নাম_না_জানা_এক_পাখি পর্ব ১০+১১+১২

#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ১০

তপসী তৈরি হচ্ছে। শ্বশুর বাড়ি ফিরবে। শ্বশুর বাড়ির লোক এসেছে নিয়ে যেতে। সবার খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ হলে তপসী ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। শাড়ি পালটে নিল।

সুব্রত ঘরে ঢুকলো। সে নিজেও ড্রেস চেঞ্জ করে নিয়েছে। সুব্রত জিজ্ঞেস করলো,

—— রেডি? বাইরে কি যেন একটা কাজ বাকি আছে, কুঞ্জ তে বসতে হবে। চলো।

—— আচ্ছা আসছি।

—— ব্যাগ গুছানো শেষ?

—— হ্যাঁ।

—— বই, নোটস নিয়েছো?

তপসী অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,

—— না তো।

—— এটা কি আলাদা করে বলতে হবে নাকি?

—— আমার আর পড়ার ইচ্ছে নেই।

—— না থাকলেও পড়তে হবে।

তপসী সুব্রতের দিকে এগিয়ে এলো। অনেকটা রাগী ভাবেই বললো,

—— আমার কি আপনাদের কথাতেই চলতে হবে নাকি?

সুব্রত বিরক্ত হলো। এখানে তপসীর আপত্তি থাকার মতো কোনো কারন তো নেই। বাচ্চা মেয়ে, পড়ালেখা করবে দ্যাটস ইট। না, সে ঘাড় ত্যাড়ামি করছে।

সুব্রত রাগী গলায় বললো,

—— দেখো তপসী, যেটা উচিৎ সেটা অবশ্যই তোমাকে করতে হবে। হোক সেটা তোমার নিজের ইচ্ছায় বা আমাদের কথায়। এখানে ডিভেট করার কি আছে?

—— আমি আর পড়বো না।

—— কেন পড়বে না? একটা কারন দেখাও যে তোমার এই কারণে পড়ার দরকার নেই। এই কারণে তোমার পড়ালেখা বন্ধ করা উচিত।

তপসী চুপ করে রইলো। সুব্রত অনেকটা জোরেই বলে উঠলো,

—— হেই, স্পিক আপ। কারণ দর্শাও।

তপসী মিনমিন করে বললো,

—— আমি পড়ালেখায় কখনোই ওতো ভালো না। পরীক্ষা দিলাম, দেখা গেল রেজাল্ট মুখে না উচ্চারণ করার মতো খারাপ। আপনাদের রেপুটেশন এর কি হবে?

—— দরকার পড়লে হাজার বার এক্সাম দেবে।

—— আমার পড়ার ইচ্ছে মরে গেছে। মনে করবেন না যে বিয়ে হয়েছে বলে পড়ার ইচ্ছে নেই। আন্টির প্রতিনিয়ত চ্যাচাম্যাচী শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। একপ্রকার ডিপ্রেশড। বিয়ের সিদ্ধান্তও আমার এই জন্যই নেওয়া। আমি এ বাড়িতে আর টিকতে পারছিলাম না।
আমি সংসার করার জন্যই বিয়ে করেছি, প্লিজ আমায় সংসার করতে দিন মন দিয়ে। প্লিজ।

সুব্রত তপসীকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তপসী কান্না করছে। মেয়েটার কান্না সুব্রতের সহ্য হয় না। সুব্রত তপসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

সুব্রত ঠান্ডা স্বরে বললো,

—— দেখো তোমার বয়স কম। তোমাকে এ বয়সে বিয়ে দেওয়াটাই অযৌক্তিক ছিল। তোমায় আমি বিয়ে না করলেও কেউ একজন করেই নিতো, তাই ভাবলাম আমিই এই বাচ্চা টাকে বড় করি। এখন তোমার দ্বায়িত্ব নিয়েছি তো তা সম্পূর্ণ ভাবে পূরণ ও কর‍তে হবে।

—— আমি বলছি তো লাগবে না।

—— স্বামী ছাড়া সংসার ইজ ওয়ান কাইন্ড ওফ নিরামিষ তরকারি। আমি থাকবো না, রায়ারা চলে যাবে। বাকি থাকবে কাকি, মা আর তুলি। বাবা আর কাকা তো তোমার আউট অফ সিলেবাস। তুমি সারাদিন কি করবে? মনে করো টাইম পাস করার জন্য পড়ালেখা টা করা। আর তোমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ? তা কে করবে শুনি?

