#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_৬
#লেখায়_জারিন
২৭.
বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছে ইরিন।সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে কিছুক্ষণ হলো বাড়ি ফিরেছে সে। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে।তাই ফ্রেশ হয়ে এসে এক কাপ চা নিয়ে বসেছে খাটের সাথে লাগোয়া জানলার ধারটায়। আকাশে হালকা হালকা মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামার আভাস দিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া। আকাশ পানে তাকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে এইসব মেঘেদের চলাচল দেখছে ইরিন । তুলোর মত মেঘগুলো কি সুন্দর করে গা ছেড়ে দিয়ে হাওয়ায় ভাসছে। যেন এদের চাইতে সুখী আর কেউ নেই। কোন দুঃখ নেই, কোন কষ্ট নেই। আর না আছে কোন পিছুটান। কেবল রাত দিন বিশাল আকাশজুড়ে ঘুরে বেড়ানো। মানুষের জীবনটাও যদি এমন হতো! মেঘেদের মতই গা ভাসিয়ে চলতো। কষ্ট হলেই আকাশের বুকে মুখ লুকিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝড়তো।কিংবা রাতের অন্ধকার আকাশে মিশে গিয়ে নক্ষত্র বন্দনায় মত্ত হতো।কখনো জ্বলজ্বল করা নক্ষত্রের আলোয় নির্ভয়ে ভেসে বেড়াতো অন্ধকার আকাশের কোলজুড়ে। নয় তো কখনো বা নিষ্প্রভ নক্ষত্রকে আগলে নিত নিজের প্রশস্থ বুকে। বলতো, তুমি আলোহীন….তাই আমিও নিকষ কালো আঁধারে ডুবে রই। দেখো, দুজনেই এক। মিশে থাকি একসাথে।এক আকাশে……একই অস্তিস্ত্বে।
এসব ভাবতে ভাবতেই চায়ের কাপে একে পর এক চুমুক দিচ্ছিল ইরিন। হঠাৎ বেখেয়ালিভাবে কিছুটা চা কাপ থেকে ছলকে পড়লো ওর বাম হাতে। চা খুব গরম না হলেও আঁচ ভালোই লেগেছে হাতে। কাপ রেখে দ্রুত ওড়না টেনে মুছতে শুরু করলো। মুছতে গিয়ে চোখ আটকে গেল বা’হাতের অনামিকায় ঝলঝম করা হীরের আংটিটার দিকে। একধ্যানে চেয়ে রইলো সে আংটিটা দিকে। সেই সাথে একে একে মস্তিষ্কে ভীড় করতে থাকে কিছু স্মৃতিকথা।
২৮.
বৌভাতের দিন সকালের ওই ঘটনার পর নক্ষত্র ওকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে । ঘরে আগে থেকেই রিতু, অদ্রিজা ও কনক বসা ছিল। নক্ষত্র মূলত রিতুর জন্যই ইরিনকে খুঁজতে এসে ওমন ঘটনার সম্মুখিন হয়। আফিয়ার চেঁচানো শুনেই নক্ষত্র বুঝে গেছিল ইরিনকে নিয়ে কিছু ঘটেছে। বাড়তি সিনক্রিয়েট যেন না হয় তাই কথা না বাড়িয়ে সোজা ইরিনকে ঘরে নিয়ে আসে। নীচে ঘটা ঘটনায় ইরিন এতটাই অন্যমনষ্ক হয়ে ছিল যে নক্ষত্র এই প্রথম ওর হাত ধরেছে সেটা ও দেখলেও সেভাবে খেয়াল করেনি। ঘরে আসতেই সবাই কে দেখে ঘোর কাটে ইরিনের। নক্ষত্র তখনও ওর হাত ধরে। সেটা খেয়াল হতেই বিরক্তির সাথে সজোরে টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল। ইরিনের এমন ব্যবহারে নক্ষত্র কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মুখে শান্তভাব থাকলেও ভেতর ভেতর রাগে দপদপ করছিল নক্ষত্র। তাই ইরিনের এই কাজটাকে সে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। বরং তার ভরাটা গলার স্বরে আরও খানিকটা গম্ভীরতা ঢেলে বলে ইরিনকে বললো, ‘ইরিন, আমি বারোচ্ছি…একটা কাজে। আমি বাড়ি না ফিরা পর্যন্ত এই ঘর থেকে কোথাও যাবে না তুমি। ‘
