দ্বিরাগমন পর্ব ২৫+২৬+২৭+২৮+২৯

দ্বিরাগমন
মিদহাদ আহমেদ
#পর্ব_২৫

গাড়িতে রুমানা বেগম সত্যকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে নুপুরের?”
সত্য বললো,
“জানি না দাদি, আমার মনে হচ্ছে মায়ের স্ট্রোক হয়েছে। এখন কথা বলো না তুমি। আর মাকে বাতাস করো পারলে। আমি ড্রাইভ করছি।”
“এসি ছেড়ে দে।”
“না না। এসির বাসাত না এখন। আমি জানালা খুলে দিচ্ছি। আর পারলে পেছনে পত্রিকা রাখা আছে, পত্রিকা দিয়ে বাসাত করো মাকে।”

এদিকে অবচেতন হয়ে মুখ হা করে মায়ের কোলে শুয়ে আছে নুপুর। তার চিন্তা ভাবনা শুধু এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে! তার জীবনের সাথেই শুধু কেনো এমন হয়? জীবনে জেদ চেপে ধরেছিলো নিজের মেয়েকে বড় কিছু একটা বানাবে। তবে সেই জেদটা সে ঠিক পর্যন্ত পালন করতে পেরেছে। ডাক্তার হয়েছে সত্য। আজ পঁচিশ বছর ধরে যে সত্য নুপুর তার মেয়ে সত্যের কাছে গোপন করে এসেছিলো, সেই সত্যই আজ নতুন করে ধরা দিচ্ছে তার সামনে। এই দুইদিনের মাথায় তারানা আপা আর সুলতানা আপার যে নতুন অধ্যায় নুপুর জানলো, সেটা সে না জানলেও পারতো। আর এখন কী শুনলো নুপুর? তার একমাত্র মেয়ে যে কিনা নুপুরের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, সেই মেয়েটাই কিনা সুলতানার ছেলেকে ভালোবাসে? চিহ চিহ! সুলতানা আর সালমানের ছেলে? এই কথা চিন্তা করাও পাপ! তবে সুলতানা আপা মা হলো কীভাবে? না না। এইটাও সম্ভব না।
অবচেতন মনে এসব চিন্তা করেই চলছে নুপুর। কখন যে সে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো, আর জ্ঞান ফিরলো পরেরদিন রাতে। নুপুর নিজেকে বাসায় আবিষ্কার করলো। পাশে আলতাফ চৌধুরী, রুমানা বেগম আর সত্য দাঁড়িয়ে আছে। আলতাফ চৌধুরী নুপুরের মাথায় হাত রেখে বলছেন,
“মারে ভেঙ্গে গেলে যে হবে না। এই বুড়া বাবা মাকে কে দেখবে যে?”
সত্য অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে বুঝতে পেরে আলতাফ চৌধুরীকে সরিয়ে এনে বললো,
“উহু, আমিতো জোয়ান এখনও। আমরা প্রেম করবো দুজনে।”
আলতাফ চৌধুরী কিছুটা কড়া গলায় বললেন
“সবসময় মজা ভালো দেখায় না সত্য।”
সত্য তখন চোখ দিয়ে ইশারা দিলো আলতাফ চৌধুরীকে। আলতাফ চৌধুরী সত্যের ইশারা বুঝে চুপ করে গেলেন। রুমানা বেগম রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস দুধ এনে নুপুরকে খেতে বললেন। অবচেতন শেষে এইমাত্র জ্ঞান ফিরে এসেছে নুপুরের। সত্য দুধের গ্লাসটা হাতে নিলো। হাতে নিয়ে মাকে উঠিয়ে বসালো বিছানায়। তারপর গ্লাসটা ঠোঁটের সামনে ধরে বললো,
“খাও। এই নাও।”
নুপুরের হঠাৎ আবার সেই কথা মনে পড়ে গেলো। সত্যের গালে চোখে চুলে ধরে নুপুর বলতে লাগলো,
” না না। এই হতে পারে না। না মা না। সত্য এটা হয় না। হয় না। এসব সম্ভব না। কখনোই না। না না না। এটা কীভাবে হয়।”
“কী মা? কী হয়েছে?”
” না না। এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। পৃথিবীর নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ কখনোই না। না না।”
সত্য দুধের গ্লাস সরিয়ে রেখে নুপুরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।তারপর বললো,
“এইতো তোমার মেয়ে তোমার কাছে আছে। তার কিচ্ছু হয়নি। চিন্তা করছো কেনো?”
” না না। না না আমি চলে যাবো। তোকে নিয়ে কোথায় কোথায়! অনেক অনেক দূরে চলে যাবো। কেউ পাবে না তোকে। সত্যের সত্য পাবে না। না আসবে না। অসম্ভব এগুলো। এইটা কখনোই সম্ভব না।”
আলতাফ চৌধুরী এবার অবাক হলেন। নুপুরকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে? কোথায় যাবি? খুলে বল আমাকে!”
নুপুর হুট করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সত্যের হাত ধরে টান দিয়ে বললো,
“চল চল। আমরা চলে যাই।”
“কী হয়েছে মা?”
“না হবে না। হবে না।”
“কী হবে না?”
“না। কিছু না। আমরা যাই।”
“কোথায়?”
“চলে যাবো। চলে যাবো অনেক দূরে। কেউ পাবে না। কেউ না কেউ না কেউ না।”

রুমানা বেগম নুপুরকে তার দিকে ফিরালেন। ফিরিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে তোর? আর এমন করছিস কেনো?”
নুপুর অবচেতনের মতো জবাব দিলো
” না না। আর না। সত্য সামনে আসবে না। পাপ পাপ! মহাপাপ!”
“কী পাপ? কী আবোল তাবোল বকছিস নুপুর?”
নুপুর রুমানা বেগমকে বললো,
“না মা। পাপ পাপ। মহাপাপ। এট সম্ভব না।”
সত্য জড়িয়ে ধরলো মাকে। কান্না করতে করতে বললো,
“কী হয়েছে মা? কী সম্ভব না? কী পাপ? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”

” না না। পাপ পাপ। পায়ায়ায়াপ!”

এই বলতে বলতে নুপুর আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল এক পাশ কাটিয়ে অন্যপাশে ফিরে বিরবির করতে করতে চোখ বন্ধ করলো।তারপর বলতে লাগলো,
“পাপ! পাপ পাপ পাপ!”

