তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৬
________________
কিরণের সাহায্যে সরাসরি রুদ্রর মেসে গিয়ে হাজির মুকুল আকন আর শাহানাজ বেগম। এভাবে আচমকা মুকুল আকন আর শাহানাজ বেগম’কে দেখে বেশ চমকালো রুদ্র।ছেলে’কে এতদিন বাদে দেখে শাহানাজ বেগমের চোখ ভিজে ওঠতে লাগলো। রুদ্র কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষণ এভাবে নিঃশব্দে’ই কেটে গেল। এক পর্যায়ে নীরবতা বিলীন করে মুকুল আকন বেশ শান্ত গলায় বলল, “সমস্যা কী তোমার রুদ্র? ফোনে যোগাযোগ করো না, বাসায় যাচ্ছো না।কী সমস্যা এখন বল আমায়?”
স্বভাবগত ভাবেই মুকুল আকন ভয়ঙ্কর মেজাজের মানুষ। একটুতেই রেগে যাওয়ার মত খারাপ স্বভাব’টা তাঁর একটু বেশিই। কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা গেল ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকলেও গলা শীতল রাখার চেষ্টা করছে। রুদ্র উত্তর দিলো, “এমনি যাচ্ছি না।ভালো লাগছে না তাই যাচ্ছি না।”
মুকুল আকন রাগান্বিত চোখে তাকালো। চোখে-মুখে স্পষ্ট রাগে চিহ্ন ফুটে ওঠেছে।গর্জে ওঠে লম্বা স্বরে বলল, “রুদ্র।”
রুদ্র কোনো জবাব দিলো না।শাহানাজ বেগম বলল, “ওঁদের ডিভোর্সের কারণ হলো ওঁদের সাথে বনাবনি হচ্ছিলো না। সেখানে আমার কী দোষ?”
– “ভাইয়া আমায় সব বলেছে মা।এসব নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। এসবের পিছনে অধিকাংশ দোষ তোমার এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে?আর অস্বীকার করেও বা লাভ কী?”
শাহানাজ বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুই আমার দোষ দিচ্ছিস?”
ডান হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছছে শাহানাজ বেগম। মুকুল আকন আরো ক্ষীপ্ত হয়ে গেল।ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল, “এত লেখাপড়া করিয়ে লাভ কী হয়েছে?এই ভদ্রতা শিখেছো তুমি?আমার আর তোমার মায়ের মুখের ওপর কথা বলছো?”
রুদ্র কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে বলল, “আচ্ছা দুঃখিত আমি। তোমাদের যদি মনে হয় তোমরা সঠিক কিংবা তোমরা সঠিক কাজ করেছো তাহলে তোমরাই সঠিক।”
রুদ্র আর কথা বাড়ালো না।বাবা-মা নামক মানুষ গুলো’কে মাঝে মাঝে তীব্র অসহ্য লাগে।রুদ্ররও এখন অসহ্য লাগছে। তাঁরা সবসময় ভাবে তাঁরা ই সঠিক।
– “নিম্মির ফুফাতো ভাই তানভীর’কে হুমকি দেয়। ওঁরা কত’টা থার্ড ক্লাস ভাবতে পারিস?”
রুদ্র চমকে গিয়ে তাকায় শাহানাজ বেগমের দিকে। কপালে ভাঁজ পড়ে। অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কই ভাইয়া তো আমায় কিছু বলল না?কোন ফুফাতো ভাই?”
পরক্ষণে রুদ্র সন্ধিগ্ধ গলায় বলল, “সূর্য?”
শাহানাজ বেগম হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো। রুদ্রর মেজাজ চড়ে গেল। সূর্য ভাবে কি নিজেকে?
