#তোলপাড়💓
#সিজন২
#পর্বঃ২৯
#শান্তনা_আক্তার(Writer)
দুটো বিয়ে একসাথে হচ্ছে বলে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বিয়ে হবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভোর বেলা। পশ্চিম আকাশ চিরে সূর্য উদয়ের সময়। ইতোমধ্যে বাড়ির অনেকেই জাগ্রত। কেউবা ঘুমাচ্ছে এখনো৷ রিমি ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে গেলেও তিয়াসা জেগে আছে। কিছুক্ষণ ফোনে গেম খেলে সে খুব বোর হয়ে গিয়েছে। তাই ফোন রেখে জানালার দিকে তাকালো। তাকাতেই তার মন কাড়লো বাগানের ফুলগাছগুলো। তিয়াসা আর এক মুহুর্ত দেড়ি না করে পা বাড়ালো বাগানের দিকে।
জবা,গোলাপ,নয়নতারা,শিউলি আরও হরেক রকম ফুলে পরিপূর্ণ বাগান। তিয়াসা বাগানে ঢোকা মাত্র দুইজন মহিলা সেখান থেকে বের হলো। তাদের হাতে পানির পাইপ। সেটা দেখে তিয়াসা বুঝতে পারলো মহিলা গুলো ফুল গাছে পানি দিতে এসেছে। মহিলা দুজন তিয়াসাকে দেখে হাসি দিয়ে চলে গেল। তিয়াসাও হালকা হাসি দিল। কখনো কখনো হাসির মাধ্যমেও মনের ভাব প্রকাশিত হয়ে যায়। মহিলা গুলো চলে গেলে তিয়াসা বাগানের আরও কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল। ফুলগুলো হাত দিয়ে ছুঁলো। ফুলের সাথে সেলফি তুলল। তিয়াসা ফোনে তোলা সেলফিগুলো দেখছিল এমন সময় পেছন থেকে জিসান বলে উঠে,
‘আমাকে হার্ট করে তুমি কত খুশি! আমি সত্যিই আশাহত।’
তিয়াসা পেছনে ঘুরতেই ওর চোখ কপালে উঠে গেল। তিয়াসা তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে চলে আসতে নিলে জিসান গিয়ে পথ আটকালো। তখন তিয়াসা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
‘কি চাই? আপনি কি ভালো হবেন না?’
জিসান খুব শান্ত গলায় উত্তর দিল,
‘ভালো থাকতে চাইতো। কিন্তু তুমি তো থাকতে দাওনা।’
‘কি বলতে চান আপনি?’
‘কি বলতে চাই জানো না? আমি তোমাকে চাই। সেটা কেন বুঝতে পারছো না?’
‘দেখুন, আজ আপনার বিয়ে। এসব কথা বলবেন না। আমি চাইনা বিয়ে বাড়িতে কোনো প্রকার ঝামেলা হোক। এতে আমার আপুর সমস্যা হতে পারে। আর আমি তা কখনোই চাইনা।’
‘ঝামেলা করতে আমারও ভালো লাগে না। তুমি শুধু সবাইকে বলো তুমি আমাকে ভালবাসো। তাহলে আমি ঝামেলা করবো না।’
জিসানের কথায় তিয়াসা এতটাই অবাক হলো যে সে কি বলবে না বলবে ভাষাই যেন হারিয়ে ফেলেছে। তিয়াসার চেহারায় রাগের আবির্ভাব স্পষ্ট। সে বলল,
‘মাথা ঠিক আছে আপনার? কি বলছেন আপনি এসব!’
‘যা বলছি ঠিক বলছি। গতরাতে শুধু এই কারণেই আমি তোমার কথা সকলকে বলতে পারিনি। শুধুমাত্র তুমি দায়ী এতকিছুর জন্য। তুমি যদি আমার প্রপোজালে রাজী থাকতে, তাহলে আহসান ভাইয়ার মতো আমিও সকলকে বলতে পারতাম তোমার আর আমার বিয়ের ব্যাপারে।’
‘আমি সত্যি হতবাক আপনার কোথায়! আমি দায়ী নাকি আপনি নিজে দায়ী? একটু ভাবুন প্লিজ।’
‘আমি কিছুই ভাবতে চাইনা তিয়াসা। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। এটা ব্যতীত আর কিছুই ভাবতে চাইনা।’
‘আপনি আমাকে কতদিন চেনেন যে অনেক ভালবেসে ফেললেন?’