ইরিন কিছু বললো না নক্ষত্রের কথার বিপরীতে। ওকে চুপ থাকতে দেখে আর কথা বাড়ালো না। অদ্রিজা ও কনককে ইরিনের।সাথেই থাকতে বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
পুরো সকাল ইরিনের ঘরেই কাটলো। নতুন বউ এত বেলা করে এভাবে ঘরে বসে আছে, এই নিয়ে কাটক্ষও হলো আত্মীয়দের মাঝে।নতুন বউ দেখতে ঘরে এসে কেউ কেউ দু একটা কথাও শুনিয়ে গেছে এ নিয়ে। ইরিনের ভীষণ লজ্জা, অস্বস্তি হওয়া স্বত্তেও নক্ষত্রের কথার অবাধ্য হলো না। সকালের ঘটনার পরে শায়লা এসেছিলেন খাবার নিয়ে। তিনিও বলে গেছেন নক্ষত্র না আসা পর্যন্ত যেন নীচে না যায়। অগত্য ইরিনকে ঘরেই থাকতে হয়েছে সারা সকাল।
২৯.
নক্ষত্র বাড়ি ফিরলো দুপুরের দিকে। ঘরে ফিরে দেখলো ঘর পুরো ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। মেজাজ খারাপ হলো নক্ষত্রের। ইরিনকে খুঁজতে যেই না ঘর থেকে বের হবে বেলকোনির থাইগ্লাসের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো ইরিন। ওকে দেখে নিজ জায়গায় নিরব মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো নক্ষত্র। ইরিনের কার্যকাল দেখতে লাগলো সন্তপর্ণে।
চুলে প্যাঁচানো টাওয়ালটা খুলতে খুলতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ইরিন। সবুজ রঙ এর একটা শাড়ি পড়েছে সে। গায়ে কোন গয়না নেই। আর না আছে কোন প্রসাধনীর ছোঁয়া। একদম নিঁখাদ স্নিগ্ধতায় ঝলমল করছে তার ফর্সা শরীর। ঘাড়ে, পিঠে এখনো বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। তাতে বেলকোনি ভেদ করে আসা দুপুরের সোনালী রোদ্দুরের ছঁটা যে আরও বেশি আকর্ষণী করে তুলেছে তার এই রূপকে। কাঁধের দিকে খানিকটা ব্লাউজ ভিজে আরও গাঢ় হয়ে ফুটে উঠেছে। একদম সবুজ প্রকৃতির মতই উচ্ছল, সতেজ ও স্নিগ্ধ লাগলো ইরিনকে নক্ষত্রের সদ্য সদ্য প্রস্ফুটিত প্রেমিক চোখে। মৃদু হাসলো সে। এই স্নিগ্ধা নারীটি আজীবনের জন্য তার। যদিও সে কিছুটা দ্বিধান্বিত যে ইরিন ওকে পছন্দ করে কিনা তবুও বিয়ে তো হয়েই গেছে। নক্ষত্রের সবটা জেনে বুঝেই ইরিন তাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে। তার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে সম্পূর্ণ করেছে তাকে। এখন তাকে(ইরিন)সব দিক থেকে আগলে রাখার দায়িত্বটা তার। যে অভাবটুকুর সাক্ষী সে হয়েছিল কোন এক কালে,সেই অভাবের রেশটুকুও যেন ইরিনকে না ছোঁয় সেটার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখবে সে। মনে মনে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলো নক্ষত্র।
পরক্ষণেই ইরিনের দিকে এগিয়ে গেল সে। পেছন থেকে ডাকলো, ‘ইরিন!’