—— আমার মায়ের ডাক্তার দের দেখলেই ভালো লাগতো। এইজন্যই ইচ্ছে ছিল মেয়েকে ডাক্তার বানাবে। আমি ডাক্তার না হলেও সমস্যা নেই। ওমন কোনো জোরদার ইচ্ছে ছিল না।

—— তপসী এবার বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু। পড়ালেখা টাকে তুমি এমন হালকা জিনিস কেন ভাবছো? মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো টা কত জরুরি তুমি জানো?

—— আমার দাড়াতে হবে না।

—— আরে, এই মেয়ে তুমি পাগল?

—— আস্তে কথা বলুন প্লিজ।

—— আচ্ছা ডান। আস্তে কথা বলছি। তুমি বই গুছিয়ে নাও।

তপসী অসহায় নজরে তাকালো সুব্রতের দিকে। জিজ্ঞেস করলো,

—— বই নিতেই হবে?

সুব্রত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এই মেয়ে পড়ালেখার ব্যাপারে এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে!

১৬.
তপসীরা বাসায় ফিরে আসলো। সুব্রতের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ছুটি শেষ। কাল সকালেই ফিরে যেতে হবে তাকে। তপসীর মন বার বার বিষন্ন হয়ে পড়ছে। কেন সুব্রত চলে যাবে? কেন আর দশ পাঁচ জন মানুষের মতো প্রতিরাতে কাজ শেষে বাসায় ফিরে আসবে না?

সুব্রত ঠিকভাবে শেষ কয়েক ঘন্টা ধরে তপসীর সাথে কথাও বলছে না। সুব্রতের ভয়েই তপসী এক প্রকার বাধ্য হয়ে একাডেমিক সব বই নিয়ে এসেছে।
তার পড়ার ইচ্ছে নেই। তপসী নিজ মনেই ভাবে, সে কখনো ডাক্তার হওয়ার মতো পড়ালেখা করতেই পারবে না। তাছাড়া পড়ার মন মরে গেছে৷ এখন কি চাইলেই সব কিছু শুরু করা যাবে?

তপসীদের বাড়ি থেকে এসে সুব্রত বাহিরে চলে গিয়েছিল। রাত এখন সাড়ে এগারোটা। সবাই যার যার ঘরে ঘুমাতে চলে গেছে।

তপসী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সুব্রতের। সুব্রত কি তার সাথে রাগ করেছে? কিন্তু সামান্য এই ব্যাপারে রাগ করার কি আছে? তপসী তো বই ও নিয়ে এসেছে। তপসী ব্যালকনির দোলনায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। সুব্রত আসার আগে কোনোভাবেই সে ঘুমাবে না।

সুব্রত আসলো রাত একটার দিকে। তপসী ততক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে দোলনাতেই।
সুব্রত ঘরে এসে তপসীকে না দেখে ভয় পেয়ে গেল। কোথায় গেছে এই রাতে। ওয়াশরুমে খুঁজেও পেল না। চোখ গেল ব্যালকনির থাই এর দিকে। থাই টা লক করা না।

সুব্রত দ্রুত পায়ে সেখানে গেল। তপসী জড়োসড়ো হয়ে দোলনায় শুয়ে আছে। সুব্রতের রাগ এবার আরো বেড়ে গেল।
তপসী কে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাকলো।

—— তপসী!

তপসী লাফ দিয়ে উঠলো। সুব্রতলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিক চমকে গেল।

সুব্রত ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— এই মেয়ে, এখানে কি করো তুমি? এখানে কি কাজ তোমার?

—— আম,,,মি আসলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

—— উদ্ধার করেছো তুমি তপসী। এখন ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে আমায় আরেক দফা উদ্ধার করো।

বলেই সুব্রত ঘরে চলে এলো। তপসীর নয়ন জোড়া আদ্র হয়ে উঠলো। সুব্রতের পিছন পিছন ঘরে ঢুকলো।

সুব্রত বিছানায় শুয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ভাজ করে দিয়ে রেখেছে। তপসী গুটি গুটি পায়ে বিছানায় উঠে বসলো।
সুব্রতের কোনো নড়চড় নেই। তপসী সুব্রতের এক হাত ধরলো।

সুব্রত চোখ মেলে তাকালো। হাত ছাড়িয়ে নিলো। জিজ্ঞেস করলো,

—— কি হয়েছে?