‘গুনে গুনে কয়েকটি দিন হবে। কিন্তু তবুও আমি বলবো আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি তিয়াসা। অল্প কদিনেই সেই ভালবাসা বিশাল আকার ধারণ করে নিয়েছে৷ শুধু তুমি বুঝলে হয়।’
‘আপনি আমাকে ভালবাসলেও, আমি আপনাকে এক বালি সমানও ভালবাসি না। ইভেন, সহ্য করতেও পারি না। এর কারণ আপনি।’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ আপনি। আমি এসব রিলেশন টিলেশন একদমই লাইক করি না। আমি এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত নই। তাই আপনি আমাকে অফার দেওয়াতে আমি খুবই লজ্জিত। প্লিজ আর লজ্জায় ফেলবেন না আমায়।’
‘ঠিক আছে মেনে নিলাম। কিন্তু তবুও সবাইকে বলে রাখো যে তুমি আমাকে পছন্দ করো। আমি যখন সবাইকে তোমার কথা বলবো, তখন শুধু সম্মতি জানিয়ো। এতেই হবে। তারপর সব ব্যবস্থা আমি করবো। আমি সকলের থেকে সময় চাইবো। তারপর তুমি যখন বলবে আমরা বিয়ে করবো। তার আগে না। তাহলেই তো তুমি রাজী।’
‘না। আমি রাজী নই। আমি বললাম তো আমি আপনাকে পছন্দ করি না। এরপরও নির্লজ্জের মতো এক কথা বারবার কেন বলেন আপনি?’
‘আমিতো নির্লজ্জই। কিন্তু কেন সেই কারণটা কেন খুঁজছো না তুমি?’
‘আমি খুঁজতে চাইনা। সরুন আমার পথ থেকে।’
‘না সরবো না। তুমি যতক্ষণ না আমার কথায় রাজী হচ্ছো, আমি তোমাকে যেতে দেব না।’
‘আশ্চর্য! এখন কি জোর করবেন নাকি?’
‘দরকার পড়লে তাই করবো।’
‘আপনার আজ বিয়ে ভুলে যাবেন না।’
‘কিসের বিয়ে? আমি তো মানি না এই বিয়ে। আমি তো শুধু তোমাকে চাই। তোমার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না আমার বিয়ে জান্নাতের সাথে হয়ে যাবে বলে?’
তিয়াসার শরীর রাগে ঘৃণায় কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। তিয়াসা গরম নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘প্রথমত আমি আপনাকে চাই না। দ্বিতীয়ত, আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং আপনার বিয়ে হবে শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। আফটার অল আপনার ফালতু কথার থেকে তো বাঁচতে পারবো।’
‘তুমি এইভাবে বলতে পারলে তিয়াসা?’
‘আরে ধুর! বিরক্ত করবেন নাতো। খুব ইরিটেট হচ্ছি আমি। আর ভালো লাগছে না আমার।’
বলে পাশ কেটে চলে আসতে নিচ্ছিলো তিয়াসা। কিন্তু জিসান তিয়াসার দুই বাহু ধরে ফেলল। তারপর ঝাকি দিয়ে বলল,
‘তুই এত অবুঝ কেন হুম? আমার কথা কানে যাচ্ছে না? নাকি মাথায় ঢুকছে না? বল তোর সমস্যা কি? এত অহংকার কিসের তোর?’