ঠোঁটে লিপজেল লাগাচ্ছিল ইরিন। নক্ষত্রের আচমকা ডাকে চমকে উঠলো কিছুটা। আয়নায় নক্ষত্রকে প্রায় নিজের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল সে। নিজেকে ধাতস্ত করেই জবাব দিল, ‘জ্বী’?
এবার পেছন থেকে এগিয়ে গিয়ে সরাসরি ইরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো নক্ষত্র। হাতে থাকা শপিংব্যাগগুলো ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে তা থেকে একটা বক্স বের করে তা মেলে ধরলো ইরিনের সামনে। ইরিনকে দেখিয়ে বললো,
‘পছন্দ হয়েছে?’
ইরিন অবাক হয়ে জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা চেইন, তার মাঝে একটা গোল পেন্ডেন্ট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে হীরার ওপর স্বর্ণ খঁচিত পেন্ডেন্টটা। সাথে একই রমক দেখতে দুটো দুল। হালকা ধরণের গহনা সব। স্বাচ্ছন্দ্যে সারাক্ষণ পড়ে থাকা যাবে। দেখতেও অনেক অভিজাত ও সুন্দর। খুশি হলো ইরিন। মনে মনে সে এটা স্বীকার করতে বাধ্য হলো, নক্ষত্রের পছন্দ খুবই ভালো। কিন্তু মূহুর্তেই আবার মন খারাপ হয়ে গেল তার। এই ভেবেই যে, মানুষটার প্রতিটা পছন্দই একদম দেখার মত, অথচ মানুষটাকে দেখতে..!
চাপা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নক্ষত্রের দিকে তাকালো ইরিন। তাকে এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিল। বিষন্ন স্বরে বললো, ‘হু’।
‘গ্রেট। তাহলে…এখন থেকে বাসায় এগুলোই পড়বে। আরও কিছু লাগবে বলবে। এসব ছাড়াও তোমার যখন যেটা প্রয়োজন হবে বলবে। আমি এনে দিবো। কিন্তু তোমার গা যেন কখনো খালি না থাকে। কেউ যেন তোমাকে কোন ব্যাপারে কিছু বলার সুযোগ না পায়। মনে থাকবে?’ একপর্যায়ে কিছুটা আদেশের স্বর ভেসে এলো নক্ষত্রের কথায়।
ইরিন কোনরূপ দ্বিরুক্তি ছাড়াই বললো, জ্বী, মনে থাকবে। ইরিনের সন্তোষজনক জবাবে মুচকি হাসলো নক্ষত্র। কিন্তু, তা ইরিনের চোখে পড়লো না। কারণ, সে নতমুখ করে দাঁড়িয়ে আছে নক্ষত্রের সামনে।
তারপর, ওই বক্সটা রেখে অন্য একটা ব্যাগ হাতে নিল নক্ষত্র। তা থেকে একজোড়া চুড়ি আর একটা আংটি বের করলো। কোন রকম কোন জড়তা ছাড়াই ইরিনের হাত টেনে নিয়ে চুড়ি দুটো পড়িয়ে দিল ওর হাতে। নক্ষত্রের এমন কাজে হকচকিয়ে গেল ইরিন। কিন্তু, বাঁধা দিতে পারলো না কেন জানি। ওর মন সায় দিল না এ কাজে।
