#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ০২
৩.
তপসী কে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে৷ নিতা আন্টি সকাল থেকে বিরস মুখেই কাজ করে যাচ্ছেন। এমন অহেতুক খাটাখাটুনি তার পছন্দ না।
তপসী বাড়ির সকল দিক পরিষ্কার করছে। সে চায় যেন যে করেই হোক শীঘ্রই সে এই বাড়ি ছাড়তে পারে। আর এই জন্য বিয়ের চেয়ে উত্তম পন্থা তার কাছে আর একটাও নেই।
তপসীর বাবা তুষারকে নিয়ে সোফায় বসে আছে। নিতা তার সামনে আসতেই বলতে শুরু করলো,
—— তারা তো খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বুঝলে। তাদের আদর যত্নে কমতি রেখো না। আমার বিজনেস পার্টনার কবে থেকে বলছে ছেলেটার কথা। আমি এতোদিন মেয়ে ছোট আছে ভেবে রাজি হই নি। কিন্তু মেয়ের নাকি বিয়ের বয়স হয়েছে, তাই চট করে তাদের আসতে বলে দিয়েছি।
—— উদ্ধার করেছো। এতো দেখাদেখির কি আছে? যতসব। কই, তোমার মেয়ের মাসিরা তো একজনও আসলো না। সব কাজ আমার করতে হচ্ছে।আমার শরীরে ব্যাথা ধরে গেল একদম।
—— মেয়েটাকে দেখতে আসবে আর তুমি কাজ করতে পারবে না? ঘর তো ও নিজেই পরিপাটি করছে। শুধু রান্নাটাই তো বাকি।
—— রান্নাটা যদি এতো সহজ হয় তাহলে তোমরা বাপ বেটি মিলে কেন করছো না? জলদি বিয়ে দিয়ে আপদ বিদেয় করো বাড়ি থেকে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। উফ, বিরক্তিকর ।
—— এতো রিয়েক্ট করো না। দুপুর হয়ে গেছে। তারা আসলো বলে।
—— যাই যাই। আর শোনো, এই প্রথম আর এই শেষ , আমি তোমার মেয়েকে কোনো রাজপুত্র দেখতে আসলেও আমি আর সে কাজে নেই। মনে থাকে যেন।
তপসী নিজের আপন মনেই হাসছে। তার বাবা নাকি তার ভালোর জন্য বিয়ে করেছিল। সেই ভালোর নমুনা এমন। নিতা আন্টির তো খুশি হওয়ার কথা যে আপদ বিদেয় হতে পারে।
কিছুক্ষণ পর তপসী নিজের ঘরে গেল। বাবা বলেছেন তৈরি হতে। শাড়ি পড়ে এসে আয়নার সামনে বসতেই তুষার ছুটে এলো তপসীর ঘরে। তপসীর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
—— দি তুমি কি সত্যিই চলে যাবে?
তপসীর বুক ভেঙে এলো। মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই তুষারই তাকে শুধু ভালোবাসে। তুষারের এমন আকুল গলায় বলা কথা শুনে তপসী বিচলিত হয়ে গেল।
—— কোথায় যাবো আমি? পাগল একটা।
তুষার অভিযোগের সুরে বললো,
—— মাম্মাম অলওয়েজ মিথ্যা বলে। মাত্রই আমাকে বললো তুমি নাকি চিরকালের জন্য চলে যাবে।
—— তোমার মাম্মাম এটা বলেছে?
—— হুম হুম। আর আমিও বলেছি তুমি চলে গেলে আমিও তোমার সাথে চলে যাবো।
তপসী তুষারের কপালে চুমু খেল। ছোট ভাইটির চোখে সে তার জন্য অসীম ভালোবাসা দেখতে পায়।
তপসী তুষারকে বিছানায় বসিয়ে দিল।
—— চুপ করে বস তুষার। আমি সাজবো। দেখো তো দি কে দেখতে কেমন লাগে।
তুষার খুশি মনে বললো,
—— আমার দি সবচেয়ে প্রিটি৷ একদম দেবী দেবী দেখতে।
৪.
পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে তপসী। পাত্র কেমন গম্ভীর মুখ করে আছে। পাত্র আর্মিম্যান। নাম সুব্রত ধর।
তপসী একবার চোখ তুলে তাকিয়ে সবাইকে দেখলো। বাবা পরিচয় করিয়ে দিলো সবার সাথে। সুব্রতের মা, বৌদি, কাকা আর কাকিমা এসেছে।
নানা ধরনের প্রশ্নই করলো তারা। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরই নিতা আন্টি দিল। তাও বেশ বাড়িয়ে বললেন। এই যেমন পড়ালেখা কতটুকু জিজ্ঞেস করতেই নিতা আন্টি আগ বাড়িয়ে বললো,
—— তপসী এ ওয়ান স্টুডেন্ট। এবার ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল ইয়ারে। এতো পড়াশোনা করেছে যে জিপিএ-৫ তপসীর হাতের মোয়া।
অথচ তপসী এভারেজ ছাত্রী। জিপিএ -৪ এর উপরে রেজাল্ট সে আশাই করে না। তপসী হঠাৎ অবাক হলো এই ভেবে যে নিতা আন্টি বানিয়ে তার সুনাম করছে? যেন এখানেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায়!
একসময় সুব্রতের মা নিরঞ্জন ধরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—— দাদা, আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে ওরা একটু আলাদা কথা বলুক?
নিরঞ্জন ধর সম্মতি জানালেন। মেয়েকে বললেন সুব্রতকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে। তপসী অনিচ্ছা স্বত্তেও উঠে দাড়ালো। সুব্রতকে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো। দরজা হালকা করে ভেজিয়ে দিল।
সুব্রত বিছানায় গিয়ে বসলো। বিরক্তিতে তার চোখ মুখ কুঁচকে আছে। তপসী তার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচল বার বার আঙুলে বাঁধছে।
সুব্রত এই প্রথম বারের মতো মুখ খুললো।
—— তোমার রুমে এটাচড ওয়াসরুম আছে?
তপসী আরো অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে। আলাদা কথা বলতে এসে ছেলে তার কাছে ওয়াসরুমের খবর জানতে চাইছে। ওহ নো, রিডিকিউলাস!
তপসী বললো,
—— জ্বি আছে।
—— আমি ইউজ করতে পারি?
—— জ্বি অবশ্যই।
,
মিনিট দু’য়েক পরেই সুব্রত বেড়িয়ে আসলো। আবার বিছানায় বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
—— টাওয়াল আছে?
—— জ্বি আছে।
—— দেওয়া যাবে?
—— জ্বি এক্ষুনি দিচ্ছি।
টাওয়ালে হাত মুছতে মুছতে সুব্রত তপসীকে জিজ্ঞেস করলো,
—— তুমি কি ‘জ্বি’ শব্দটা প্রতি লাইনে ব্যবহার করো?
—— জ্বি না।
—— এইতো মাত্রও করলে। আমার সব প্রশ্নের জাবাবেও ‘জ্বি’ যুক্ত লাইন বলেছ। হোয়াই?
—— ভদ্রতা স্বরূপ।
—— ওহ আই সি। তোমার কি কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?
—— কি?
—— আমার সম্বন্ধে?
—— না।
—— তাহলে এখানে নিয়ে আসলে যে?
—— আই থট আপনার জিজ্ঞেস করার আছে।
—— না নেই।
—— তাহলে আপনি সেখানে মানা করে দিলেই পারতেন।
—— ওয়াসরুমের প্রয়োজন ছিল। আর শুধুমাত্র এ জন্যই এসেছি।
—— আচ্ছা তাহলে বাহিরে চলুন।
—— ওয়েট। একটা কথা বলো, তোমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই কেনো?
—— আপনার কেন নেই?
—— কারন আমি বিশ্বাস করি এই দশমিনিটের জিজ্ঞাসাবাদে সিদ্ধান্ত নেওয়া যা, কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া ডিসিশন নেওয়াও তা। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ এগুলো যাস্ট ফর্মালিটি।
এবার বলো, তোমার কেনো কিছু জিজ্ঞেস করার নেই?
