ করিস তোরা… দাড়া রাখ, দেখি আগে আমার নাতির জন্য চেইন ঠিক করে নেই তারপর দেখাচ্ছি।”
ঠাকুমার দেয়া গয়না গুলো দেখে শ্রাবণের চোখদুটো কেমন ভিজে আসলো। হায়রে ভালোবাসা.. ওকে দেখেওনি পর্যন্ত ওর ঠাকুমা আর ওর বউয়ের জন্য কত যত্ন করে নিজের ভালোবাসাটুকু রেখে গিয়েছেন।
“মা.. ”
“কিরে ”
“আমি এগুলো আমার কাছে রাখি?”
“অ্যা না, না এগুলো তোর কাছে দেয়া যাবেনা। বউ এলে আমি নিজে ওর হাতে এগুলো পরিয়ে দিবোখন।”
নির্মলা তাড়াতাড়ি ছেলের হাত থেকে বালা দুটো নিয়ে নিলেন। পুরোনো দিনের নকশার গোলাপবালা দুটো তার শাশুড়িমায়ের স্মৃতি… ছেলে নিয়ে হারিয়ে ফেললে।
“এতো বড় বালা.. এতো ওর হাত গলেই পরে যবে মা।”
মুখ ফসকে বলে জিভ কাটলো শ্রাবন, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
“ওর!… তুই বৌমার হাতের মাপ জানিস ? ” নির্মলা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
“আরে না, আ…আ.. মি কোথ থেকে জানবো। মানে সাধারণত অল্প বয়সী মেয়েদের হাত তো অনেক সরু হয়।”
শ্রাবন তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরালো, মায়ের সামনে ধরা খেলে ওর খবর আছে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে এলো ওর। কিন্তু মাকে যে বলতেই হবে সুমোর কথা, কিন্তু কিভাবে?
“হ্যাঁ তা হয়,” নির্মলা আবার চেইন খুঁজতে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন।
” মা বলছি কি আমার বউয়ের গয়না গুলো দশ পনের দিনের জন্য একটু দাও না, আমি এগুলো জুয়েলারিতে দিয়ে ধুয়ে নিয়ে আসি…কেমন লালচে হয়ে আছে।”
নির্মলা বুঝলেন না শ্রাবন হঠাত এগুলোর পিছনে কেন লাগলো… বেচে টেচে দেবে নাতো…. কিন্তু ছেলে তার নিজেই অনেক ভালো আয় করে … টাকার অভাব তো ওদের নেই।
” ওমা দাও না।”
“নাহ তুই বড্ডো জ্বালাচ্ছিস তো শ্রাবন, এগুলো মেয়ে মানুষের জিনিস… তোর এ নিয়ে মাথা ঘামাবার এতো কি দরকার?”
মায়ের কথায় মুখ ফোলালো শ্রাবন।
“ঠিক তো.. পরে কিন্তু ঔ মেয়ে মানুষ নিয়ে আমার সাথে কোন কথা বলতে আসলে আমি শুনবো না,এই বলে দিলাম।,” কথাটা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো শ্রাবন। মাকে কোন কায়দায় বাগে আনা গেলনা,বেচারি বউটা ওর হাতে নিয়ে একটু পরে দেখতো।
“আরে…, ” নির্মলা অবাক। এরা বাপ ছেলে যখন যা খুশি করবে আর বলবে কিন্তু কেউ যদি তাতে তিল পরিমান আপত্তি করে ব্যাস, হয়ে গেলো তার ষোল কলা পূর্ণ ।
নির্মলা নিজের কাজ শেষে গহনার বাক্সটা আলমারিতে তুলতে গিয়ে কি মনে করে আবার থেমে গেলেন… কিছু একটা যেন মাথায় খেললো, মুখ টিপে হেসে গহনার বাক্সটা নিয়ে আবার বিছানায় এসে বসলেন।
…………………………………….