খুব যত্ন করে চুড়ি দুটো ইরিনের হাতে পড়িয়ে দিয়ে হাত দুটো উঁচু করে ধরে দেখলো। ইরিনও তখন নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে।ওর হাবভাব পরখ করতে ব্যস্ত।
‘তোমার সব গয়নাই নতুন দিয়েছি ইরিন। শুধু এই চুড়িগুলো ছাড়া। এগুলো আমার মায়ের চুড়ি। পুড়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছিল অনেকটাই। তাও আমি জুয়েলার থেকে ঘেঁষে মেজে তোমার হাতের সাইজ মত গড়িয়ে দিয়েছি । পুরোটা না হোক, কিছুটা হলেও এগুলো মায়ের চুড়িই। অযত্ন করোনা এগুলোর, প্লিজ। ‘
ইরিন খেয়াল করলো নক্ষত্রের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এসেছে। ইরিনের কি হলো কে জানে…নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কখনো অযত্ন করবো না। ‘
নক্ষত্র তখনো ইরিনের হাতগুলো নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে। তাকিয়ে আছে ইরিনের কব্জিতে পড়ে থাকা চুড়িগুলোর দিকে। ইরিনের কথায় রাজ্যের প্রশান্তি খেলে গেল ওর মনে। আস্তে করে ইরিনের ডান হাতটা নামিয়ে রাখলো। ছোট বক্সটা থেকে একটা হীরার আংটি বের করে ইরিনের অনামিকায় পড়িয়ে দিতে দিতে বললো, ‘বিয়ের আংটিটা অনেক বড় ইরিন। ওটা আর বাসায় পড়ার দরকার নেই। এখন থেকে এটা পড়ে থাকবে। দেখতো ভাল্লাগছে কিনা ডিজাইনটা। নইলে চেঞ্জ করে এনে দিতে পারি। সমস্যা নেই। ‘
ইরিন তাকিয়ে দেখলো এটাও হীরার। মনে মনে আউড়ালো সে, ‘এই লোক কি হীরা ছাড়া কিছু বুঝে না নাকি! এত টাকা খরচ করে সব হীরার জিনিস কিনেছে। আক্কেল নাই কোন। টাকা কি গাছে ধরে নাকি! ‘
‘কি হলো…ভাল্লাগেনি?’ নক্ষত্রের প্রশ্নে ভাবনাচুত্য হলো ইরিন।নক্ষত্রের দিকে হকচকিয়ে তাকিয়ে দেখলো ভ্রু কুচকে বিভ্রান্ত মুখে তাকিয়ে আছে ইরিনের দিকে।চোখ নামিয়ে নিল ইরিন। আরেকবার দেখলো আংটিটাকে। সত্যিই ভীষণ সুন্দর। ওদিকে তাকিয়েই সন্তুষ্ট মনে বললো, ‘হু, খুব সুন্দর’।
ইরিনের জবাবে মুচকি হাসলো নক্ষত্র। তাকে তাড়া দিয়ে বললো, ‘ঝটপট রেডি হও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘
‘জ্বী’।
ইরিনকে তৈরী হতে দিয়ে নক্ষত্র চলে গেল ফ্রেশ হতে। সে যেতেই, সযত্নে আংটিটায় হাত বুলালো ইরিন। তারপর, এক এক করে নক্ষত্রের দেওয়া গয়নাগুলো পড়ে তৈরী হয়ে নিল মুখ দেখানোর অনুষ্ঠানের জন্য।
৩০.