—— আপনি খেয়েছেন?

—— জি।

—— শুনুন না!

—— প্লিজ আমার ঘুম পাচ্ছে। তোমার কথা শোনার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই এই মুহূর্তে আমার নেই।

তপসী হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। সুব্রতের পা জড়িয়ে ধরলো। কান্না মাখা গলায় বললো,

—— আ’ম সরি। আমি পড়বো। যা বলবেন তা করবো। আমায় প্লিজ দূরে সড়িয়ে দিবেন না।

সুব্রত উঠে বসলো।

—— কান্না থামাও তপসী। এই মাঝরাতে এমন মরা কান্নার মানে কি? কেউ মারা গেছে বুঝি?

—— আমার মন মারা যাচ্ছে, আমি মারা যাচ্ছি। আমার দম হয়ে যাচ্ছে। আপনি এমন করবেন না প্লিজ। আমি পড়বো। যতদিন আপনি চাইবেন। তবুও আমায় এতো কষ্ট দিবেন না।

—— কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছা নেই আমার তপসী। তোমার ভালোর জন্যই পড়তে বলেছিলাম। নাথিং এলস৷

—— আমি পড়বো তো। একদম আপনার মনের মতো বউ হবো।

—— ঘুমাও তপসী।

—— আপনি এখনো রাগ করে আছেন?

—— আমি রাগ করিই নি আগে। তোমায় ব্যালকনিতে বসে থাকতে দেখে রাগ লেগেছে। বিয়ের মাত্র কয়দিন হয়েছে, এখন এমন রাতে একা খোলামেলা জায়গায় থাকা ঠিক না বউ।

—— আমি জানতাম না।

—— ইটস ওকে। ঘুমাও।

সুব্রত শুয়ে পড়লো। তপসী সুব্রতের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো। সুব্রত আবার জিজ্ঞেস করলো,

—— বসে আছো কেন এখন আবার?

তপসী উত্তর দিলো না। সুব্রত আবার জিজ্ঞেস করলো,

—— কি ব্যাপার? বলো! কি হয়েছে?

—— কাল তো চলেই যাবেন। আজও আপনি এতো দূরে শুয়ে আছেন!

সুব্রত তৎক্ষনাৎ তপসীর কোমড় জড়িয়ে ধরলো। তপসী লজ্জা রাঙা হয়ে বললো,

—— আপনার ছুটি কি বাড়ানোর উপায় নেই?

—— ছুটি বাড়ানোর সুযোগ নেই তো।

—— আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ুন।

সুব্রত তপসীর কোলে মাথা তুলে দিয়ে বললো,

—— আজ না হয় বিনিদ্রই কাটুক সারারাত!
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা:সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ১১

১৭.
ছলছল নয়নে দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে তপসী। সুব্রত ব্যাগ গুছাচ্ছে। তপসীকে একবার বলেছিল সাহায্য করতে, তপসী এক পা ও নড়ে নি।

সুব্রতও আর কথা বাড়ায় নি। সে তপসীর মনে অবস্থা খুব করে বুঝতে পারছে নতুন নতুন বিয়ের পর স্বামীর দূরে চলে যাওয়া খুব কম মেয়েই সহ্য করতে পারে।

সুব্রতের নিজেরও মনের অবস্থা খারাপ। আগে যারা তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো এখন তাদের দলে আরেক জন যুক্ত হয়েছে। যার অপেক্ষা হয়তো সবার অপেক্ষাকে ছাড়িয়ে যাবে৷ যে হয়তো রাতে একাকী কান্না করে বালিশ ভিজাবে।

সুব্রত তপসীর দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তপসী অনবরত নাক টানছে। কান্না আঁটকে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। সবাই নিচ তলায় সুব্রতের জন্য অপেক্ষা করছে। চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে যে।

