#তোলপাড়💓
#সিজন২
#পর্বঃ৫১
#শান্তনা_আক্তার(Writer)
(কোনো ক্রমেই কপি করবেন না)
দেখতে দেখতে আজ জান্নাতের প্রেগন্যান্সির ৮ মাস পূর্ণ হলো। সামনের মাসেই ডেলিভারির ডেইট দিয়ে দিয়েছে। জান্নাত ও জিসান খুব আনন্দ-উল্লাসের সাথে দিনগুলো উপভোগ করছে। শুধু অপেক্ষায় আছে আগামী মাসের।
এইদিকে আহসানদের বাড়িতেও খুশির জোয়ার। রিমিও কন্সিভ করেছে। রঞ্জিত জানা মাত্রই সকল রিলেটিভ’সদের জানানো সারা। তার ইচ্ছে এই খুশিতে বাড়িতে একটা বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। মুনতাহাও রাজী হয়, তবে রিমির অমত থাকায় রঞ্জিতের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হয় না। কারণ রিমি চায় ওর অনাগত বাচ্চার জন্য মিলাদ দেওয়া ও দোয়া পড়ানো হোক। সাথে এতিমখানার বাচ্চাদের অনুদানসহ ফফির-মিসকিনদের পেট ভরে খাওয়ানো হোক। রঞ্জিত খুশি মনে রিমির আবদার পূরণ করেন।
আহসান একটা গাড়ি ভর্তি বেবি টয়েজ সাথে দোলনা নিয়ে আসে। এত এত টয়েজ দেখে রিমির চোখ কপালে উঠে গিয়েছে। ও শুধু হা হয়ে সব দেখে যাচ্ছে অবাক চাহনি নিক্ষেপ করে। রুমের এক সাইডে খেলনাপাতি দিয়ে জমা হয়ে আছে। আচমকাই আহসান রিমির কানের কাছে গিয়ে বলল, ‘কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?’
রিমি মুখ বিকৃত করে বলল, ‘এত! পাগল নাকি হুম?’
আহসান প্যান্টের পকেটে দুহাত পুরে কিছুটা স্টাইল মেরে বলল,
‘বাচ্চার বাবা বলে কথা।’
‘বাচ্চা আসতে বহুত দেড়ি। ওতদিন কি আমরা দুজন এগুলো দিয়ে খেলবো নাকি? আজব!’ দাঁত খিচে বলে রিমি।
‘নট ব্যাড আইডিয়া।’
‘আশ্চর্য! এগুলো ফেরত দিয়ে আসো গিয়ে। টাকা মনে হচ্ছে গাছে ধরে তোমার আর তোমার বাবার। তাইনা?’
‘আরে এত রাগ করার কি আছে? আমি এইগুলো জান্নাতের বেবির জন্য কিনেছি। আমি জানি যে আমাদের বেবি আসতে এখনো অনেক সময় বাকী।’
‘ওহ তাই বলো। তাহলে ঠিক আছে। তো এখানে কেন এনেছো? পাঠিয়ে দাও জান্নাতের শ্বশুরবাড়ি।’
‘তার দরকার নেই, কারণ কয়েকদিনের মধ্যে জান্নাত এখানে চলে আসছে।’
‘ওও, তাহলে ঠিক আছে।’
‘কি ঠিক আছে? আমার বেবিকে নাহয় এখন কিছু দিতে পারবো না, কিন্তু তার মাকে তো দিতে পারবো!’
‘কি দেবে? তোমার দাদি আর মা অনেক কিছু দিয়ে ফেলেছে অলরেডি। আমার আলমারি ভর্তি। কিছুই চাইনা আমার।’
‘কিছুই চাই না?’ প্রশ্ন করে আহসান।’
‘না কিছুই চাইনা। তবে আম্মু-আব্বুর সাথে একটু দেখা করতে মন চাচ্ছে খুব। কতদিন দেখি না সামনাসামনি! এখান থেকে রিকশা নিলে আমাদের বাড়ি যেতে হায়েস্ট ৩০-৩৫ লাগে। কিন্তু তবুও আমি চাইলেই যেতে পারি না। কি অদ্ভুত মেয়েদের জীবন!’