সারাদিন বিভিন্ন আত্মীয়, অতিথিদের সাথে পরিচিত হতে হতে সময় গেছে ইরিনের। আর বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত বৌভাতের অনুষ্ঠানেই ব্যস্ত ছিল সে। সব মেহমান বিদায় দিয়ে তবেই কমিউনিটি সেন্টার থেকে বাড়ি ফিরেছে ওরা সবাই।
টানা দু/তিন দিনের লাগাতার এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের কারণে শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছে পুরোপুরি। বড্ড ক্লান্ত সে। এখন ঘুমের খুব প্রয়োজন। তাছাড়া, সারাদিন আর বিছানায় গা ঠেকানোর সুযোগ হয়নি ওর। তাই, ফ্রেশ এসেই কোন কিছু না ভেবেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। নরম তুলতুলে বিছানা পেয়ে ঘুম যেন আর বাঁধ মানলো না। একেবারে উপচে পড়ে ইরিনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
নক্ষত্র ঘরে ফিরে দেখলো পুরো ঘর অগোছালো। ইরিনের লেহেঙ্গা, গয়নাগাটি, জুতো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিছানার এক কোনায় প্রায় অনেকটা ঝুলেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ইরিন। নক্ষত্র প্রায় অনেকগুলো বছর ধরে একলা থেকে অভ্যস্ত। তাই নিজের কাজ নিজে করার পাশাপাশি বড় গোছালো স্বভাব ছেলেটার। তাই আজ নিজের ঘর এমন অগোছালো দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হলো সে। কিন্তু, ইরিনের এমন ঘুম দেখে বিরক্তিভাবটা চেপে গেল। ভাবলো, হয় তো অনেকবেশি ক্লান্ত তাই কিছুই গোছায়নি। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নিজেই সব গোছাতে শুরু করলো। সব গোছানো শেষে নিজে গেল ফ্রেশ হতে।
ফিরে এসে দেখলো ইরিন এখনো ওভাবেই ঘুমিয়ে আছে। পড়নের শাড়ির অবস্থা যাচ্ছে তাই। চট করে ওর মাথায় এলো গত রাতে ইরিন একটা গোল ছাটের লম্বা জামা পড়েছিল। তাহলে আজ শাড়ি পড়ে কেন ঘুমাচ্ছে? ইরিনের এমন অগোছালো অবস্থা দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল নক্ষত্র। চোখ সরিয়ে নিল সে। একবার ভাবলো, কাছে গিয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিবে কিনা। তারপর, কি সব ভেবে প্ল্যান বাতিল করলো। আলমারি থেকে একটা পাতলা কম্বল বের করে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল ইরিনের। মনে মনে ঠিক করলো, কালকেই কিছু সালোয়ার কামিজ কিনে আনবে ইরিনের জন্য। আর যাই হোক, শাড়ি সামলে ঘুমানো এই মেয়ের কম্ম নয়। পাছে এমন না হয় রোজ রোজ ইরিনকে এভাবে দেখে সে নিজেই বেসামাল হয়ে কিছু করে বসে। কিন্তু, যতদিন না ইরিনের সাথে তার সম্পর্কটা একেবারে সহজ হচ্ছে অন্তত ততোদিন নক্ষত্র নিজেকে সামলে রাখতে চায়। তবে, ভালো লাগার মানুষটা আর বৈধ অধিকার দুটোই যখন প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয় তখন কতদিন আর নিজেকে বেপরোয়া হওয়া থেকে আটকে রাখা যায়?
বিয়ের আগে বৈধতার অভাবে আর মনে কিছুটা সংশয় থাকায় যথাসম্ভব ইরিনকে এড়িয়ে চলেছে সে। কিন্তু, মনে মনে ঠিকই ইরিনের জন্য জায়গা তৈরী করেছে একটু একটু করে। বিয়ের পর সেই জায়গাটা পাকাপোক্ত করে যখন ইরিন তার জীবনে এসেছে ইরিনের অজান্তেই তাকে নিজের সবটা সঁপে দিয়েছে নক্ষত্র। যে নারী তার সবটা মেনে তাকে গ্রহণ করেছে তার কাছে নির্দ্বিধায় নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। ইরিন তার চোখে একরাশ স্নিগ্ধতা। এই স্নিগ্ধতায় মিশে যেতে ইচ্ছে করে বারেবারে। কিন্তু, কতদিন দূরে রাখতে পারবে সে নিজেকে এই স্নিগ্ধতা থেকে? আজ সারাদিন যতবার সে ইরিনকে দেখেছে,নিজ মনে এই আশংকাই তার উঁকিঝুঁকি দিয়েছে বারেবারে।
৩১.