তিয়াসা ভয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল। তারপর কান্নাজড়িত কন্ঠেই বলল,
‘অসভ্য মায়ের সন্তান। এরকম আচরণ শুধু রাস্তার ছেলেরাই করতে পারে৷ ঠিক আপনারই মতোই।’
তিয়াসার কথাগুলো জিসানের বুকে গিয়ে বারি খেল। জিসানের কাছে মনে হলো ওর হৃদয় ছিদ্র হয়ে গিয়েছে যেন। চট করে তিয়াসার বাহুদ্বয় ছেড়ে দিল জিসান। ছাড়া পেয়ে এক দৌঁড়ে পালিয়ে গেল তিয়াসা। জিসান ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। চোখের কোণে পানি জমা হলো তার। সে অস্ফুটে বলল,
‘আমি অসভ্য মায়ের সন্তান? আমার জন্য তুমি আমার মাকে অসভ্য বললে? এটা তুমি মোটেও ঠিক করোনি তিয়াসা। ভালবাসি বলে একটু পাগলামি কি করলাম, আমার মাকেই অসভ্য বানিয়ে দিলে! আমি মেনে নিতে পারলাম না সেটা। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না।’
___________________________
সূর্য প্রায় মাথায় চড়ে বসেছে। ওইদিকে বিয়ের সব আয়োজন কমপ্লিট। শুধু লোকজন পৌঁছানো বাকী। কমিউনিটি সেন্টার থেকে ফোন এসেছে কয়েকবার। সকলে তৈরি হচ্ছে যাওয়ার জন্য। বর-বউ বাদে সকলে রেডি হয়েই যাবে সেখানে। মুনতাহা সর্বদাই সম্পূর্ণ সাদার সাথে নীল পাড়ের শাড়ি পড়েন। আজও তাই পড়েছেন। মুনতাহা কপাল অবধি আঁচল টেনে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই আহসান প্রবেশ করলো তার রুমে। আহসানকে দেখা মাত্র মুনতাহা বললেন,
‘আহসান তুই? কিছু বলবি?’
‘হুম তুমি যদি চাও তাহলে।’
‘এখন তো দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।’ মুনতাহা বলল।
‘বেশিক্ষণ লাগবে না। হাতে গুনে কয়েক মিনিট লাগবে শুধু।’
‘আচ্ছা বসে বল তাহলে।’
মুনতাহা বিছানায় গিয়ে বসলো। আহসানও বসলো। তারপর কিছু সময় আমতা আমতা করে বলেই ফেলল,
‘জিসানের সাথে কি এটা ঠিক করা হয়েছে দাদিয়া?’
মুনতাহা ভুরু দ্বয় বাঁকিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি তোর কথা৷ কিন্তু এ ছাড়া আর কি করার ছিল বলতো? জান্নাত অবুঝ এখনো। উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলত।’
‘তাই বলে জিসান কি দোষ করেছে? ও নিশ্চয়ই কাউকে পছন্দ করে বলেই জান্নাতকে বিয়ে করবে না বলেছিল।’
‘সেটা যদি বলতো তাহলে আমি কি এত বড় সিদ্ধান্ত নিতাম? জিসান স্পষ্ট বলেছে ও কাউকে পছন্দ করে না। এখানে অন্যায় কি হলো?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমি।’
‘আমি সব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আহসান। আমি জিসানকে সুযোগও দিয়েছি। কিন্তু সে সাফ সাফ বলেছে সে কাউকে পছন্দ করে না। যদি করতো,তাহলে তোর মতো তারও মত অনুযায়ী বিয়ে দিতাম৷ তবে এখানে পরিস্থিতি পুরোই উল্টো। আর জান্নাত খুব বেশিই অবুঝ। আমার কোলেই তো বড় হয়েছে। তোর মায়ের থেকেও আমি তোকে আর জান্নাতকে বেশি চিনি। তোদের ভালো লাগা,খারাপ লাগা টের পাই খুব সহজে। তোদের কিভাবে ভালো হবে,সেটাও খুব বুঝি। তাই আমি বলবো জান্নাত জিসানের সাথেই ভালো থাকবে। মিলিয়ে নিস তুই।’
‘আমার যে চিন্তা হচ্ছে দাদিয়া। আমার একটাই বোন। ও যদি ভালো না থাকে, তাহলে আমিও ভালো থাকবো না। বড় ভাই হয়ে কিভাবে ভালো থাকবো বলো?’