‘তা ঠিক। তুমি চিন্তা করো না, আমি দু-এক দিনের মধ্যে তোমাকে নিয়ে ঘুরে আসবো শ্বশুরবাড়ি থেকে।’
‘আমি তো আমার বাবা-মায়ের অতিথি হয়ে গেলাম! ঠিক এইজন্যই আমি চাই আমার একটা ছেলে হোক। কারণ মেয়ে হলে তো আমাদের ভুলে অন্যের ঘরে চলে যাবে। তাই ছেলে হওয়াই ভালো।’ রিমির চোখে মুখে বিষন্নতার ভাব স্পষ্ট।
‘এটা কোনো কথা রিমি? তুমি জানো না মেয়ে মানে তার বাবা-মায়ের জান্নাত? যার মেয়ে নেই, সে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অভাগা ব্যক্তি। আর আমি সেই অভাগা হতে চাইনা। অন্যভাবে, কন্যা সন্তান আল্লাহর রহমত বর্ষণের একটি মাধ্যম বলা যায়। আর প্রথম কন্যা সন্তান তার সাথে করে আয়-উন্নতি নিয়ে আসে। আমার কিন্তু তোমার কথাটা মোটেও ভালো লাগেনি শুনতে।’
রিমি গালে হাত দিয়ে বলল, ‘বাব্বাহ! তুমি তো অনেক কিছু জানো দেখছি। ঠিক আছে আমাদের তাহলে মেয়ে সন্তানই হোক।’
‘এটা বলাও ঠিক না। কি হবে না হবে তা আমরা জানি না। তাই ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন, সে যেন সুস্থ-সবল হয়ে দুনিয়ায় আসে। পুরোটাই আমাদের সৃষ্টিকর্তার হাতে। তাই আগাম চিন্তা করতে নেই। যেটাই হোক আমি বাবা হচ্ছি এটাই যথেষ্ট। কি হবে না হবে তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তুমিও এসব নিয়ে কোনো চাওয়া প্রকাশ না করলেই খুশি হবো।’
‘খুব ভালো। এভাবে তোমার মতো কজন পুরুষ ভাবে বলো?’
‘সেটা আমি জানি না। এখন এই বিষয় বাদ দিলেই ভালো। তুমি কি চাও আমার কাছে তাই বলো?’
‘কিছু চাওয়ার নেই গো। তোমার মতো এত ভালো একজন স্বামী পেয়েছি, এটাই অনেক।’
‘তাহলে তুমি চাইবে না? ঠিক আছে। আমিই কিছু দেই।’
‘বললাম তো আমার কিছু চাইনা। আমি অনেক কিছু পেয়েছি তোমার থেকে।’
আহসান অস্ফুট স্বরে বলল,
‘আমি ভাবলাম সামনের কটা মাস তোমার সাথে সাথে থাকবো। আমার বাবুটা আসা পর্যন্ত তোমাকে অনেক কেয়ার করবো। কিন্তু তুমি যখন চাইছো না তাহলে থাক।’
‘এই তুমি কি বললে? তুমি আমার সাথেই থাকবে? তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি চাই তুমি আমার সাথে থাকো সবসময়। কিন্তু তোমার কাজ?’
‘বাপি আছে তো। তাছাড়া যেই স্বামী ডক্টর হয়েও স্ত্রীয়ের সেবা না করে, সে অন্যদের সেবা কিভাবে করবে?’
‘আসলেই তুমি আমার প্রিন্স আহসান। সেই ছোট্ট লাল টমেটোর মতো গোলুমোলু ছেলেটা।’ বলে আহসানের গাল টেনে ধরে রিমি।
‘এখনো কি আমাকে তোমার সেই লাল টমেটো মনে হয়?’