“শ্রাবন.. ”
শ্রাবন নিজের আলমারির সামনে দাড়িয়ে টাকার হিসেব করছিলো। হঠাত মায়ের ডাক শুনে ঘুরে দাড়াতেই দেখলো নির্মলা একটা মাঝারি ধরনের গহনার বাক্স হাতে দাড়িয়ে আছেন।
“নে তোর বৌয়ের গহনাগুলো।”
“থাক মা লাগবে না, এগুলো তোমার কাছেই থাক,” শ্রাবন হেসে বললো।
“কিন্তু তুই যে নতুন করে ধুয়ে আনতে চাইলি খোকা… সেটা করে নিয়ে আয়, তারপর তুলে রাখি। আর বলি কি হাতের বালাগুলো যদি বৌমার হাতে বেশি বড় মনে হয় তবে কেবল বিয়ের দিন পরেই না হয় তুলে রাখলো… পরে একটু ভার ভারিক্কি হলেই দেখবি কত সুন্দর লাগে দেখতে। ”
শ্রাবন নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো। মায়ের কথাগুলোতে ওর ভীষন অস্বস্তি হচ্ছে, মাকি কিছু টের পেলো?
“নে ভালো করে রাখ।”
“তুমি টেবিলে রাখো আমি পরে তুলে রাখছি।”
নির্মলা বাক্সটা টেবিলের উপর রাখলেন। দরজার বাইরে পা দেবার সময় হঠাত করেই বলে বসলেন, “বৌমাকে বালাজোড়া পড়ানোর সময় বলিস যে ও দুটো তোর ঠাকুমার ছিলো.. পুরোনো ডিজাইনের বলে যেন আবার ছ্যা ছ্যা না করে।”
শ্রাবন বিস্ফোরিত চোখে বেকুবের মতো দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
……………………..
সুমনের বন্দনা বৌদিকে দেখে যে কি আনন্দ হচ্ছিলো, বলার মতো না। অনেকক্ষণ বাদে লাইনে দাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়ার যখন একটু সুযোগ পেলো ও… চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করছিলো সুমনের।
” কিরে কাকিমা হয়েই তোর এতো আনন্দ হচ্ছে, মা হলে তো তুই আকাশের চাঁদ হয়ে যাবি দেখছি।”
ঘর ভর্তি লোকের মধ্যে শ্রাবন ফিসফিস করে কথাগুলো বলতেই লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে উঠলো সুমন,”ছি .. কি সব বলো শ্রাবনদা! ”
” সুমো তুই মুখটা একটু স্বাভাবিক কর, নাহলে লোকে মনে করবে সুযোগ বুঝে আমি বুঝি তোর কাপড় ধরে টানাটানি করছি।”
সুমন আর এক সেকেন্ডও ওখানে দাড়াল না। তাড়াতাড়ি শ্রাবণের পাশ থেকে সরে গিয়ে বন্দনার মাথার কাছে গিয়ে বসে পড়লো। এই ছেলেকে দিয়ে একফোঁটা বিশ্বাস নেই… সেদিন দিনে দুপুরে ওকে আস্ত ছিড়ে খেয়েছে এই লোক মৌমিতাদিদের বাড়িতে আর এখন হেসে হেসে হুমকি দিচ্ছে, কতো বড় খারাপ।
“বৌদি তুমি নিশ্চিন্তে সুমোকে দিয়ে ছোটনের হাগুমুতু পরিস্কার করাতে পারো… সুমো খুব এক্সাইটেড এগুলো শেখার জন্য, ভবিষ্যতে ডে কেয়ার সেন্টার খুলবে।”
” শ্রাবনদা..!”
“কি শ্রাবনদা… মাত্রই না তুই বললি যে তোর বাচ্চা পালার এক্সপেরিয়েন্স দরকার, সমীর মামা প্রতিদিন তোর বিয়ের জন্য পাত্র দেখে বেড়াচ্ছে।”
সুমন আঁড়চোখে একবার শ্রাবণের দিকে তাকিয়েই মুখ ভেঙচালো। কি অসভ্য একটা মানুষ বাবা … কি রকম সাধুবাবার মতো চেহারা করে নিজের বৌয়ের বিয়ের কথা বলছে, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না.. অসহ্য।