মাঝ রাতে হঠাৎ বুকের উপর ভারী কিছুর আঘাতে ঘুম ভেঙে গেল নক্ষত্রের। ঘটনা কি ঘটেছে সেটা বুঝার চেষ্টা করতেই ধড়াম করে আবারও কিছু একটা এসে পড়লো তার পায়ের উপর।ঘাঁড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো ইরিন এক হাত পা নক্ষত্রের উপর তুলে দিয়ে উপুর হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ইরিনের এমন শোয়ার ধরণ দেখে পুরো আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল নক্ষত্র। কিছুটা সময় নিয়ে সামলে নিল নিজেকে। তারপর,ইরিনকে ডাকলো বারকয়েক। কিন্তু, ইরিনের ঘুম ভাঙলো না। হাল ছেড়ে দিল নক্ষত্র। না পারতে হাত ছাড়িয়ে উঠে বসলো সে। পায়ের উপর থেকে ইরিনের পা সরিয়ে ঠেলেঠুলে একপাশে চাপিয়ে শুইয়ে দিল ইরিনকে। দ্বিতীয়বার এমন ঘটার আশংকায় নিজেও এবারে একটু চেপে শুলো। এক নজর ইরিনকে দেখে ও পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল আবার।
কিন্তু, বেশিক্ষণ সে ঘুম স্থায়ী হলো না। প্রবল এক ধাক্কায় ধড়ফড় করে উঠে বসলো নক্ষত্র। চারপাশে তাকাতেই দেখলো ইরিন এবার কোণাকোণি হয়ে শুয়েছে। নড়তে গিয়েই হয় তো পা দিয়ে নক্ষত্রের পায়ে ধাক্কা মেরেছে। বেশ জোরেই লেগেছে সেটা। আবার নক্ষত্রের পায়ের উপর পা রেখেই দিব্যি ঘুমাচ্ছে সে। বোকার মত তাকিয়ে কিছুক্ষণ এ দৃশ্য দেখলো নক্ষত্র। তারপর, সাইড টেবিল থেকে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখলো। রাত ২’৪৪ বাজে। ফজরের আযান দিতে এখনো অনেকটাই দেরি। আর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু যা পরিস্থতি ঘুমানো আসলেও যাবে কিনা সেই নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান সে। তারপরেও, হতাশ হয়ে ওভাবেই সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো সে।ঘাঁড় ঘুরিয়ে ইরিনকে দেখলো। নক্ষত্রের ঘুম হারাম করে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। একদম অবুঝ শিশুর মত মুখ করে রেখেছে।
ইরিনের চোখগুলো ভীষণ সুন্দর। চোখের পাতাগুলো বেশ ঘন। টেনে কাজল পড়লে একদম ইলিশ মাছের মতো লাগে চোখগুলোগুলো। নক্ষত্র অনেক ভেবে চিনতে এই উপমাটা বের করেছে। ইরিনের গালগুলো একদম টানটান। পাতলা ঠোঁট। খাঁড়া নাক। তাতে জ্বলজ্বল করছে হীরের সাত পাথরের নাকফুল। মেদহীন ছিমছাম শরীর। ঝরঝরে মোলায়েম চুল। গড়ন গাত্রে এককথায় চমৎকার দেখতে ইরিন। অথচ, অভ্যাস দেখো…..কিভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমায়! এই বউ সামলাতে হবে এখন তাকে আজীবন। এসব ভাবতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো নক্ষত্র। এরমাঝেই আবার নড়েচড়ে নক্ষত্রের উপর হাত পা তুলে দিয়েছে ইরিন। মাথা এনে ফেলেছে নক্ষত্রের কাঁধে। অগত্যা বাকি রাতটুকু নক্ষত্রকে ওভাবেই সোজা হয়েই ঘুমহীন শুয়ে থাকতে হলো বিছানায়।
চলবে…