হাতে মেডিক্যাল রিপোর্ট রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছে সানজিদা। চোখ ফেটে কান্না আসছে তার। আচ্ছা সে মারা গেলে কে তার দাফন কাফন করবে। তার মা বাবা যে তাকে একা রেখে চলে গিয়েছে অনেক দূরে। তবে সে তো এখন তার মা বাবার কাছেই চলে যাবে। দুনিয়ায় যে তার আপন বলে কেউ নেই। ছিল একজন। আচ্ছা সে কি কখনো জানতেও পারবে যে তার মৃত্যুর কথা। হয় তো হ্যাঁ হয় তো না। তাচ্ছিল্যের একটা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। সানজিদা বিরবির করে বলতে লাগলো
“” তাকে বেড়াজালে বেধে রাখেনি,
ভালোবাসায় হৃদমাঝরে বাধতে চেয়েছি
সে কেন বুঝেনি?
ও আমায় ভালোবাসেনি!
সে ভালোবাসার গভিরতা খুজেনি!
ভালোবাসি জেনেও বোঝেনি,
ও আমায় ভালোবাসেনি””
হঠাৎ কারো হেচকা টানে হুশ ফিরলো সানজিদার। ভয়ে সে চোখ বুজে রইলো। সে বুঝতে পারছে সে কারু বুকে পরেছে। সে পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে ছাড়িয়ে দেখলো। একটা ছেলে রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ছেলেটি রাগী কন্ঠে বলে উঠলো “রাস্তায় এভাবে হাঁটার মানে কি! জীবনটা কি ছেলেখেলা পেয়েছেন। এমন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলেন কেন? রাস্তায় মন কোথায় থাকে। আমি এখন না বাঁচালে কি হতো।”
সানজিদা তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল “কি আর হতো ছয়মাস পরের ঘটনা এখনই হয়ে যেত।”
ছেলেটি বলল “মানে কি বলছেন আপনি এগুলো!”
সানজিদা বলল “না তেমন কিছু না। আর ধন্যবাদ আপনাকে।” বলেই চলে গেল সানজিদা। ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সানজিদার যাওয়ার দিকে। কপালে সামান্য ভাজ ফুটে উঠলো ছেলেটার।
সানজিদা হেলেদুলে কোনো মতে তার বাসায় এসে প্রবেশ করলো। হাতে থাকা ব্যাগটি সোফায় রেখে চলে যায় তার রুমের দিকে। হাতের রিপোর্টটি তার বেডের পাশে থাকা টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো সে। চোখ বেয়ে নোনা জলগুলো ধুয়ে যাচ্ছে শাওয়ারের পানিতে। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নেওয়ার পর চুলে কোনোমতে টাওয়েল পেচিয়ে বাহিরে চলে এলো। বারান্দায় টাওয়েল শুকাতে দিয়ে বারান্দায় থাকা দোলনায় বসে পাশে থাকা কাঠের তাকে রাখা অনেকগুলো বইয়ের মাঝে থেকে একটা খয়েরী রঙের ডায়রি বের করে। ডায়রিটা একবার বুকে জরিয়ে ধরলো। তারপর তাতে তার ঠোঁট হালকা করে ছুঁয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পাশে থাকা টেবিল থেকে একটা কলম নিয়ে ডায়রিতে ছোঁয়ায়। কাঁপাকাঁপা হাতে লেখতে লাগল
••জানো প্রিয় আমি আর তোমার স্মৃতিচারণ করে তোমাকে কষ্ট দিবো না। দিবো না তা নয় দিতে পারবো না। কারণ আমি আর পারবোই না। আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে আমার কাছে। তোমাকে আর কেউ জালাবে না প্রিয়। আমি যে এবার চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলবো তোমাকে মনে করার তোমাকে নিয়ে ভাবার। আর ছয়মাস না হয় এর চেয়েও কম সময়। আচ্ছা তুমি কি মনে রাখবে আমাকে। না তা কিভাবে হবে তুমি তো এখনই আমাকে ভুলে গিয়েছ। আচ্ছা তোমার কি কখনো আমার কথা মনে পরবে না। মনে পরবেনা আমার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। জানো তো জীবিত অবস্থায় সারাক্ষণ আমি তোমাকে স্মরণ করি। তুমি যে আমার প্রতিটা রঙিন মুহূর্তের সাক্ষী। জানো তো আমার হাতে না বেশিদিন। যদি পারতাম শেষবারের মতো তোমাকে একবার দেখতাম। তোমার কোলে মাথা রেখে নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। জানি কখনো এই ইচ্ছে পূরণ হবে না আমার। তবুও আমার অবাধ্য মন যে বাস্তবতা মানতে চায় না। জানো তো ইদানিং মাথা ব্যথাটা খুব বেড়ে গিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা হয়। আর বাঁচতে মন চায় না এই ব্যথায়। কিন্তু তোমাকে শেষ একবার দেখার জন্য যে আর মরে যেতে মন চায় না। এই কালে তোমাকে নিয়ে বাঁচা হলো না আমার। আমি পরকালে তোমাকে চাই। তোমাকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই।••