‘তোর এসব কেন মনে হচ্ছে আহসান?’
‘কারণটা স্রুতি। ও কোনভাবেই জান্নাতকে মেনে নিতে পারবে না। যদি জিসান মেনে নিত, তাও একটা আশা ছিল। এমতাবস্থায় আমি আমার বোনকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে চাইনা।’
‘বুঝলাম না। স্রুতি তো জান্নাতকে খুব ভালবাসে। তাহলে জান্নাতকে কেন মেনে নেবে না?’
‘শুনলে না স্রুতি কাল কি বললো সবার সামনে।’
‘ওটা তো জিসান মানছিল না বলে বলেছিল। তুই যেমন জান্নাতকে নিয়ে ভাবিস, স্রুতিও তো জিসানকে নিয়ে ভাবে।’
‘তুমি বুঝবে না দাদিয়া। আমার ভয় পাওয়ার কারণ তুমি বুঝতে পারবে না কিছুতেই।’
‘আমি সব বুঝতে পারছি। তুই ভাবিস না। জিসান যখন জান্নাতের ভালবাসা,পাগলামি বুঝতে পারবে, তখন ঠিক সব কিছু সুন্দর হয়ে উঠবে। সেদিন তোর ভয়ও কেটে যাবে।’
‘কিন্ত দাদিয়া,,’
‘কোনো কিন্তু নয়। বড়দের কিছু সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পারলেও, পরবর্তীতে দেখা যায় সেই সিদ্ধান্তই মঙ্গলময় হয়ে যায়। এখন চল। বিয়ের ফুল ফুটবে তো আজ। সাবধান! রিমিকে পেয়ে আমাকে ভুলে যাসনা যেন?’
আহসান স্মিত হেসে বলল, ‘কি যে বলো না তুমি! তুমি তো আমার প্রথম ক্রাশ।’ বলে মুনতাহার হাতে চুমু খেল আহসান।
#তোলপাড়💓
#সিজন২
#পর্বঃ৩০
#শান্তনা_আক্তার(Writer)
বিনা ঝায়-ঝামেলায় বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সকলে ভাব বিমিময়ে নিয়োজিত হয়ে গেল। কমিউনিটি সেন্টারের যাবতীয় খরচ রিমির বাবা নাজমুলই বহন করতে চেয়েছিলেন তবে রিমির সাথে জান্নাতের বিয়ে হওয়ায় রঞ্জিত নাজমুলের সাথে শেয়ারে খরচ সামলেছেন। রঞ্জিত পুরো খরচ নিজের কাঁধে নিতে চাইলেও নাজমুল তা মেনে নেননি। এজন্য রঞ্জিত শেয়ারের অপশন বেছে নিয়েছেন। ফলে নাজমুলও দ্বিমত জানাননি।
সন্ধ্যা পেড়িয়ে ঘড়ির কাটায় রাত ৮টা ছুঁই ছুঁই। কমিউনিটি সেন্টার থেকে রিমিকে বিদায় দিয়ে বিষন্ন মনে নিজ বাড়িতে চলে আসেন নাজমুল, আম্বিয়া ও তিয়াসা। আহসানদের পরিবারও তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মুনতাহার নির্দেশে জিসান ও জান্নাতকে যেতে দেওয়া হয়নি। একেবারে বউ-ভাতের অনুষ্ঠান শেষ করেই যেতে দেবে তাদের। এইজন্য জিসানের পরিবারের সকলেই আহসানদের বাড়িতেই রয়ে যাবে। রিমি পুরো রাস্তা কান্না করতে করতে এসেছে। রিমি ও আহসান এবং জিসান ও জান্নাত একই গাড়িতে বসেছে। জিসান ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা। আহসান, রিমি ও জান্নাত পেছনে বসা। রিমির দুই পাশে আহসান ও