‘হুম, আর সবসময় তাই মনে হবে।’
‘তবে রে!’ এই বলে আহসান জোর করে রিমির ঠোঁট জোড়া নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।
রাতে সবাই মুনতাহার রুমে চেয়ার ফেলে বসেছে। সবাই বলতে রঞ্জিত-অপা এবং আহসান-রিমি। সকলের উপস্থিতিতে মুনতাহা বললেন,
‘তোমরা কোনদিনও আমার কথার নড়চড় করোনি। আশা করছি আজও করবে না।’
রঞ্জিত বলল, ‘জ্বি মা। তুমি হুকুম দাও শুধু।’
‘হাফসা ডেইলি ফোন দিয়ে কান্না করে আমার কাছে। বারবার অনুরোধ করে স্রুতিকে যেন ফিরিয়ে আনি। মায়ের মনতো! মেয়ের জন্য কষ্ট তো হবেই। একজন মাই জানে সন্তান জন্ম দেওয়া কত কঠিন। তো আমি আগে ব্যাপারটা এড়িয়ে চললেও এখন আর পারছি না। স্রুতির বয়স বাড়ছে দিনদিন। এতদিন বিয়ে হলে ছেলেপেলে হয়ে যেত ওর। অনেক তো হলো। প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে ওর। প্রত্যেক মানুষকে শেষ সুযোগ দেওয়া উচিত। নইলে এটা অন্যায় বলে বিবেচিত হবে। আমি সব দিক বিবেচনা করে দেখলাম এবার ওকে জামিন করালে ভালো হবে। তারপর একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব। তাহলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। তোমরা কি বলো?’
মুনতাহার কথার মাঝে কেউ কথা বলেনা বলে এতক্ষণ সকলে কিছু বলার দুঃসাহসিক দেখায়নি। তবে অনুমতি পাএয়া মাত্র আহসান বলে ওঠে, ‘অসম্ভব। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনা। স্রুতি ছাড়া পেলে আবারও রিমির ক্ষতি করতে চাইবে। তার চেয়ে ও যেখানে আছে, সেখানেই থাক।’
পরক্ষণেই রিমি বলল, ‘কিছু হবে না। আর দাদি তো ঠিকই বলেছে। তুমি স্বার্থপরের মতো কথা বলবে নাতো! স্রুতি একটা মেয়ে। ওরতো ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে। আমারও মনে হচ্ছে স্রুতিকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া দরকার।’
‘ঠিক আছে। তবে আমার একটা শর্ত আছে দাদিয়ার কাছে। তুমি যদি আমার শর্ত মেনে নাও, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
মুনতাহা জিজ্ঞেস করে, ‘কি?’
প্রতুত্তরে আহসান বলল, ‘স্রুতি আমাদের এই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। আমি চাইনা ওর ছায়া পর্যন্ত রিমির উপর পড়ুক।’ বেশ ক্রুদ্ধ চোখেই বলল আহসান।
মুনতাহা সাথে সাথে বললেন, ‘তাই হবে।’
পরের দিনই স্রুতিকে জামিন করিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয় সাথে ওর জন্য ছেলে দেখাও শুরু করে দেয় তোড়জোড় নিয়ে।
#তোলপাড়💓
#সিজন২
#পর্বঃ৫২(অন্তিম)
#শান্তনা_আক্তার(Writer)
(কোনো ক্রমেই কপি করবেন না)
টানা এক সপ্তাহ যাচাই-বাছাই করার পর সেরা একজনকে মুনতাহা নির্বাচন করলেন তার নাতনী স্রুতির জন্য। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে স্রুতি তেমন কারো সাথে কথা বলেনা। শুধু তার মা হাফসা ব্যতীত। তার যে বিয়ে হবে সেটা নিয়েও তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা মাথাব্যথা নেই। সে স্বাভাবিক ভাবেই আছে। খারাপ অথবা ভালো, কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছে না সে। আজ সন্ধ্যায় স্রুতির গায়ে হলুদ। ঘড়ির কাটা ৫টা ছুঁই ছুঁই তখন। অর্থাৎ এখন গোধূলি বেলা। রঞ্জিত,অপা ও মুনতাহা একদিন আগেই স্রুতিদের বাড়ি চলে এসেছে। আহসান রিমিকে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখনো এসে পৌঁছায়নি। বরং তার স্রুতির বিয়েতে যাওয়ার নিয়তই নেই। রিমি বড় একটা লাগেজের উপর ঠোঁট উল্টে বসে আছে।