রুদ্রর বড় খালা ঢাকায় থাকে। মুকুল আকন আর শাহানাজ বেগম সে বাসায় ওঠলো। তারা চলে যাওয়ার পর পরই রুদ্রর ফোনে কল আসলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আবেগী রাণী লেখা।ফোন ধরতেই উতলা হয়ে ওপাশ থেকে বলল, “আপনায় দেখতে ইচ্ছে করছে। তাড়াতাড়ি আসবেন। পাঁচ মিনিটে আসবেন।”
– “কোথায় আসবো?এত তাড়াহুড়ো করছো কেন?কী ব্যাপার বলো তো?”
– “আপনাকে দেখার তৃষ্ণা পেয়েছে তাড়াহুড়ো করবো না?”
রুদ্র হাসলো।অরূণীর পাগলামি’তে বিমোহিত হয়ে মাঝে মাঝেই নিঃশব্দে হাসে।এমন আহ্বান উপেক্ষা করার মন্ত্র কী? পাঁচ মিনিটে যেতে পারলো না,চল্লিশ মিনিট লেগেছে যেতে। রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে সময়’টা একটু বেশিই লেগেছে।
– “অদ্ভুত রমণীর হঠাৎ আমায় এত দেখতে ইচ্ছে হলো কেন? কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি’তে ভর্তি হয়ে গেলে। পাগলামি গুলো আর গেল না।”
– “আপনি কি চান আমার পাগলামি গুলো চলে যাক?”
– “উঁহু না।কখনোই না।”
কিছুক্ষণ পর রুদ্র জিজ্ঞেস করলো, “আব্বা-আম্মা ঢাকায় এসেছে। সূর্য না-কি তানভীর ভাই’কে হুমকি দিয়েছে।তোমার ভাই একটু বেশি করছে না অরূণী?ডিভোর্স তো দুইজনের মতেই হয়েছে।”
অরূণী কোনো উত্তর দিলো না। রুদ্র ফের বলল, “যাক বাদ দিই ওসব কথা।তোমার ভাইকে আমি গালি দিই নি।মন খারাপ করার কিছু নেই।”
_____________
দুপুরের দিকে শাহানাজ বেগম ফোন দিলো রুদ্র’কে ওঁর খালার বাসায় যাওয়ার জন্য।লাঞ্চ করতে বলল সেখানে। দুপুরে সেখানে খাওয়া-দাওয়া করলো রুদ্র।শাহানাজ বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “আমাদের সাথে বাসায় যাবি তুই। কতদিন বাসায় যাস না।”
মুকুল আকন অভিমান নিয়ে বলল, “যেতে হবে না ওঁর বাসায়।”
বাবা-মায়ের এই তীব্র অভিমান দেখে রুদ্রর রাগ উবে গেল।বলল, “আচ্ছা যাবো,আমার এক্সাম শেষ হলেই যাবো।”
শাহানাজ বেগম সপ্তাহ খানেক থাকলো তাঁর বোনের বাসায়। রাজশাহী যাওয়ার কয়দিন পরই মুকুল আকন অসুস্থ হয়ে পড়লো। বেশ কয়েক বছর ধরেই হার্টে সমস্যায় ভুগছেন তিনি। মুকুল আকনের অসুস্থতার খবর পেয়ে পরীক্ষার চিন্তা-ভাবনার কথা ছেড়ে অগত্যা বাস ধরলো রুদ্র।বাসে বসে অরূণী’কে ফোন করে জানালো।মিনিট দুয়েক ফোনে কথা বলে রুদ্র ফোন কেটে দিলো। অরূণী বুঝতে পারলো রুদ্রর মন খারাপ। পুনরায় ফোন দিতে গিয়েও দিলো না অরূণী। অরূণী বিষণ্ণ মনে বসে রইলো। চোখে পানি চিকচিক করছে। মুকুল আকন সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রুদ্র হয়ত ঢাকায় ফিরবে না। রুদ্রর সাথে কতদিন কথা হবে না,দেখা হবে না এসব ভাবতে ভাবতে অরূণীর গাল বেয়ে নোনাজল গড়িতে পড়তে লাগলো।অরূণী চোখ মুছে, নিজেকে প্রবোধ দেয় সবকিছু নিয়ে এভাবে হেবলার মত কান্না করা উচিত নয়। কিন্তু অরূণীর অপ্রোবধনীয় মন এসব শুনে না।