—— বিকজ আই বিলিভ, এই ক্ষণিকের জিজ্ঞাসাবাদে এমন কোনো চাঞ্চল্যকর তথ্যই আমি জানতে পারবো না, যা বিয়ের আগে জানা যাবে।
—— সিরিয়াসলি?
—— অবশ্যই। আপনার সিক্রেটস আপনি বলার হলে এমনিতেই বলতেন। আর ইচ্ছে না থাকলে আমি জিজ্ঞেস করলেই কেন বা সত্য টা বলবেন?
—— ইন্টিলিজেন্ট গার্ল।
—— শুনুন, আমার আন্টি, সরি মা আপনাদের আমার ব্যাপারে যা যা বললো তা অনেকটা বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলা। আমি অতো টাও গুণী না।
—— এটা সবাই জানে। পাত্রপক্ষ কে সব মা’ই একটু বাড়িতে বলে।
—— জ্বি, বাহিরে চলুন।
তপসীর সাথে সুব্রত বেড়িয়ে এলো ড্রয়িংরুমে। সবাই আলাপ আলোচনায় মশগুল। তপসী ক্ষাণিক শুনে যা বুঝলো তাকে সুব্রতের পরিবার বেশ ভালোই পছন্দ করেছে।
৫.
তপসী হাতের অনামিকায় পড়ে থাকা আংটির দিকে তাকিয়ে আছে এক পলকে। সাধারণত মেয়ে দেখতে এসে কেউ স্বর্ণ দেয় না। তারা কেন দিল? তপসীকে পছন্দ হয়েছে বলে? নাকি অত্যাধিক ধনী তারা তা বুঝাতে?
তুষার রসমালাই এর বাটি নিয়ে দিদির কাছে এসে বসলো। দি’র মুখে রসমালাই তুলে দিয়ে বললো,
—— মা আবারো বলেছে তুমি চলে যাবে।
—— আবারো কেন বললো?
—— দুপুরে লোকগুলো আসলো যে, তারা বাবাকে বলেছে তারা তোমায় নিয়ে যাবে।
তপসী চুপসে গেল। এ বাড়িতে সে থাকতে চায় না। কিন্তু এ বাড়ি ছাড়ার কথা ভাবলেই তার বুক ফেটে আসে। সুব্রত কে দেখে মনে হয়েছে সে কম করে হলেও তপসীর সাত থেকে আট বছরের বড়।
সাধারণত এ যুগে এতো এইজ ডিফারেন্সে কেউ বিয়ে করে না। তপসীর কান্না পাচ্ছে। তুষার তার সামনে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে বসে আছে। যেকোনো সময় কেঁদে ফেলবে সে। সে শুধু দি’য়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শোনার জন্য সে সত্যিই যাবে কিনা।
তপসী ভাইকে শান্ত করতে বললো,
—— আমি যাবো না সোনা। তোমাদের ছেড়ে আমি কোথায় যাবো?
—— প্রমিস করো।
—— পাক্কা প্রমিস।
,
ক্ষাণিক বাদে তপসীর বাবা তপসীর সামনে এসে দাড়ালেন। তপসী তখন ভাইকে হাসাতে ব্যস্ত। তপসীর বাবা গম্ভীর সুরে বললো,
—— তারা তোমাকে পছন্দ করেছে। ১৩ দিন পর আশীর্বাদ এর তারিখ। আর আমরা যাবো আরো ৫ দিন পর। তুমি নিশ্চয়ই রাজি। আফটার অল তোমার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে।
—— অবশ্যই আমি রাজি এবং খুশি, বাবা। তবে তোমাদের চেয়ে কম। আফটার অল তোমাদের ঘরের আপদ বিদায় হচ্ছে।
—— দাত থাকতে দাতের মর্যাদা কেউ বুঝে না। তুমিও এখন বুঝছো না, কিন্তু একদিন ঠিক বুঝতে পারবে।
—— সেইম কথা টা আমি তোমাকেও বলতে পারি। একদিন তুমিও বুঝতে পারবে। গুড নাইট বাবা। আমি ঘুমাবো। প্লিজ। আর তুষার আজ আমার কাছে থাকবে।
তুষার খুশি মনে বললো,
—— হুম বাবা। তুমি যাও।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ০৩
৪.