“তুমি আর সুমনের পেছনে লেগোনা তো ঠাকুরপো। বেচারি এমনি সারাদিন মঞ্জুমামীর তোপের মুখে থাকে তার উপর তুমি আবার ওকে এতো কেনো জ্বালাচ্ছো বলতো? ”
“কি বৌদি… তুমি জানোনা সুমো এখন আর মঞ্জুমামীর তোপের ধার ধারেনা। মঞ্জুমামীকে কন্ট্রোল করার রিমোট এখন সুমোর হাতে, আদিত্য অন বলল অন আর অফ বললে অফ।”
সুমন চোখ পাকিয়ে তাকাতেই শ্রাবনের মুখের হাসি কমার বদলে আরও বাড়লো। কাল শ্রাবন ওকে সন্ধ্যায় ঘরে আসতে বলেছিলো কিন্তু রাতে অনেক রান্না ছিলো বলে সুমন আসতে পারেনি। শ্রাবন টিপন্নী কেটে তার সেই রাগের জ্বালা মিটাচ্ছে।
সুমন, বন্দনার ঘর থেকে বের হয়ে বাসায় যাবার সময় ইচ্ছে করে শ্রাবণের ঘরে এসে ঢুকলো। সাতদিন হলো ওর এই রোগ বেড়েছে। খানিক বাদে বাদে এই ঘরে না আসলে অস্থির লাগে, আসার জন্য মন আঁকুপাঁকু করতে থাকে। কিন্তু এই কথা বাবু জানলে খুশিতে আটখানা হবে, তাই এ কথা তার সামনে একদমই বলা যাবেনা।
” কিরে আজ সূর্য দিক ভুলে গেছে নাকি? ”
সুমনকে দরজায় দাড়াতে দেখেই জিজ্ঞেস করলো শ্রাবন। আজকাল সুমো প্রায়ই শাড়ি পরে, ভালোই কেমন বউ বউ দেখায়।
” সে তুমি আজ জানলে.. আমি তো সাতদিন ধরে দেখছি, ” রাগে গর গর করে উঠে সুমন।
বড্ডো কথা শিখেছে যে আজকাল সুমো, শ্রাবণ বসা থেকে আৎকা উঠে দাড়ায়।
“এই খবরদার এখন কাছে আসবেনা বলে দিলাম, কাজের লোকগুলো সব সিড়ি বেয়ে উঠা নামা করছে, ” সুমন সতর্ক সুরে বলে উঠে। শ্রাবনের চেহারা ওর মোটেই সুবিধার মনে হয়না।
“তো… আমি কি ওদের ভয় পাই? ”
“পাওনা? তবে আজই বিয়ের কথাটা সবাইকে বলে দাও।”
সুমন কথা শেষ করার আগেই শ্রাবন ওর মুখটা চেপে ধরলো,” দোহাই লাগে থাম। সময় হলে আমিই সবাইকে বলবো তোর এতো ভাবতে হবে না। ”
“বারে তুমি বললে কাউকে ভয় করোনা,”সুমন হাসলো। বর ওর সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিলো যে।
” কে বললো করিনা… তোকে তো সবচেয়ে বেশি করি.. তুই হলি সাক্ষাৎ আগুন, দেখিস না কেমন পুড়ছি।”
সুমনকে হাসতে দেখে শ্রাবনের স্বর গাঢ় হয়ে আসে।
“তো পুড়তে কে বলেছিলো . আমি? ”
সুমন কপট রাগ দেখায়।
“বড্ডো চটাং চটাং কথা শিখেছিস আজকাল,” সুমনকে জড়িয়ে ধরে চুলের উপর চুমো খায় শ্রাবন৷ এখানটায় আজকাল ওর নামে লুকিয়ে সিঁদুর দেয় সুমো জানে শ্রাবন।
“ছাড়ো… আমি আর আসবোনা এ ঘরে। ”
“কেন? ”
“তুমি কি সব উল্টাপাল্টা বলছিলে তখন, আমি আদিত্যকে কন্ট্রোল করি? আর.. আর তুমি যে আমায় রিমোট দিয়ে দিনে দশবার অন অফ করো তারবেলা কি হ্যাঁ? খালি সব কিছুতে সুমো খারাপ, পড়াশোনাতেও সুমো খারাপ, স্বভাবেও সুমো খারাপ,অলক্ষী।
ইররর.. এতো ক্ষেপে গেছে।
“কি যে বলিস না তুই সুমো, তোর মতো লক্ষী কোন মেয়েই আমি জীবনে দেখিনি… নইলে কি ওরকম হন্য হয়ে তোকে বিয়ে করি.. পাগলী কোথাকার।”
“তুমিই তো বললে।”
“কি বললে?”