সুব্রত তপসীর দিকে তাকালো। তপসীর মুখ নাক কান্নার দমকে লাল হয়ে উঠেছে। সুব্রত কেঁপে উঠলো। পুরুষ মানুষের কান্না মানায় না। সে কিছুতেই অশ্রু বাঁধ ভাঙতে দিতে পারে না।

সুব্রত আবেগপ্রবণ হয়ে তপসীকে ডাকলো,

—— তপসী, ও তপসী। একটু আসো না কাছে। জড়িয়ে ধরো না৷

সুব্রত কণ্ঠ শোনা মাত্রই তপসী প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়লো। দরজার চৌকাঠের পাশেই বসে পড়লো কাঁদতে কাঁদতে। সুব্রত চোখ মুছলো নিজের। তার চোখের সামনে সে তপসীর এমন কান্না সহ্য করতে পারছে না।

সুব্রত নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার ডাকলো তপসীকে,

—— ও বউ। একটু জড়িয়ে ধরবে না?

তপসী দৌড়ে এসে সুব্রতের বুকে মুখ বুঝলো। তপসীর কান্নার আওয়াজ পুরোটা ঘরময় প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। সুব্রত অনবরত নিজের নয়ন মুছতে ব্যস্ত। এতো ভেঙে পড়ছে কিভাবে সে! নিজেকে সে যথেষ্ট শক্ত মনের মানুষ হিসেবেই জানতো।

তপসী বার বার সুব্রত কে আঁকড়ে ধরছে। খামচে ধরছে শার্টের কর্লার। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। সুব্রত তপসীর মাথায় চুমু দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

—— এই জন্যই তো বলি তুমি বাচ্চা। এমন করে কেউ? আমাকেও কাঁদিয়ে দিচ্ছো একদম।

তপসীর কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। হিচকি উঠে গেছে তার। সুব্রত বিছানায় বসালো তাকে। জলের গ্লাস এগিয়ে দিলো৷

তপসীর মুখের সামনে গ্লাস ধরে নিজেই জল খায়িয়ে দিল। তপসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। তপসী ধীরে ধীরে শান্ত হলো। সুব্রত কপালে চুমু দিয়ে বললো,

—— কি বলেছিলাম তোমায়? শক্ত হতে হবে তো নাকি? শক্ত হও, আমার শক্তি হও, আমার দুর্বলতা হয়ো না প্লিজ।

তপসী হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছলো। এখনো হিচকি সম্পূর্ণ ভাবে থামে নি। কোনোমত তপসী বললো,

—— আমি আপনার দুর্বলতা কখনো হবো না। ভালোবাসা, স্ত্রী কখনো কারো দুর্বলতা হয় না।

তপসী সুব্রতের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। সুব্রতকে জড়িয়ে ধরলো। একদম আষ্টেপৃষ্টে মিলিয়ে নিল নিজের সাথে।

কতোক্ষণব্যাপী দুজন আলিঙ্গনে আবদ্ধ ছিল তা হয়তো কারোই খেয়াল নেই। সুব্রত এক পর্যায়ে তপসীকে ছাড়িয়ে নিল। কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে বললো,

—— পড়ালেখা করবে ঠিকমতো। মা’কে হেল্প করবে। নিজের খেয়াল রাখবে। মা-বাবার খেয়াল রাখবে। আর বেশি করে বাচ্চামো করবে, ওকে? আমি যেন ফিরে এসে এই বাচ্চা বাচ্চা তপসীকে ফিরে পাই। আমার বাচ্চা বউয়ের খেয়াল রাখার দ্বায়িত্ব তোমায় দিয়ে গেলাম।

তপসী মাথা নিচু করে রইলো। সুব্রতের চোখের দিকে তাকানো যাবে না। কান্নারা গলায় আঁটকে আছে। যে কোনো সময় তারা যুদ্ধজয়ী হয়ে বেড়িয়ে আসবে বাঁধ ভেঙে।

সুব্রত আবারো তপসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। বললো,

—— পড়ায় ফাঁকি দিবে না। আর তুমি আমার সাথে এখন নিচে আসবে না।

তপসী মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। সে নিচে যাবে না। সুব্রত মানা না করলেও যেতো না। সুব্রতের চলে যাওয়ার দৃশ্য সে সহ্য করতে পারবে না।

