#৯ম_পর্ব
#আতিয়া_আদিবা
সূর্যের সরু আলো ঝাঁকড়া গাছটির পাতার ফাঁক দিয়ে লম্বালম্বি এসে মাটি স্পর্শ করছে। সেই ঝাকড়া গাছটার নিচে বর্ষা বসে আছে। শীতল পাটি পেতে। গায়ে এখনো হালকা জ্বর আছে। নিয়াজ সাহেব নাতনির পাশে বসে বই পড়ছে। চোখে সোনালি রঙের চশমা। বর্ষা তাঁর দিকে তাঁকিয়ে আছে অপলক। লোকটি তার আপন দাদা নয়। বাবার বড় চাচা। কিন্তু বর্ষাকে প্রচন্ড আদর করেন। তার নিজের দাদা তাকে এতটা আদর করতেন কিনা কে জানে!
ধবধবে ফর্সা শরীর নিয়াজ করিমের। চামড়া এ জায়গায়, ও জায়গায় ঝুলে গেছে। তবুও কি পবিত্র শুভ্রতা ছড়িয়ে আছে চোখে মুখে।
বর্ষা দাদুর বুকে মাথা রাখলো। নিয়াজ নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আচমকা বর্ষার ভীষণ কান্না পেলো। সে ভাবলো, এ মানুষটার বুকে মাথা রেখে ক্ষণিককাল আয়েশ করে কেঁদে নেওয়া যাক।
বর্ষার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগলো। সূর্যের আলোয় সেই অশ্রুজল চিকচিক করছে। নিয়াজ করিমের সাদা গেঞ্জি ভিজতে শুরু করছে। তিনি বুঝলেন। বর্ষা কাঁদছে। বইটার মাঝে ফিতা গুঁজে পাশে রেখে দিলেন। নাতনিতে পরম আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়েটা কাঁদুক।
তার বুকে মাথা রেখেই তো মেয়েটা মনের সব কষ্ট উজাড় করে কাঁদার সাহস পায়!
পরম মমতায় মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে নিয়াজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
হ্যা রে! তোর মূর্খ বাপ আবার কিছু বলেছে?
বর্ষা মাথা নাড়ালো। বলল,
হু বলেছে। আচ্ছা দাদাজান, আমি কি খুব খারাপ?
নিয়াজ বললেন,
মোটেও না। তুই খারাপ হবি কেনো?
স্কুলের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই একজন ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম। ভালোবেসে হারিয়েও ফেললাম। বিষয়টা নিয়ে জানাজানি হলো। পরিবারের সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিলাম। ওইটুকুন বয়সে কেউ প্রেম করে? আমি খারাপ না?
প্রেমের কি বয়স আছে রে? প্রেম হলো এক পবিত্র অনুভূতি। এমন এক অনুভূতি যা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এই অনুভূতি বয়স, ধর্ম, বর্ণ কিচ্ছুটি মানেনা! আপন গতিতে এগিয়ে চলে। জাগ্রত নদীর স্রোতের মত বাঁধাহীন ভাবে এগিয়ে চলে। কল কল। কল কল। কল কল।
ছেলেটার কথা এখনো মনে পরে?
বর্ষা নরম গলায় বলল,
পরে।
কতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো! এখনো ভুলতে পারিস নি।
বর্ষা দুদিকে মাথা নাড়ালো। এর মানে হলো না। সে এখনো ভুলতে পারে নি।
নিয়াজ করিম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
আর কতদিন এই বুড়োর বুকে মাথা রেখে চোখের জল ফেলবি? আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। তোকে যদি ভালো কোনো মানুষের হাতে তুলে দিতে পারতাম। শেষ নিশ্বাস শান্তিতে ফেলতে পারতাম!
বর্ষা চুপ করে রইলো।
শেষ যেবার হেফাজতের সাথে কথা হলো, কোন এক পাত্রর কথা যেনো বলেছিলো। বড় এক কোম্পানিতে চাকরি করে। দেখতে শুনতে ভালো।
হু। বাংলিশ পাত্র।
বাংলিশ পাত্র মানে?
মানে ছেলে বাঙ্গালী কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র। বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতে দাঁত কপাটি যেনো খুলে আসে।
নিয়াজ করিম নাতনির কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,
তোর পচ্ছন্দ হয়নি?