জান্নাত বসা। রিমি নিঃশব্দে কাঁদছে। বারবার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। আহসান তা দেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে রিমির সামনে ধরল। রিমি আহসানের দিকে এক পলক চেয়ে হাত বাড়িয়ে রুমালটা নিয়ে নিল। পরমুহুর্তে আহসান রিমিকে ওর বুকের সাথে মিলিয়ে নিল। রিমির কান্না নিমিষেই থেমে গেল। সে চোখ বন্ধ করে আহসানের বুকেই কান পেতে রইলো। রিমির সব হাহাকার উবে গেল আহসানের হার্টবিট শুনে। জান্নাত রিমি ও আহসানকে দেখে মুচকি একটা হাসি দিল। মুহুর্তেই জান্নাতের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এই ভেবে যে জিসান ওর দিকে একটাবার তাকাল না আজ। জান্নাত জিসানের ভাব ভঙ্গি দেখে বেশ বুঝতে পেরেছে যে জিসান অখুশি। মুখ ভাড় করেই রেখেছে জিসান। মনে যেন শান্তি নেই তার। অশান্তির ছাপ আছড়ে পড়ছে জিসানের মুখমন্ডল জুড়ে। তাইতো কারো সাথে ভালো মন্দ কোনো প্রকার ভাব প্রকাশ করেনি সে।
বাড়িতে পৌঁছে রিমি ও জান্নাতকে ফুল সজ্জিত রুমে প্রবেশ করানো হলো। জান্নাত তার নিজের রুমেই আছে বলে তেমন কোনো অনুভূতি প্রকাশিত হয়নি তার ভেতরে। তবে রিমির ক্ষেত্রে আলাদা এক অনুভূতির জাগরণ ঘটেছে। রিমি তার সাথে হওয়া সকল পরিবর্তনের প্রভাবগুলো উপলব্ধি করছে। নিজের ঘর,নিত্যদিনের কাজ, অভ্যাস সবকিছুতেই পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। এরই সাথে নতুন অধ্যায়কে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে। এই ভেবে মনে যথাসম্ভব শক্তি সঞ্চয় করে নিল।
আহসান বেশ কিছুক্ষণ ধরে জিসানকে খুঁজছে। বাড়িতে ঢোকার পর থেকে আহসানের চোখ দুটো জিসানের খোঁজেই নিয়োজিত। বাড়ির কাজের লোকের সাহায্যে আহসান জিসানের খোঁজ পেয়েও গেল। খোঁজ পেয়েই পা বাড়ালো ছাদের উদ্দেশ্যে। জিসান ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কারো হাতের উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে ঘুরলো সে। আহসানকে দেখে তার হাত শক্ত করে ধরলো জিসান। জিসানের মুখ দেখেই আহসান বুঝে গেল যে জিসান ভালো নেই। আহসান অস্ফুটে বলল,
‘আমি বুঝতে পারছি তুই খুশি হসনি এই বিয়েতে। কিন্তু এর জন্য দোষ সম্পূর্ণই তোর। তুই কেন সকলকে বললি না যে তুই অন্য কাউকে ভালবাসিস? তাহলে তো এত বড় Sacrifice করতে হতো না তোকে।’
জিসান ঘাড় ইষৎ বাকিয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
‘একতরফা ভালবাসার জোর কতটুকু বলতে পারিস?’
‘মানে? কে একতরফা ভালবাসে?’