সুব্রত আবার বললো,

—— আমি সময় পেলেই ফোন করবো। কথা হবে আমাদের।

তপসী আবারো মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।

সুব্রত তপসীর অধর‍যুগল নিজের আয়ত্তে নিলো। তপসীকে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলো। এরপর আচমকাই উঠে ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে গেল। পছন ফিরে তাকালো না। দরজা পাড় করতেই কানে এলো তপসীর কান্নার আওয়াজ। দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল সুব্রত। তপসীর কান্না এখনো কেন তার কানে বাজছে। উফ, এতো করুণ কেন তার কান্নার সুর।

,
সুব্রতের মা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কান্না করছে। এই কাজ সে প্রত্যেকবার সুব্রতের যাওয়ার সময়ই করে। ছেলের চাকরির অনেক বছর হয়েছে, তবে মায়ের কষ্ট কখনই কম হয় না।

সুব্র‍ত মা’কে জড়িয়ে ধরলো। বললো,

—— যলদি ছুটি নিয়ে ফিরে আসবো মা।

—— যলদি আসিস বাবু। তুই বাসায় না থাকলে আমার এই বাড়িটাকে মরুভূমি মনে হয় রে বাবা।

সুব্রত মায়ের হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করলো। বললো,

—— শোনো, এখন মরুভূমি মনে হবে না৷ আমার জন্য যে একটা পুতুল বউ এনে দিয়েছো তার খেয়াল রাখতে রাখতেই তোমার দিন চলে যাবে।

—— দুইজন গলা ধরে কাঁদবো।

বলেই সুব্রতের মা হেঁসে দিল। সুব্রতও হাঁসলো। রায়া ঘুম ঘুম চোখে তাকালো সুব্রতের দিকে। সুব্রত ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

রায়া আমতা আমতা করে বললো,

—— যলদি যা ভাই, আমার ঘুমে ডিস্টার্ব হচ্ছে। আমিও তোকে একটুও মিস করবো না।

সুব্রত রায়ার দিকে এগিয়ে গেল। রায়া কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। বললো,

—— আমি তোকে একটুও ভালোবাসি না।

—— আমিও না।

সুব্রতের মা হেসে দিলো। তপসীকে খুঁজলো আসে পাশে। দেখতে না পেয়ে ভাবলো সুব্রতকে জিজ্ঞেস করবে৷ পরে ভাবলো হয়তো সুব্রত বিদায় নিয়ে এসেছে। তাই আর কিছু বললো না।

সুব্রত চলে গেল। বাড়ির পরিবেশ অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে গেল। সুব্রতের বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলে চলে যেতাই সে ঘরের ভিতর চলে গেল।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ১২

১৮.
সুব্রত চলে গেছে আজ তিন দিন। তপসীর মন এখনো ভালো হয় নি। কি এক ভীষণ রকমের ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। শূণ্যতায় মন বিষন্ন হয়ে আছে।

তপসী কলেজের পোশাক পড়ে নিল। আজ থেকে আবার কলেজে যাওয়া শুরু করবে। রায়া ও চলে গেছে। বাড়ি খালি খালিই লাগে। শ্বাশুড়ি মা বলেছেন, পড়বেই যখন শুধু শুধুবসময় নষ্ট করে তো লাভ নেই।এমনিতেই এতোটা সময় পার হয়ে গেছে।

তপসী মোবাইলের দিকে তাকালো। সুব্রত সকালে ফোন করে নি একদিনও। আজও হয়তো করবে না৷ তবুও তার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে একটু কথা বলে নিতে। রাতেও খুব সময় হয় না কথা বলার। সারাদিন কর্ম ব্যস্ততার পর সুব্রতের রাতের ঘুমের সময়টুকু তপসী তার কারণে নষ্ট হতে দিতে চায় না।

তপসী খাবার খেতে নিচে নামলো। মা দুইবার ডেকে গিয়েছে৷ খাবার রান্না করা শেষ, খালি পেটে কিছুতেই বের হওয়া যাবে না। তপসী ডাইনিং টেবিলে তার শ্বশুর কে বসে থাকতে দেখলো।

শ্বশুর লোকটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। এই কয়েকদিনে তপসীর তার সাথে কথা হয়েছে হাত গোনা কয়েকবার। তাই তপসীর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে সে খুবই গম্ভীর। তপসী ওড়নাটা মাথায় টেনে নিলো। টেবিলের সামনে গিতে দাঁড়ালো।

তার শ্বশুর হাসি মুখে বললো,

—— গুড মর্নিং।

তপসী মৃদ্যু হাসলো। বললো,

—— গুড মর্নিং বাবা। আপনি চা খেয়েছেন? আমি না হয় নিয়ে আসি?