না।
বাংলিশ ছেলে বলে পচ্ছন্দ হয় নি? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
ছেলে বাছুর প্রকৃতির।
বাছুর প্রকৃতির!
বয়স অল্প দেখে বাছুর বললাম। আরেকটু বড় হলে সোজা গরু বলতাম।
সে আমি বুঝতে পেরেছি। তোর বাবার পচ্ছন্দ হয়েছে মানে একই গোত্রের হবে। গরু গোত্রের। কথায় আছে না? মানিকে মানিক চিনে, রতনে চিনে রতন।
ঠিক বলেছো, দাদাজান।
দাদা আর নাতনি দুজনেই হেসে উঠলো।
একটু দূরে ফারুক দাঁড়িয়ে আছে। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সীম কোম্পানি থেকে লোক এসেছে। স্যারের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহুর্তে তার কাছে যাওয়াটা তিনি পচ্ছন্দ করবেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
উপায় না পেয়ে, খানিকটা ইতস্তত করে ফারুক এগিয়ে গেলো। নিয়াজ করিম চশমা ঠিক করে বললেন,
কিছু বলবে ফারুক?
জ্বি স্যার।
বলে ফেলো। জ্বি স্যার বলে বাঁশের মত দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
স্যার, সীম কোম্পানি থেকে লোক এসেছে।
আবার?
জ্বি স্যার। খুব অনুরোধ করছে। আপনার সাথে একটিবার কথা বলতে চায়।
নিয়াজ করিম ক্ষণিককাল চুপ করে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন,
ঠিকাছে পাঠিয়ে দেও।
এখানে পাঠিয়ে দিবো স্যার?
হ্যাঁ। কেনো? কোনো সমস্যা আছে?
ফারুক একবার আঁড়চোখে বর্ষার দিকে তাঁকিয়ে বলল,
না স্যার। কোনো সমস্যা নেই।
ঠিকাছে যাও। আর শোনো। কথায় কথায় স্যার বলবে না। খুবই বিশ্রি শোনায়। শব্দের গাঁথুনি হবে শ্রুতিমধুর। তোমার শব্দের গাঁথুনি বিশ্রি। বুঝেছো?
বুঝেছি স্যার।
নিয়াজ করিম হতাশ ভঙ্গিতে বর্ষার দিকে তাঁকালো। বর্ষা ফিঁক করে হেসে ফেললো।
শিহাব গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল বড় জায়গা। কত ধরনের সারি সারি গাছ। তিন চার গাছ পর পর আবার লণ্ঠন ঝুলছে। চারিদিকে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ। কিছুদূরে সুন্দর গোলাকার উঁচু সিমেন্টের বেদি। উপরে ছাতার মত টিনের চাল। বৃষ্টির সময় নিশ্চয়ই ভীষণ সুন্দর টুপ টুপ শব্দ হয়!
এখানে টাওয়ার বসানো নিয়ে মালিকের অনাগ্রহী হওয়ার কারণ কিছুটা আঁচ করা গেলো। এ জায়গার দাম চোখ বন্ধ করে কয়েক কোটি টাকা হবে। সে পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে অবশ্যই এ জায়গার সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইবেন না।
তবুও তাকে চেষ্টা করতে হবে।
ফারুককে আসতে দেখা গেলো। শিহাব নড়েচড়ে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। ফারুক হাসিমুখে বলল,
স্যার, বাড়ির বাইরে বসে রোদ তাপাচ্ছে।
শিহাব রোদ তাপানোর মানে বুঝলো না। তবুও তার ভঙ্গিমায় বোঝালো বিষয়টা তার বোধগম্য হয়েছে। সে প্রশ্ন করলো,
তার রোদ তাপানো শেষ হওয়া পর্যন্ত উই হ্যাভ টু ওয়েট রাইট?
ফারুক ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। ইংরেজীতে ভীষণ কাচা। তবুও বুক ফুলিয়ে দু চারটে ভুল ইংলিশ আওড়াতে সে ভালোবাসে। সামনে আপাদমস্তক বাংলিশ বাবু দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। দাঁত কপাটি বের করে বলল,
হোয়াই লেট? স্যার এক্ষুণি আমার সাথে আপনাকে যেতে বলেছে। নো সমস্যা। উই গো নাউ।
শিহাব হেসে বলল,
অলরাইট।
ফারুক শিহাবকে পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর শিহাব জিজ্ঞেস করলো,
প্রতিটি গাছে লাইট লাগানো দেখলাম। ডেকোরেশনের জন্য?