তপসীর আশীর্বাদ এর অনুষ্ঠান শুরু হবে কিছুক্ষণ পর। রূপালী পাড়ের নীল বেনারসিতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। যে কারো জন্য চোখ ফেরানো মুশকিল হবে। তপসীর শ্বাশুড়ি এসে তিনবার ঘুরে গেছে তপসীর ঘরে।
প্রতিবারই তার মুখে এক কথা,
—— আমার ছেলেটা কি ভাগ্যবান! কি ভাগ্যবান!
তপসী হবু শ্বাশুড়ির কথা শুনে লজ্জায় লাল বর্ণ ধারন করে৷ তপসীর এক মাসি এসেছে। অন্য কোনো সময় না আসলেও আপন ভাগ্নীর আশীর্বাদ এ সে না এসে পারলো না।
তপসীর মায়েরা তিনবোন ছিল। এক বোন বর্তমানে সপরিবারে ভারত থাকে। অন্য বোন দেশেই থাকে। তপসীর মাসি সযত্নে তপসীর মাথায় টিকলি লাগিয়ে দিচ্ছে৷
হঠাৎ করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—— তোকে একদম তোর মায়ের মতো দেখতে হয়েছে তপসী। জানিস তুই?
—— আমার মা সবচেয়ে সুন্দর ছিল।
—— তুই ও৷ তোর শ্বাশুড়ির তো তোকে এতোই পছন্দ হয়েছে যে বার বার ঘরের সামনে দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে।
তপসী হাসলো৷ জিজ্ঞেস করলো,
—— ও বাড়ি থেকে কয়জন এলো?
—— ত্রিশ মতোন হবে। তোর শ্বশুর, শ্বাশুড়ি থেকে শুরু করে কাছের আত্নীয় সবাই এসেছে।
—— আচ্ছা মাসি, অর্পি কেন আসলো না?
তপসীর মাসি একটু বিষন্ন হয়ে গেল। অর্পি তার একমাত্র মেয়ে। নিতার অশোভনীয় ব্যবহারের কারনে সে এই বাসায় আসে নি৷ কিন্তু তপসী কে সে আসল কারন বলতে চায় না। মেয়েটার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন আজ। এইদিনে এমন কিছু সে বলতে চায় না, যার জন্য তপসীর মন খারাপ হয়!
মাসি মৃদ্যু হেসে বললো,
—— ওর তো কোচিং এ এক্সাম আছে রে। ওর খুব মন ছিল আসার। কিন্তু এক্সাম মিস দেওয়া যাবে না রে।
—— আচ্ছা, বিয়েতে কিন্তু আসতে হবে।
—— একদম আসবে৷ সব বাদ দিয়ে হলেও আসবে।
তপসী হেসে ফেললো। সে জানে অর্পির কোনো এক্সাম নেই। সে এ বাড়িতেই আসতে চায় না।
কিছুক্ষণ পর ঘরে তপসীর কাকি আসলো। তারা মিরপুর থাকে। তপসীর কাকা সরকারি চাকরি করে। যাতায়াতের সুবিধার জন্যই মিরপুর থাকা।
তপসীর কাকি তাড়া দেওয়ার স্বরে বললো,
—— দিদি ও’কে নিয়ে আসুন ড্রয়িংরুমে। দাদা বলেছে নিয়ে যেতে।
—— তপসী উঠ মা। শাড়ি টা ঠিক করে দেই।
তঅপসী বসা থেকে উঠে দাড়াতেই মাসি পায়ের কাছে বসে শাড়ির কুঁচি টেনে ঠিক করে দিল।
৫.