রুমানা বেগম নুপুরকে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলেন কীসের পাপ? নুপুরকে জিজ্ঞেস করতে সত্য আটকালো। ইশারায় রুম থেকে বেরিয়ে আসততে বললো। তারপর আলতাফ চৌধুরী ও রুমানা বেগমকে বললো,
“জানি না মায়ের মাথায় কী চলছে। এখন আর তাকে আমরা কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করি। কেমন?”
রুমানা বেগম বললেন,
“মেয়েটার কী হয়েছে? পাপ পাপ কেনো বলছে সে?”
“জানি না। কিচ্ছু জানি না আমি। শুধু জানি মানসিক এই ট্রমা মায়ের জীবনের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। মাকে আমি ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিচ্ছি। তারপর একটা ঘুম হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
আলতাফ চৌধুরী উপরের দিকে হাত তুলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,
“হে মাবুদ, আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখো। আমার মেয়েটার জীবনে দুঃখের কমতি ছিলো না। মাবুদ! আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখো তুমি!”

সত্য মায়ের রুমে গিয়ে মাকে তুলে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিলো। নুপুর তখন সত্যের গালে হাত দিয়ে ধরে বললো,
“পাপ পাপ। পাপ পাপ। মারে পাপ করিস না।”
সত্য নুপুরের কথা শুনেও না শুনার বাহানা ধরলো। নুপুরকে ট্যাবলেট খাইয়ে দিলো। তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলো। নুপুর সত্যকে বললো,
“আয় আয় মায়ের পাশে আয়। এই আয় না।”
নুপুরের আচরণে কেমন জানি বাচ্চামো স্বভাব দেখা যাচ্ছে। সত্য বিচলিত হলো না। মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। নুপুর সত্যের লম্বা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর গান গাইছে,
“ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো,
খাট নাই পালঙ্ক নাই চোখ বুজে বসো
বাটা ভরা পান দেব গাল ভরে খেয়ো
সত্যের চোখে ঘুম নাই…”
না না। পাপ পাপ। সত্য পাপ করিস না। করিস না।

হুট করে গানের মধ্যে পাপ পাপ বলে সত্যকে আবার জড়িয়ে ধরলো নুপুর। জড়িয়ে ধরে গান ধরল আবার…
আয় রে আয় টিয়ে
নায়ে ভরা দিয়ে
বউ সাজবে কালকি
চড়বে সোনার পালকি…

“না না। এই বউ সাজলে হবে না। পাপ পাপ। না পাপ করবে না। আমার সত্য পাপ করবে না।”

কখন যে নুপুর বাচ্চার মতো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে সেটা সত্যও টের পায়নি। সত্যের যখন ঘুম ভেঙ্গেছে তখন রাত আটটা। মা তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। সে আস্তে আস্তে তার মাকে ছাড়ালো। ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছে। এখন ঘুম হবে মায়ের। ঘুম থেকে উঠে শরীর ঠিক হবে হয়তো।

সত্য তার রুমে গিয়ে আলভিকে কল দিলো। আলভি কল রিসিভড করতেই নুপুর সব কাহিনী খুলে বললো। আলভি বললো,
“আর ইউ সিরিয়াস?”
“হ্যাঁ।”
“আমি শকড সত্য! বাসায় আজকে একই কাহিনী ঘটেছে। আমি মাকে তোমার কথা বলেছি”
“তারপর?”
“তারপর মা তোমার ছবি দেখতে চাইলেন। আমি আন্টির সাথে তোমাদের পুরো ফ্যামিলির যে ছবি যেটা তোমার দাদার বার্থডেতে তোলা, সেই ছবিটা দেখালাম মাকে।”
“তারপর…”
“তারপর মা নুপুর নুপুর বলে কেমন জানি চিৎকার করে উঠলো”
“নুপুর? আন্টি আমার মাকে চিনেন নাকি আগে থেকে?”
“জানি না। আমার শেষে মনে হলো যে তোমার মায়ের নাম নুপুর। তবে সেইটা মা জানলেন কীভাবে?
“কীভাবে জানলেন?”
“এইটাতো আমারও প্রশ্ন।”
“হ্যাঁ ঠিক তাই।”
“তারা একে অপরকে চিনেন?”
“হয়তোবা!”
“হয়তোবা! আর মা আজকে এই বিয়ে পাপ পাপ বলে হাইপার হয়ে গেলেন কেনো?”
আলভি অবাক হলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পাপ? কীসের পাপ?”
“জানি না। বাট পাপ হবে কেনো?”
“জানি না। তবে মা নুপুর নুপুর বলে দুপুর থেকেই কান্না করে চলছেন।”
“মানে?”
“হ্যাঁ। যা বলছি তাই।”
“আন্টিকে জিজ্ঞেস করোনি যে উনি আমার মাকে চেনেন কী না?”
“সাহস হয়নি।”
“মানে? এসব কী হতে চলেছে আলভি?” আন্টি কান্না করছেন আয়ের ছবি দেখে আর এদিকে আমার মা পাপ পাপ বলে কেমন জানি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। ঘটনা কী?”
“জানি না। আমি এটুকু জানি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না সত্য”
“আই লাভ ইউ আলভি। আই লাভ ইউ। তুমি আমার আরেকটা জীবন। এইটা আমি অস্বীকার করতে পারবো না।”
“পৃথিবীর যতো বাধাই আসুক, আমরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না সত্য।”
“হ্যাঁ।”
“লাভ ইউ।”
“লাভ ইউ টু”

এদিকে খুনের দায়ে তারানাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। আপাতত মামলার সত্য মিথ্যা জানা যায়নি এখনও। পুলিশের ধারণা, নিজের স্বামী রাফি আহমেদকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছেন তার স্ত্রী তারানা।

আর এদিকে রুমানা বেগম আলতাফ চৌধুরীকে বলছেন,
“আমি মনে মনে আবার বড় ছেলের ঘরের নাতির জন্য সত্যকে পছন্দ করে রেখেছি। সত্যেরও বিয়ের বয়স হয়েছে এখন।”
“কিন্তু…”
“কিন্তু কী? সত্য তো আমাদের রক্তের কেউ না। তাকে এই পরিবারের নাতবউ করে এই পরিবারের একজনের সম্মান তাকে দিতে চাই আমি। নুপুরের মতো মেয়ের, মেয়ে হয়ে সত্য আমার আগের সংসার টা আবার গুছিয়ে দিবে। আমি এইটাই চাই।”
“না এটা হবে না।”
“কেনো হবে না?”
“তোমার কানাডিয়ান নাতি কি সত্যকে বিয়ে করতে রাজি হবে?”
“সেই দায়ভারটা আমার। সত্য ও তো যোগ্যতায় কম না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার সে।”
দ্বিরাগমন
মিদহাদ আহমেদ
#পর্ব_২৬