ওগুলা লণ্ঠন স্যার।
লণ্ঠন? এটা কি জিনিস?
স্যার কেরোসিন তেল দিয়া ধরাইতে হয়। আমাদের এখানে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা নাই।
ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা নেই? কেনো!
স্যারের ইচ্ছা। এই জায়গার সে মালিক। মালিকের ইচ্ছা মতোই সব হয়। উনার অন্ধকার বেশি পচ্ছন্দ।
শিহাব চোখ বড় বড় করে বলল,
ইটস হরিবল। উনার ছেলে মেয়ে নেই?
একটা ছেলে আছে। দেশের বাইরে পড়তে পাঠাইছিলো। এরপর আর যোগাযোগ করে নাই। মেয়েটা ক্যান্সারে মারা গেছে অনেক বছর আগে।
স্যাড।
তবে উনার একটা নাতনি আছে। সে মাঝে মাঝে এসে থাকে। দিন কয়েক থেকে চলে যায়।
আই সি!
আমরা প্রায় চলে আসছি। স্যারের সাথে নরম গলায় কথা বলবেন।
অফ কোর্স। বলবো।
আর স্যারের সামনে তার নাতনির দিকে ভুলেও তাঁকাবেন না।
শিহাব ভড়কে গিয়ে বলল,
তার নাতনি এখানে আছে নাকি?
জ্বি। গতকাল রাতে আসছে। উনার দিকে তাঁকাবেন না। তাঁকাইলে ভাববে আপনার চরিত্রে দোষ আছে। আর চরিত্র দোষ আছে এমন মানুষ স্যার দেখতে পারেন না।
শিহাব বলল,
নো। না। আই ওন্ট লুক এট হিজ গ্র্যান্ড ডটার।
ফারুক তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,
গুড। ভেরি গুড। আপনার তো ভেরি গুড চরিত্র। ভেরি গুড চরিত্র!
#১০ম_পর্ব
#আতিয়া_আদিবা
দূর থেকে ফারুককে আসতে দেখে নিয়াজ করিম তার নাতনিকে বললেন,
তুই বোস। আমি জামাটা পাল্টে আসি। হাজার হলেও একটি বড় কোম্পানি থেকে দেখা করতে লোক এসেছে। আমি এই জায়গার মালিক। জামাকাপড়ে একটা মালিক মালিক গন্ধ থাকা প্রয়োজন।
বর্ষা বলল,
জামাকাপড়ে আবার মালিক মালিক গন্ধ কিভাবে থাকে দাদাজান?
নিয়াজ করিম বললেন,
থাকে থাকে! জামাকাপড়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া থাকে। কাপড়টা পাল্টে ফিরে আসি তখন দেখিস।
বর্ষা হেসে বলল,
ঠিকাছে এসো।
নিয়াজ করিম নিজের ঘরের দিকে এগোলেন।
শীতল পাটিতে যত্ন করে রেখে দেওয়া বইটি বর্ষা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ তার ভীষণ ভালো লাগে। সে বইয়ের মাঝে নাক গুঁজে বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগলো।
ফারুক শিহাবকে নিয়ে এদিকটায় চলে এসেছে। নিয়াজ করিমকে কোথাও দেখতে না পেয়ে সে বর্ষাকে প্রশ্ন করল,
আপা স্যার কই?
বর্ষা ফারুকের দিকে না তাঁকিয়ে উত্তর দিল,
দাদাজান ভেতরে গিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। যে ভদ্রলোকের আসার কথা ছিল তিনি এসেছেন?
জি আপা। এই তো পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।
শিহাব ক্ষীণ গলায় সালাম দিল,
আসসালামু আলাইকুম।
গলার স্বর শুনে চমকে উঠল বর্ষা। কি পরিচিত গলার স্বর! এই গলার স্বর সে আগে কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায় শুনেছে?
বর্ষা মুখ তুলে তাঁকালো। শিহাব ও তার দিকে তাঁকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই দুজনের চক্ষু যেনো ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইলো।
শিহাব অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
আপনি এখানে?
