তোমারই আছি আমি
পর্ব-২৯ ( শেষ)
Sara Mehjabin
( এই পর্বের শুরুটা গোলমেলে লাগতে পারে তাই সবাই ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।)
৫ বছর পর…
ফুল আলোক রোশনাইয়ে ঝলমলে সাজে মুখরিত খান প্যালেস। রক্তলাল গোলাপ আর বেলীফুলের বিভিন্ন ধাচের সাজের সুবাস খান প্যালেসের প্রতিটি কোনায় কোনায়,,,প্রত্যেক আনাচে কানাচে। ধবধবে সাদা আলোর ঝলকানিতে দেখে মনে হচ্ছে বাড়িটাকে যেন জোৎস্না মাখানো হয়েছে। সত্যি সত্যিই আজ এই বাড়ির জোৎস্না মাখার দিন। আজ এই বাড়িতে পূর্নিমার চাঁদ প্রবেশ করবে। যে চাঁদের জোৎস্না আলোকিত করে তুলবে পাঁচ বছর অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটাকে।
“সানভি, সানভি সোনা বাবা দৌঁড়ায় না। আসো। বাবা পড়ে যাবা সোনা। কথা শোনো,,ও সানভি।”
খানবাড়ির সামনের যে বিশাল সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ সেটা জুড়ে ছোটাছুটি করে চলেছে পাঁচ বছরের ফুটফুটে একটা শিশু। ছোট্ট মুখটা জূড়ে যেন এক বিশ্ব মায়া। ভীষণ গভীর দুটো চোখ। গাঢ় গোলাপি পান্জাবীর সঙ্গে সোনালি পায়জামা পড়ানো হয়েছে। মাথায় ছোট্ট একটা মুকুট। দৌড়াতে দৌড়াতে গেট পর্যন্ত চলে গেল। অদ্বিতীও কম না। গেটের কাছে গিয়ে খপ করে ধরে কোলে তুলে নিল। বিকাল থেকেই এই চাকরি হয়েছে তার। পাঁচ মিনিট পরপর গেটের কাছে চলে যায়। আবার টেনে আনতে হয়। আবার চলে যায়। কি পরিমাণ পাজি তার হিসাব নেই। আর বুদ্ধিও,,,বাবারে বাবা একদম শিয়ালের মতো বুদ্ধি। অদ্বিতীর দুইদিনের দম বন্ধ লাগছে,,আর পাঁচটা বছর এই ভয়াবহ বস্তুকে পেলে বড় করল কিভাবে এর মা! নাঈমের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে আসার পর বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান করছিল। কিন্তু না বাবা সারা ও আকাশের পুত্র সানভিকে দেখে বাচ্চার শখ মিটে গেছে। কে জানে তার পেটের জিনিসটা সানভির ফটোকপি হয়ে জন্ম নেয় বাই চান্স! হতেই পারে, এক ভাই আরেক ভাইয়ের মতো হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। না থাক্ দরকার নেই। সানভিকে মানুষ করতে এই বাড়ির সব মেয়েদের সার্ভিস প্রয়োজন হবে। সো অন্য কারো বাচ্চা না নিলেও চলে।
: ও মনিআম্মু বলো না আমার মাম্মাম কখন আসবে? আনছে না কেন আমার মাম্মাম কে? জানতাম ও পারবে না। ও আনতে গেলে আমার মাম্মাম আসবেই না। এজন্যই আমি যেতে চেয়েছি। আমি গেলে মাম্মামকে নিয়ে এতক্ষনে চলে আসতাম। উফ,, এই পাপা লোকটা কিচ্ছু পারে না।
বড়দের ভঙ্গিতে কপালে হাত রাখল সানভি। ওর এই আচরণ দেখে অদ্বিতী ফিক করে হেসে ফেলে।
: হাসছ কেন? এই মনিআম্মু হাসছ কেন তুমি? তুমি জানো আমার কত্ত রাগ উঠে গেছে। আমার মাম্মামকে না দেখলে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। আর দুইদিন মাম্মামকে দেখি না আমি। তোমরা তো কথাও বলতে দাও নি মাম্মামের সাথে,,বলেছ সারপ্রাইজ আছে। আমার সারপ্রাইজ লাগবে না,,কিচ্ছু লাগবে না। শুধু কথা বলতে দাও মাম্মামের সাথে।
: ওলে বাবা মাম্মাম চলে আসবে তো। তোমার মাম্মামকে সবাই আনতে গেছে। আজকে মাম্মামকে দেখলে চমকে যাবে তুমি। মাম্মাম আজকে বৌ সেজে আসবে।
: কৈ? আসছে না তো আমার মাম্মাম।
: আসবে রে বাবা আসবে। আগে তুমি একটু খাও।
মুখের সামনে চামচ এগিয়ে ধরতেই সানভি ছুঁড়ে ফেলল। রাগী কন্ঠে বলল, বলেছি না খাব না আমি। মাম্মামের হাতে ছাড়া আমি খাই না। মাম্মামের হাতে ছাড়া আমাকে খাবার দেবে না। আসলে খামচি দেব।
খামচির কথা শুনে অদ্বিতী ভয়ে চুপসে যায়। ইতিমধ্যে সানভির বিখ্যাত খামচির পরিচয় সে পেয়ে গিয়েছে। তাই খাবার দূরে থাক নিজেই কোনরকম জান নিয়ে পালাল। ছেলেটা বান্দরের ওস্তাদ হলেও মা’কে বড্ড ভালবাসে। মা যেন ওর জান-প্রান সবকিছু। দুইদিন আসছে এই বাসায়, মা ছাড়া কোন কথা নেই। মা কখন আসবে, মা’কে আনছ না কেন? কেমন বড় মানুষের মতো ফোন কানে নিয়ে জিগ্যেস করে,,খেয়েছ মাম্মাম? কি, তুমি খাও নি? ঝগড়া বুড়ি (তার নানি) টা কে ফোন দাও। এক্ষুনি দাও। ওকে বলে এসেছি তোমার খেয়াল করতে। কিচ্ছু কাজ করে না। বুড়ি একটা!
আবার বলে, ও মাম্মাম আমাকে ছাড়া তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব, তাই না? এই তো আরেকটা দিন। তারপর তোমাকে নিয়ে আসব। তুমি কিন্তু কাঁদবে না। আর আমার জন্য একদম চিন্তা করবে না,,হুম?