পরেরদিন ঘুম থেকে উঠার পর থেকে নুপুর মোটামুটি সুস্থ। সত্যও কালকের দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কিছু বলছে না। নুপুরের মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, সত্যের জীবন সত্য যদি সামনে এসে যায়! নুপুর এইটাও চিন্তা করছে, আলভির সাথে নুপুরের পরিচয় হওয়া, ভালোবাসা, প্রেম, পঁচিশ বছর আগের কাহিনী আবার শুরু হওয়া, এসবের মধ্যে কেমন কেমন জানি শুধু রহস্য রহস্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। নুপুর আনমনে রান্নাঘরে ছিলো। পেছন থেকে রুমানা বেগম এসে বললেন,
“নুপুর একটা কথা ছিলো তোর সাথে।”
নুপুর পেছন ফিরলো। রুমানা বেগমকে বললো,
“হ্যাঁ বলেন।”
“আয় ঘরে আয় আগে।”
নুপুর রুমানা বেগমের পেছন পেছন উপরের তলায় উঠলো। তারপর রুমানা বেগম নুপুরকে তার রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর নুপুরকে বললেন,
“আজকে তুই আমাদের সাথে আছিস কত বছর রে মা?”
নুপুর মায়ের মুখে এমন কথা শুনে কেমন জানি অবাক হলো। তারপর বললো,
“পঁচিশ বছর।”
“এই পঁচিশ বছরে আমি তোর কাছে কোনো কিছু চেয়েছি রে নুপুর?”
অবাক হলো নুপুর। চোখ তার ছলছল করে উঠলো। তারপর বললো,
“কিছু চাইলে আমি আজও দিতে পারবো না মা।আমার এই যোগ্যতা আগেও ছিলো না এখনও নেই। আমি আজীবনের জন্য আপনার কাছে, বাবার কাছ রিদ্ধ হয়ে থাকবো।
রুমানা বেগম কড়া গলায় বললেন,
“উহু! এসব বলতে বলেছি আমি?”
“তারপরও…”
“না তারপরও না। আমি তোর কাছে আজ কিছু একটা চাইবো।”
“কী মা?”
“সত্য।”
“সত্য!”
“হ্যাঁ সত্যকে চাই।”
নুপুর কিছুটা বিচলিত হল। তারপর আমতা আমতা করে বললো,
“সত্য তো আপনাদের আছেই। সত্য আমার যেমন, আপনাদেরও তেমন।”
“না তেমন চাই না।”
“তাহলে?”
“সত্যকে আরিয়ানের বউ বানাতে চাই। আমার নাতিবউ বানাতে চাই”
নুপুর রুমানা বেগমের মুখে এই কথাটা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। নুপুর অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রুমানা বেগমের দিকে। রুমানা বেগম বললেন
“কী হয়েছে? দিবি তো সত্যকে?”
নুপুর নিশ্চুপ ছিলো কিছুক্ষণ। সাথে সাথে নির্বাক ও হয়ে রইলো। রুমানা বেগম নুপুরের হাতে ধরে বললেন আবার,
“কী হয়েছে? কিছু বল”
নুপুর কোনোকিছু বলার আর শব্দ খুঁজে পেলো না। অবাক আর হতবাক যেনো নুপুরকে গ্রাস করে বসেছে। একদিকে সত্য আর আলভির ভালোবাসা, অন্যদিকে রুমানা বেগমের এখন এরকম চাওয়া দুটোই যেনো তাকে একদম শেষ করে তুলেছে। এমন সময় সত্য রুমের দরজা খুলে রুমে ঢুকলো। মা আর দাদিকে সামনাসামনি দেখে সে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
“কী? মা মেয়ের কী ফন্দি হচ্ছে আমাকে ছাড়া?”
রুমানা বেগম সত্যের সামনে গিয়ে একটা হাসি দিলেন। গালে হাত দিয়ে ধরে বললেন,
“মিষ্টি মতোন আমার ঘরটা আগলে রাখবি তুই।”
সত্য হাসলো। হেসে জবাব দিলো,
“এইযে, তোমার বুড়া জামাইকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।”
“ধুর বোকা। ওই বুড়ার পাশে তোকে মানায় নাকি? তোর পাশে তো আরেকটা রাজপুত্তুর থাকবে।”
“এএএএ হয়েছে যা। রূপকথার কাহিনী কাকে শুনানো হচ্ছে শুনি? আমি একজন ডাক্তার! আর ডাক্তারের জন্য ডাক্তার থাকবে। এসব রাজপুত্র-টাজপুত্র না”

সত্যের কথায় নুপুর আরও অবাক হলো। সে ডাক্তার আলভিকে ভালোবাসে। আর তার সাথে সংসার করার পরিকল্পনা করছে।