‘আমি। তাইতো কিছু বলতে পারিনি।’
‘তুই আগে বলতি সেটা। আমি চেষ্টা করতাম মেয়েটিকে মানানোর।’
জিসান ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, ‘পারতি না। বরং তুই নিজে আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসতি।’
আহসান চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে বলল, ‘আমি এটা কেন করতাম? মেয়েটি কে তাই বল।’
‘সেটাই তো বলতে চাইনা আমি। প্লিজ ভাইয়া, আমাকে সেই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করিস না। তার কাছে আমি খারাপ ছেলে। অবশ্য তার জায়গায় যেকোনো মেয়ে থাকলেও এই একই কথা বলতো। খারাপ ছেলেরাই মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। আর যারা উত্ত্যক্ত করে তাদের বাবা-মায়ের উপর আঙুল উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। সব ক্ষেত্রে আমিই দোষী। আমার জন্যই সব হয়েছে।’
‘তুই এসব কি যা-তা বলছিস জিসান? আমার সাথে শেয়ার কর, দেখবি ভালো লাগবে। মন হালকা হয়ে যাবে।’
‘আমাকে মাফ করে দে ভাইয়া। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি এই নিয়ে আলোচনা করতে চাইনা। তাহলে কষ্টের মাত্রা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাবে।’
‘তুই যখন কিছু ভেঙে বলতে পারবি না, তখন খামখা কষ্ট পেয়ে তো কোনো লাভ নেই। মেনে নে জান্নাতকে। একতরফা ভালবাসায় জীবনকে জলাঞ্জলি না দিয়ে, যে ভালবাসে তাকে আঁকড়ে ধর। নইলে দেখা যাবে দিনশেষে কেউ পাশে নেই।’
‘আমি যে মেয়েটিকে খুব ভালবেসে ফেলেছি ভাইয়া। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন পুষে রেখেছি মনে। তাকে কিভাবে ভুলে গিয়ে অন্য কাউকে মনে বসাবো? বলতে পারিস ভাইয়া?’
‘তুই ঠিক বলছিস জিসান। তবে জোর করে ভালবাসা পেতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়।’
‘ঠিক একই ভাবে আমিও জান্নাতকে ভালবাসি না। ওকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই আমার মনে। তাহলে ওকে কিভাবে ভালো রাখবো বলতে পারিস? আমি তো ওকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছি না আর পারবোও না।’
‘তুই ঠিক বলেছিস। আসলে জান্নাত যে কাজটা করেছে, খুবই ভুল করেছে। তবে ছোটরা ভুল করবে,পাগলামি করবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের বোঝাতে হবে খুব সতর্কতার সঙ্গে। কিন্তু এক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি সাথে দেড়ি হয়ে গিয়েছে। এত ফাস্ট সব হয়ে গেল যে কিছু করার সময় ছিল না। যদি তোর ভালবাসা একতরফা না হতো, তাহলে আমিই সব ম্যানেজ করতে পারতাম। কিন্তু এখানে কেসটাই উল্টো।’
‘আমি এখন কি করবো ভাইয়া? আমি যে কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক দূরে চলে যেতে মন চাচ্ছে আমার। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আমি সব বুঝতে পারছি। তবে তুই পালিয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান বের করতে পারবি না। কখনো কখনো নিয়তির উপর সব ছেড়ে দিতে হয়।’
‘আমি যে পারবো না ভাইয়া।’
‘পারতে হবে তোকে। চেষ্টা করলেই পারবি।’
‘আমি জানি না ভবিষ্যতে পারবো কিনা। তবে এই মুহুর্তে জান্নাতকে মেনে নেওয়া অসম্ভব। আমি কিছুতেই ওকে মেনে নিতে পারবো না।’ এই বলে বেশ দ্রুত গতিতে চলে গেল জিসান।
জিসান চলে গেলে আহসান কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন হয়ে নানান কথা মস্তিষ্কে আওড়াতে লাগলো। এমন সময় স্রুতির আগমন ঘটে। স্রুতি খানিক কৌতুক করে বলল,
‘ইশ! বোনের জন্য নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে তাইনা রে?’
আহসান ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে রাগী ভাবটা স্পষ্ট করল। তারপর বলল,
‘তোকে কে বলেছে এসব? আমি মোটেও তা ভাবছি না।’
‘হয়েছে,হয়েছে। আমাকে বোঝাতে আসিস না। তুই যে জান্নাতকে নিয়ে চিন্তা করছিস, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। চিন্তা তো হবেই। জিসান তো জান্নাতকে বিয়ে করতেই চায়নি। আমার মনে হয়না জান্নাত সুখী হবে বলে। কারণ বিয়ে হলেও হাসবেন্ডের মন পাবে না ও। বুঝিয়ে দেখলি তো জিসানকে। পারলি কি?’