রাতে প্রতিদিন মায়ের কাছে ফোন করে, মাম্মাম তুমি কিন্তু একা শোবে না। তোমার যদি ভয় করে! আমরা তো কেউ নেই তোমার সাথে। তুমি শাশুলির (শাশুড়ি/ ফারিহা/ সায়ানের বৌ) কাছে ঘুমাও। আমার লক্ষী মাম্মাম,,,,টাটা।
ফোনে মায়ের কপালে অদৃশ্য চুমু দিয়ে অদ্বিতীর কোলে ঘুমিয়ে পড়ত।
আর কিছুক্ষণ পেরোতেই বাদ্যযন্ত্র আর গানে মুখরিত ফুলে সজ্জিত সব গাড়িগুলো মহা সমারোহ করে খান প্যালেসের ভিতরে প্রবেশ করল। গাড়ির ভেতর থেকে বরবেশে আকাশ নামে। গাড়ির দরজা খুলে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে হাতটা সামনে বাড়িয়ে দেয়। সাথে সাথেই জমকালো শাড়ির নিচে আলতারাঙা পা’দুটি আকাশের হাতের ওপর রাখতেই আকাশ তাকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নেয়। চারদিকে প্রচুর লোকজন, বাদ্যবাজনা আর মাঝখান দিয়ে আকাশ নববধূকে কোলে তুলে হেঁটে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে গোলাপের পাপড়ি গোলাপজল ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে ওদের মধ্যে। আজ সারা ও আকাশের বিয়ে। পাঁচ বছর পর সারা তার শশ্বুরবাড়ি কে বরন করে নিয়েছে। আর আকাশো রেখেছে তার কথা। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী স্ত্রীকে না নিয়ে এই বাড়ির দরজায় পা রাখেনি। নতুন বৌ সাজে বৌকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্মিত হাসে আকাশ। অবশেষে শেষ হলো শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত আর নির্বাসন। ভালবাসার বহু পরীক্ষা দিয়েছে আকাশ। এইবার সেই পরীক্ষার ফল ভোগের সময়।
পাঁচ বছর আগে…
সারার লেখা চিঠিটা পড়ার পর আকাশ কিছুক্ষনের জন্য বোধশক্তিহীন হয়ে পড়ল। যেন নিঃশ্বাস নিতেও পারছিল না। বুকের দুইপাশ যেন চেপে এসে পাজরে আঘাত করছিল। একটাই কথা মাথায় ঘুরছিল এতো বড় শাস্তি দিবি পুতুল? ছেড়ে চলে যাবি? হ্যা আমি শাস্তি চাই। খুব শাস্তি চাই তোর থেকে। তোর যেভাবে ইচ্ছা ; যেমন ইচ্ছা। তুই যদিও হারিয়ে গিয়ে নিঃস্ব করতে চাস আমাকে-বেশ, নিঃস্ব আমি হবো। কিন্তু তোকে তো হারিয়ে যেতে দেব না।
আকাশ প্রায় পাগলের মতো খুঁজেছিল সারাকে। দেশের এমন একটা জায়গাও বাদ ছিল না খোঁজার। আশ্চর্যজনকভাবে সারাকে কোথাও পাওয়া গেল না। তবে কি সারা বিদেশে? এয়ারলাইন্সের সবজায়গায় খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হলো সারা বিদেশে নেই। সারার নিঁখোজ হুলস্থুল শুরু হয়ে গেল গোটা দেশজুড়ে। সমস্ত পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এ একটাই টার্গেট। সব নিউজপেপার জুড়ে শুধু সারার ছবি। সারাকে খুঁজে দেওয়ার পুরস্কার এক কোটি দুই কোটি এমনকি শেষ পর্যন্ত খান ইন্ডাস্ট্রিজ এর অর্ধেক সম্পত্তি হয়ে গেল। তবুও কোন খোঁজ নেই সারার। এইবার একটা ব্যাপারে আকাশ নিশ্চিত তার পুতুল ঠিক নেই। অনেক বড় বিপদ হয়েছে তার পুতুলের। হাসপাতালেও খোঁজ নেওয়া হলো সারার। এমনকি অনেকগুলো পাচারকারী গ্যাং, নারী ব্যবসায়ী, পতিতালয় পর্যন্ত যাওয়া হয়। আকাশ যেন দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন সারার খোঁজ। রাতের বেলা শাড়িতে মুখ গুজে সারার ঘ্রান নেওয়া; মদের বোতল খাওয়া- বেঁচে থাকার শক্তিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
একদিন রাতের বেলা। বার থেকে পুরোপুরি ড্রাঙ্ক হয়ে বেহুশ অবস্থায় ফুল স্পিডে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আকাশ। হঠাৎ-ই একটা মেয়ে গাড়ির সামনে এসে পড়ে।
” ভাইয়া ও ভাইয়া প্লিজ একটু গাড়ি থামান। আমার বান্ধবী প্রেগনেন্ট, সন্ধ্যা থেকে সব-ই ঠিক ছিল হঠাৎ করে লেবার পেইন শুরু হয়েছে। এই রাত তিনটায় কোথায় গাড়ি পাব, ওকে কিভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। দয়া করুন ভাইয়া। আমাদের হাসপাতালে নিয়ে চলুন। সারাজীবন ঋনী থাকব।”
বোরকা পড়া মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল আকাশ। ফারিহা! সারার সঙ্গে এতোদিন ফারিহারো কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।
ফারিহা উত্তেজনার বশে এতক্ষণ খেয়াল করে নি সামনে কে। আকাশকে দেখে সেও চমকে উঠলো।
আকাশ আর এক সেকেন্ড-ও দেরি না করে পা দিয়ে গাড়ির দরজা এক ধাক্কায় ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে। ফারিহা সারাকে রাস্তার পাশের একটা বেন্ঞে শুইয়ে এসেছিল। আকাশ দ্রুত সারাকে সেখান থেকে কোলে তুলে নেয়। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তোলে কপাল গাল মুখ। ব্যথায়-যন্ত্রনায় সারার চোখ থেকে ঝরা পানিগুলো মুছিয়ে দিয়ে কপালে আবারও গভীর চুমু খায়। এতদিন সারা এই শহরেই ছিল; সবার খুব কাছে। কিন্তু বোরকা পড়া ছদ্মবেশে ওকে কেউ চিনতে পারে নি। আট মাস ধরে নিজের জীবন একাই চালাচ্ছে সারা। ফারিহা আর সারা আলাদা একটা বাসায় থাকে। সায়ান, সারার বাবা অনেকবার নেওয়ার জন্য এসেছে। সায়ান তো পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে তাও সারা ফিরে যায় নি। দুইজন থাকে; এক অফিসে জব করে; হয়তো সেই অফিসে আকাশ খোঁজ নিতে গিয়েছিল কিন্তু সারার একান্ত অনুরোধে আকাশকে কেউ কিছু জানায় নি। পাশাপাশি দুইজন পড়াশোনা করছে। বিদেশে স্কলারশিপ এর জন্য পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছে। এরই মধ্যে আকাশের শারীরিক চাহিদার ফসল হিসেবে সারা প্রেগনেন্ট হয়ে গেল। সারার পরিবার খবর পেয়ে আবার আসে। সারার বাবা-মা দুইজনে অনেক জোরাজুরি করে বাচ্চাটা নষ্ট করার জন্য। কিন্ত সারা বলে এই বাচ্চাটা তাদের চেয়ে ওর কাছে বেশি আপন। সুতরাং তাদের কথায় এই বাচ্চা সে কখনো নষ্ট করবে না। ফারিহা ও সারা মিলে ঠিক করে এখন থেকে এই বাচ্চাটা ওদের দুইজনের। দুইজনে মিলে মানুষ করবে এই সন্তানকে।