রুম থেকে সত্য আর রুমানা বেগম বেরিয়ে গেলেন। নুপুর রান্নাঘরে চলে গেলো। আলভি এমন সময় কল দিলো সত্যকে। সত্য কল রিসিভড করল। আলভি বললো,
“গুড নিউজ আছে।”
“গুড নিউজ? কীসের?”
“আগে বলো তুমি খুশি হবা?”
“আরেহ গুড নিউজ মানে খুশি হওয়ার মতো নিউজ। তাইনা?”
“হুম ঠিক তাই আবার তাও না।”
“তাহলে কী?”
“আমাকে ভালোবাসো তো সত্য?”
“অদ্ভুত! তোমার মাথায় সমস্যা নাকি?”
“না। তারপরও বলো। আবার শুনতে চাই।”
“ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি। এখন বলো গুড নিউজটা কী?”
“বিয়ে”
“অহ ভালো। মেয়ে পেয়েছো এখন রিলেশন ব্রেকাপ করতে চাইছো। তাইনা? এইটাই গুড নিউজ?”
“হ্যাঁ।”
“এএএ! কী মজা নেওয়ার সময় এখন? গুড নিউজটা কী আলভি?”
“আমাদের বিয়ে।”
সত্য অবাক হলো।।বিয়ে নিয়ে সে এখনও কোনো পরিকল্পনা করেনি। তার উপর এখন আলভি বলছে বিয়ে!
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু না সত্য। আর জানো আজকে সকালে কী মিরাকল ঘটেছে?”
“কী?”
“মা এসে বলেছে সিলেট তোমাদের বাসার ঠিকানা দিতে। বাবা কালকের ফ্লাইটের টিকেট করেছে। আগামীকাল সন্ধ্যায় আমরা সিলেট আসছি। আর এটাই সারপ্রাইজ! ”
“মানে? সিলেট? তুমি? আন্টি? আঙ্কেল?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমরা আসছি। মা আমাদের সম্পর্ক নিয়ে খুব খুশি আর তিনি নিজেই বিয়ের আলাপ দিয়ে আসতে চান আন্টিকে!”
“মানে? আর ইউ সিরিয়াস আলভি? তোমার মাথা ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সিরিয়াস! আমিতো অবাক সত্য। মা কেমন জানি প্রথমে আনইজি ফিল করছিলো তারপর আজ সকালে নিজ থেকেই বললো, আমরা সিলেট যাচ্ছি আর মা আন্টির কাছে সম্বন্ধ নিয়ে যেতে চান”
“আমার ভয় হচ্ছে আলভি!”
“ভয়? কীসের ভয়?”
“আমার মা তো কিছুই জানেন না।”
“জানতে হবে না। আমার মা সব হ্যান্ডেল করবে সত্য
মা খুব এক্সাইটেড এই বিয়ে নিয়ে। ইভেন এইমাত্র গোল্ডের শো রুমে গিয়েছে চুড়ি কিনতে। আমাকে সাথে যেতে বলেছিলো আমি যাইনি। এখন বুঝো মায়ের অবস্থা!”
“কিন্তু…”
“না। কোনো কিন্তু না।”
“ভয় হচ্ছে আলভি। মা অসুস্থ!”
“কোনো ভয় না। আর আন্টিকে আগে জানাবা না। তুমি যে জানো এইটাও না।”
“তবে…”
“উহু! বুঝো না কেনো তুমি! আমরা চট্টগ্রাম থেকে আসবো, আন্টি যেনো আগে না জানে। আর বিষয়টা এতটাও ইজি না। বুঝতেইতো পারছো”
“মা রাজি হবে তো আলভি?”
“রাজি না হওয়ার কোনো কারণ আছে?”
“না কারণ নাই। তবে আলভি তুমি আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানো না।।আমার সত্য জানো না। কিচ্ছু না।”
আলভি সত্যের কথায় হাসলো। হেসে হেসে বললো,
“তুমিও আমার সত্য জানো না সত্য। যেই সত্যটা আমি তোমার কাছে গোপন করেছি। আমার অস্তিত্বের সত্য!”
“মানে?”
“মানে এখন বুঝা লাগবে না। আগামীকাল আমরা আসছি। এইটা জেনে রাখো শুধু। ব্যস”
“আসলে এসব কিছু কী হচ্ছে আমি বুঝে উঠতে পারতেছি না।”
“বুঝা লাগবে না। শেষ পর্যন্ত আমাদের চার বছরের রিলেশন যে বিয়েতে পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে এটা ভাবতেই আমার কেমন জানি এক্সাইটেড ফিল হচ্ছে।”
“লাভ ইউ আলভি”
“লাভ ইউ টু।”
“আর হ্যাঁ, একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য!”
“কী সারপ্রাইজ?”
“সারপ্রাইজ আগে বলে নাকি বোকা মেয়ে?”
“তাহলে সারপ্রাইজ আছে এইটা আগে বলে নাকি?”
“হু! রাখছি তাহলে।”
“আচ্ছা। আমি ভয়ে মরেই যাচ্ছি এখন।”
“মরলে হবে না”
“হ্যাঁ মরলে তো নতুন প্রেমিকা খুঁজবা”
“না আমিও সাথেই মারা যাব”
“হয়েছে হয়েছে ফিউচার ওয়াইফের সাথে আর ফ্লার্ট করতে হবে না”
“রাখি এখন”
“আচ্ছা।”

আলভির সাথে কথা শেষে সত্য চিন্তায় ডুবে গেলো। অস্তিত্বের সত্য আবার কী? আলভির কোন সত্য সে জানে না? এদিকে কালকে আলভির মা বাবা আর আলভি তার সম্বন্ধ নিয়ে আসবে! তাদের সামনে কী হবে কী না হবে কিচ্ছু সে বুঝে উঠতে পারছে না।

রুমানা বেগমকে আলতাফ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, নুপুর সত্যের সাথে আরিয়ানের বিয়েতে মত দিয়েছে কী না?
রুমানা বেগম বললেন,
“নুপুরের অমত থাকার কথা না। অমত হলে নুপুর না করবো। না বলতো।”
“অহ আচ্ছা।”
“হ্যাঁ। এতোদিন নুপুর আর সত্যকে আমাদের সাথে রেখেছি, বড় করেছি। এর বিনিময়ে সত্যকে এই ঘরের বউ বানাতে চাইলে, আমি মনে করি না নুপুরের আপত্তি থাকবে।”

আলতাফ চৌধুরী আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন,
“আল্লাহ চাইলে তাই হবে। সত্যের মতো মেয়ে আমার ঘরে আমার নাতিবউ হয়ে আসুক এইটা আমিও চাই।”
#দ্বিরাগমন
#পর্ব_২৭

পরেরদিন সন্ধ্যায় আলভি তার বাবা মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট আসলো। সিলেট এয়ারপোর্ট থেকেই আলভি সত্যকে কল করল। সত্য কল রিসিভড করতেই আলভি বললো,
“আমরা চলে এসেছি মাত্র। তোমার বাসার লোকেশন টা?”
“আমি মেসেজে দিচ্ছি। চ্যাক করো।”
“আচ্ছা।”

এদিকে সন্ধ্যায় সত্যের দাদি তার এক খালাতো বোনের ঘরের নাতির আকিকায় যাবে। সত্যকে এসে জোর করে বললেন,
“আয় আমার সাথে।”
“না যাবো না আমি। তুমি একাই যাও।”
“গাড়ি কে চালাবে?”
“ড্রাইভার আছে তো দাদি।”
“উহু এমন করে না মেয়ে আমার। আয় আমাকে নিয়ে চল”
“না আমি যাব না আজকে। বুঝো না কেনো?”
“তাহলে নুপুরকে নিয়ে যাই। দাদা আর নাতিন রান্না করে খেয়ে নিস। কেমন?”
“না মাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না আজকে।”