“এই যে আমি আদিত্যকে কন্ট্রোল করি। ”
“আচ্ছা ভুল হয়েছে… এরপর থেকে বলবো আমাকে কন্ট্রোল করিস। ”
“এই না.. একদম না।”
“তবে? ” হাসে শ্রাবন।
“কিছুনা, ” সুমন সামনের চওড়া বুকটায় মুখ লুকায়৷ আজকাল এটা ওর বড় পছন্দের জায়গা হয়েছে।
শ্রাবন সুমনের হাতটা নিয়ে লাল সাদা চুড়িগুলোতে হাত বুলাতে লাগলো। বহুকষ্টে সেদিন সুমনকে শাঁখা পলা খুলতে রাজি করিয়েছিলো শ্রাবন, মৌমিতাদের বাড়িতে বসে। তার বদলে এই চুড়িগুলো কিনে দিতে হয়েছে ওকে জরিমানা বাবদ।
“সুমো.. তোকে একটা জিনিস দেখাই।”
“কি? ”
“দেখাচ্ছি.. ” শ্রাবন ঘরের দরজাটা আস্তে করে চাপিয়ে দেয়। আলমারি খুলে ঠাকুমার হাতের বালা দুটো সুমনের হাতে পরিয়ে দিতেই বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে থাকে সুমন। এ বালাগুলো ও চেনে… বড়মা কতবার করে দেখিয়েছে ওকে, এগুলো সব বাড়ির ছোট বৌয়ের জন্য।
“কাঁদছিস কেন পাগলী.. এগুলো সব তোর। কিন্তু এখনতো দিতে পারবোনা.. দোকান থেকে ধুয়ে এনে মাকে আবার ফেরত দিতে হবে, তার আগে তুই কয়দিন কাছে রাখ।”
সুমন বালাদুটো হাতে নিয়ে এতোই আবেগ আপ্লুতো হয়ে উঠলো যে ওর মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হলো না, কেবল শ্রাবনের বুকের কাছের কাপড়টা খামচে ধরে ফোপাঁতে লাগলো। জীবন এক সময় ওর কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু কেড়ে নিয়ে নিয়েছিলো… আজ থেকে কি ওর সব ফিরে পাবার দিন শুরু হলো?
চলবে……তোমার পরিনীতা – ৩০
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
দিন দশেক পরের শান্ত এক দুপুর। জানালার ফাঁক গলে হালকা রোদের আলো আর বাগানের ঘুঘু পাখির বিরতিহীন ডাক শোনা যাচ্ছিলো অনেকটা সময় ধরে।
মাঝে মাঝে বাতাসের তোড়ে মাথার কাছের জানালার পর্দাটা সরে গিয়ে মৃদু মন্দ বাতাসও বইছিলো। সুমন অনেকক্ষন থেকে খুব চেষ্টা করছিলো বিছানায় একটু উঠে বসার কিন্তু পিছন থেকে দুটো হাত আড়াআড়িভাবে এমন শক্ত করে ওকে আকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে যে, সুমন নড়তেই পারছিলনা।
“শ্রাবণ….. ”
মুহূর্তে দমবন্ধ হয়ে আসলো সুমনের, ভয়ে চোখদুটো ছিটকে বের হয়ে আসতে চাইলো। সর্বনাশ এতো বড়মা! একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে যে… এখন?
“শ্রাবণ, বাবা দরজাটা খোল,জরুরি কথা আছে।”
এবার শ্রাবণের কানে বোধহয় মায়ের ডাকটা একটু ঢুকলো। সুমনকে ছেড়ে উঠে বসতেই সুমনের ভয়ার্ত আর কাঁদো কাঁদো চেহারাটা ওকে বেশ খানিকটা অবাক করে দিলো। সুমো এরকম করে তাকাচ্ছে কেন? কাঁচা ঘুম তার সব উল্টেপাল্টে দিয়েছে, সুমনের মুখ ছেড়ে তাই খানিকটা সময় শ্রাবণের চোখদুটো সুমনের জলপ্রপাতের মতো চুলগুলোর উপর স্থির হয়ে রইলো।
“বড়মা ডাকছে… এ.. এখন কি হবে,
আমি কি করবো, কোথায় লুকোবো? ” সুমন বড় বড় চোখ করে জানতে চাইলো।
শ্রাবণের মাথা তখনও জট পাকানো। বোধ বুদ্ধি ধোয়াশা হয়ে আছে। ঘন্টাখানেক আগে সুমো ওকে এক বাটি পায়েশ দিতে এসেছিলো চুরি করে। দুপুরের খাওয়া শেষে এপাশ ওপাশ গড়াচ্ছিলো তখন শ্রাবন। পায়েশ খাওয়া শেষে উপযুক্ত মুহুর্তে ভালোবাসার ভূত মাথাচাড়া দিতেই সজোরে আকড়ে ধরেছিলো সুমোকে…. ফলাফল দুজনের গায়ে সুতোটাও নেই। এমন সময়ে মায়ের সুমধুর ডাকও কাকের চেয়ে কর্কশ লাগলো শ্রাবণের কানে।
সুমন যখন দিক বিদিক শূন্য হয়ে কাপড় খুঁজতে ব্যাস্ত, তখন ভারী আমলের কাঠের দরজার উপর বাইরের আঘাতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে.. সুমন চোখের পানি সামলে কিছুই সুস্থ ভাবে ভাবতে পারছিলনা।
” অ্যাই তোরা কেউ ছেলেটার মোবাইলে একটা ফোন দেতো… এতো ধাকাচ্ছি, শ্রাবন উঠছেনা কেন? ” নির্মলা চিন্তিত সুরে সবাইকে ডাকতে লাগলেন।
শ্রাবন এক সেকেন্ড কি যেনো ভাবলো, তারপর জোর গলায় বলে উঠলো, মা একটু অপেক্ষা করো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম.. উঠছি।”
নির্মলা বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন স্বস্তিতে।
শ্রাবণ বড় করে একটা আলসি ভাঙতেই দেখলো সুমন রাজ্যের বিতৃষ্ণা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে..যেন সব দোষ শ্রাবণের। অবশ্য বেচারি ক্ষানিকটা সময় না.. না করেছিলো কিন্তু তাতে কি?