আর আহসান পরম শান্তিতে বিছানায় চারহাত পা ফেলে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। রিমি স্রুতির গায়ে হলুদ ও বিয়ে অ্যাটেন্ড করবে বলে রাতেই সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছিল। আহসান সকাল থেকে যাবে যাবে বলে বিকেল বানিয়ে ফেলেছে। এমনকি রিমিকে রেডি হওয়ার জন্যও বলেছে। তবে রিমি রেডি হয়ে এসে দেখে আহসান হাতপা মেলে পড়ে আছে বিছানায়। আহসানকে ঘুমিয়ে যেতে দেখে রিমির মাথায় এক বস্তা রাগ ভর করে নিমিষেই। এমনিতে আহসান এখন যাব,তখন যাব করে রিমির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছে। তার উপর অসময়ে নাক ডেকে ঘুমানো! সব মিলিয়ে রিমি রাগের শেষ সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সে আর দাঁড়িয়ে না থেকে চটজলদি আহসানকে ধাক্কাতে শুরু করে। তবে বেশ কয়েকবার ডাকার পরও আহসান জেগে ওঠে না। তা দেখে রিমি হার মেনে রাগ করে ফ্লোরে রাখা লাগেজের উপর গিয়ে বসে থাকে ঠোঁট উল্টে। খানিক বাদে রিমি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলতে থাকে, ‘আমি কিন্তু একাই চলে যাব তোমাকে রেখে। কি ভেবেছো নিজেকে? ভেবেছো তুমি ছাড়া আমি স্রুতির বিয়েতে যেতে পারবো না? তুমি যদি তাই ভেবে থাকো তো ভুল ভাবছো। আমি একা একাই চলে যাব ওখানে।’
রিমি একা একা বকবক করছে আর নাকে কান্না কাঁদছে। আহসান খানিক বাদে বাদে এক চোখ মেলে পুনরায় বন্ধ করে ফেলছে। আহসানের থেকে কোনো প্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে রিমি সম্পূর্ণ অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর লাগেজটা টানতে টানতে দরজার কাছে চলে গেল। এরপর বলল, ‘আমি আর আমার বেবি যাচ্ছি স্রুতির বিয়ে খেতে। তুমি থাকো পড়ে, হুহ।’
রিমি তার কথা শেষ করার পর পরই আহসান লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। তারপর এক দৌঁড়ে রিমির সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ায়। আর বলে, ‘বড্ড সাহস বেড়েছে তোমার। কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?’
রিমি লাগেজটা ঠাস করে ফেলে দিল। তারপর কোমড়ে দুহাত গুজে চোখ ছোট করে আহসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি ঘুমানোর ভান করছো। সকাল থেকে আমাকে আশা দেখিয়ে এই অবধি এনে এখন আর কোনো যুক্তিসঙ্গত উপায় বা বাহানা না পেয়ে ঘুমানোর অভিনয় করলে? আমি কি দোষ করেছি যার জন্য এত জ্বালাচ্ছো আমায়? বলো কি করেছি আমি?’
‘তুমি কিছুই করোনি। তবে আমার মনে হচ্ছে স্রুতির বিয়েতে না যাওয়াই ভালো। আমার মন খারাপ কিছু ইঙ্গিত করছে বারবার। তোমাকে দেখলে স্রুতির মনে আবারও হিংস্রতা জেগে উঠতে পারে। তাই আমার কথা রাখো। আমি সবাইকে বলবো তোমার শরীর ভালো না বলে যেতে পারিনি। আগামীকালও একই কথা বলে চালিয়ে দেব।’
‘একটাও কথা শুনবো না তোমার। এত ভয় মেয়েরাও পায়না, যতটা তুমি পাচ্ছো। যেভাবে ভয় পাচ্ছো, মনে হচ্ছে স্রুতির বিয়েতে গেলে আমি মরে যাব!’
সঙ্গে সঙ্গে আহসান জোড়ালো ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ! বাজে কথা কেন বলছো? আমার ভালো লাগে না এসব কথা শুনতে। আমি কিছুই শুনতে চাইনা। আমরা যাচ্ছি না এটাই ফাইনাল।’
‘ঠিক আছে, তাহলে আমিও টানা ১০ দিন অনাহারে থাকবো সাথে মৌনতা ধারণ করবো। তুমি আমার কথা শুনছো না, তাই আমিও তোমার কোনো কথা শুনবো না। রাজী?’
‘বাচ্চামি বন্ধ করো৷ তোমার এখন বাচ্চামি করার বয়স নেই। ভুলে যেওনা তুমি আর একা নেই। তোমার মধ্যে আরেকজন বেড়ে উঠছে।’
রিমি বাম পাশের ভ্রু কুচকে বলল, ‘তো?’