বর্ষা স্বাভাবিক গলায় বলল,
এত অবাক হওয়ার কি আছে? এ ফার্ম হাউস আমার দাদার। আমি যখন খুশি আসতে পারি। এই প্রশ্ন তো আমার আপনাকে করা উচিত। আপনি এখানে কেন এসেছেন?
আমি এসেছি কোম্পানির কাজে।
বেশ তো! কাজ করে চলে যান।
না মানে। আপনার সাথে এখানে দেখা হয়ে যাবে ডিডেন্ট এক্সপেক্ট দ্যাট!
বর্ষা ফারুকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বর্ষার মুচকি হাসির অর্থ একেক সময় একেক রকম। এখন এই মুচকি হাসির অর্থ ধরা যেতে পারে – ফারুকের প্রস্থান কামনা। ফারুক বর্ষার মুচকি হাসির অর্থ ধরতে পেরেছে কিনা বোঝা গেল না। তবুও সে মাথা নিচু করে চলে গেল।
ফারুক চলে যেতেই বর্ষা আগ্রহ ভরা কন্ঠে শিহাবের কাছে জানতে চাইল,
আগে থেকে এক্সপেক্ট করলে কি করতেন? এখানে আসা ক্যানসেল করে দিতেন? নাকি পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দিতেন?
শিহাব ঢোঁক গিলে বলল,
না ক্যানসেল কেন করব। কোম্পানির জন্য আসতেই হত।
তাহলে এমন বলদ টাইপ চেহারা কেন বানিয়ে রেখেছেন?
না মানে! আনএক্সপেক্টেড ভাবে দেখা হয়ে গেল তো। তাই আর কি।
আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
Not at all. ভয় কেন পাব? Is there any reason to be afraid?
বর্ষা হাসি চাপিয়ে নরম সুরে বলল,
ভাবতেই পারেন আমার দাদাও ২৪ ঘন্টার জন্য আপনার সাথে কোন এগ্রিমেন্ট যাবে কিনা!
শিহাব কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারল না। কেননা, বর্ষার দাদা নিয়াজ করিমকে এদিকটায় আসতে দেখা গেলো।
বর্ষা ফিসফিস করে বলল,
ভয় নেই। আমার দাদা আইনের ছাত্র ছিলেন না।
এটুকু বলেই সে ক্ষান্ত হলো না। মুখ চাপিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। শিহাব লক্ষ করল বর্ষা হাসলে বাম গালে ছোট্ট একটি টোল পরে। বেশি গভীর নয়। খুব মনোযোগ দিয়ে তার হাসি পর্যবেক্ষণ করলে এই টোলের অস্তিত্ব টের পাওয়া সম্ভব। শিহাব চোখ ফিরিয়ে নিলো।
নিয়াজ করিম এসেছেন ধুতি পাঞ্জাবি পরে। গায়ে চাদর জড়ানো। মুখে চুরুট। তার পিছে পিছে মালা এসেছে। হাতে দুটো চেয়ার। ঝাঁকড়া গাছটার কিছু দূরে চেয়ার দুটো ফেলা হলো। শিহাব নিয়াজ করিমকে সালাম দিলো। নিয়াজ করিম সালামের উত্তর দিলেন না। ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,
আপনার চেহারা সুরাত তো ভালোই আছে!
শিহাবকে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
সর্যি স্যার?
বললাম, আপনার খোমা সুন্দর। ফেইস কাটিং। আগের বার আপনার কোম্পানি থেকে যে লোক এসেছিলো তার মুখ ছিলো ছিলা মুরগীর মতো। দাঁড়ি কামানো ছেলে সমান সমান ছিলা মুরগী।
শিহাব ছোট্ট করে ঢোক গিললো। নিয়াজ করিম চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? চেয়ারে বসেন।
শিহাব পরিপাটি ভাবে চেয়ারে বসলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
ভালো আছেন, স্যার?