সেইদিন জন্ম নেয় সানভি; সারা ও আকাশের প্রথম সন্তান। ওদের ভালবাসার প্রথম চিহ্ন। বাচ্চা জন্ম দেবার পর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল সারা। প্রচুর রক্ত লেগেছিল। তিন-চার মাস অসুস্থ থাকে। সময়টায় আকাশ সব বাদ রেখে সারার কাছে থেকেছে। সারাকে খাওয়ানো, ওষুধ দেওয়া, সারার জন্য রান্না-বান্না, গোসল করানো- সারার সবকিছু আকাশ-ই করত। সারা সহ্য করত না আকাশকে। খাবার আনলে ছুঁড়ে ফেলে দিতো; জেদ করে নিজে গোসল করতে গিয়ে বাথরুমে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল কোনরকমে আকাশ ওকে বাঁচায়। ধীরে ধীরে সারা সুস্থ হয়ে ওঠে। খেয়াল রাখতে শুরু করে বাচ্চার। গত তিন-চার মাস বাচ্চা ফারিহাই দেখেছে। সারা কোনমতে শুধু ফিডিং করাতো। এরপর শুরু হয় আকাশ ও সারার সংসার। না,সারা কিন্তু আকাশকে ক্ষমা করে নি। অবহেলা, অযত্ন, অপমান আর ঘৃনা নিয়েই আকাশ হাসিমুখে সংসার করতে থাকে। একজনের একবুক ভালবাসা আরেকজনের একবুক ঘৃনা নিয়েই এগিয়ে চলতে থাকে ওদের দাম্পত্য জীবন। সারা আকাশকে সহ্য করতে পারত না। আকাশের মুখ দেখামাত্র খিটখিট করে উঠত। প্রয়োজনের বাইরে আকাশের সঙ্গে একটা কথাও বলত না। আর স্বামীর অধিকার অনেক দূরের ব্যাপার। তবে আকাশের সন্তানকে কখনো দূরে সরিয়ে দেয় নি সারা। সন্তান ওদের দুজনের, আকাশের-ও অধিকার আছে সানভির ওপর। আর সারা এটাও চায় নি তার সন্তান বাবার ভালবাসা ছাড়া বড় হোক। সানভির নিয়ম ছিল সপ্তাহে চারদিন মা, তিনদিন বাবার কাছে ঘুমানো। সানভি অদ্ভুত এক পরিবেশে বড় হতে থাকে। সে দেখে তার মা তার বাবাকে দেখতে পারে না; পছন্দ করে না। অথচ তার বাবা মা’কে কত ভালবাসে। সারাক্ষণ তার মায়ের খেয়াল রাখছে তার মায়ের খুশি নিয়ে চিন্তা করছে,,মায়ের একটু কিছু হলেই তার বাবা অস্থির হয়ে যায় অথচ মা তো বাবাকে কত কষ্ট দেয়। বাবার তাও রাগ হয় না? এইসব প্রশ্নগুলো সারাক্ষণ মনে ঘুরলেও কাউকে বলতে পারে না।
এইদিকে সায়ান ও ফারিহার সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে সারার ঘটনার প্রভাবে। যে ছেলে নিজের বোনকে বিপদে অসহায়ভাবে ফেলে দেয়,সে অন্য মেয়েকে কি সম্মান করবে? সায়ান নিজের ভুলের জন্য সত্যিই খুব অনুতপ্ত। সারার সামনে মুখ দেখাতেও ঘিন্না হতো।আর আকাশের সামনে যাওয়ার কথা সে ভয়েও ভাবতো না। কারণ সেইরাতে সারাকে রাস্তায় বের করে দেওয়ার ঘটনার পর সায়ানকে সামনে পেলে আকাশ কি কি করতে পারে সেটা ওর খুব ভালো ধারণা আছে। ফারিহার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে ফারিহার বিয়ে ঠিক করল আকাশ। ফারিহার বিয়েতে ইচ্ছা ছিল না; তবু সায়ানকে চিরতরে মুছে ফেলতে চায় বলেই রাজি হয়ে গেলো। বিয়ের দিন হুট করেই উধাও হয়ে যায় ফারিহা। পরে জানা গেল সায়ান তাকে তুলে নিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করেছে। সায়ান ও ফারিহার সংসারের শুরুটাও ছিল আকাশ ও সারার মতোই। তারমধ্যে সায়ানের মা শুরু করেন নতুন ঝামেলা। ফারিহাকে কিছুতেই মেনে নেবেন না। মায়ের বাজে ব্যবহার, অপমানজনক কথা থেকে ফারিহাকে রক্ষা করে চলেছে। নিবিড় ও মেধার শাস্তি হয়েছে। ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। আর এদিকে এতোদিন যা হয়েছে সব নিবিড়ের গেম প্ল্যান ছিল-নিবিড়ের কারণে সে আকাশকে খুন করতে গিয়েছিল অথচ সেই নিবিড়ের কাছে সে ছিল শুধু গেমের একটা উপকরণ এইসব জানার পর কষ্ট-রাগ-ঘৃনা-অপরাধবোধ সবকিছু মিলিয়ে অদ্বিতী একদম ভেঙে পড়ে। তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে একটা তীব্র অপরাধবোধ। এই পরিমাণ মানসিক চাপ অদ্বিতী নিতে পারে নি। ওর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আকাশ সারার কাছে থাকলেও খুব ভালো খেয়াল রেখেছিল অদ্বিতীর। আকাশের বন্ধু আমান জুনায়েদ। পেশায় সাইক্রিয়াটিস্ট। বিদেশ থেকে সাইকোলজি তে পি এইচ ডি করে বাংলাদেশ এসেছে। অদ্বিতীকে আকাশ তার চেম্বারে না গেলে। আমান বলল এই ধরনের পেশেন্টকে সুস্থ করার জন্য চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশন প্রয়োজন। অতঃপর আমান কে খান প্যালেসে আনা হলো। কোন ডাক্তার যে একজন রোগীর পেছনে এত শ্রম এত মোনোযোগ এত যত্ন ব্যয় করতে পারে আমানকে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করত না। অদ্বিতীকে মানসগকভাবে সম্পুর্ন করে তোলাই যেন তার একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান, লক্ষ্য। অদ্বিতী অদ্ভুত পাগলামি করত। প্রথম দিন থেকে আমানকে সে নিবিড় বলে ডাকত। নিবিড়ের সঙ্গে যা যা করত সব আমানের সঙ্গে করা শুরু করে। বাড়ির সকলে এতে বিব্রতবোধ করলেও ব্যাপারটাকে আমান খুব সহজভাবে নিয়েছিল। সে তার সম্পুর্ন চেষ্টা চালাত অদ্বিতীর খুশি থাকার। অবশেষে আমান বুঝতে পারে এই যে অদ্বিতীর প্রতি যত্ন, অদ্বিতীর খুশি দেখে ভালো লাগা, নিজের অসুবিধা সত্ত্বেও ওকে আগলে রাখা এসব কোন রোগীর প্রতি হতে পারে না। অদ্বিতী ধীরে ধীরে ওর অভ্যাস হয়ে উঠেছে। আমান সিদ্ধান্ত নেয় সে অদ্বিতীর দায়িত্ব নিবে, তাকে চিরদিনের জন্য নিজের সঙ্গিনী বানিয়ে। আমানের প্রস্তাবে খান পরিবার একটুও সম্মতি দেয় না। কারণ তারা চায় না তাদের অসুস্থ মেয়ের জন্য একটা ছেলের জীবন নষ্ট হোক। কিন্তু আমানের জেদের কাছে হার মানে সবাই। একপ্রকার জোর করেই একটি অসুস্থ মেয়েকে সে তার জীবনসঙ্গী বানায়। যদিও সুস্থ হয়ে সম্পর্কটা মেনে নিতে বেশ সময় লাগে অদ্বিতীর। অবশেষে আকাশ সফল। সারার মনের ঘৃনার পাহাড়কে সে ভালবাসায় ভাঙতে পেরেছে। তার-ই ফলস্বরূপ সারার গর্ভে তার দ্বিতীয় সন্তান। আজকে সারাকে তার ঘরে নিয়ে যাবে সে। চিরদিনের জন্য নিয়ে যাবে।
মনিরা খান বধূবরনের সমস্ত আয়োজন সাজিয়ে দরজায় দাঁড়ালেন।
“আয় রে আমার ঘরের লক্ষী ঘরে আয় আমার। লক্ষীর রাগে এতোদিন আমার এই ঘরটা অন্ধকার হয়েছিল। লক্ষী যখন রাগ ভেঙে সব ভুলে আবার প্রবেশ করবে আমার ঘরে। আমার অন্ধকার সংসারটা আবার আলোয় ভরে ওঠবে। না না, আমার সংসার কেন? এটা তোর বাড়ি। তোর সংসার। অনেক খাটানো হয়েছে আমাকে। এইবার আমি ছুটি নিব। এই গোটা সংসারের বোঝা তুই ঘাড়ে তুল দয়া করে। আমি আর কিছু করতে পারছি না। আমি শুধু আমার সানভির সঙ্গে থাকব, খেলা করব, অনেক মজা করব। তাই না রে সানভি?