‘তোর বলা শেষ হলে চলে যেতে পারিস।’
‘শেষ হয়নি রে। সবে তো শুরু। আমি না খুব বোকা। জান্নাতের মতো আমিও যদি সুইসাইড করার চেষ্টা করতাম, তাহলে তোকে অনায়াসেই পেয়ে যেতাম। আসলে এসব চিন্তাধারা কাঁচা মাথার ছেলে মেয়েদেরই আসে৷ আমি যে কেন বড় হতে গেলাম? কেন যে বোধবুদ্ধি হলো আমার!’
আহসান স্মিত হেসে বলল, ‘হাসালি রে? তুই যদি বোধবুদ্ধি সম্পন্ন হতি, তাহলে নিয়তি মেনে নিয়ে আমাকে পাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতি। জান্নাত আর জিসান হয়তো এখনো অবুঝ, কিন্তু তুই না। তোর বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। এত কথা বলতে চাইনা তোর সাথে। রিমি অপেক্ষা করছে। আমাদের বিবাহিত জীবন যেন সুখের হয়, সে দোয়াই করিস।’
‘ওপ্স, কত বড় স্বার্থপর তুই। বোনকে নরকে ফেলে নিজের সুখে মজে আছিস।’
আহসান বিকৃত চোখে তাকাল। তা দেখে স্রুতি আবারও বলল,
‘আমি জান্নাতের ননদ হলাম সম্পর্কে। ফ্রিতে একটা কাজের মেয়ে পেলাম। ভালোই হলো। কাজের লোকের টাকা বেচে যাবে। আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাড়িতে গিয়ে সবগুলো কাজের লোককে ছাটাই করা।’
‘তুই কি বলতে চাচ্ছিস?’ গরম চোখে বলল আহসান।
‘যা শুনেছিস তাই। আমি জান্নাতকে কোনো ভাবেই ভালো থাকতে দেব না। স্বামীর সুখ তো পাবেই না,সাথে পারিবারিক ভাবে কোনো প্রকার সুখই পাবে না। আমি পেতে দেব না।’
‘আমি কিন্তু তোকে খুন করে ফেলবো স্রুতি।’
‘কর। কে মানা করেছে? আমি চাই তুই নিজ হাতে আমাকে মেরে ফেল।’ স্রুতি আহসানের একেবারে কাছে চলে আসলো।
আহসান দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল,
‘আমি তোর কাছে হাত জোর করে বলছি আমার বোনের সাথে কোনো প্রকার অনৈতিক আচরণ করিস না। অনেক আদরে বড় হয়েছে জান্নাত। আমি কখনো একটা ধমক দেইনি ওকে৷ এমনকি কেউই দেয়নি। ও খুব ইমোশনাল একটি মেয়ে। মনটাও খুব পরিষ্কার। বোঝে কম।’
‘আমি জানি সেসব। তবে কি করবো বল? আমার ভাই তো তোর বোনকে মেনে নিতে চায়না। এতে আমার কি দোষ বল?’
‘মেনে নিতে কতক্ষণ? মানুষের মন কখন, কিভাবে পরিবর্তন হয়ে যায় বলা মুশকিল।’
‘তাই নাকি? তাহলে চল একটা বাজী ধরা যাক। আই মিন ডিল।’
‘কিসের ডিল?’
‘এইযে জিসান যদি জান্নাতকে মেনে নেয়, তাহলে আমি তোকে আর বিরক্ত করবো না। আর আর ততদিন জান্নাতকেও জ্বালাতন করবো না।’
‘ঠিক আছে মেনে নিলাম।’
‘আরে দাড়া। শর্তটা তো শোন আগে।’
আহসান বিস্মিত চাহনির সাথে বলল,
‘শর্ত! কি শর্ত?’