ড্রয়িংরুমের সোফা সড়িয়ে ফ্লোরে শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। সবাই সেখানে জড় হয়ে বসেছে। তপসীর লজ্জা লাগতে শুরু হলো। এই এতো গুলো মানুষ কি সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে! আড়ষ্ট হয়ে এলো লজ্জায়।
তপসীর মনে হঠাৎ আনন্দ ও হলো। এই প্রথম এতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো তার জন্য। শুধুমাত্র তার বিয়ে উপলক্ষে। তপসী চোখ তুলে একবার সুব্রত কে খুঁজলো। তার হবু স্বামীকে কেমন দেখতে সে অনেকটাই ভুলে গেছে। শুধু মনে আছে শ্যাম বর্ণের যুবকটি অত্যন্ত হ্যান্ডসাম। যেকোনো তরুণীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতে পারে সে।
তপসী সুব্রতকে কোথাও পেল না। পাওয়ার কথাও না । আশীর্বাদ এ কোনো পাত্রই কখনো আসে না। এছাড়াও সুব্রতের ছুটি শেষ। ক্যাম্প থেকে জরুরি তলব এসেছে৷ তাই সে দুইদিন আগেই চলে গেছে। বিয়ের আগে আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। তাই তপসীর বাবা চার দিন আগে কয়েকজন নিকট আত্নীয় নিয়ে আশীর্বাদ এর পালা শেষ করে এসেছে।
তপসীর শ্বাশুড়ি সবার আগে উঠে এলো আশীর্বাদ করতে। গলায় একটা ডায়মন্ড লকেটের স্বর্ণের চেইন পড়িয়ে দিল।
মুখে বললো,
—— মাগো, আশীর্বাদ করি আমার ঘরে যেন তুমি দুধে ভাতে থাকতে পারো। আমার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে সারাজীবন আমার ঘর আলো করে রাখতে যেন পারো।
তপসী তার পা ছুয়ে নমস্কার করলো। তার কান্না পেয়ে গেল এতো মমতা ভরা কথায়। কারো মনে কতোটা মমতা থাকলে সে ছেলের বউয়ের জন্য এতো মমতাভরা কথা বলতে পারে!
একে একে সবাই এসে নিজেদের মতো উপহার দিয়ে আশীর্বাদ করলো। তপসীর মন ভালো হয়ে গেল। সুব্রতের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
তপসী মনে মনে আপসোস করে উঠলো,
—— ইস, মোবাইল নম্বরটা তো নেওয়া হলো না।
সন্ধ্যার পর পর সবাই চলে গেল। বিয়ের তারিখ পাঁকা করে গিয়েছে তারা। আগামী বাংলা মাসের ৯ তারিখ বিয়ে। হাতে এখন মাত্র ১৪ দিন আছে। এতো যলদি তারিখ দেওয়ার কারন সুব্রত এরপর আর ছুটি পাবে না অনেকদিন। তাই যতো তাড়াতাড়ি হয় বিয়ে দিয়ে দেওয়া গেলে ভালো।
পূরোটা অনুষ্ঠানে তপসী নিতা আন্টিকে যতবার দেখেছে ততবার তার মুখে চওড়া হাসি দেখতে পেয়েছে। এমন অখুশির মধ্যেও এতো চওড়া হাসি কিভাবে দিয়ে থাকলো তপসী তা ভেবে পায় না।
তপসীর শ্বশুর যৌতুক সমন্ধে কোনো কথা বলে নি। তাদের কোনো দাবি নেই। এ কথা তপসী তার কাকির মুখে শুনেছে।
অথচ নিতা আন্টি কাল রাতেও তাকে বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বলেছে,
—— যেই না আমার মেয়ে, মুখের নাই শ্রী, এতো বনেদি ঘরে বিয়ে দিবে বলে যে লাফাচ্ছে, যৌতুক চাইবে কমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকার জিনিস। আমিও দেখবো এই যৌতুক কোথায় পায় আর কিভাবে হয় এই বেয়াদবের বিয়ে।
তপসীর নিতা আন্টির সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
—— আন্টি, দেখুন বিনা যৌতুকে আমার বিয়ে হচ্ছে। আপনি কি এখনো জোনাকি পোকা আছেন? নাকি পশ্চাৎদেশের বাতি নিভেছে?