আকাশ ধীরে ধীরে সারাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল।
অদ্বিতী: সারার কিন্তু পাঁচ মাস চলছে। খুব সাবধানে নামা দাদা। ব্যথা পাবে,,
সারা এগিয়ে এসে মনিরার পায়ে সালাম করার উদ্দেশ্যে ঝুকতেই মনিরা টেনে তোলেন।
মনিরা: তোর তো কম সাহস না রে ছেরি! আমার সামনে আমার নাতনীকে ব্যথা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিস! তোকে বলেছি সালাম করে আমার আশীর্বাদ নে। আমি তোরে আশীর্বাদ করি না? এই যে এতগুলো দিন আমার ঘর সংসার সব ফেলে চলে গিয়েছিলি তাও দোয়া করতে ভুলি নাই।
সারা: বড়মামি আমি হয়তো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করো। বিশ্বাস করো চলে যাওয়া ছাড়া কোন রাস্তা খোলা ছিল না আমার।
মনিরা: না সারা আমি কখনো ক্ষমা করব না। যে ভুল তুই করেছিস তোর কোন ক্ষমা হয় না।
সারা: বড়মামি তুমি এই কথা বললে? তুমি যদি ক্ষমা না করো তাহলে কোন অধিকারে তোমার সংসারে থাকব?
মনিরা: ঠিকই তো। বড়মামির সংসারে কেউ কোনদিন থাকে নাকি। আমার এমন একখানা সুন্দর কপাল যে নিজের দুই দুইটা নাতী-নাতনীর মায়ে আমাকে বড়মামি ডাকে।
সারা: মা..
মনিরা: গুড। ভেরি গুড। এখন থেকে এইটা ব্যতীত অন্য কোন শব্দ দিয়ে আমাকে সম্বোধন করবে না কথাটা যেন মগজের মধ্যে আটকানো থাকে। দরকার হলে কথাটা পিন দিয়ে মগজের সাথে আটকিয়ে নে।
—————————————————————–
আকাশ ও সারাকে বিশাল আয়োজন করে ঘরে ঢোকানো হলো। সারাকে জড়িয়ে ধরে আকাশ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করছে আর বারবার তাকিয়ে দেখছে চারপাশে। এই বাড়ি, নিজের আপনজন সবাইকে কতগুলো বছর পর চোখের সামনে দেখছে। এদের থেকে কতগুলো দিন দূরে থাকতে হয়েছে যদিও যোগাযোগ ছিল-ই। তাছাড়া সারাকে পাওয়ার কাছে সব ত্যাগ-ই তুচ্ছ তাও কষ্ট তো হয়-ই। এই মুহুর্তে একজন মেয়ে, একজন স্ত্রীর কষ্টটা আকাশ অনুভব করতে পারছে। খুব গভীরভাবে অনুভব করতে পারছে। যে বাড়িতে জন্মায়, যে মানুষগুলো সারাক্ষণ বুকে আগলিয়ে আদরে-ভালবাসায় বড় করে তোলে একদিন সেই বাড়ি, সেই মানুষজন সবার আদর-ভালোবাসা সবকিছুকে পেছনে ফেলে চলে আসতে হয়। যেখানে আসে সেখানে কখনো ঐ বাড়িটার মতোন ভালোবাসা পায় না কিন্তু। তবুও ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। অথচ এইরকম ত্যাগ স্বীকার করা বৌয়েরা স্বামীর কাছে মূল্য পায় না।
আজকে সব ঠিকঠাক। আজকের দিনটার মতো আনন্দের দিন হয়তো এই বাড়িতে আর নেই। কখনো ছিল না।
সারা আর আকাশকে পাশাপাশি বসিয়ে সবাই ওদের ঘিরে বসে।
মনিরা খান হঠাৎই বললেন, আচ্ছা সায়ানরা কখন আসবে? ওদের বাসায় বিয়ে হয়েছে ভালো কথা তারজন্য আমাদের অনুষ্ঠানে আসবে না? এখনো আসলো না কেন ওরা? আমান বাবা একটু আগিয়ে দেখো না,,,
বাইরে থেকে অদ্বিতীর বর আমানের কন্ঠ শোনা গেল, বড়আম্মু সায়ানভাইরা চলে আসছে।
দরজার সামনে সায়ান, ফারিহা ও জাফরিনা এসে দাঁড়ালেন। সায়ান ফারিহাকে ধরে রেখেছে। পাঁচ মাস চলছে ফারিহার। আজব হলেও সত্যি ওরা দুই বান্ধবী এক-ই দিন এবং এক-ই সময় কনসিভ করেছে। ফারিহার পেটের বাচ্চা মেয়ে এই বিষয়ে সানভি একশো পার্সেন্ট শিওর। জন্মনোর আগেই সে তাকে বৌ বানিয়ে বসে আছে। এবং সেই হিসাবে ফারিহাকে শাশুড়ি, সায়ানকে শশুর ডাকছে।
মনিরা খান আবার তাড়াহুড়া শুরু করেন বরনের জন্য।
মনিরা: যে কাহিনী করে বিয়ে হলো সায়ানের। না কোন অনুষ্ঠান হলো, না বৌটাকে বরন করতে পারলাম। বৌটাকে তো আশীর্বাদ-ই করা হয় নাই। আমি তাই ভাবছি আকাশ আর সারার সঙ্গে সঙ্গে সায়ান আর বৌমারো বরন করব।
জাফরিনা: ওহো ভাবি ভাগ্য ভালো তুমি মনে করলে। সব ঝামেলা-ঝন্ঞাট মেটার পর আমার উচিত ছিল সায়ানের বিয়ের ভালোমত একটা অনুষ্ঠান দেওয়া। বৌয়ের তো একটা সম্মান রাখা দরকার। কত অন্যায় অবিচার হয়েছে ওর সঙ্গে।
মনিরা: থাক্ ছেলের বৌয়ের প্রতি অন্যায় অবিচারের কথা বাদ দাও। নিজের মেয়েকেই যে চিনতে পারে না, বিপদের দিনে মেয়ের পাশে দাঁড়ায় না,,,তার কাছে আমি কিছুই আশা করি না।
মনিরার কথার উত্তরে জাফরিনা একদম চুপ হয়ে রইল। সত্যি উত্তর দেওয়ার কোনো মুখ তার নেই।
পরিবেশটা অন্যদিকে চলে যাওয়ায় অদ্বিতী দ্রুত বলল, আপনারা আমার বেচারি দাদাকে দেখেছেন,,,উনার দীর্ঘ সাত+পাঁচ মোট বারো বছরের সংসার অথচ একবারো বাসর হয় নাই। একবারো বাসরঘরে সে বৌ স্যরি বিড়াল মারতে পারে নাই। একটা মানুষ আর কত ধৈর্য্য রাখবে বলেন? আমার দাদা কি মানুষ না?তার কি মন চায় না বাসররাতে বৌ থুক্কু বিড়াল মারতে? আমার দাদা বাসরে ঢোকার জন্য অস্থির হয়ে আছে, তার হাত-পা চুলকাচ্ছে। তাকে যদি আরও কিছুক্ষণ বসানো হয় এইখানে সে বৌ কোলে তুলে সে বাসরঘরে ঢুকে যাবে। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিবে।
আকাশ(বিড়বিড় করে): তাই করব। আর কিছুক্ষণ যদি এইখানে বসিয়ে রাখে সত্যিই তাই করব। বৌ কোলে তুলে সোজা বাসরঘর বরাবর দৌড় দিব। দ্যান দ্য ডোর ইজ ক্লোজড।
: আসতে পারি?