—— আরে এতো ব্যস্ত হতে হবে না। চা খাই নি, তোমার মা হয়তো করে দিবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তুমি বসো তো।

তপসী দাঁড়িয়ে ছিল, আবার বসে পড়লো। শ্বশুর বাবাকে সে অনেকটা রাগী ভেবেছিল। কিন্তু এখন তেমন মনে হচ্ছে না।
বাবার বংশগত ব্যবসায় সামলান সে। নিজের গুনে ব্যবসায়ী মহলে খুব নাম ডাকও তৈরি করেছেন। বয়স হয়তো ষাটোর্ধ, কিন্তু দেখতে অতোটা মনে হয় না।

সুব্রতের মা দুই টা প্লেটে পরোটা নিয়ে এসে টেবিলে রাখলেন। একটা এগিয়ে দিলো স্বামীর দিকে আরেকটা তপসীকে দিলো।

সুব্রতের মা জিজ্ঞেস করলেন,

—— তপসী তুমি চা খাবে? তোমার শ্বশুর আবার খাবার খেয়ে এরপর চা খান। তোমায় কি আগে এনে দিবো?

—— না না, আমার একদম চা খাওয়ার অভ্যাস নেই।

সুব্রতের মা আবার রান্নাগর থেকে দুইটা বাটিতে করে তরকারি নিয়ে আসলো। সুব্রতের বাবা তার উদ্দেশ্যে বললো,

—— শোনো সুব্রতের মা, আবার যখন আমার সম্পর্কে বউমা কে কিছু বলবে তখন আমাকে ‘তোমার শ্বশুর’ না বলে ‘তোমার বাবা’ বলবে। এটা কেমন যেন শুনতে লাগে।

তপসী হাসলো। লোকটা সত্যিই গম্ভীর নাকি? এখন কথাবার্তায় তো মনে হচ্ছে না। কি সুন্দর করে কথা বলতে জানে।

তপসী খাবার খেয়ে উঠে গেল। ড্রাইভার কাকা বসে আছেন বাহিরে। তিনিই দিয়ে আসবেন আবার নিয়েও আসবেন। তপসীর আজ আবার প্রথমদিন কলেজ যাওয়ার মতো লাগছে। নতুন সাজে যাবে সে। অন্যরকম একটা অনুভূতি।

,
কলেজে পা রাখতেই তপসীর নজর খুঁজতে লাগলো দিয়াকে। দিয়া তার একমাত্র বন্ধু যার সাথে সে সামান্য পরিমাণ কথা বলে। তবে অতো গলায় গলায় ভাব ধরনের বন্ধুত্ব তপসীর কারো সাথে নেই।

তপসী দিয়াকে খুঁজে পেল ক্যাম্পাসের এক কোণে৷ এ মেয়েটাও সবসময় চুপ থাকে। কারো সাথে মিশতে দেখা যায় না৷ তপসীর সাথে কিভাবে যেন একটু আধটু কথা বলে।

তপসী নিজেই দিয়া কে ডাকলো,

—— দিয়া, ক্লাসে যাবে না?

দিয়া তাকালো তপসীর দিকে। সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। জিজ্ঞেস করলো,

—— তপসী, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?

তপসী নিজের হাতের দিকে তাকালো। সুব্রতের অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার চিহ্ন সে সাথে নিয়েই ঘুরছে। তপসী মৃদ্যু হেসে মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।

দিয়া কাছে এগিয়ে আসলো। বললো,

—— কংগো। তুমি তো বললে না আমায় একবারও। অনুষ্ঠান হয় নি কোনো?