কিন্তু নিতান্তই নিতা আন্টির সাথে কোনো রূপ কথা বলার ইচ্ছে না থাকায় তপসী কোনো কথাই বলে নি।
,
তপসীর বিয়ের শপিং নিরঞ্জন ধর নিজের হাতে করছে। নিজের পছন্দসই মেয়েকে সাজাবে। রূপালী পাড়ের খয়েরী লাল রঙের বেনারসি কিনেছে সে।
বোনের ড্রেস কালারের সাথে ম্যাচিং করে তুষারের জন্য ড্রেস কিনে দিয়েছে নিরঞ্জন ধর। তুষার এখন আনন্দিত। তার দি তাকে বলেছে, সে সত্যিই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু মাঝেমাঝে দেখা করতে আসবে।
এর ফলে দি কে আর মায়ের বকা শুনতে হবে না। দি কষ্ট পাবে না। কান্নাও করবে না। তাই সে ভীষণ খুশি।
তপসীর কাছে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তার কেমন গহনা পছন্দ। সে তার পছন্দ সম্পর্কে কিছুই বলে নি। নিজের মায়ের গহনাগুলো চেয়ে নিয়েছে। গহনা গুলো মায়ের একেকটা স্মৃতি তে ভরপুর।
৬.
বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে তপসীকে তার কাকি। কাটগোলাপের গহনা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। একদম ছোট একটা পরীর মতো লাগছে থাকে।
তপসীর গায়ের রঙ মোটামুটি ফর্সা। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা সে। মোটামুটি স্লীম পর্যায়েই পড়ে সে। বাসন্তী রঙা শাড়ি টা যেন তার শরীরে প্যাঁচিয়ে নিজের শোভা আরো বাড়াচ্ছে।
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। বাড়ির ছাদে স্টেজ সাজানো। সেখানেই বসানো হয়েছে তাকে। হলুদের অনুষ্ঠান বলা হলেও মূলত তপসী কে হলুদ ছোঁয়ানো হচ্ছে না।
হিন্দু নিয়মানুযায়ী বিয়ের দিন সকালে হলুদ ছোঁয়ানো হয়। তাই কালই একেবারে হলুদ লাগানো হবে।
হঠাৎ তপসীর মোবাইলে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসে।
তপসী রিসিভ করে কানে ধরতেই একটা সুন্দর কন্ঠস্বর ভেসে আসলো অপরপাশ থেকে।
—— আমি কি আমার হবু বউয়ের একটা ছবি দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি?
তপসী যেন মুহূর্তেই একটা হার্টবিট মিস করলো। আনমনেই বলে উঠলো,
——কতো সুন্দর করে কথা বলতে পারেন আপনি!
সুব্রত জোরে হেসে উঠলো।
—— এই প্রথম কেউ আমার কথার প্রসংশা করলো। কিন্তু প্রসংশা করার মতো কিছু কি বলেছি আমি?
তপসী লজ্জায় পড়ে গেল। এই প্রথম সুব্রতের সাথে ফোনালাপ তার। আর কারো সাথে কথা বলতে তো এতো লজ্জা লাগে না। এতো ভালোও লাগে না। তপসী নিজের মনে নিজেই নিজেকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলো।
সুব্রত আবার জিজ্ঞেস করলো,
—— কোথায় হারিয়ে গেলেন তপসী ম্যাডাম? শুনতে পাচ্ছেন কি?
—— জ্বি পাচ্ছি। আমি ছবি কিভাবে দেখাবো আপনায়?
—— সোস্যাল মিডিয়াতে একাউন্ট ওপেন করেছো ক্যান যদি ইউজই না করো।
—— আপনি এড আছেন নাকি?
—— চেক হোয়াটসঅ্যাপ।
—— আচ্ছা আমি পাঠাচ্ছি। আর হ্যাঁ শুনুন, ছবিতে কিন্তু আমায় খুব বিশ্রী লাগে দেখতে।
সুব্রত হেসে উত্তর দিলো,
—— তোমার অপূর্ব, বিশ্রী, কুৎসিত, সুশ্রী সবই আমি দেখবো তপসী। শুধু আমিই দেখবো।
তপসী যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইলো। এতো সুখ তার কপালে সইবে তো!
চলবো……….
চলবে………