সত্যের এমন হুটকারি বাহানা আর কথায় রুমানা বেগম অবাক হলেন। অবাক বিস্ময়ের চোখে তিনি তাকালে সত্য আমতা আমতা করে বলল,
“না দাদি মা তো অসুস্থ আর সেখানে গেলে যদি অসুস্থ হয়ে যায়?”
“অহ আচ্ছা। তাহলে থাকুক নুপুর। তুই আয় আমার সাথে”

সত্য বুঝাতে পারছিলো না রুমানা বেগমকে যে তার এখানে থাকা টা কতটুকু জরুরী। তারপর আবার বললো,
“আসলে এখানে মাকে একা একা…”
“হয়েছে হয়েছে। গেলাম আমি। ”
হুরহুর করে রুমানা বেগম সন্ধ্যার আজানের সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপর ড্রাইভার কে ডেকে তিনি চলে গেলেন। এদিকে নুপুর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দুই তলায় নিজের রুমে এসে শুয়ে আছে। সত্য রুমে ঢুকে মায়ের পায়ের কাছে বসলো। নুপুর জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু হয়েছে?”
” না মা।”
“কিছু চাই?”
“কীভাবে বুঝলে?”
“ছোটবেলা থেকেই তো দেখছি কিছু চাইতে হলে তুই এভাবে পায়ের কাছে এসে বসিস।”
“আসলে মা….

সত্য কথাটা শেষ করার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো। নুপুর বলল,
“দেখ তো কে আসলো”
সত্য নিচে নামলো। দরজা খুললো সত্য। তারপর সে যা যা দেখলো তা দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। ব্যান্ড বেজে উঠলো। আলতাফ চৌধুরী বাইরে বের হয়ে এলেন হুইল চেয়ারে করে। জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হচ্ছে এসব?”
বাইরে থেকে আলভি ভেতরে ঢুকে সালাম করলো সত্যের দাদাকে। তিনি কিছু বুঝলেন না। উপর থেকে নুপুর শব্দ শুনে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। একে একে থাল নিয়ে লোকেরা ঘরে ঢুকছে।একটা একটা করে অনবরত থাক ঢুকছেই। কাজের মেয়ে রহিমা নুপুরকে জিজ্ঞেস করলো,
“ও আপা সত্য খালার বিয়া নাকি? এতো এতো থাল তো জামাই বাড়ি থাইকা আইসে”
নুপুর ঝাঁঝালো গলায় বললো,
“চুপ থাক তুই।”

সব থাল ভেতরে ঢুকার পর পেছন পেছন সালমান ও সুলতানা ভেতরে এসে ঢুকলো। সুলতানা ঢুকেই সত্যকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। সালমান পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। সালমানের পাশে একটা চিকন করে সুন্দর চশমা পরা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওইটা কি তাহলে আলভি?

নুপুর পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। উপর থেকে নিচে চেয়ে চেয়ে দেখলো, একী হতে চলেছে তার জীবনে?
পঁচিশ বছরের আগের লুকানো সত্য আজ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে?
নুপুর হুট করে শুনতে পেলো সেই কমনীয় সুর! পঁচিশ বছর আগের নারীকন্ঠ!
“নুপুউউর… নুপুউউউর…আমার ছোট বোন কই তুই? তোর বড় সতীন এসেছে। নুপুর….”

লেখা: Midhad Ahmed
#দ্বিরাগমন
#পর্ব_২৮

সুলতানার ডাকে নুপুর দাঁড়িয়ে গেলো। সত্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সুলতানার দিকে। সে বুঝে উঠতে পারছে না, আলভির মা তার মাকে সতীন বলে ডাকছে কেনো। পাশে থাকা আলতাফ চৌধুরী সুলতানাকে বললেন,
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। নুপুরকে সতীন বলছেন কেনো?”
সুলতানা কান্নাভেজা গলায় আলতাফ চৌধুরীকে বললো,
“আমার ছোট বোন। আমার সতীন। আমার সবকিছু নুপুর।”
তারপর হেঁটে হেঁটে সিঁড়ির সামনে গিয়ে সুলতানা ডাক দিলো,
“নুপুর, নুপুর আসবি না তোর বোনের কাছে? নুপুর?”
নুপুর পেছন ফিরে তাকালে। আকাশী রঙা শাড়ি, হাতে চুড়ি, গলায় চেইন পরা, শ্যামলা বর্ণের সেই পঁচিশ বছর আগেকার সুলতানা আপা আর এখনকার সুলতানা আপার মধ্যে বিস্তর তফাত। গাল তার কুচকে গিয়েছে। মাথার সবকটা চুল সাদা। চোখের চশমার সাথে চেইন জড়ানো। হাতে একটা পার্টস ব্যাগ, আর পায়ে চামড়ার জুতা। ঠিক একজন শিক্ষিকা যেমন তেমন দেখতে।
নুপুর আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। জড়িয়ে ধরলো সুলতানাকে। সুলতানার কান্নায় শব্দ লোপ পেলো। নুপুর ধড়ফড় করে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সত্য কিছুর কোনো মিল খুঁজে পেলো না। সুলতানা নুপুরের গাল ধরে বললো,
“আমাদের ছেড়ে একা থাকতে তোর কষ্ট হলো না? এই পঁচিশ টা বছর তোকে কত খুঁজেছি জানিস?”
নুপুর জবাবা দিলো না। সুলতানা নুপুরের হাত ধরে মাঝখানে নিয়ে গেলো। সালমানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সুলতানা সালমানকে বললো,
“এই দেখো নুপুর। তোমার ছোট বউ নুপুর। ছেলে হয়নি বলে যেই মেয়েকে অস্বীকার করেছিলে স্ত্রী বলে, যে মেয়েটার কোলে জন্ম নেওয়া তোমার নিজের মেয়েকে অস্বীকার করেছিলে সেই সত্য আজ একজন ডাক্তার। নুপুর আজ জয়ী হয়েছে।”

সালমানের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরলো। সালমান বাকশূন্য হয়ে গেলো। সত্য নুপুরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মা কী বলছেন উনি? আর উনি আমার বাবা?”
নুপুর কোনো উত্তর দিলো না। সত্য নুপুরের মুখে ধরে বললো,
“কী হলো মা? উত্তর দাও! উনি আমার বাবা?”
নুপুর এবারও নির্বাক। সুলতানা এসে নুপুরের হাতে ধরে সালমানের সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে বললো,
“হ্যাঁ মা। উনি তোর বাবা। তোর সেই বাবা যে তোকে পঁচিশ বছর আগে অস্বীকার করেছিলো। সেই বাবা যে তোর মায়েদের জীবনে সম্মান দিতে জানতো না। সেই বাবা, যেই বাবার ভালোবাসা ছাড়া তুই বড় হয়েছিস”

