#তোমার_প্রেমের_ছোঁয়ায়💜
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি💜
#পার্টঃ০৭
প্রচন্ড জোড়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে আদিয়াত।দিক বেদিক কিছুই খেয়াল নেই ওর।অসয্য এক ভোতা যন্ত্রনা অনুভূত হচ্ছে হৃদয়ের মাজে।মস্তিষ্ক ফাকা ফাকা লাগছে।কোথায় যাবে? কি করবে?কিছুই ভালো লাগছে না ওর।একদম ভালো লাগছে না।প্রিয় মানুষটিকে এরকম অবস্থায় দেখে হৃৎপিন্ডটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ওর।আবার সে নাকি অন্য কারো প্রেমিকা?আজ এইটাই শোনার বাকি ছিলো ওর।এব্রোড থেকে এসে প্রতিটা দিন ওর বিষাক্ত নিশ্বাস নিয়ে চলতে হচ্ছে।বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই।হনহন করে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভীতর প্রবেশ করলো আদিয়াত।তারপর চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,
” আম্মু! আম্মু! কোথায় তোমরা এক্ষুনি আসো। জলদি।নাহলে আজ অনেক খারাপ হয়ে যাবে।জলদি এসো।”
একাধারে চিৎকার করেই যাচ্ছে আদিয়াত।
এদিকে মাত্রই সবকিছু গুছিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে ছিলেন সেহরা জাহান।ছেলের এমন চিৎকারে হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে।পাশে সুয়ে থাকা স্বামিকে দ্রুত ডেকে উঠালেন,
” ওগো শুনছো! উঠো! দেখো তোমার ছেলে এমন চিৎকার করছে কেন?চলো জলদি নিচে চলো।”
হাসান আহমেদ স্ত্রীর ডাকের আগেই উঠেছেন।চশমাটা পরে নিয়ে বলেন,
” দ্রুত চলো।দেখি কি হলো?”
————-
–” জলদি নামো নাহলে কিন্তু আমি আজ এই বাড়ির সব কিছু ভেঙে ফেলবো।”আদিয়াত জোড়ে বলে উঠে।
এদিকে ভাইয়ের এমন চেঁচামেচিতে সিয়াও ঘুম থেকে উঠে দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসলো।ভাইয়ের এমন রক্ত লাল চেহারা দেখে দ্রুত পায়ে আদিয়াতের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে ভাই? তুই এমন করছিস কেন?”
আদিয়াত লাল হয়ে যাওয়া চোখ দিয়েই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সিয়ার দিকে তাকালো।বললো, ” ভালোই ভালো আজ আমাকে সব সত্যি বলতে হবে নাহলে অনেক খারাপ হবে অনেক।কিয়ামত এনে ফেলবো আমি এই বাড়িতে।”
ভাইয়ের এমন ভয়ানক ধমকিতে সিয়া চুপসে গেলো।আদিয়াত প্রচন্ড রাগি। রাগলে ওর মাথা ঠিক থাকে না একদম না।বড্ড উন্মাদ হয়ে যায় সে।সামলানো মুসকিল হয়ে পড়ে।আগে এমন রেগে গেলে একমাত্র তাকে শান্ত করতে পারতো আহি আপু।কেন জানি ভাইয়া আহি আপুর মিষ্টি আর মন ভুলানো কথা শুনে গলে যেতো।মুখ গম্ভীর করে রাখতো এক, দুই দিন তবুও এমন ভাংচুর ওয়ালা চিৎকার চেঁচামেচি করে রাগ দেখাতো না।সিয়া শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে বলে,” ভাইয়া তুই শান্ত হো! আস্তে ধীরে সব বলা যাবে প্লিজ।”
আদিয়াত এইবার হুংকার করে উঠলো পাশে থাকা টি-টেবিলে জোড়ে এক লাত্থি মেরে দিলো ফলে টি-টেবিলটা উলটে পড়ে গেলো।সিয়া ভয়ে কান চেপে ধরে চোখ মুখ খিচে ফেললো।আদিয়াত গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ” শান্ত হয়ে বসা মাই ফুট! এতো দিন ভালোভাবেই জিজ্ঞাস করেছি।কিন্তু আর না।আমাকে আহিয়ানার ব্যাপারে সব খুলে না বললো এর পরিনতি ভয়ানক হবে।”
এরই মাজে বেরিয়ে আসলেন সেহরা জাহান আর হাসান আহমেদ।হাসান আহমেদ এসেই ছেলের কান্ডে দেখে রেগে গেলেন।
আর এদিকে সেহরা জাহান ভয়ে জোড়োসোড়ো হয়ে আছে।এই ছেলেকে সে কিভাবে সামলাবে ভেবে পাচ্ছেন না তিনি!যা রাগ এর! কাছে যেতেই হাত-পা হিম শীতল হয়ে আসে শরীর।
আদিয়াত ওর মা বাবাকে দেখে আরো রেগে গিয়ে ফ্লাওয়ার ব্যাসটাও আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। হাসান আহমেদ এইবার রেগে গিয়ে ধমকে উঠেন,” আদি এইসব কি হ্যা? রাত দুপুরে কি শুরু করলে?এইটা যে একটা ভদ্র লোকের বাড়ি তুমি কি তা ভুলে গিয়েছো?”