‘ভেতরে চলো। মাথা খারাপ করবে না আমার।’
‘আমি যাব না ভেতরে। তুমি জোরজবরদস্তি করে নিয়ে যেতে পারো। তবে আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ও অনড় থাকবো। আর আমি কেমন তুমিতো জানোই। আমি যা বলেছি তাই করে দেখাবো। তারপর তুমি মানবে না তোমার ঘাড় মানবে দেখে নিও।’
আহসান প্রতিবার রিমির জেদের কাছে হার মেনেছে, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
_______________
আট মাসের উঁচু পেট নিয়ে খুব সাবধানে চলাফেরা করে জান্নাত। জিসান গায়ে সবুজ পাঞ্জাবি জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। আর জান্নাত মোহিত ও পলকহীন চোখে জিসানকে দেখছে। জান্নাত বাংলা শাড়ি পড়েছে। যার ফলে একটু বেশিই মোটা দেখাচ্ছে ওকে। সহসা জিসানের নজর কাড়ে আয়নায় জান্নাতের প্রতিবিম্বটি। জিসান ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলে,
‘এত দেখলে তোমার সুগার বেড়ে যাবে আর নয়তো আমার নজর লেগে যাবে!’
জান্নাত বিব্রত কন্ঠে বলল, ‘ইশ! তুমিও না। সবসময় আমার পেছনেই লাগতে হবে তোমায়।’
জিসান জান্নাতের দিকে যেতে যেতে বলে, ‘তোমার সাথে আমার সেই ছোট বেলার শত্রুতামি। আমি যদি বুড়ো খুনখুনে হয়ে যাই, তবুও তোমার পেছনে লাগার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবো না। বিকজ আমার খুব বেশি আকারে ভালো লাগে তোমার পেছনে লাগতে।’
‘হায় আল্লাহ! এই ছেলেটা আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।’
জান্নাত খাটে বসে পা ফ্লোরের উপর দিয়ে রেখেছে। জিসান হাটু মুড়ে জান্নাতের কোলে মাথা রেখে আদুরে গলায় বলে, ‘আমি সবসময় তোমার পেছনে লেগে থাকতে চাই। তুমি আমি আর আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে সারাজীবন একসাথে কাটিয়ে দিতে চাই।’
‘বাচ্চাদের কথাটা কোথা থেকে আসলো?’ প্রশ্ন করে জান্নাত।
‘হুম, ঝুড়ি ঝুড়ি বাচ্চার বাবা হবো আমি। একেবারে সেঞ্চুরি হবে।’
জান্নাত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো জিসানের দিকে। তা দেখে জিসান আবারও বলল, ‘এভাবে কেন তাকাচ্ছো? ভুল কি বলেছি আমি?’
‘ননসেন্স! আস্তা একটা পাগল তুমি। এটা কি সম্ভব?’
‘সম্ভব হবে চাইলেই। ধরো তুমি প্রতিবছর ৩-৪টা বাচ্চা দিলে। তাহলে ১০০ পার হয়ে উল্টে যাবে।’
‘হ্যাঁ আমি তো ছাগল। তাই একসাথে অতগুলো বাচ্চা দিতে পারবো। বন্ধ করো তো এসব আজগুবি কথাবার্তা। যত্তসব ফাউল কথা তোমার থেকেই উদয় হয়।’
জান্নাত রাগে গিজগিজ করছে এরই মাঝে সার্ভেন্ট মিসেস নীলা এসে দরজার কড়া নাড়লেন। যদিও দরজা খোলা ছিল। তিনি বললেন,
‘আপু আপনার জন্য গরম দুধ আর হাঁসের ডিম এনেছি।’
জিসান উঠে গিয়ে নীলার হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিল। তারপর তাকে বিদায় জানিয়ে নিজ হাতে জান্নাতকে খাইয়ে দিল।
_________________
বারবার রুমের পায়চারি করছে স্রুতি। বাড়ি ভর্তি লোকজনে ভরা বলে একটু সায় শব্দ বেশি হচ্ছে। যা স্রুতির মোটেও ভালো লাগছে না। সে কানে হাত চেপে দাঁত কামড়ে বলছে, ‘আর নিতে পারছি না এই ডিজগাস্টিং শোরগোলগুলো। আহসানরা এখনো কেন আসছে না? ওরা না আসলে তো আমি আমার কাজ শুরু করতে পারবো না। তাহলে কি আমি নিজের চোখে আহসানের চোখের পানি উপভোগ করতে পারবো না? উফ! এই আজকের দিনটার জন্যই আমি শান্তশিষ্ট হয়ে ছিলাম এই কটা দিন। তবে আর না। আজই আমি শেষ খেলা খেলবো। কিন্তু আহসান আর রিমিই যদি না আসে, তাহলে আমি কিভাবে আমার প্ল্যান কাজে লাগাবো?