সত্যের চোখ বেয়ে কান্না নেমে আসলো। সত্য পেছনে নেমে এসে আলতাফ চৌধুরীর হুইল চেয়ার ঘেষে মাটিতে বসে পড়লো। আলতাফ চৌধুরীকে বললো,
“দাদা, একি বলছেন উনি? ওই লোকটা কে?”
আলতাফ চৌধুরীও নির্বাক!
সত্য গলা ফাটিয়ে কান্না করতে করতে বললো,
“উনি কে? আমি কে? আমার সত্যটা কী?”
তারপর নুপুর দাঁড়িয়ে আলভির সামনাসামনি গেলো । আলভির কলারে ধরে বললো,
“আলভি তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তুমি বলো আমি কে?”
আলভিও নির্বাক। সত্য আলভির ঝাপটে ধরে চিৎকার করতে করতে বললো,
“আমি কে…আমি কে… আমি কে…”
তারপর সত্য ঢুকরে কেঁদে উঠলো। আলভির শার্টের বুকে মাথা লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। সহসাই আবার আলভিকে দূরে ঠেলে দিলো সত্য।” না না বলে উঠলো মনে মনে।”
তারপর আলভিকে বলল,
“তাহলে তুমি কে? আমি কে? আমরা কে?”
মায়ের সামনে গেলো সত্য। মাকে নিজের দিকে তাক করে বললো,
“আমি কে? মা আমি কে বলো?”
নুপুর কান্না করেই চলছে নিচের দিকে চেয়ে। সত্য গলার জোরে বলল,
“পাপ? এজন্যই আমার আর আলভির বিয়ে পাপ পাপ করে বেড়াচ্ছিলে তুমি?”
নুপুর এবারও জবাব দিলো না। সত্য কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি জবাব চাই। আমি আমার অস্তিত্ব জানতে চাই। আমি বাঁচতে চাই। আমি কে মা? মা আমি কে? আমার পরিচয় কী?”
কান্নায় গড়িয়ে পড়লো সত্য মাটিতে। অবচেতনা যেনো সত্যকে জড়িয়ে ধরেছে।

সুলতানা এসে নুপুরের সামনে দাঁড়লো। নুপুরকে বললো,
“বল! তাকে সত্যটা বল এবার।”
“কী বলবো আমি?”
“এইযে সালমান তার বাবা। আমি তার সৎ মা।”
“আর আলভি?”
এই কথা বলতেই সুলতানা চুপ করে গেলো। নুপুর জিজ্ঞেস করলো,
“আলভি কে? সে কার সন্তান?”
সুলতানা জবাব দিলো না। নুপুর কান্না করতে কর‍তে বলল,
“যেই সত্য আজ এতোদিন থেকে আমি চাপা দিয়ে রেখেছিলাম সেই সত্য আজ নতুন করে বের হচ্ছে। এই সত্য আমি চাইনি প্রকাশ করতে আমি চাইনি!”
সালমান সামনে এসে দাঁড়ালো নুপুরের। মাথা নিচু করে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও নুপুর।”
নুপুর কোন কথা বললো না। সালমান বললো,
“আমার জীবন সত্যকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও”
না… না… না…
বলতে বলতে নুপুর গিয়ে ঝাপটা মেরে জড়িয়ে ধরলো সত্যকে। কেমন যেনো ঘোর ঘোর থেকে বলে উঠলো,
“হবে না হবে না। আমার মেয়েকে আমি দিবো না।কখনোই না। এই সত্য আমি কখনোই প্রকাশ করবো না।”
তারপর সালমানের সামনে সুলতানা নুপুরকে নিয়ে গিয়ে বললো,
“এই তোর বাবা। যেই বাবার সত্য তুই জানতে চাস, সেই বাবা আজ তোর সামনে দাঁড়িয়ে।
সত্য বললো,
” না না। এইটা হতে পারে না। ”
তারপর মায়ের সামনে গিয়ে বললো,
“মা তুমি একবার বলো এই লোকটা আমার বাবা না।”
নুপুর কান্না থামাতে পারলো না। সত্য আবার বলল,
“মা একবার বলো না এই লোকটা আমার বাবা না।”
নুপুর সত্যকে জোরে ধরে বলল,
“এই লোকটাই তোর বাবা। এই লোকটাই তোর বাবা”

সত্য পেছনে নেমে আসলো। না। এটা হতে পারে না। কখনোই না। আমার সত্য? আমার পরিচয়? আমার বাবা বেঁচে আছে? পঁচিশ বছর আমি কী জানলাম? আমার সত্য এটাই? না না। এইটা হতে পারে না। কখনোই না। এই সত্য আমি মানি না। না না এই সত্য আমি মানি না। না না।
সত্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে তার রুমে উঠে আসলো। দরজা লাগালো। বিছানায় শুনে কান্না করতে লাগলো। বিরবির করে বলতে লাগলো “আলভি কে? আমি কাকে ভালোবাসলাম? আমার সত্য কী? না না। এ আমার বাবা হতে পারে না। কখনোই না। মা মিথ্যা বলছে। কখনোই না। এই লোকটা আমার বাবা না।

এদিকে টিভিতে খবরে দেখা গেলো টিভি রিপোর্টার বলছে,

“গতকাল দেয়া জবানবন্দিতে তারানা তার স্বামীকে হত্যা করার ঘটনা স্বীকার করেছে।”

টিভি রিপোর্টারের এই কথা শুনে ড্রইংরুমে থাকা সুলতানা আর সালমান অবাক হয়ে টিভিতে তাকালো। সেখানে তারানার ছবি দেখা যাচ্ছে। সুলতানা নুপুরকে জিজ্ঞেস করল,
“এই আমাদের তারানা না?”
নুপুর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। সুলতানাকে নুপুর জিজ্ঞেস করলো,
“তারানা আমাদের বাসায় থাকে, আর তোমরা?”
সুলতানা জবাবা দেয়ার আগেই তারানার জবানবন্দি টিভিতে প্রচার করা হলো। তারানার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কান্না করতে করতে তারানা বলে উঠলো,
“আমি রাফির উপর অসহ্য হয়ে গিয়েছি। ভালোবেসে বিয়ে করেছি আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। এই পঁচিশ বছরের সংসারে আমি পঁচিশ দিনের জন্যও সুখ পাইনি। আমার দুই ছেলেমেয়ে আছে, তাদের কী হবে আমি জানি না। তবে আমি যা করেছি তা ঠিক করেছি। আমি স্বীকার করছি আমি আমার স্বামী রাফি আহমেদকে খুন করেছি”