আদিয়াত এমন ভাবে তাকায় যেন চোখ দিয়েই আগুন বের হচ্ছে।তারপর শরীর হিম ধরিয়ে দেওয়া ঠান্ডা স্বরে বলে,” এতোদিন ভদ্র লোকের বাড়ি বলেই চুপ ছিলাম।কিন্তু আফসোস আজ আমার এই চুপ করে থাকাটাই আমার জীবনের কাল হয়ে দাড়ালো।”
” কি বলতে চাইছো তুমি?”
আদিয়াত নিজের চুল খামছে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো।যতো যাই হোক উনারা ওর বাবা, মা। কিন্তু শতো চেষ্টা করেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না।রাগে ঠোঁট জোড়া থরথর করে কাঁপছে। কপালের হাতের রগ গুলো ফুলে উঠেছে সাথে নীল বর্ণও ধারণ করেছে। তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে অতি শান্ত স্বরে বলে,” আহিয়ানা কোথায় বাবা?”
হাসান আহমেদ,সেহরা জাহান,আর সিয়া ওর এই প্রশ্নে ঘাবড়ে যায়।সেহরা জাহান ভীত চোখে তাকান স্বামির দিকে।হাসান আহমেদ স্ত্রীর দিকে রাগী চোখে তাকালেন আবারও ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আহিকে দিয়ে তুমি কি করবে?”
” আহিয়ানা কোথায় বাবা?”
হাসান আহমেদ এখনো চুপ।উনাকে এমন চুপ থাকতে দেখে আদিয়াত আবারো চিৎকার করে বলে,” লাস্ট বার বলছি আহিয়ানা কোথায়?”
সিয়া আর সয্য করতে পারলো না। আর কতো দেখবে সে এসব।আহি চলে গেছে? আর ও যেটুকু জানে সব বলবে ওর ভাইকে। আর কতোদিন লুকিয়ে থাকবে এইগুলো আদিয়াত থেকে।সিয়া বলে,” আমি বলছি ভাইয়া!”