হঠাৎ মাথাটা আবার ব্যথা শুরু হওয়াতে ডায়রির মাঝে কলমটা রেখে উঠে পরলো সানজিদা। মাথা চেপে ধরে রুমের বেডের দিকে এগিয়ে গেল। ধপ করে শুয়ে পরে বেডে। একটা হাত কপালে রেখে চোখ বন্ধ করে সে। মাথা ব্যথায় ছটফট করছে। হঠাৎ কপালে কারো উষ্ণ স্পর্শে চোখে পানি ছেড়ে দেয় সানজিদা। সানজিদা শক্ত করে মানুষটার হাত আকড়ে ধরে বলল “আচ্ছা শশী আমার জীবনটা এমন কেন হয়ে গেল। আমার জীবনটা তো অন্যরকমও হতে পারতো। সে কেন আমায় ভালোবাসলো না। কি হতো একটুকু ভালোবাসলে। আমি তো তার কাছে তেমন কিছু না শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম।” বলেই ফুপিয়ে উঠলো সানজিদা।
সানজিদার প্রিয় বান্ধুবী শশী সানজিদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে সানজিদার দিকে। সানজিদার কপালে আলতো একটা স্পর্শ দিয়ে বলল “আর কতো করে বলবো যে তোকে যে ছেড়ে দিয়ে সুখে থাকার জন্য চলে যায় তাকে ভেবে আর নিজেকে কষ্ট দিস না। তা ডাক্তার কি বললেন।”
সানজিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “কি আর বলবে আমার আর থাকা হবে না এই নিষ্ঠুর দুনিয়াতে। আমার হাতে যে আর সময় নেই।”
শশী বলল “মানে কি বলছিস এগুলো”
সানজিদা একটা মুচকি হাসি দিয়ে শশীকে আলতো করে জরিয়ে ধরে বলল “আমার ব্রেন ক্যান্সার ধরা পরেছে। লাস্ট স্টেজ আমার হাতে আর মাত্র ছয় মাস রয়েছে। আমি আর জালাবো না তোমাকে।”
সানজিদার কথা শুনে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো শশী। আচ্ছা এই কি সেই সানজিদা যে নাকি সবসময় হাসিখুশি থাকত। বাস্তবতার চাপে সে যেন পাথর হয়ে গিয়েছে।
শশী বলল “আমি তোর ভালো চিকিৎসা করাবো। তোর কিছু হবে না দেখিস। তুই সুস্থ হলেই তোর জন্য একটা লালটুকটুকে জামাই এনে দিবো।”
সানজিদার মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। সে বিরবির করে বলল “আমার লালটুকটুকে জামাইটা যে এখন হয় তো অন্য কারো জামাই।” তারপর শশীকে উদ্দেশ্য করে বলল
“শশী তিশা কোথায় ওর তো পড়তে আসার কথা।”
শশী বলল “ও পড়তে বসেছে আমি ওকে পড়িয়ে দিবোনি তুই টেনশন নিস না। আর আন্টির কাজ থাকায় ওকে দিয়েই চলে গিয়েছে। আর জান্নাতি আন্টি তোকে সহ আমাকে ওখানে খেতে বলেছে। না গেলে মন খারাপ করবে যাবি তো!”
সানজিদা মুচকি হেসে বলল বাহ ও পড়তে বসেছে অবাক করা বিষয়। ওর এই অভ্যাসটা গড়ে তুলতে হবে। আমি যখন থাকবোনা তখন তো এমন করেই পড়তে হবে। আর ওকে না চকলেটের লোভ দেখাবি। তাহলে দেখবি ঠিক সব পড়া শেষ করবে। আমি যখন থাকব না তখন তো তোকেই এগুলো করতে হবে। আর আমি যাবো ওদের বাসায় সমস্যা নাই।”
হঠাৎ একজন দৌড়ে এসে সানজিদাকে জরিয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠে বলল “আপুই তুমি কোথায় যাবে! আমি কিন্তু পড়তে বসব না তুমি চলে গেলে।”
সানজিদা মুচকি হাসি দিয়ে তিশার মাথায় হাত রেখে বলল “ধুর এসব পাগলামি করে না। তোমার বাবা মার তোমাকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখে জানো না তুমি। আমি না থাকলে কিছুই হবে না। ভালো মতো পড়াশোনা করে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। ঠিক আছে।”
তিশা আরো আকরে ধরে সানজিদাকে আর বলল “আপুই আমি কিছু জানি না। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।”
সানজিদা বলল “আচ্ছা বাবা যাচ্ছিনা এখন শান্ত হও তো।” সানজিদার কথার মাঝেই জান্নাতি বেগম রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল “আজ তুই আমাদের বাড়ি গিয়ে খাবার খাবি। এখন চল তো।”
সানজিদা বলল “এতো ঝামেলা করার কি দরকার ছিলো খালামণি।”
জান্নাতি বেগম বলল” ধুর পাগলি এতে ঝামেলার কি আছে তুমি কি আমাদের অপর নাকি।”
বলেই জান্নাতি বেগম ওদের নিয়ে গেল ওনাদের বাসায়।
#চলবে
#তোমার_স্মৃতি
#পর্বঃসূচনা_পর্ব
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।