হঠাৎ মেয়েকন্ঠের ডাক শুনে সবাই পিছন ফিরে দেখল মেধা। মেধার জামিনের খবর ইতিমধ্যে সবাই জানে। কিন্তু তাকে এইখানে আচমকা আশা করে নি কেউ।
সবাইকে চুপচাপ দেখে মেধা আবার বলল, আসাটা মনে হয় ঠিক হলো না, তাই না? বোধহয় তোমাদের ঘরে আসতে পারি না আমি। সেই অধিকার বা যোগ্যতা আমার নেই। আমি ঘরে ঢুকবো না খালি দেখতে এসেছিলাম ওরা দুজন কেমন আছে। আমি চলে যাচ্ছি। এখনি।
হঠাৎ মেধার হাত টেনে ধরে সারা তাকে আটকালো। খুব সহজভাবেই বাড়ির সবাই ওকে গ্রহণ করে নেয়।
যাওয়ার সময় হঠাৎই মেধা বলল, সারা তোমার ছেলেটা কোথায় গো? একটা কারণে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে ওকে।
সানভিকে দেখেই আচমকা মেধা থপ করে মাটিতে বসে পড়ল। তারপর সানভিকে জড়িয়ে ধরল হঠাৎ করে। খুব শক্তভাবে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখল কিছুক্ষণ।
সানভি: এই যে এই মেয়ে,,ছাড়ো না ছাড়ো আমাকে। এইখানে কিন্তু আমার বৌ আছে। আমার বৌ মাইন্ড করবে। পরে যদি ও রাগ করে! রাগ যদি বাইরে না আসে! যদি শাশুলির পেটেই থাকে তখন আমি কি করব!
সানভির কথা শুনে সবাই জোরে হেসে উঠলেও মেধা হাসল না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সানভির দিকে। তার হাত সানভির নাক মুখ চোখ চষে বেড়াচ্ছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরে যাচ্ছে। অবিকল আকাশের প্রতিচ্ছবি। যেন ছোটবেলার আকাশ এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে।
মেধা: তুমি কি জানো আমার ছোটবেলায় একটা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল একদম তোমার মতো। যে আমাকে নিয়ে অনেক খেলাধুলা করত, আমাকে পড়ালেখা করাত, আমাকে সবসময় বোঝাত আমি ভুল কাজ করছি। কিন্তু আমি ওর কোন কথা শুনি নি। এখন ঐ বেস্ট ফ্রেন্ড আমার সাথে আর কোন কথা বলে না।
সানভি: কেন? কথা বলে না কেন?
মেধা: আমি যে দুষ্ট মেয়ে, অনেক দুষ্টুমি করেছি। সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। তাই কোন বন্ধু নেই আমার। আমার কেউ নেই।
সানভি মেধার কথাগুলোর অর্থ একটুও বুঝতে পারল না। অথচ গভীর দৃষ্টি নিয়ে মেধার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। মেধা সানভির গালে কপালে হাতে নিয়ে ইচ্ছামতো চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়াল।
তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আকাশের কাছে,
: আকাশ তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। জানি তুমি এখনি না করে দেবে। কিন্তু দয়া করে না করো না। আর না করেও লাভ নেই। এটা আমি তোমাকে দিয়েই যাব।
আকাশের থেকে কোন উত্তর না পেয়েও মেধা তার ব্যাগ থেকে র্যাপিং পেপারে মোড়া একটা বিশাল প্যাকেট আকাশের হাতে তুলে দিল।
আকাশ সন্দিহান হয়ে জিগ্যেস করল, এটা কি?
মেধা: খুলেই দ্যাখো।
আকাশ প্যাকেটটা খুলল ধীরে ধীরে। অবাক হয়ে একবার মেধা আরেকবার প্যাকেটের দিকে তাকাতে লাগলো।
মেধা: আকাশ আমি যখন তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যেতাম তুমি ড্যাবড্যাব করে শাড়ি চূড়ি টিপ কাজল এই জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি তো এগুলো ব্যবহার করি না। আমার ভালোও লাগে না। কিন্তু তোমার তাকানো দেখে মনে হতো তুমি শাড়ি পড়া খুব ভালবাসো। মনে আছে, শপিং শেষ করে আমি তোমাকে সবসময় কোন না কোন অজুহাতে আগে বের করে দিয়েছি। ঐ যে তুমি বেরিয়ে যেতে তারপর তুমি যেই জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলে সব আমি কিনতাম। আমার খুব শখ ছিল একদিন কপালে টিপ চোখে গাঢ় কাজল আর শাড়ি পড়ে তোমাকে চমকে দেব। আমি তো বুঝতাম না ওগুলো সারার পছন্দের জিনিস তাই তুমি তাকিয়ে থাকতে। আমি সব জিনিসগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছিলাম। সারাকে দিও প্লিজ। আমি একদিনো ব্যবহার করি নি। আসি, ভালো থেকো।
সারা: আবার এসো মেধা আপু।
মেধা: আমার এই পৃথিবীতে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমি বারবার আসতে পারি। সেটা আমার নিজের দোষেই। খারাপ মানুষ হয়েছি,,,কি আর করা! সারা, ভালবাসার মানুষের সঙ্গে সারাজীবন থাকার সৌভাগ্য সবার হয় না। অনেকের ভালবাসার মানুষটির ভালবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য-ও হয় না। তুমি কিন্তু ভীষণ ভাগ্যবতী। তুমি যেই লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে আছো বিশ্বাস করো এমন ভালো কেউ কাউকে বাসতে পারে না। তুমি কিন্তু ওকে এতটা ভালবাস নি যতটা ও তোমাকে ভালবাসে। আচ্ছা তুমি যদি কখনো জানতে আকাশ তোমাকে ঠকিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তোমার সঙ্গে,,, আর একটা মুহুর্ত কি তুমি ওর কথা ভাবতে? আকাশ কিন্তু ভেবেছে।আকাশ অন্যায় করেছে। ভুল বুঝেছে তোমায়। কিন্তু তারপরেও সে তোমাকে ছেড়ে যায় নি। দূর থেকে সবসময় তোমাকে দেখত, তোমার খেয়াল রাখত, তোমার অসুস্থতায় রাত জেগে কাটাতো। সে আমার সঙ্গে সাত বছর মিথ্যা সম্পর্কে জড়িয়ছিল সেটা কিন্তু তোমারই জন্য। আর এরপর নিজের ভুল বোঝার পর ও কিভাবে ওর প্রায়শ্চিত্ত করেছে। তুমি ওকে একবিন্দু ভালবাস নি সম্মান দাও নি তারপরও পাঁচটা বছর তোমাকে আগলে রেখেছে। অনেক ভাগ্যে এরকম স্বামী পাওয়া যায়।