কিছুক্ষণ পর স্রুতিকে সাজানোর জন্য লোকেরা চলে আসে। স্রুতি বাধ্য মেয়ের মতো সেজেগুজে স্টেজে গিয়ে বসে পড়ে। তার কিছুক্ষণ পর পরই আহসান ও রিমি চলে আসে। ওদের দেখে স্রুতি মনে মনে শয়তানি হাসি হাসে। রিমি স্রুতির কাছে অনেকবার যেতে চেয়েও পারেনি। কারণ আহসান রিমির হাত মনের ভুলেও এক মুহুর্তের জন্য ছাড়েনি। সাথে নিজেও যায়নি স্রুতির সাথে কথা বলতে। ইচ্ছে হয়নি তাই।
রিমি ও আহসান জান্নাতের সাথে কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল অন্যত্র। আর জিসান বিয়ের কিছু কাজে ব্যস্ত।
এদিকে স্রুতির রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে চারিদিকের কোলাহলে। সকলে উপস্থিত হলেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। সবাই স্রুতির গায়ে হলুদ দিল, তবে আহসান আর রিমি ছাড়া। অবশ্য আহসানের জন্যই রিমি স্রুতিকে হলুদ লাগাতে পারেনি। রিমি মন খারাপ করে আহসানের পাশে বসে আছে। আর স্রুতি সুযোগের আশায় ভদ্রতা বজায় রেখে চলেছে। তবে তা যেন ধীরে ধীরে খুব কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য। স্রুতি না পারছে কিছু করতে, আর না পারছে বসে বসে সব সহ্য করতে।
‘এই আহসান রিমির থেকে দূরে কেন যাচ্ছে না? ওর জন্য তো রিমিকে কিছু করতেও পারবো না। বাচ্চা পয়দা করার খুব শখ তাইনা? তোকে আর তোর বাচ্চাকে একসাথে মেরে মনের খায়েশ মেটাবো। একদিকে তুই মরবি আর অন্যদিকে আহসানও তোর শোকে মরণযন্ত্রণা সহ্য করবে। আমাকে জেলের ভাত খাইয়েছিস,কাজ করিয়েছিস,নোংরা কতগুলো মহিলাদের সাথে মশা-মাছির মধ্যে থাকতে হয়েছে আমাকে। সবই এই রিমির জন্য করেছিস তাইনা? এখন দেখবি তোর রিমির কি হাল করি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমার প্রধান লক্ষ্যই ছিল রিমি আর আহসানকে আলাদা করা। তারজন্য আমার যা যা করতে হয়, আমি তাই করবো। আমি যেভাবেই হোক আহসানকে অনেক, অনেক, অনেক বেশিই কষ্ট দেব। আমি মরলে মরি, তবুও আহসানকে শাস্তি দিয়ে ছাড়বো। ও আমার ভালবাসাকে তুচ্ছ করে আমাকে অনেক আঘাত করেছে। আমিও ওকে ছেড়ে দেব না। ওকে এমন শাস্তি দেব যেন ও সারাজীবন কপাল ঠুকে কান্না করে। কিন্তু কিভাবে? ওতো রিমির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে লেগে আছে।’
স্রুতি তার মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে কুৎসিত সব চিন্তা ভাবনা আওড়ে যাচ্ছে মনে মনে। আচমকাই ভয়াবহ একটা হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো স্রুতি। গিয়ে মাউথ হাতে নিয়ে নিল। তারপর সকলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘অ্যাটেনশন প্লিজ! আমার কিছু কথা ছিল সকলের সাথে।’
সবাই স্রুতির দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। স্রুতি একটু একটু করে স্টেজ থেকে নিচে নেমে বলল, ‘আমার আগামীকাল বিয়ে। কদিন আগে জেল খেটে এসেছি। জেলে থেকে খুব সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি। সেখানে আমি ঝাড়ু দিয়েছি, প্রয়োজন পড়লে রান্না-বান্না করেছি, বৃক্ষ রোপনের মতো সমাজ উন্নয়নমূলক কাজও করেছি। সেই সাথে যা কখনো খাইনি সেসব অখাদ্য-কুখাদ্য গিলেছি পেট বাঁচানোর দায়ে। জানেন! একটা মশারী ছিলনা যে রাতে একটু আরামে ঘুমাবো। সেখানে কত যে কষ্ট করেছি তা কেবল আমি নিজেই জানি।’