সুলতানা আমতা আমতা করে নুপুরকে বলল,
“আমাদেরকে সেই বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলো তারানা।”
নুপুর বিস্ময়ের চোখে তাকালো সুলতানার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“মুনা..! মুনা কেমন আছে? কোথায় আছে?”
সালমান মুনার নাম শুনে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। সুলতানা বললো,
“নাইরে! মুনা আর বেঁচে নাই। তুই যাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় মেয়েটা মারা গিয়েছে।”
“মা?”
“নাই। কেউ নাই। এই পঁচিশ বছরে আর কেউ কাওকে দেখিনাই রে বোন কেউ না।”

নুপুরের চোখ দিয়ে কান্না ঝরছে। টিভির রিপোর্টার বলে উঠল,
“আসামীর পক্ষে পুলিশের বাদি হওয়া মামলা রয়েছে। তার পরিবারের পক্ষে আপিল করা হয়নি তবে আমাদের ধারণা, আদালত এই হত্যা মামলার পক্ষেই রায় দিবে। আর এভাবে স্বামীহত্যার জন্য তারানা তার উপযুক্ত শাস্তিও পাবে। হয়তোবা সেই শাস্তিটা মৃত্যুদন্ডও হতে পারে।”

লেখা: Midhad Ahmed
#দ্বিরাগমন
মিদহাদ আহমেদ
#পর্ব_২৯

সুলতানা নুপুরকে জিজ্ঞেস করলো,
“তারানা বিয়ে করেছে?”
নুপুর সুলতানার এই কথা শুনে অবাক হলো। চোখ দুইটা বড় বড় করে সে বলল,
“মানে? তারানা বিয়ে করেছে কী না সেটা তুমি জানো না আপা?”
সালমান পাশে থেকে উত্তর দিলো
“আমি জানতাম তারানা নতুন বিয়ে করেছে। জীবনে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাকে। তোমাকে, তোমাদেরকে। তাই আর এই জীবনটা তারানার সুখে কাটুক সেই আশায় জেনেও না জানার বাহানায় ছিলাম এতোদিন। তবে এখন আর সেটা গোপন রাখা সম্ভব হলো না।”

সত্য উপর থেকে নিচে নেমে এলো। সালমানের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার বাবা কে?”
সালমানের চোখ দুইটা জলে টলমল করে উঠলো। সালমান সত্যকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি তোর বাবা রে মা। আমিই তোর বাবা।”
সত্যকে সালমান জড়িয়ে ধরলে সত্য আর দূরে সরে যায়নি। জীবনে প্রথমবারের মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরে, বাবার যে পরশ সে পেয়েছিলো, সেই পরশটা তাকে অদ্ভুত এক রকমের প্রশান্তি দিয়েছিলো। নুপুর সুলতানাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে গেলো। পাশ থেকে আলভি বলল,
“হয়েছে হয়েছে। এখন আমার সত্যটাও সত্যকে জানানো উচিত। তাইনা?”
সত্য বাবার বুক থেকে মুখ তুলে তাকালো আলভির দিকে। নুপুর ভাবান্তর চোখে সুলতানার দিকে তাকালো। সুলতানা এগিয়ে গিয়ে সত্যের চিবুক ধরেরে বলল,
“মারে আলভি আমার ছেলে না।”
নুপুর অবাক হলো। সত্য জিজ্ঞেস করল,
“আলভি কে?”
নুপুর এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
“আলভি কে?”
সুলতানা আবার বলল,
“আলভি আমার ছেলে না। আমি কখনোই মা হতে পারব না”
নুপুর একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। যে ভাবনা তাকে ভর করেছিলো সত্য আর আলভির ভালোবাসা একটা পাপ সেই ভাবনা তাকে আর আচ্ছন্ন করছে না। আলভির মুখে হাসি। সত্য আলভিকে জিজ্ঞেস করল,
“কী সত্য? আমি জানতে চাই।”
নুপুর সুলতানার সামনে গিয়ে আলভির দিকে আঙুল তুলে বলল,
“কে আই আলভি?”
সুলতানা নুপুরকে বলল,
“আমার ছেলেটার চোখের দিকে তাকা রে বোন। এই চোখটা তোর পরিচিত পরিচিত মনে হয় না?”
নুপুর সুলতানার কথায় আলভির দিকে তাকালো। আলভির চোখ দুইটা ইষৎ কালো। এই কালোর চারিদিকটা ঘন পাপড়িত বদ্ধ। সুলতানা নুপুরকে জিজ্ঞেস করল,
“বুঝা যায়?”
“কী?”
“চোখ”
“না”
“ভালো করে দেখ বোন।”
নুপুর আলভির সামনে গেলো। ঘন পাপড়ি আর ভ্রু!ঠিক একই ধাচের! সেই পঁচিশ বছর আগেকার! কী দেখছে সে? এইটা কি সত্য?
নুপুর সুলতানার সামনে গেলো। বলল,
“এইটা….”
“হ্যাঁ এইটাই। ঠিক ধরেছিস তুই!”
“মানে? ও? আমাদের ছেলে? আমাদের?”
“হ্যাঁ রে বোন। আমাদের সন্তান। আমাদের।”

নুপুর জড়িয়ে ধরল আলভিকে। আলভি নুপুরকে সালাম করলো পায়ে ধরে। সালমান বলা শুরু করল

“মুনার বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছিলো। বাচ্চাটা জন্মেছিলো সুস্থ! মহান আল্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আমার বাচ্চাটা ভালো রেখেছিলেন তখন। আমি আর তারপর মুনার লাশ নিয়ে ঘরে গিয়েছিলাম। বাচ্চাটাকে নেইনি। আজ দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে মুনার এই ছেলেটাকে নিজের ছেলে বলে বড় করছি।”
আলভি সালমানের পাশে গেলো। জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবা কখনোই এরকম কথা বলবা না।”
তারপর সুলতানার হাতে হাত রেখে আলভি বলল
“এই আমার বাবা আর এই আমার মা। আমার জীবন বলতে এরাই। আমার আর কেউ নাই।”