রাজশাহী যাওয়ার পর রুদ্রর ব্যবস্থা বাড়লো। মুকুল আকন’কে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। সারাক্ষণ ব্যস্ততার ওপরে থাকতে হয় রুদ্র’কে।মাঝে মাঝে সুযোগ হলে ফোন দেয় অরূণীর কাছে।বেশি সময় কথা হয় না। বড়জোর মিনিট পাঁচেক।
_____________
দুইদিন পর অরূণীর জন্মদিন। রুদ্র রাজশাহী থেকে এখনো ফিরে নি। রুদ্র কখনো জানতে চায় নি অরূণীর জন্ম তারিখ। রুদ্র’কে কী এখন ফোন করে বলা উচিত, “দুইদিন পর আমার জন্মদিন আপনি উইস করেন।” কি লজ্জাজনক কথা! নিজের জন্মদিনের কথা নিজে বলবে?অভিমানে অরূণীর মন পূর্ণ হয়ে গেল। রুদ্র রাজশাহী যাওয়ার পর থেকে অরূণীর মনের দুরাবস্থা।পরন্ত বিকালের অবসরে এসব কারণে অরূণীর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল বিসর্জিত হয় প্রায়শ। বুকের ভিতর’টা ভারী হয়ে যায়। সারাক্ষণ একটা কষ্ট অরূণীর মন জুড়ে বিচারণ করে। মাঝে মাঝে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে অরূণী।
মুকুল আকন মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে। রুদ্র অরূণী’কে না জানিয়ে ঢাকায় চলে আসে। কিরণ’কে আগে থেকেই বলে দিয়েছে, “আমি যে ঢাকায় আসছি,এটা যেন অরূণী কিছুতেই না জানে।”
ঢাকায় পৌঁছে ই রুদ্র প্রথম কিরণের সাথে দেখা করলো।এত তাড়াহুড়ো করে ঢাকায় ফেরার কারণ জিজ্ঞেস করলো কিরণ।রুদ্র উত্তর দিলো, “আব্বা এখন মোটামুটি সুস্থ।আর অরূণীর জন্মদিন কাল। গিয়ে দেখ এই কয়দিনে কান্নাকাটি করে কি অবস্থা করেছে। ও’কে একটা সারপ্রাইজ দিতে তাড়াতাড়ি ফিরলাম।তোর সাহায্য লাগবে।
– “কি সাহায্য করতে পারি তোদের?”
– “তুই অরূণী’কে দেখা করার কথা বলে আনবি।”
কিরণ উৎসুক হয়ে বলল, “অরূণী’কে বলবো যে তুই আবার লাবণ্যের সাথে রিলেশন কনটিনিউ করেছিস।এসব ব্যাপারে আরো তথ্য পেতে আমার সাথে যোগাযোগ করো।”
– “ধুর শালা!অরূণী হার্ট ফেল করবে।এসব কুবুদ্ধি তোর মাথায় আসে কোত্থেকে?”
– “কু-বুদ্ধি না।এটা বলে ও’কে দেখা করতে আসতে বলব।ও যদি এসে এসব দেখে তাহলে বেশি সারপ্রাইজড হবে।”
রুদ্র হাসতে হাসতে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না।ও অনেক বেশি আবেগী।এসব শোনার সাথে সাথে যদি কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে? এমনিতেই অনেক দিন ধরে ও’কে সময় দিতে পারছি না।”
কিরণ রুদ্রর কথা মত কাজ করলো। অরূণী’কে বিকালের দিকে দেখা করতে আসতে বলল। হঠাৎ কেন কিরণ দেখা করতে বলল?এই চিন্তাটা অরূণী’কে জেঁকে ধরেছে।অন্যদিকে রুদ্রর ওপর পাহাড়সম অভিমান। রুদ্র কিরণ’কে বলল, “কিরণ একটা অদ্ভুত কথা শুনবি?”