নিয়াজ করিম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
ভালো আছি কিনা জানি না। তবে বেঁচে আছি কিন্তু শান্তিতে নাই। দুইদিন পর পর যদি টাওয়ার বসানোর জন্য আপনাদের কোম্পানি থেকে এভাবে লোক পাঠায় কীভাবে শান্তিতে থাকবো? অথচ এই বয়সে আমার শান্তিতে থাকার কথা। হাতে একটা তসবি থাকবে। মাথায় থাকবে টুপি। বাড়ির সামনে হাঁটবো আর আল্লারে ডাকবো। অথচ এসব কিছুই করতে পারছি না। সিম কোম্পানির ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছে।
শিহাব বলল,
সর্যি স্যার! আসলে এক্টেল এর নেটওয়ার্ক এদিকটায় পাওয়া অনেক বেশি টাফ! তাই একটা টাওয়ার বসানো ইজ ব্যডলি নিডেড। আপনি যদি একটু কনসিডার করতেন!
আমার উত্তর আমি পূর্বেও জানিয়েছি, এখন আবার জানাচ্ছি। মাসে লাখ টাকার বিনিময়েও এইখানে আমি টাওয়ার বসাতে দিবো না।
শিহাব আরো কয়েকবার বিভিন্ন অফারের মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলো। ফলাফল শূন্য।
মালা ট্রেতে করে চা, বিস্কুট ও কেক নিয়ে এসেছে।
নিয়াজ বললেন,
সময় নষ্ট করে লাভ নেই বাপু। চা খেয়ে চলে যান। এই ফার্ম হাউজে কোনো টাওয়ার বসবে না।
এমন সময় ঘরের ভেতোর টেলিফোন বেজে উঠলো। নিয়াজ বিরক্ত মুখে টেলিফোন ধরতে উঠে গেলেন।
তিনি বাড়ির ভেতর ঢুকতেই বর্ষা গুটি গুটি পায়ে শিহাবের দিকে এগিয়ে আসলো।
শিহাব এতক্ষণ চায়ের কাপ স্পর্শও করেনি। বর্ষাকে দেখে কাপ হাতে নিয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিলো।
বর্ষা হেসে বলল,
কাজ হয়েছে?
শিহাব অসহায় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো। বর্ষা ক্ষণিককাল চুপ থেকে বলল,
আপনি চাইলে দাদাজানকে অনুরোধ করে দেখতে পারি। উনি আমার কথা ফেলতে পারবেন না।
শিহাবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
সত্যি? আপনি রিকুয়েস্ট করবেন তাকে?
রিকুয়েস্ট করা তো আহামরি কিছু না। এতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। করা যেতেই পারে।
এই প্রজেক্টটা ফাইনাল না করতে পারলে জবটা আমার নাও থাকতে পারে। প্লিজ হেল্প মি, বর্ষা!
শিহাবের মুখে এই প্রথম নিজের নাম শুনলো বর্ষা। অজানা এক ভালোলাগার শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে গেলো তাকে। বেচারার জন্য কিছুটা মায়াও লাগলো।
বর্ষা গলা পরিষ্কার করে বলল,
আপনার উপকার করে আমার কি লাভ? আমি কি পাবো?
শিহাব বলল,
আপনি যা চান। হোয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট!
বর্ষা চিন্তার ছিপ ফেললো। তার ছিপে বড় সড় সাইজের দুষ্ট বুদ্ধি আটকা পরলো। সে হাসিমুখে বলল,
ইংলিশ বাবু! আপনার ক্ষণে ক্ষণে ইংরেজি আওড়ানোটা বন্ধ করতে হবে। এরপর যখন আসবেন খাঁটি বাংলায় কথা বলতে হবে। পারবেন?
শিহাব বিস্মিত স্বরে বলল,
ইট’স নট পসিবল! আমিতো ঠিকমতো বাংলা পড়তেও জানি না।
বর্ষা হাসিমুখে বলল,
কোনো সমস্যা নেই! বাজারে অনেক বই পাওয়া যায়। ‘দশ দিনে ইংরেজিতে বাঘ’ টাইপের। আপনি ‘দশ দিনে বাংলায় সিংহ’ টাইপ বই খুঁজবেন। প্রয়োজনে ঢাকার নীলক্ষেতে যাবেন। বুঝেছেন?
শিহাব হতভম্বের মত বর্ষার দিকে তাঁকিয়ে রইলো।
বর্ষা বলল,
আবার বলদের মত চেহারা করেছেন? শোনেন, এই একটা মাত্র কন্ডিশন। ভেবে দেখুন কি করবেন। চলি, ইংলিশ বাবু! শুভ কামনা।
বর্ষা আর দেরী করলো না। উলটো ঘুরে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে এগুতে লাগলো।