শ্রাবন মুখ নিচু করে হাসতেই সুমনের রাগ আরও বাড়লো, মানুষ এতো বেহায়া হয়? কি একটা বাজে অবস্থার মধ্যে আছে ওরা আর শ্রাবন আরাম করে হাই তুলছে! লোকটা একটা যা ইচ্ছা তাই… অসভ্যর অসভ্য। সুমো আর জীবনেও এই লোকের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেনা, মরলেও না।
“গালি দেওয়া শেষ হলো? ”
“মানে?”
“মানে.. ” শ্রাবন উত্তর না দিয়ে আৎকা সুমনের কোমরের কাছে পড়ে থাকা চাদরটা টেনে নিয়ে সুমনের গায়ে প্যাঁচ দিয়ে, ওকে কাঁধে তুলে নিতেই, সুমন দুমদাম কিল মারতে লাগলো।
“ছাড়ো ছাড়ো বলছি, না হলে আমি চিৎকার করবো বলে দিলাম।”
“নে এবার যতোখুশি চ্যেঁচা।”
সুমনকে বাথরুমের ভিতরে নামিয়ে দিতেই চুপ হয়ে গেলো সুমন। মিনমিন করে বলে উঠলো,
“আমার কাপড়।”
“ওয়েট কর এনে দিচ্ছি… বোঝেনা সোঝেনা আগেই রাস্তার শোভা পাগলীর মতো শুরু করে। আর কোনদিন তোকে আদর করবনা .. দেখি কত ভালো লাগে।”
সুমন জবাব না দিয়ে দ্রুত কাপড় পরতে লাগলো, আর আদর… এঘর থেকে আজ বেঁচে ফিরে কিনা সন্দেহ আর উনি এসেছেন স্বামী গিরি ফলাতে।
ওদিকে নির্মলা দাড়িয়ে থেকে থেকে, বিরক্ত হয়ে ছেলেকে আবারো ডাকতে লাগলেন।
শ্রাবন এলোমেলো চুলগুলো কোনমতে পরিপাটি করে মায়ের সামনে দাড়াতেই, নির্মলা জানতে চাইলেন ওনারা দেশের বাইরে কবে যাচ্ছেন।
“এই তো মা.. কেন কিছু হয়েছে? ”
“কেন আবার কি? বাইরে থেকে ঘুরে এলেই আমি তোর বিয়ের দিন ক্ষন ঠিক করবো , নইলে তোর বাবার খোটা শুনতে শুনতে শেষ হয়ে গেলাম আমি।”
” বিয়ের দিন ! কিন্তু বিয়ের জন্য পাত্রীই তো এখনো ঠিক হয়নি।”
” তাতে কি, হয়নি হবে…. আর যার তার হাতে তো নিশ্চই তুই বালা পরিয়ে বেড়াস না, তাই না? ”
মায়ের এমন সোজাসাপ্টা প্রশ্নে থতমতো খেয়ে গেলো শ্রাবন। মা কি আজকাল ঈগল পাখির চোখ দিয়ে দেখে নাকি? তা না হলে নিশ্চিত কোন জেমস বন্ডকে পিছনে লাগিয়েছে।
তা না হলে সুমোকে ও বালা পড়িয়ে দিয়েছে সেটা মা জানলো কি করে ?