‘৩ মাসের মধ্যে যদি জিসান জান্নাতকে মেনে না নেয়, তাহলে জান্নাত ও জিসানের ডিভোর্স এর ব্যবস্থা করবি। তুই নিজের হাতে ওদের ডিভোর্স পেপার রেডি করবি।’
‘কি বলছিস তুই এসব?’
‘ঠিক বলছি। আর সেই তিনমাস আমি জান্নাতকে জ্বালাবো না। আর ৩ মাসের মধ্যে যদি জিসান জান্নাতকে ভালবেসে কাছে টেনে নেয়, তাহলে তো আর কোনো ঝামেলাই হবে না। ওরা সুখে থাকুক তারপর। আমি কিছুই করবো না। ওদের মধ্যে কোনো প্রকার বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না।’
আহসান খানিক সময় ভাবলো। তারপর বলল,
‘ঠিক আছে আমি রাজী।’
‘আরেকটু কথা বাকী আছে। আমার শর্ত এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।’
আহসান বিরক্ত হয়ে বলল,
‘আমার সময় নেই। যা বলবি তাড়াতাড়ি বল। রিমি ওয়েট করছে আমার জন্য।’
স্রুতি পৈশাচিক এক হাসি দিল। তারপর আহসানের চারিদিকে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলল, ‘সেই তিনমাস তুই আর রিমি আলাদা থাকবি। মানে সকলের অগোচরে তোরা স্রেফ অচেনা এক দম্পতি হয়ে থাকবি। ৩মাস পর জিসান জান্নাতকে মেনে নিক বা না নিক, তোরা বৈবাহিক জীবন শুরু করতে পারবি। আমি আটকাবো না। তবে এই তিনমাস তুই রিমির থেকে দূরে থাকবি। এইবার বল রাজী কি?’
আহসান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আমি এটা কেন করবো?’
‘নিজের বোনের জন্য। দেখ তুই যদি রিমির সাথে হাসবেন্ডের মতো আচরণ করিস, তাহলে আমি জান্নাতের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করবো। আর জান্নাতকে বলব কাউকে যেন সেই কথা না বলে। তাহলে ও বলবেও না। তবে ঝিয়ের মতো খাটবে ঠিকই। ছাড় পাবে না ও। যদি তা না চাস তাহলে আমার শর্তে রাজী হয়ে যা। আরে বোকা তিনমাস পর তো আমি আর তোকে আটকাবো না। তখন তো এটাও বোঝা যাবে যে জিসান আদৌ জান্নাতকে নিয়ে খুশি কি না। শেষ হয়ে গেছে আমার৷ এবার তুই তোর ডিসিশন জানা। সময় মাত্র ২মিনিট।’
আহসান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে ২মিনিট পার হয়ে গিয়েছে। তাই স্রুতি আবারও বলে উঠল,
‘তোর সময় শেষ। আমি বুঝে গিয়েছি তুই জান্নাতকে ভালবাসিস না। নিজের জন্যই ভাবিস শুধু। ওকে তাই হবে। আমি আমার শর্ত ডিল সব তুলে নিলাম। বায়। দেখা হবে আবার। আমাদের বাড়ির নতুন কাজের মেয়েকে দেখতে যাস কিন্তু!
টাটা।’
স্রুতি চলে যাচ্ছিলো কিন্তু আহসানের কথায় থেমে গেল।
আহসান বলল, আমি রাজী। তুইও শুনে রাখ। ৩মাস পর জিসান জান্নাতকে মেনে নেবে। আর আমিও রিমিকে নিয়ে ভালো থাকবো। তুই আর তোর কুৎসিত মনোভাব হেরে যাবে সেদিন। দেখে নিস তুই।’
স্রুতি উচ্চস্বরে হেসে দিয়ে বলল, ‘দেখা যাবে কি হয়। আর যদি তোর কথা সঠিক হয়, তাহলে আমিও তোদের চার জনের জীবন থেকে নিজ ইচ্ছেতেই সরে আসবো। কথা দিলাম।’
#চলবে,
(