কিরণ আগ্রহী গলায় বলল, “কী?”
– “আমি অরূণী’কে কখনো বলি নি যে আমি ও’কে ভালোবাসি। ভালোবাসা বলা ছাড়াই আমাদের প্রেমটা হয়ে গেছে।”
অরূণী কিরণের কথা মত বিকালের দিকে আসলো।মুখ’টা ফ্যাকাশে। চেহারায় উসখুস ভাব। মনমরা,বেহাল দশা!
অরূণী অদ্ভুত দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।কোথায় কিরণ? চারদিকে বেলুন দিয়ে সাজানো।ছোট একটা টেবিলের ওপর কেক রাখা। কি হচ্ছে এসব?অরূণী প্রথমে আতঙ্কিত হয়ে গেলেও খানিকক্ষণ পর প্রচণ্ড উৎসুক ভাবে চারদিকে তাকাচ্ছে। রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে আড়ালে।অরূণী স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেলুনের ওপর প্রিন্ট করে বড় বড় অক্ষরে লেখা শুভ জন্মদিন আবেগী রাণী।অরূণীর চোখ আপনাআপনি বড় হয়ে গেল।কী হচ্ছে এসব?এই বাক্য’টা অরূণীর মনের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। হঠাৎ অরূণীর কানে ভেসে আসলো শুভ জন্মদিন।অরূণী চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে,মুখে এক ঝলক স্বপ্ন।অরূণীর বিশ্বাস হচ্ছে না এসব।শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। রুদ্র কয়েক পা এগিয়ে পিছন থেকে অরূণী’কে জড়িয়ে ধরলো।অরূণীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ভালোবাসি তোমায়।”
অরূণীর চোখ দুটো আবেশে বুঁজে গেল।কয়েক হাজার বছর আরাধনা করেছে যেন এটা শোনার জন্য।অরূণীর শরীর টলমল করছে।অতি আশ্চর্য আর বিস্ময়ে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে। অবশেষে অরূণীর সমস্ত আবেগ নয়ননীর রূপে আত্মপ্রকাশ করছে।কান্নার বেগ ক্রমশ বাড়ছে।
– “এত কাঁদার কি হলো বলো তো?এত অবাক কেউ হয়?কান্না থামাও।”
অরূণী ঘুরে দাঁড়িয়ে রুদ্র’কে জড়িয়ে ধরলো। খুব শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো।অরূণীর কান্না থামতে মিনিট বিশেক লাগলো। রুদ্র কান্না থামানোর চেষ্টা করলো না।কাঁদুক!কখনো কখনো প্রিয়জন’কে কাঁদতে দেখলেও প্রশান্তি লাগে। রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “খুশি হয়েছো?”
অতি আবেগে অরূণীর গলা ধরে আসছে,গলার স্বর চিকন যাচ্ছে।বলল, “কেউ যদি পুরো পৃথিবীটা আমার হাতের মুঠোয় এনে দিতো তাহলেও আমি এত খুশি হতাম না।”
অরূণীর বাসায় যেতে যেতে সন্ধ্যা হলো। ভালোলাগার রেশ কাটছে না। এই রেশ কাটতে মাস খানেক লাগবে বোধ হয়। অপূর্ব পুলকে অরূণীর পুরো শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছে।এই খুশি ব্যাখ্যা করতে গেলে সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম উপন্যাস হয়ে যাবে। রুদ্রর দেওয়া উপহার গুলো দ্রুত ড্রয়ারে রেখে দিলো অরূণী।ছোট একটা চিরকুটও দিয়েছে রুদ্র।অরূণী সেটা টেবিলের ওপর রেখে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই অরূণী দেখে সূর্য রুদ্রের দেওয়া চিরকুট টার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
(চলবে)