“কি হলো বুঝতে পারছিস না? ”
“না.. “শ্রাবন পরাস্ত হয়ে মাথা নাড়লো। মা তার বরাবরই বিচক্ষণ, এ নিয়ে ওর ভিতরে কোন সন্দেহ নেই।
“সেদিন সুমন বলছিলো…”
এই সেড়েছে… সুমো বলেছে। তা হলে তো মনে হয় মায়ের আর কিচ্ছুটি জানার বাকি নেই।
” কি বলছিলো? ” শ্রাবন সতর্ক হয়ে জানতে চায়, সুমো কোন উল্টাপাল্টা উত্তর দিয়ে ধরা খেয়েছিলো কিনা কে জানে।
“সুমন বলছিলো বালা দুটো তুই নাকি ওকে দেখিয়ে বলেছিস বাড়ির ছোট বৌয়ের বালা, খবরদার হারিয়ে ফেলিস না যেনো। ”
“ওহ, এই.. তা হারিয়ে ফেললে তো তুমি আমার নামে চুরির কেস ঠুকবে।”
“হমম.. কিন্তু সুমন তো এও বললো যে তুই নাকি বলেছিস যে এতোবড় চুড়ি, বিয়ের দিন বৌয়ের হাত গলে পড়ে গিয়ে হারিয়ে না যায়। ”
নির্মলা খোঁচা দিয়ে ওর পেট থেকে যে কথা টেনে বের করার চেষ্টা করছেন, শ্রাবণের আর বুঝতে বাকি রইলো না।
“ওতো মজা করে বলেছি মা, আমি কি আর পাত্রীর হাতের সঠিক মাপটা জানি? ”
“হ্যারে শ্রাবন, লাবন্য মেয়েটা কিন্তু আসলেই বড্ডো সুন্দরী। ”
মা যে আন্দাজে ঢিল মারছে সেটা এবার স্পষ্ট হলো শ্রাবনের কাছে, তাই আর হকচকালো না।
লাবন্যপ্রভার মনের কাছ থেকে শ্রাবন এখন যোজন যোজন মাইল দূরে। ভালোলাগা আর ভালোবাসার ফারাক এখন খুব স্পষ্ট ওর কাছে, লাবণ্য যে কোনকালেই ওর ভালোবাসা ছিলোনা সেটা এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার ওর কাছে। কিন্তু আপাতত লাবন্যই ভরসা.. মা তাহলে সুমোর উপর ভুলেও সন্দেহ করবেনা।
মুখে তাই একটা নির্ভেজাল বোকার হাসি ঝুলিয়ে দিল শ্রাবণ। মাও সন্তুষ্ট আর ওরও মুক্তি।
নির্মলা চলে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো শ্রাবণ। ভাগ্যিস মা দরজা থেকেই চলে গেছে, বিছানার অবস্থা একেবারে যা তা।
খুট করে ছিটকিনি খুলতেই বাইরে বেরিয়ে এলো সুমন, ভয়ে ওর মুখটা তখনও সাদা। শ্রাবনের ওকে দেখেই ভীষন হাসি পেলো, বেচারি।
“একদম হাসবেনা তুমি.. ছি আর আর কোনদিনও আমি তোমার ঘরে আসবোনা।”
“তাই নাকি… তো কার ঘরে যাবি শুনি? ওই আদিত্যর ঘরে।”
” শ্রাবনদা”
“ওই দেখো আবার শ্রাবনদা। ”
“তুমি… তুমি একটা খারাপ মানুষ, সবচেয়ে খারাপ মানুষ, আমি মরে গেলেও তোমার খালি হাসি পাবে। ”
“কি যে বলিস… কতগুলো টাকা খরচ করে বিয়ে করলাম, এখনই মরে গেলে অনেকগুলো টাকা লস হবে।” শ্রাবণ, সুমনকে রাগানোর লোভটা সামলাতে পারলোনা।
“জানিতো… আমি জানিতো তুমি কতো খুশি হবে,” কথা জড়িয়ে আসলো সুমনের।