কেউ বুঝে উঠতে পারছে না স্রুতির মতিগতি। কি বলছে বা চাচ্ছে, কেনই বা বলছে তা সকলের কাছেই অজানা।
স্রুতি খানিক হেসে আবারও বলল, ‘আপনারা ভাবছেন আমি এসব কেন বলছি তাইনা? তো একটু বিস্তারিত ভাবে বলি, যাতে বুঝতে সুবিধা হয় আপনাদের। আমি দেড় বছরের জেলখাটা আসামি। ইতোমধ্যে সবাই জানেন। এই তকমাটা অলরেডি আমার গায়ে লেগে গিয়েছে আরও দেড় বছর আগে। এটা জানার পরেও আমাকে কেউ বিয়ে করছে এটা আমার ভাগ্য বলা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো আমি ওই আসামির জীবন স্পেন্ড করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই আমাকে আর আমার হাসবেন্ডকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি আমার প্রাণপ্রিয় নানুজানের কাছে। উনি পারমিশন দিলেই সম্ভব হয় আরকি। কারণ আমাদের তো নিজস্ব মাথা নেই। যেটা আছে ওটা জাস্ট শো। মানুষ যেন ভয় না পায়,তাই গলার সাথে লেগে আছে মাথাটা। কিন্তু এটা কেবলই নামমাত্র। কারণ আমাদের ফ্যামিলির মেইন মাথা তো মুনতাহা তালুকদাদের ঘাড়ে ঝুলে আছে।’
তখন স্রুতির বাবা নিলয় বেশ রেগেমেগেই বললেন, ‘তুই কি শুরু করেছিস? বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে সিনক্রিয়েট করা কোন ধরনের বেয়াদবি?’
স্রুতি মৃদু হেসে পরক্ষণেই মুখ কঠিন করে ফেলল। সে বলল, ‘সিনক্রিয়েট নয় বাবা। এটা আমার অভিমত। আমি সত্যিই জেলে যেতে চাই। তোমরা আমাকে বিয়ে দিচ্ছো দাও, তবে আমি পরবর্তী জীবনটুকু জেলেই কাটাতে চাই। আমার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কোনো কিছুই চাইনা। কেউ নেই আমার। তোমরা আমার কেউ না। আমি যেভাবেই হোক জেলে ফেরত যেতে চাই। তার ব্যবস্থাও আমি নিজ হাতে করছি।’
এই বলে জান্নাতকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। জিসান জান্নাতের আশে পাশে কাউকে ঘেঁষতে মানা করেছিল, যাতে জান্নাত ব্যথা না পায় কোনভাবে। তাই জান্নাতের ধারেকাছে কেউ ছিলনা। ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগালো স্রুতি। জান্নাত মুখ থুবড়ে বেশ খারাপ ভাবেই মেঝেতে পড়ে গেল। সাথে সাথে পুরো বাড়িসুদ্ধ মানুষ আতংকে কেঁপে ওঠে। জান্নাত মাটিতে ছটফট করতে করতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর স্রুতি পাগলের মতো হাসছে। উপস্থিত সকলের হাত পায়ে শক্তি নেই জান্নাতের এমন করুণ অবস্থা দেখে। এক মুহুর্ত দেড়ি না করে জিসান কোলে তুলে নিল জান্নাতকে। হাসপাতালে নেওয়ার দরুন গাড়িতে প্রচুর ব্লিডিং হয় জান্নাতের। জান্নাত কাতরাচ্ছে ব্যথায়। জিসান শক্ত করে জান্নাতের হাত ধরে আছে। জিসান বলছে,
‘আমরা চলে এসেছি হসপিটালের কাছে। তুমি চিন্তা করোনা। সব ভালো হয়ে যাবে।’
গলগল করে চোখ বেয়ে পানি ঝরছে জিসানের। সাথে শীতল কাঁপা হাত।