সেহরা জাহান মেয়ের দিকে রাগী চোখে তাকালে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সিয়া আবারও বলে,” আমি যা যা জানি আমি সব বলবো তোমাকে।”
আদিয়াত সোফায় গিয়ে বসলো তারপর বোনকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” এদিকে আয়।”
সিয়া গুটিগুটি পায়ে ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাড়ালো। আদিয়াত সিয়ার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয় পাশে বলে, ” এখন এ টু যেট যা জানিস সব বল আমাকে।”
সিয়া আঁড়চোখে মায়ের দিক তাকালো। সেহরা জাহান ওকে চোখ রাঙানি দিচ্ছেন।সিয়া চোখ ঘুরিয়ে নিলো জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে,” তুমি বিদেশে যাওয়ার আহি আপু অনেক চুপ চাপ হয়ে যায়।কারো সাথে কথা বলে না।কাজের সময় কাজ করে এরপর রুম বন্ধি হয়ে থাকতো।খাওয়া দাওয়া করতো না।এইভাবেই যাচ্ছিলো দিন।আমি অনেক বুজাতাম আপুকে।কিন্তু কোন লাভই হচ্ছিলো না।এরপর তুমি যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায় দুজন ব্যাক্তি আমাদের বাড়িতে আসেন।একজন মহিলা একজন পুরুষ।স্কুল থেকে বাড়িতে এসে এমন অচেনা ব্যাক্তিকে দেখে আমি মাকে জিজ্ঞেস করি এরা কারা?মা আমাকে বলে এরা না-কি আহি আপুর চাচা চাচি।আমি অবাক হয়ে যাই।ফুফা ফুফি মারা যাওয়ার এতো বছর পর এরা কোথা থেকে আসলো? আমি সেদিকে বেশি একটা গুরুত্ব দিলাম না।গোসল করলাম,খাওয়া দাওয়া করলাম।তারপর গেমস খেললাম।তারপর ভাবলাম আহি আপুর কাছে যাই।রুম থেকে বের হতেই নিচে বসার ঘরে আহি আপুকে মাথা নিচু করে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। অনেক অবাক হয়েছিলাম।প্রচন্ড অবাক।দ্রুত পায়ে নিচে গিয়ে আপুকে বলি ‘ কোথায় যাও আপু?আমিও যাবো তোমার সাথে?’ আপু চোখে তখন জল ছিলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভেজা কন্ঠে বলেছিলো ‘ ভালো থাকিস সিয়া আর তোর ভাইকেও বলিস ভালো থাকতে।কি বলবি তো?এমনিতেও সে আমাকে ছাড়া দিব্বি ভালো থাকবে আমি জানি।তবুও বলে গেলাম তোর কাছে।হ্যা! আমি চলে যাচ্ছি ভালো থাকিস!’ এই কথা শোনার পর সেকি কান্না আমার।আমি আপুর হায় শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম কিছুতেই যেতে দিবো না।আপু আমার হাত ছাড়িয়ে চলে গেলো উনাদের সাথে।আমি আবারো আপু কাছে যেতে নিলে মা আমাকে টেমে ধরে রেখেছিলো যেতেই দিচ্ছিলো না।আমি অনেক আকুতি মিনুতি করলাম আমাকে মা যেতে দেয় নি। আমি থামাতে পারিনি আপুকে।”
সিয়া হু হু করে কাঁদছে।বুকের ভীতর জমে থাকা এতোগুলো কথা আজ ভাইকে বলে দিয়ে বুকটা হালকা হালকা লাগছে তার।আজ কতোদিন হয়ে গেলো সে তার আহি আপুকে দেখে না।তার সাথে কথা বলতে পারে না।তার সাথে খেলতে পারে না।মায়ের উপর অনেক অভীমান জমা সিয়ার মনে কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারে না।হাজার হোক সেতো মা তাই না?মার সাথে কথা না বলে কি থাকা যায়?এরই মাজে আদিয়াত প্রশ্ন করে, ” বাবা কোথায় ছিলো?উনি কিছু বলেন নি?”