“বড়মা তো সেদিনই বলছিলো, হ্যাঁ রে সুমন, তোর শ্রাবনদার মনে হয় ঐ লাবণ্য মেয়েটাকে অনেক পছন্দ তাই না, মেয়েটাও দুই তিনদিন বাড়ি এলো ওর খোঁজে।”
সুমনের চোখ দুটো আবার জলে টইটম্বুর হলো। রাগে, অভিমানে ওর মনটা ভার হয়ে আসছে। আগে লাবণ্যদিকে নিয়ে ওর মনে কোন জ্বালা হতোনা কিন্তু এখন হচ্ছে… শ্রাবনদার নামের সাথে আর কোন নাম এখন ওর সহ্য হয় না।
এই রে… কোথাকার জল এখন কোথায় গড়াচ্ছে? সুমনের কান্না দেখে শ্রাবণের মনটাও ভার হলো।
“আরে তোর মাথা খারাপ, আমি দুষ্টুমি করছি সুমো আর তুই সত্যি ভেবে নিলি। তোর মাথায় আসলেই কিছু নেই.. তুই একটা রামগাধী।”
“সেটাও জানি, তাই জন্যই আমাকে তোমার পছন্দ না। তাই জন্যই আমাকে তুমি খালি বকো।”সুমনের চোখের জল তখন নাকের পাশ দিয়ে ঠোঁটের উপর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। শ্রাবনের মনে হলো সুমোর মুখটা ওর জন্য অক্সিজেনের মতো। একটু সময় না দেখলেই ও মরে যাবে।
“আর আমাকে তোর পছন্দ নয় বলে তুই সারাক্ষণ খালি আমার সাথে ঝগড়া করিস।”
“বললেই হলো, আমি কখন ঝগড়া করি?”
” তবে এতোক্ষণ কি করলি.. এগুলোকে বুঝি সোহাগ করা বলে, এগুলো বুঝি কোন ভালো মেয়ের কাজ? ”
” আচ্ছা থাক আমি খারাপ, আমার সাথে তোমার আর কথা বলতে হবে না।”
সুমন ঘরের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ওকে পেছন থেকে টেনে ধরলো শ্রাবন।
” আমি পরশুদিনই মাকে নিয়ে দেশের বাইরে যাবো ভাবছি। ”
পরশু! সুমনের পা দুটো ভারী হয়ে গেলো মুহুর্তেই। কতদিনের জন্য যাবে এবার… সুমনের তো সঙ্গে যাবার কায়দা নেই, মামী ওকে এবার কিছুতেই যেতে দিবেনা।
” কি হলো অমন ঠান্ডা মেরে গেলি কেন? মাত্রই তো আগুনের গোলা ছুটছিলো।”
কিন্তু সুমন তখন রনে ভঙ্গ দিয়েছে। শ্রাবনদা চলে গেলে ও তখন কি করে থাকবে… কতটা দিন থাকতে হবে ওকে একা একা আর কোন কারনে ও যদি মরে যায় তখন কি হবে? শ্রাবনদাকে না দেখেই মরে যাবে!
সুমনকে এমন চুপ হয়ে যেতে দেখে সত্যি শ্রাবণ একটু ঘাবড়ালো এবার। শ্রাবন কি এমন বললো যে সুমো এমন করছে।
“অ্যাই সুমো, কি হলো… ”
“তুমি কবে ফিরবে? ওখানে গিয়ে কতদিন থাকবে? ”
“উমম… এক দেড়মাস। তুই আজই কাপড় গুছিয়ে নে।”
“আমি কি করে যাবো, মামী তো বলেছে এবার আমায় যেতে দিবেনা।”
“কেন… কেন যেতে দিবে না, এখনও কি তোর বিয়ে দেবে নাকি মঞ্জুমামী? ”
মঞ্জু মামী কি করবে সেটা কি ছাতা সুমন নিজেই জানে… কিন্তু সত্যি সত্যি যদি কোন ভাল সম্মন্ধ এনে হাজির করে আদিত্য ওর মামার কাছে তখন ও কি বলে সেটা ঠেকাবে?