জান্নাতের নিশ্বাস নিতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। এমতাবস্থায়ও গলায় জোরপূর্বক স্বর টেনে বলল, ‘মরণাপন্ন মানুষ মৃত্যুর আহবান পেয়ে যায় জানো? আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাব কিছুক্ষণের মধ্যে।’
জান্নাতের এই কথাটা জিসানের হৃদপিন্ড ভেদ করে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে আসলো বাহিরে। জিসান জান্নাতকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল মুহুর্তেই।
‘তুমি এভাবে বলো না। আমি এমন সময়ে দাঁড়িয়ে, যে সময়ে আমি তোমাকে ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করতে পারবো না। আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই। দরকার পড়লে আমার বাচ্চা লাগবে না। তবুও তুমি বেঁচে থাকো।’
‘না! আমাদের বাচ্চা বেঁচে থাকুক। আমাদের বাচ্চা যদি বেঁচে থাকে তাহলে তুমি ওর খেয়াল রেখো। কোনো অভাব বুঝতে দিও না। আমি কিন্তু তোমার দায়িত্বে ওকে রেখে যাব।’
‘চুপ! একদম এসব ভুলভাল বলবে না। আমার ভয় লাগে। আমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি এসব বলো না।’
‘আমি না বললে কিভাবে হবে? আমি যে ওর মা। মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারবো না বলে কি আমার সন্তান অবহেলায় বড় হবে? তুমি ওর খেয়াল না রাখতে পারলে তিয়াসাকে বলো। ও পারবে আমার সন্তানকে মায়ের মতো ভালবাসতে। তুমি আমাকে ছুঁয়ে বলো তিয়াসাকে বিয়ে করবে?’
‘চুপ করতে বলেছি তোমায়। বলছি তো কিছু হবে না তোমার। আমি কিছু হতে দেব না।’
‘তোমাকে আমার কথা রাখতে হবে। তুমি যদি আমাকে ভালবেসে থাকো, তাহলে সেই ভালবাসার খাতিরে তোমার প্রথম ভালবাসাকে মেনে নিও। তুমি ওর মধ্যে আমাকে খুঁজে নিও। তুমি আমার কপালে নেই। এটাই হয়তো নিয়তি। তিয়াসাই ছিল তোমার ভাগ্যে। আমিই উঁড়ে এসে জুড়ে বসেছি তোমাদের মধ্যে। আমি বুঝলাম জোর করে বা ব্লেকমেইল করে কাউকে পাওয়া যায়না। কোন ভাবেই না। নিয়তি এটা কখনোই মেনে নেয়না। তাইতো আমার কপালে সুখ সইলো না। আমি আমার ভুলের শাস্তি পেয়ে গেলাম।’
কথাটি বলেই জান্নাত সেন্সলেস হয়ে যায়। এরপর জিসান হাজার চেষ্টা করেও জান্নাতের চোখ খোলাতে পারে না।
__________
ওটি থেকে রাত ১২টা নাগাদ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একজন মহিলা ডক্টর বের হয়। খুব গুরুতর অবস্থা হওয়ায় ইমার্জেন্সি সিজার করানো হয় জান্নাতকে। জীবিত কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে জান্নাত। খবরটা শক্ত পাথর বানিয়ে দেয় জান্নাতের প্রতিটি কাছের মানুষদেরকে। জিসানের কান্নার শব্দে পুরো হাসপাতালে কম্পন উঠে যায়। রঞ্জিত ও আহসান ডাক্তার হয়েও জান্নাতকে বাঁচাতে পারলো না। পারলো না বাবা-ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে। তাদের আক্ষেপ! ডাক্তার হয়ে লাভ কি হলো,যদি আপন মানুষকেই বাঁচাতে না পারে?
ভাগ্য কখন, কাকে, কোন দুয়ারে নিয়ে দাঁড় করাবে, তা কারোই বোধগম্য নয়। তবে নিয়তি মেনে নিতে পারলেই বাঁচার উপায় খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ।
(সমাপ্ত)
(