মেধা সারাকে কাছে টেনে কপালে চুমু খায়। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। বিশ্বাস-ই হতে চায় না,,,একদিন এই মেধা সারাকে তার জুতার কাদা মুছতে বলেছিল। সারাকে পশুর মতো র্যাগ করিয়েছিল ভার্সিটির ছাত্রছাত্রী দিয়ে। সেইদিনের সাথে আজকের দিনের কোন মিল নেই।
: আসি বোন। সংসারকে যত্নে রেখো। এই সংসারের চেয়ে বেশি মূল্যবান একটা মেয়ের জীবনে কিছুই না। আমরা মেয়েরা যেখানেই যাই, যতদূরেই যাই,,,সংসারে সুখ না থাকলে আমরা কোনদিন সুখি হতে পারি না। আসলে যে কখনো সংসার করতে পারবে না, যার কখনো মা ডাক শোনা হবে না তার কাছে যে এই সংসার কি জিনিস! আসলাম।
সারাকে আরেকবার বুকে জড়িয়ে মেধা বেরিয়ে যায়।
আমান আর অদ্বিতী বাড়ির পেছনের শ্বেতপাথরের ঘাটে। পূর্নিমা রাত। লেকের টলটলে টানিতে গোল চাঁদের প্রতিফলন অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। অদ্বিতী আমানের কাঁধে মাথা দিয়ে সেই অপরূপ দৃশ্য দেখছে। আমান অদ্বিতীর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আর দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছে একজোড়া চোখ। চোখদুটো কানায় কানায় জলে ভর্তি।
: ভালো থেকো অদ্বিতী, সুখে থেকো। যে মানুষটির কাধে এমন নিশ্চিন্তে মাথা রেখেছ প্রার্থনা করি পৃথিবীর সমস্ত সুখ সে তোমার পায়ে এনে দিক। আমি জানি যে লোকটার কাধে তুমি মাথা দিয়ে আছ আমি তার সঙ্গে আমার কোনো তুলনাই চলে না। তবু ঐ লোকটাকে খুব হিংসা হচ্ছে! তুমি আমাকে যতটা ভালবেসেছ কোনদিন পারবে ঐ লোকটাকে ভালবাসতে? না, পারবে না। প্রথম প্রেম ভোলা অত সহজ নয়। আমি এতো বোকা কেন অদ্বিতী? নিজের এতো দামি অলংকার রেখে কেন অন্যের।জিনিস চুরি করতে গিয়েছিলাম? আজ দেখো সব হারিয়েছি আমি। কাউকে ঠকিয়ে কখনো কিছু পাওয়া যায় না। বরং নিজের যা আছে তাও হারিয়ে ফেলতে হয়। তোমাকে হারানোর আফসোস আমার কোনদিনও যাবে না।
চোখের পানি মুছে দ্রুত খান প্যালেস থেকে বেরিয়ে পড়ল নিবিড়। যা দেখতে এসেছিল তা দেখা হয়ে গেছে। অদ্বিতী ভালো আছে। খুব ভালো আছে। একজীবনে আর কিছুই চাই না তার ।
—————————————————————-
সারা আর আকাশের বাসরের খাট সাজানো হচ্ছে। বারো বছরের বিবাহিত দম্পতির প্রথম বাসর।
সারাকে আকাশের পছন্দের গাঢ় নীল রঙের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে। সাথে সিলভার রঙের ওড়না। কানে, গলায় ডায়মন্ডের কারুকাজ করা সেট। দু’হাত ভর্তি দুই ডজন নীলা পাথরের চূড়ি। হীরার ওপর নীল পাথর বসানো কোমরবন্ধনী। চুল খোপা করে নীল গোলাপ গুজে দেওয়া।
আকাশ সিলভার রঙের সিল্ক শেরওয়ানি সঙ্গে গাঢ় নীল পায়জামা। বুকের কাছে নীল পাথরের চেইন। ( ছেলেদের শেরওয়ানির সঙ্গে অনেক সময় একটা লম্বা চেইনের মতো জিনিস থাকে,, নাম সঠিক জানি না )
আমান সায়ান ও আকাশের বাকি বন্ধুরা আকাশকে বাসর ঘরে নিয়ে আসছিল। ঘরে ঢোকার মুহুর্তে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল ফারিহা অদ্বিতী আজমী মাইশাসহ বিশাল মেয়েদের দল। এমনকি মনিরা খান-ও এসে যুক্ত হয়েছেন।
অনেক দরাদরি ঝগড়াঝাটি শেষ করে মেয়েরা আকাশকে বাসরে প্রবেশ করতে দিল। তারপরেই শুরু হয়ে গেল ফিসফিস। ঘর সাজানোর ফাঁকে আজমী আর অদ্বিতী সি.সি ক্যামেরা ফিট করেছে রুমে।
আমান: আল্লাহ এতো কষ্ট করলাম এতো চিকিৎসা করলাম বৌটার তাও তুমি আমার বৌয়ের মাথাটা ঠিক করে দিলা না,,,এই পাগলনী নিয়ে সারাজীবন কিভাবে থাকব!
অদ্বিতী: ওই কি বললা তুমি? আমি পাগলনী?? হ্যা,,
সায়ান: জ্বি। আপনাদের মাথায় এতোই বুদ্ধি সারা যে প্রেগনেন্ট এটাই আপনেরা ভুলে গিয়েছন। ওরা ওদের মেয়ের সামনে বাসররাত পালন করবে না। সো আপনাদের প্ল্যান ফ্লপ।
আজমী: ভ্যাআআআআ। ভাল্লাগে না। ধুর্ কত আশা করেছিলাম জীবন্ত বাসররাত দেখব! একেবারে মুভির মতো। সব নষ্ট হয়ে গেল। কিচ্ছু ভাল্লাগে না। ভ্যাআআ। আমি আজকে সারারাত কাঁনমু।
সায়ান: এত কাঁদার প্রয়োজন নেই শালিকা। আমরা প্র্যাকটিক্যালি আপনার বাসর রাতের ব্যবস্থা করতে চলেছি। আঙ্কেল আন্টির সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে।
আজমী: কিইইহ? আপনারা তলে তলে আমার বিরুদ্ধে এতো বড় ষড়যন্ত্র করছেন। আমাকে বিয়ে দেওয়ার? আপনারা আমাকে অ্যারেন্জ ম্যারেজ দিবেন,,হ্যা? আপনাদের সবার এতো বড় সাহস। শোনেন আমরা তিন বান্ধবী ছোট থেকে একজন কোনকিছু করলে সবাই সেইটাই করছি। আমার দুই দুইটা বান্ধবীরে জামাই তুলে নিয়ে বিয়ে করছে। সো আমারও তুলে নিয়ে বিয়ে করা জামাই লাগবে। এন্ড ইট’স আর্জেন্ট। প্রয়োজনে আমি নিজে কিডন্যাপ হয়ে কিডন্যাপারকে বিয়ে করব।
আকাশ ও সারার রুমের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ বিরক্ত করে অবশেষে অদ্বিতী বলল, গাইস এইবার ওদেরকে একটু ছাড়ান দেও। বহুত জ্বালাইছিস। বেচারিরা বারো বছরের বাসর একরাতে করবে। আজ তো পূর্নিমা। সবাই ছাদে চলো। খুব ভালো লাগবে।
সবাই মিলে হৈ হৈ করে ছাদে উঠে গেল। সায়ান বলল, গাইস অনেক রাত তো। আজ থাক। পরে যাব নি।
আমান: কেউ একটা বাঁশ দাও তো। ইচ্ছামত ঐটার মাথায় কয়েকটা বারি দিয়ে নেই। তখন থেকে সবকিছুই না করছে। হয়েছে কি ভাই আপনার? আপনার প্রবলেম টা কি?