সত্য আর নুপুরের চোখে খুশির ঝলমল হাসি। সুলতানা নুপুরের সামনে এসে নুপুরকে হাত ধরে সোফায় বসালো। তারপর বলল
“আজ আবার সেই পঁচিশ বছর পর আমি আমার পরিবার নিতে চলেছি। এক করতে চলেছি। আগে আমরা সতীন ছিলাম আজ আমি তোর মেয়েকে আমার ছেলের বউ করতে এসেছি। আমাকে সেই মর্যাদাটা দে বোন।”
নুপুর সত্যের দিকে তাকালো। সত্যের মুখে হাসির রেখা। নুপুর সুলতানাকে বলল,
“মেয়ে তোমারও আপা। এই অধিকার টা তোমাকেই দিলাম। তুমি যা বুঝো তাই হবে। তবে আলভি তো সত্যের চেয়ে এক বছরের ছোট!”
সালমান পাশ কাটিয়ে বলল,
“ভালোবাসায় আজকাল আর এসব দেখতে নেই।”

আলভির দিকে তাকালো নুপুর। আলভি মুখ নিচের দিকে করে তাকিয়ে আছে। নুপুর আলভির সামনে গিয়ে আলভিকে বলল,
“মামিকে শাশুড়ি বলে ডাকতা পারবা এখন?”
লজ্জায় আলভি লাল হয়ে গেলো। সুলতানা বলল,
“নুপুর মা তো একই রয়ে গেলাম। তবে সম্পর্কে আমাকে মামিও ডাকতে পারো।”

সালমান কড়া গলায় বলল,
“আলভি আমাদের মামা মামি ভাবেনি কখনো। বাবা মা ভেবেছে। তার এই ভাবনার সম্মান আমি জানি।”

আলভি মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভালোবাসি মা। খুব ভালোবাসি।”

সুলতানা ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে সত্যের হাত সামনে এনে সত্যের হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলো। সত্য সুলতানাকে সালাম করলো। সুলতানা নুপুরকে বলল,
“আমার ঘরের বউ আজ তোর কাছে আমানত রাখলাম রে বোন। আমি চট্টগ্রামে সব আয়োজন করে তোকে জানাবো”

“বাহ বাহ! আয়োজন? আমার ঘরের বউ? এতোদিন কোথায় ছিলো? আপনারা বড় করেছেন তাকে? আর এই নুপুর, ঠিক ই আসল রূপ দেখিয়ে দিলি? এতোদিন আজ পঁচিশ বছর আগে যখন মাথার উপরের ছাদ ছিলো না তখন কে তোকে আশ্রয় দিয়েছে? শীতের রাতে যখন চারদিনের শিশুকে নিয়ে আমার ঘরে এসেছিলি তখন এরা কোথায় ছিলো? আর আজ নতুন ঘর সংসার সব হয়ে গেলো? তোর সত্যকে কে বড় করেছে? আজ সে ডাক্তার হয়েছে। এখন বিয়েটা তুই দিবি? তোর সেই আগের ফেলে রাখা পরিবারের সাথে? বাহ! এতো সকাল বদল ধরলি তুই? বাহ বাহ!”

কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন রুমানা বেগম। নুপুর আমতা আমতা করে মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
” মা উনি সুলতানা আপা। উনি সালমান”

“ব্যস! আর বলতে হবে না। দিনশেষে নিজের লোকদের জোগাড় হয়ে গিয়েছে।”
তারপর রুমানা বেগম স্বামীর হুইল চেয়ারের সামনে গিয়ে বললেন,
“দেখেছো? পঁচিশ বছরের সব এক মুহূর্তেই শেষ? আর নুপুর তার মেয়ের বিয়ে দিবে। আসলে অন্যের মেয়েকে বড় করাটা আমাদের উচিত হয়নি। আজ তার মেয়ে ডাক্তার হওয়ায় আসল চেহারা দেখাল। দেখলে তুমি?”

আলতাফ চৌধুরী বললেন,
“ইশ বন্ধ করে রুমানা।”
“বন্ধ করবো কেনো? বন্ধ করবো কেনো? আমার নাতির সাথে সত্যের বিয়ে দিতে চাইছিলাম না আমি? সেই চাওয়াটা কি হলো? কী হলো এখন? পরিণাম কী হলো?”
“মুখ বন্ধ করবে তুমি?”
“না আমি বন্ধ করবো না।”

এই বলে রুমানা এগিয়ে গেলো সত্যের দিকে। সত্যের হাত থেকে চুড়ি দুইটা খুলে নিলেন রুমানা বেগম। তারপর নিজের হাতের দুইটা বালা সত্যের হাতে পরিয়ে দিয়ে, সুলতানার পরানো চুড়ি দুইটা মাটিতে ফেলে রুমানা বেগম বললেন,
“আমার নাতি আরিয়ান ছাড়া সত্যের আর কারো সাথে বিয়ে হতে পারে না।”

সত্যের এক হাত ধরে টেনে সত্যকে নিয়ে উপরের তলায় উঠতে লাগলেন রুমানা বেগম। পেছনে ফেলফেল চোখে সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সত্য বারবার বলছে,
“আমাকে ছাড়ো দাদি। আমি আলভিকে ভালোবাসি। আমি তাকে ভালোবাসি দাদি…”

[এই প্রথম গতকাল দ্বিরাগমন পোস্ট দেওয়া মিস করলাম। এর আগের দেওয়া ২৮ টা পর্বের একটা পর্বও প্রতিদিন দেয়া মিস হয়নি। তবে দুঃখের বিষয়, এই একদিন হুট করে বন্ধ হওয়ার কারণ কেউ জানতে চাইলেন না। অসুস্থও হতে পারি, দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে, অথচ কেউ জানতে চাইলেন না। তবে হ্যাঁ, বেশ কয়েকজন ইনবক্স করেছন, জানতে চেয়েছেন, জেনেছেন আমি অসুস্থ কী না! এটা ভালো লাগায় আমাকে ভীষণ। রোজরোজ হাজার জন একটা পর্ব পড়লেও সত্যিকার অর্থে লেখকের খোঁজ বা ভালো চাওয়াটা হাতে গুণে কয়েকজন করেন। যেই কয়েকজন আমি গতকাল খুঁজে পেয়েছি। ভালোবাসা ভীষণ। হ্যাঁ সুস্থ আছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার জন্মদিন ছিলো গতকাল। তাই লিখার সময় পাইনি। দোয়া রাখবেন আর লেখার বিনিময় হিসেবে শুধু ভালোবাসাটুকু চাই। যেইটা ভীষণ জরুরি আমার জন্য। দোয়া রাখবেন। ভালোবাসা]

(চলবে)
(চলবে)
(চলবে)
(চলবে)
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here