সিয়া তাকায় আদিয়াতের দিকে।আদিয়াতের চোখ জোড়া ভয়ানক লাল কিন্তু সেখানে চোখের জলগুলো টলমল করছে।এই বুজি গড়িয়ে পড়লো।সিয়া শ্বাস নিয়ে বলে,” বাবা অফিসে ছিলো।বাবা আসতেই আমি বাবার কাছে সব বলি অনেক অনেক বিচার দেই।বাবা অনেক রাগারাগি করে মায়ের সাথে।কেন আহি আপুকে যেতে দিলেন ওদের সাথে। বাবা জিজ্ঞাসা করে কোথায় নিয়ে গেছে আহি আপুকে?কিন্তু মা বলে না।বাবা পরে নাকি আহি আপুদের সেই সিলেটে যে বাসা ছিলো মানে ফুফা ফুপি বেচে থাকতে যেখানে থাকতেন সেখানে খোজ করে কিন্তু পায় না সেখানে গিয়ে।বাবা যতো জায়গা চিনতেন সব খুজে দেখেন পায়নি।আমি এরপর এক মাস মায়ের সাথে কথা বলিনি।কিন্তু কি করবো বলো মা তো কথা বলতেই হতো।”
আদিয়াত মায়াভরা চোখে বোনের দিকে তাকায়।আদুড়েভাবে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।সিয়া ঝাপ্টে ধরে আদিয়াতকে তারপর কান্না করতে থাকে।আদিয়াত সিয়াকে সামলে নিয়ে এইবার ওর বাবা আর মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।শান্তভাবে ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” যা করেছো একদম ঠিক করোনি আম্মু।একরমি ঠিক করো নি।আমি ঠিক তোমার কথা শুনেই আহিয়ানাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম।তুমি কথা দিয়েছিলে ওকে আগলে রাখবে।কিন্তু তুমি তোমার কথা রাখোনি।এটা একদম আশা কনি নি আম্মু।আর কিছু বলার নেই।আর রইলো আহিয়ানার খোঁজ নেওয়া।সেটা আমি একাই পারবো।আর পুরো সত্যি ওর মুখ থেকেই শুনে নিবো।আচ্ছা আর কথা বারালাম না।যাচ্ছি!”
হাসান আহমেদ ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন।আদিয়াত মুচকি হেসে বাবার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,” টেন্সন করো না বাড়ি ছেরে যাবো না।আমি জানি আমি চলে গেলে তোমরা কষ্ট পাবে।আমি এতোটা নিষ্ঠুর নই তোমার বউয়ের মতো।কোথাও যাবো না।আর আমি তোমার ওপর রেগে নেই বাবা।তুমি তোমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছো।এইবার আমি সবটা সামলে নিবো।তুমি বিশ্রাম করো।আর সাথে উনাকে ও(সেহরা জাহান) নিয়ে যাও।”
কথা শেষ হতেই আদিয়াত ধুপধাপ শব্দে চলে গেলো।সিয়া নিজে উঠেও চলে গেলো।হাসান আহমেদ স্ত্রীকে বলে,” বলে না যেমন কর্ম তেমন ফল।তোমার ভুলের শাস্তি তুমি পাবে সেহরা। এখন রুমে চলো।”
হাসান আহমেদ চলে গেলেন।সেহরা জাহান স্বামির পিছে পিছে যেতে যেতে বলেন,” হ্যা হ্যা! আমি সবার ভালোর জন্যে যা করি তাই সবার খারাপ মনে হয়।আমি তো কারো ভালো চাইতেই পারি না।এমনটাই মনে হয় তোমার আর তোমার দু ছেলে মেয়ের।বলে ‘ যার জন্যে চুরি করলাম সেই বলে চোর।’
হাসাম আহমেদ বিছানায় সুয়ে ছিলেন।স্ত্রীর কথায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন,” লাইট নিভিয়ে দেও ঘুম পাচ্ছে।”
সেহরা জাহান রাগে গজগজ করতে করতে লাইট নিভিয়ে দিয়ে সুয়ে পড়লেন।
…
এদিকে আদিয়াতের চোখে ঘুম নেই।বার বার সেই ক্লাবের দৃষ্যটি ভেসে উঠছে।আর রাগে হাত পা জ্বলে যাচ্ছে।কি হয়ে গেলো হাসিখুশি বাচ্চা মেয়েটা কি করে এমন মাদকাসক্ত হয়ে গেলো।হায় দুনিয়া! আর কতো নিষ্ঠুরতা দেখাবি ভালো মানুষদের উপর।আদিয়াত চোখ বুজে বিরবির করে বলে,
” আজকের রাতটাই শুধু আহিয়ানা। কালই আমি আসবো তোমার কাছে।তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসবো।আমার ভালোবাসার কথা বলবো।যেটা শোনার জন্যে দিনরাত তুমি অস্থির হয়ে আমার পিছু পিছু ছুটতে।আমার ভালোবাসাও তোমাকে উপলব্দি করাবো।শুধু আজকের রাতটা। অপেক্ষা করো।”
#চলবে_________
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।অনেক অনেক ভালোবাসা সবার জন্যে।