সায়ান: আমার প্রবলেম টা কি তুমি এখন বুঝবা না ভাই। নিজের বৌ যখন প্রেগনেন্ট হবে তখন বুঝবা। এই মাঝরাতে প্রেগনেন্ট বৌ নিয়ে আমি খোলা জায়গায় বসব? তার মধ্যে ফারিহা এখানে এসেই ভীষণ অনিয়ম শুরু করছে। এইজন্য ওকে আনতে চাই নাই।
ফারিহা: হ্যা হ্যা আমাকে তো আনতে চাইবাই না। বিয়েবাড়ি ভর্তি কত সুন্দর সুন্দর ডানাকাটা পরী; আমি আছি বলে ওদের কারো ফোন নাম্বার নিতে পারলা না। অনেক আফসোস হচ্ছে; তাই না? আপনারা জানেন এই লোকটা একটা নাম্বার ওয়ান লুচু। সারাকে কলেজে দিতে এসে সহজে নড়ত না। চোখগুলো বড় বড় করে মেয়ে দেখত। মনে হতো একেবারে চোখ দিয়েই সবগুলো মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এই পরিমাণ খারাপ লুচ্চা প্রকৃতির লোক। আবার জানেন আননোন নাম্বার থেকে যদি কোন মেয়ের কল আসত সারারাত ঐ মেয়ের সঙ্গে আলাপ করত।
সায়ান: ওকে ওকে,,,আমি তো লুচু। সব মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বাট আমি যে সব মেয়ের দিকে তাকাই এইটা তুমি জানলে কিভাবে? দ্যাট মিনস তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে। তারপর আমি রাত জেগে মেয়েদের সঙ্গে আননোন নাম্বারে গল্প করি তুমি জানতে কিভাবে? তারমানে ঐ মেয়েগুলো বাই চান্স তুমি না তো? সবাই শোনেন আমার বৌ প্রতি রাতে কন্ঠ নকল করে আননোন নাম্বার থেকে ফোন দেয়। আমার সঙ্গে সারারাত গল্প করতে চাও বললেই পারো জান। আমি তোমার এইটুকু কথা রাখতাম না, বলো?
সায়ানের কথায় সবার মধ্যে হাসাহাসির রোল পড়ে যায়। আজমী ফারিহার কানে কানে মুখ এনে বলে, কি রে সায়ানভাইয়ের ক্যারেক্টার প্রুফ করতে চেয়েছিলি না,,দেখলি একেবারে 24 ক্যারেট গোল্ডের পিওর লাভার। ফোন কানে ধরেই বৌয়ের কন্ঠ বুঝে যায়। দুইটাই তোরা খুব লাকি রে। সায়ানভাই যে ভালবাসে তোকে; আর আকাশভাইয়ের কথা না’ই বললাম। আমার যে কবে একটা জুটবে!
ফারিহা: পিওর লাভার না ঘোড়ার আন্ডা।
জোৎস্নাভরা খোলা আকাশের নিচে চাদর বিছিয়ে সবাই বসে গেল। আজকে সারারাত শুধু গল্প আড্ডা আর মজার মজার খেলা চলবে। সবচেয়ে বেশি উৎসাহ আজমীর।
“এইখানে সবাই কাপল। শুধু আমিই এক ব্যক্তি যে সিংগেল। সুতরাং তোমাদের সকলেরই বেডরুমে ঢুকে দরজা আটকানোর শখ জাগলেও আজকে রাতের জন্য তোমরা সবাই কিডন্যাপ। কেউ বৌ/জামাই নিয়ে বেডরুমে যেতে পারবে না যতক্ষণ না আমি বলব। এটাই আমাকে সিংগেল রেখে সবার ডাবল হওয়ার জন্য প্রতিশোধ। হুহু।”
দূরের থেকে ছেলেমেয়েদের হৈ-চৈ আনন্দ-উল্লাস দেখে মনিরা খান ধীরে ধীরে সরে এলেন। নিজের ঘরের দরজা আটকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরনের সাদা শাড়িটার দিকে তাকালেন।
তারপর দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ফ্রেমে বাঁধানো ফটোটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আপনাতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে গেল। “তোমার মৃত্যুর পাঁচ বছরে আমি একবারো তোমার কথা ভাবি নি। এমনকি এক বিন্দু চোখের পানিও ফেলি নি তোমার জন্য। ঘিন্না হতো তোমাকে। মানুষ বলে মৃত মানুষের প্রতি রাগ রাখতে নেই। কিন্তু তুমি মরে যাওয়ার পরেও আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি নি। মোনাজাতে কখনো দোয়াও করি না তোমার জন্য। যেদিন জেলখানা থেকে খবর আসল শাস্তির অর্ডার শুনে তুমি হার্ট অ্যাটাক করেছ আমি তোমার লাশটাও দেখি নি। কারন আমি একজন মা। একজন মা তার সন্তানের জীবন নষ্টকারীকে কখনো মাফ করতে পারে না। তোমার কথা ভাবলেই আমার চোখে আকাশের মুখ ভেসে উঠত। আকাশের সাতটা বছর ধরে পাওয়া যন্ত্রণাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠত। তোমাদের পাপের শাস্তি আমার ছেলে পাচ্ছে। সারাকে হারিয়ে ফেলেছে,,, সব কিছুর জন্য তুমি দায়ী ছিলে। তুমি। তাই ঘিন্না ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারি নি তোমায়। জানো আজকে সব ঠিক হয়ে গেছে। সারা আমার সংসারে এসেছে। ক্ষমা করে দিয়েছে আমার আকাশকে। আমাদের একটা নাতি হয়েছে,, একদম আকাশের মতো দেখতে। আমাদের আরো একটা নাতি-নাতনী হবে,,এখনো হয় নি। আর কয়েক মাস পরে আসবে। জানো অদ্বিতীরো খুব ভালো বিয়ে হয়েছে। অবশেষে ঐ খারাপ স্মৃতির থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। কি এমন ক্ষতি হতো ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনী এই ভরা সংসারে দুইজনে একসাথে সবার ভালো থাকাটা দেখতে পারতাম। একসাথে সবাইকে আশীর্বাদ করতাম। এই বুড়ো কালে সবার মাঝেও কেন জানি না মনে হচ্ছে আমার কেউ নেই। আমি খুব একা। মৃত্যুর পর এই প্রথম তোমার শূন্যতা অনুভব করছি। আমাদের একসাথে বুড়ো হওয়া হলো না; নাতি-নাতনীদের নিয়ে দুইজনের একসাথে খেলব কথা ছিল; কিন্তু তুমি কথা রাখলে না। আমার নাতি তার দাদুর কাছে জানতে পারল না তার দাদু তার দাদিকে কতটা ভালবাসত। ইচ্ছা ছিল বুড়ি হয়ে তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নাতিদের সঙ্গে সময় কাটাবো। তোমাকে আর কিছুই দেখানো হলো না। যেদিন আমার সময় শেষ হয়ে যাবে আমাকে নিতে এসো। পয়ত্রিশ বছর আগে যেমন এসেছিলে আমাদের বাড়ি আমাকে নিতে; সেইদিন আবার এসো। আমি আবার তোমার হাত ধরব। মৃত্যুর পরজগতে নতুন সংসার হবে আমাদের। সেইখান থেকে আমরা একসাথে আমাদের ভরা সংসারটা দেখব। সারাক্ষণ ঝগড়া করব। কথা রাখবে তো তুমি?