“আমি কিছু জানতে চাইছি সুমো… তুই কেন আমার সাথে যেতে পারবিনা? তুই এখন আগে আমার বউ তারপর ও বাড়ির মেয়ে।”
শ্রাবণের কথায় সুমনের চোখদুটো চক চক করে উঠলো,” তবে তুমি ওদের বিয়ের কথাটা বলো।”
এতক্ষণে টনক নড়লো শ্রাবণের। বিয়ের কথা! তাইতো…। আসলে এভাবে বুক টান করে বিয়ের কথা বলতে আপত্তি নেই ওর কিন্তু ওর বাবা রামনাথ চৌধুরী,সে কি ওর এই আস্পর্ধা মেনে নিবেন? বিয়ের সময় ভেবেছিলো মাকে বললেই মা একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। হয়তো করবেও কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা করলে বাড়িতে তুলকালাম শুরু হবে। এমনও হতে পারে বাবার চিৎকারে মা অসুস্থ হয়ে পড়লো, তখন? তারচেয়ে ভালো বাইরে থেকে ঘুরে এসে তারপরই এই বিষয় নিয়ে ফয়সালা করা। বাইরে গিয়ে আগে মাকে ডাক্তার দেখানোই এখন শ্রাবণের প্রথম কাজ, তারপর নাহয় সুমো আর ওর ঝামেলাটা মিটাবে।
” কি হলো বলবেনা? তুমি বিয়ের কথাটা বললে ওরা আমাকে আর আটকাতে পারবে না।”
সুমোর কন্ঠে প্রত্যাশা… শ্রাবণ ঢোক গিললো। সুমোকে ফিরিয়ে দিতে কষ্ট হচ্ছে ওর, কিন্তু এই মুহূর্তে ওরও হাত পা বাঁধা।
“সুমো… সোনাপাখি আমার, দেখ এই মুহূর্তে বললে বাবা চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলবে আর ওরকম সিচুয়েশনে তো মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়াই পসিবল হবে না। ”
সুমন খুব ভালো করেই জানে যে রামনাথ ওদের বিয়েটা কখনোই ভালো মনে মেনে নিবে না, কিন্তু বিয়েটা যে হয়ে গেছে।
সুমনের ফ্যাকাসে মুখটা দেখে দ্রুত ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো শ্রাবন,”সুমো… আমাকে তুই একটা মাস সময় দে। আমি মাকে বাইরে থেকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসি তারপর যে করেই হোক বাবার সামনে কথাটা আমি তুলবো। তাতে যদি বাবা আমাকে গাল মন্দও করে সেটা আমি হাসিমুখে মেনে নিবো ঠিকআছে।”
“কিন্তু বাবা যদি আমাকে মেনে না নেয়… যদি তোমাকে অন্য কাউকে বিয়ে করতে বলে তখন? ”
সুমোর মুখে এর আগে বাবা ডাকটা শোনেনি শ্রাবণ। ডাকটা এতো মিষ্টি শোনালো যে শ্রাবণ নিজেেকে কোনভাবেই আটকাতে পারলো না। নিচু হয়ে সুমোর চোখদুটোতে নিজের ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলো। তারপর ফিসফিস করে বললো, “ওরকম বললে আমি তোকে নিয়ে বাসা থেকে সোজা বেরিয়ে যাবো… তোর খরচ বইবার ক্ষমতা আমার আছে।”
কথা সত্যি সুমনের খরচ আসলেই অনেক বছর ধরে শ্রাবণ বহন করে চলেছে… এখানে তার আধিপত্য আর অধিকার অনস্বীকার্য। শ্রাবণের কথাগুলো পুরোপুরি না হোক কিছুটা হলেও সুমনের মনে শান্তির একটা বাতাস বইয়ে দিলো।
শ্রাবন আলগোছে তখন সুমনের চোখের পানি জিভের মাথা দিয়ে তুলে নিয়েছে, ” ইশশ কি ভীষন নোনটা… কোথাও যে কেন একটু স্বস্তি নেই।”
……………………..
বাড়ি এসে বাথরুমে ঢুকতেই মঞ্জুর বকাবকি কানে ঢুকলো সুমনের। কিন্তু আজ কেন যেন খুব বেশি রাগ হলো না সুমনের মামীর উপর। বেচারির আসলে দোষ নেই, এই ভীষন টানাটানির সংসারে ও এক উটকো লোক। শ্রাবন যতোই ওর খরচ টানুক খাবারের খরচটাতো ওর মামা সমীরই দেয়। গায়ে সাবান ঘষতে ঘষতে সুমনের কেবলই মনে হতে লাগলো, সামনের মাসে বড় সর একটা যুদ্ধ হবে… এখন তাতে হার হবে না জিত সুমন জানে না, তবে ওর জীবনটা পাল্টাবে । শ্রাবণ বলেছে দরকারে ওরা চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে.. কথাটা ভাবতেই ভীষন একটা আশংঙ্কা আর পুলক একই সাথে সুমনের মনের ভিতর দাপাদাপি করতে লাগলো। আশংকা বিয়েটা মেনে না নেবার ভয়ে আর আনন্দটা শ্রাবণের ভরসা পেয়ে।
চলবে……..