—— হয়েছে। তবে তুমি জানো আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে। তাই আমি নিজ থেকে কাউকেই ডাকি নি।

—— অন্তত জানাতে পারতে।

—— তোমায় জানাতাম কিন্তু নিমন্ত্রণ করতাম না, ব্যাপার‍টা ওড না?

দিয়া আর কথা বাড়ালো না। বললো,

—— আচ্ছা ক্লাসে চলো। সময় হয়ে গিয়েছে।

—— হু। চলো।

—— ভাইয়া কি করে?

—— তোমার ভাইয়া আর্মি।

দিয়া একটু অবাক হলো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

—— এর মানে কি ভাইয়া আবার চলে গেছে।

—— হুম।

তপসী সংক্ষেপে জবাব দিল। তার মন ভারী হয়ে উঠছে সুব্রতের কথা মনে পড়তেই।
দিয়া তপসীকে স্বান্তনা দেওয়ার স্বরে বললো,

—— ডোন্ট বি স্যাড! আচ্ছা তোমার শ্বশুর বাড়ির লোক কি তোমায় আরো পড়াবে?

—— হ্যাঁ।

—— বাহ, বেশ দারুণ ফ্যামিলি পেয়েছো নিশ্চয়ই।

—— হ্যাঁ। সবাই খুব ভালো। তুমি জানো, আমি তো পড়তে চাইনি, তারা জোর করে পড়াচ্ছে।

আরো টুকটাক কথা বার্তা বলতে বলতে ক্লাসে চলে গেল তারা।

১৯.
তপসী বাসায় ফিরে দেখলো তার কাকি এসেছে। কাকি কে দেখে খানিকটা অবাক হলো তপসী। জিজ্ঞেস করলো,

—— কেমন আছো কাকি?

—— ভালো আছি রে মা। তুই কেমন আছিস?

—— ভালো আছি। তুমি হটাৎ আসলে? একটা ফোন করে দিতে।

—— তোর বাবা ফোন দিয়েছিল তো। তুই তখন কলেজ ছিলি।

—— ওহ।

সুব্রতের মা বললো,

—— তপসী মা যাও তৈরি হও।

—— কেন?

কাকি বলে উঠলো,

—— আরে কেন বলছিস কেন? যাবি বাসায় আমার সাথে।

—— কার বাসায়?

তপসীর কাকি থতমত খেয়ে বললো,

—— কেন? তোদের বাসায়।

—— আমি যাবো না কাকি।

সুব্রতের কাকি নরম।স্বরে বললো,

—— বউমা, এটা তো একধরনের নিয়মের মতোই বলো। নায়র যেতে হবে। আর সুব্রত বাড়ি নেই এখন। ঘুরে আসলে মন ভাল লাগবে।

—— কাকি মা আমার এখানেও ভালো লাগছে, আমি এখানেও বেশ আছি।

সুব্রতের মা তপসীর কাছে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,

—— আমি জানি তুমি কি পরিস্থিতি তে বিয়ে করেছো। তোমার মনের অবস্থাও বুঝছি। মানুষের জীবনে এরচেয়েও কঠিন সময় আসে। সব কিছু মোকাবিলা করতে হয়। আমি নিজে এরচেয়েও কঠিন সময় পার করেছি। আচ্ছা বাদ দেও, আজ যাও, যদি ভালো না লাগে আমরা কালই নিয়ে আসবো তোমায়।

তপসী নিজের ঘরে চলে গেল। বিরক্ত লাগছে তার। সেদিনের নিতা আন্টির ব্যবহারের পর তার আরোও বেশি ইচ্ছা করছে না ও বাড়িতে যেতে। এতো সব নিয়ম কেন? তাকে কেন সব নিয়মই পালন করতে হবে? যেখানে স্বামীই কাছে নেই সেখানে এতো নিয়মের মানে কি!

তপসী কাকির সাথে বাসায় চলে গেল। তুষারের সাথেও দেখা হবে এই ভেবে সে কিছুটা খুশি হলো। কিন্তু তাতে বিরক্ত ভাব তার একটুও কমলো না। নিতা আন্টি এবার কিছু বললে সে নিশ্চয়ই এর উচিত জবাব দিয়ে আসবে৷

চলবে………
চলবে……..
চলবে…………

(একদমই আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য পাই না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here