—————————————————————–
সারা লজ্জায় জড়োসড়ো খাটের মধ্যিখানে গোলাপের পাপড়ির তৈরী হার্টশেপে বসে আছে। ঘোমটাটা ঠোঁট পর্যন্ত টেনে দেওয়া। ঘোমটার নিচে অনবরত কাঁপছে মেয়েটা। মানুষটা তো অপরিচিত নয়। বরং নিঃশ্বাসের চেয়েও বড় অভ্যাস হয়ে গেছে এই লোকটা। তার কাছে তো লজ্জা ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। তাও পারছে না সারা। অদ্ভুত একটা ভয় অজানা লজ্জা তাকে ঘিরে রেখে দিয়েছে।
লজ্জারত বৌয়ের দিকে দেখে মুচকি হাসল। সারার হার্টশেপের মাঝে বসে থাকাটা দেখে খুব ভালো লাগছে তার। এই মেয়েটা তো এমনি করেই তার হার্টের মাঝখানে গুটিগুটি হয়ে বসে আছে। মেয়েটা বসে আছে বলেই এই হার্টে রক্তসঞ্চালন চলছে। এই মেয়ে কখনো উঠে গেলে হৃৎপিন্ড সেই মুহুর্তেই তার কাজ বন্ধ করে দেবে। না না, উঠে যাবে কেন? উঠতে চাইলেই উঠতে দেবে নাকি? এই মেয়েটা তার। এই মেয়ের সবকিছু তার। এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তার বৌ। তার সন্তানের মা।
সারা: একটা কথা বলি? মা বলেছেন বাসর রাতে স্বামীকে সালাম করতে হয়। আমি একটু সালাম করতে চাই তোমাকে। বেশি ঝুকব না। একটু মাথা নিচু করেই পায়ে হাত রাখব শুধু। করব?
কোনরকম কথাটা বলেই সারা ভয়ে ভয়ে আকাশের মুখের দিকে তাকালো। রাগে থমথম করছে। চোখমুখ একদম লাল। সারা কোনমতে ঢোক চিপে বলল, থথাক সসালাম করতে চাই না। থাক
আকাশ: সালাম করবি?
সারা: হ্যা। না না। করব না। করব না।
আকাশ আর কোন কথা না বলে ড্রেসিং এর সামনে থেকে টুলটা নিয়ে বিছানায় রাখল। তারপর খুব আস্তে যেন খাটে একটুও না নড়ে এমনভাবে টুলের ওপর উঠে দাঁড়াল।
সারা: এই এই কি করছো তুমি? পড়ে যাবে তো। এমনিতেই যে তালগাছ। তারোপর টুল নিয়ে খাটের ওপর উঠেছে। ফ্যান মাথায় লাগবে। নামো তুমি,, এক্ষুনি নামো।
আকাশ: তুই-ই বললি সালাম করবি। তো কর্।
সারা বুঝতে পারল যাতে তাকে নিচু হয়ে ঝুকতে না হয় পেটে চাপ না পড়ে তাই আকাশ এই কান্ড ঘটাল। সারা আকাশকে পায়ে হাত রেখে সালাম করে নেয়।
আকাশ: এইবার কি ঘোমটাটা তুলতে পারি বৌয়ের?
আকাশ ঘোমটায় হাত দিয়ে মুখটা খুলতেই আচমকা সারা আকাশের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।দুইহাতে শক্তভাবে আকড়ে ধরে আকাশকে। আকাশ খুব অস্থির হয়ে পড়ে কারণ সারা কাঁদছে। খুব জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না শুরু করেছে। এরকম বুক ভাঙা কান্না যে কাউকে কাঁদতে বাধ্য। কান্নার কারণে বারবার কেঁপে উঠে আকাশকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে। সারা কেঁদেই চলেছে। কোনভাবেই থামছে না। আকাশ নানাভাবে ভুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।
আকাশ সারার মাথা বুকের সঙ্গে শক্তভাবে চেপে ধরে। কপালে আলতোভাবে চুমু খায়। ধীর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, খারাপ স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে, তাই না?
সারা কোন উত্তর করে না। আকাশের বুকে লেপ্টে থেকে শুধু মাথা নাড়ায়। আকাশ ওকে আরো জড়িয়ে নেয় নিজের মধ্যে।
কত কষ্ট, কত যন্ত্রণা, কত অপেক্ষার পর সারা অবশেষে এই সুখের দিন দেখেছে। সারার আজকে বারবার সেই পুরানো স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে। আকাশের তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া, মেধার সঙ্গে রিলেশন, সাত বছর পর দুজনের দেখা, ভুল বোঝাবুঝি, অবশেষে বিয়ে, সেই বিয়েতেও একফোঁটা সুখ নেই, এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, রাস্তায় রাস্তায় লান্হঞনার শিকার হয়া, এমনকি নিজের পরিবারের কি নিষ্ঠুর ব্যবহার। সব মনে পড়ে যায়। ঐ কথাগুলো ভাবলে আজকের দিনটাকে বাস্তব মনে হয় না। মনে হয় এটা একটা স্বপ্ন। একটু পরেই তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে। সবটা মিথ্যা হয়ে যাবে।
কিন্তু কিছুই আর মিথ্যা হলোনা। আকাশ নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ।করে ফেলল ওকে। খুব দৃঢ়ভাবে। যেন আর কোনদিন না হারিয়ে ফেলে।
“কি ভয় পাচ্ছ খুব? ভয় পেয়ো না। আমাদের জীবনে কোন বাধা আর আসতে পারবে না। বাধারা এখন ভয় পায় আমাদের। কারন দিনশেষে ওরা হেরে গেছে, আমরা জিতে গেছি। কারনটা কি জানো? আমাদের ভালবাসা শুদ্ধতম ভালবাসা, পবিত্র; ভীষণ পবিত্র বন্ধন আমাদের। আমাদের ভালবাসা কেন শুদ্ধ জানতে চাও? কারণ ভুল বোঝাবোঝি ছিল, রাগ, অভিমান এমনকি ঘৃনাও ছিল কিন্তু আমাদের কারো জীবনে দ্বিতীয়জন ছিল না। আমরা হয়তো অনেক সময় বিশ্বাস রাখি নি কিন্তু একে অপরের জায়গায় অন্য কাউকেও ভাবতে পারি নি। হাজার দূরত্বের মাঝেও দিনশেষে আমরা বলতেই পারি “তোমারই আছি আমি”। এই তোমার হয়ে থাকাটাই সবচেয়ে দরকার। শুদ্ধতম ভালবাসার সবচেয়ে বড় পরিচায়ক।
সারার চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে যায়। আকাশ তা মোছায় না। বরং গভীর চুম্বনে আবিষ্ট করে স্ত্রীকে। সেই গভীর চুম্বন অনুভব করামাত্র সারার মনে হয় একজীবনে সেসব পেয়েছে। সবকিছু। তার আর কিছু চাওয়ার নেই। পাওয়ারো নেই।
——- —————-সমাপ্ত————————-
( “