#নীল_শূন্যতা
লেখনীতে: মাহমুদা
|শেষাংশ|
মিমের বাবা দেশে ফিরে সবটা নিয়ন্ত্রণ করে নেয় ঠিক, কিন্তু মিমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মিম যেন শকে আছে। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া তাকে কক্ষ থেকে বের হতে দেখা যায় না। সারাদিন কক্ষের দরজা লাগিয়ে ভেতরেই থাকে। না খাওয়া-দাওয়া করে, আর না কারো সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝে প্রায় সারারাতই তার কক্ষের বাতি জ্বালানো থাকে। সপ্তাহের তিনদিন কলেজে গেলে বাকি তিনদিন যায় না। পড়ালেখাতেও তার মনোযোগ নেই। ব্যাপারটি নিয়ে মিমের বাবা-মা ও তুষার এবং তার পরিবার বেশ চিন্তিত হয়। তুষারের পরিবার মিমের সাথে কথা বলে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ।
দেখতে দেখতে ঈদ-উল-আযহা চলে আসে। সেই ঈদেও মিমের কোন আনন্দ নেই, আট-দশ দিনের মতো করেই সে ঈদ কাটিয়েছে। না মেহেদী দেওয়া আর না নতুন জামা পরিধান করে ঘুরতে বের হওয়ার মতো কোন কাজ সে করেছে। ঈদের ছুটিতে তুষার বাড়ি ফিরলেও সে ইচ্ছাকৃতভাবে মিমের সাথে দেখা করেনি। তার বাবা-মাকে বলে মিমের পরিবারকে দাওয়াত দেয়।
ঈদের তৃতীয় দিন,
মিম যেতে অনিচ্ছুক। কিন্তু তার বাবার কথায় সে যেতে রাজি হয়। জনাব নাহিদ, জনাবা তাহমিনা অনেক চেষ্টা করেন মিমকে বুঝাতে, কিন্তু তারাও ব্যর্থ। দুপুরের খাবারের সময় সবাই টেবিলে থাকলেও তুষার আসেনি। মিম এক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। হঠাৎ জনাবা তাহমিনা মিমকে ডাকলে সে তার দিকে তাকায়। জনাবা তাহমিনা মিমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তুষার তো আসছে না। তুমি একটু ডেকে আনবে?’
মিম কথাটিতে বিরক্ত হয়। বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তুষার কক্ষ কোনটা সে তা জানত। তুষারের কক্ষের সামনে দৃষ্টি নিচু করে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়া নাড়ে। প্রথমবারেই তুষার দরজা খুলে দেয়, যেন সে মিমেরই অপেক্ষায় ছিল। মিম তুষারের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকায়। তুষার নিষ্পলক মিমের দিকে তাকিয়ে আছে। তুষারের এ-ই দৃষ্টিতে আজ মিম অন্য ভাষা বুঝতে পারছে। তুষার নিজেও দৃষ্টিতে সবটা প্রকাশ করছে যেন। দৃষ্টি সরিয়ে মিম বলে,
‘আন্টি খাবারের জন্য ডাকছে। আসুন।’
তুষার ভ্রু উঁচু করে মিমের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করে,
‘কী?’
‘আন্টি ডাক্,,’ মিম তার বাক্যটি পুনরায় সম্পূর্ণ করতে পারেনি।
মিমের এক হাত ধরে এক টানে তাকে নিজ কক্ষের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় তুষার। এতে মিম ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে কাচুমাচু হয়ে সে একপাশে সরে দাঁড়ায়। মিমকে ভয় পেতে দেখে তুষার তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
‘আরে, রিলেক্স। কোন খারাপ উদ্দেশ্যে তোমায় ভেতরে আনিনি। এসো এদিকে‚’ তুষার আবারও মিমের বাহুতে হাত রাখতে গেলে মিম আবারও সরে দাঁড়ায়। মিমের এমন আজব ব্যবহার আর ভয়ে তুষার বিরক্ত হয়ে যায়। রাগান্বিত কন্ঠে মিমকে ধমক দিয়ে বলে,
‘এমন ব্যবহার করছ যেন আমি তুষার নই, কোন পশু। চুপচাপ বসো বিছানায়।’
তুষারের ধমকে মিম আরো আৎকে উঠে। ভয়ে তার চোখে পানি চলে আসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুষার মিমের দু’বাহুতে ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। মিমের সামনে নিজে হাঁটু গেড়ে বসে। মিমের চোখে চোখ রেখে তুষার বলে,
‘কেন মানতে পারছ না? কেন অস্বাভাবিক হয়ে আছ? আমি কি কখনও তোমার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি?’
উত্তরে মিম না বোধক মাথা নাড়ায়। তুষার বলতে থাকে,
‘তবে কেন এমন ব্যবহার করছ? তোমার জীবনে অন্য কেউ আছে কি?’ একইভাবে তুষারের প্রশ্নে মিম না বোধক মাথা নাড়ায়। তুষার ফের প্রশ্ন করে,
‘তবে কী সমস্যা? কী ভুল আছে আমার মাঝে?’
‘আমি প্রতিষ্ঠিত হতে চাই,’ মিম এতটাই ধীরে বলে যে তুষারের মনোযোগ না থাকলে শুনতে পাওয়া অসম্ভব। তুষার হেসে বলে,
‘তো তোমায় কে বাধা দিচ্ছে? আমি, না আমার পরিবার? তুমি প্রতিষ্ঠিত হবার পরই তোমায় ঘরে তুলা হবে, এর আগে না।’
ভয়াতুর চাহনিতে মিম প্রশ্ন করে,
‘আমিই কেন?’
‘কারণ তুমি আমার অন্ধকার জীবনের আলো।’
‘বুঝলাম না!’
তুষার সংক্ষেপে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলে, কীভাবে ভুল কাউকে ভালবেসে নেশার জগতে চলে যায় এবং মিমের মাধ্যমে ফিরে আসে। সবটা শুনে মিম বাকরুদ্ধ হয়ে যায়৷ আজ সে বুঝতে পারছে কেন জনাব নাহিদ ও জনাবা তাহমিনা তাকে এতো পছন্দ করত, এতো আদর করত। তুষার মিমের দু’হাত তার দু’হাতে বন্দি করে নিয়ে বলে,
‘প্রমিস করছি, মিম। কখনও ছেড়ে যাব না। তোমার ভুল সিদ্ধান্ত ও কাজ ব্যতীত কোন কিছুতে বাধা দেব না। ভুল বুঝাবুঝি গুলো কথা বলে মিটিয়ে নিব। তবুও যদি না করতে হয়, তবে একটামাত্র কারণ দেখিয়ে না করো।’
‘ভাইয়া, না করার কোন কারণ নেই। আপনাকে আমি ছোট থেকে জানি। আমার সমস্যা একটাই, আমার স্বপ্ন পূরণের বাধা হয়ে যেন না দাঁড়ান,’ মিম উত্তরে বলে।
‘কখনও না। আমি নিজে তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে লড়াই করব। তাছাড়া, আমার মা’কে আমার বাবা নিজেই প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন,’ তুষার হেসে বলল।
মিম একটু হাসে। তুষার এতে প্রশ্ন করে,
‘তবে কি আমি হ্যাঁ ধরে নেব?’
উত্তরে মিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। তুষারের খুশি আর দেখে কে! মিম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘ বাহিরে সবাই অপেক্ষা করছে। বেশি দেরি হলে আবার—। ’
মিমের বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে তুষার বলে,
‘কিছুই ভাববে না। এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল।’
তুষারের কথা শুনে মিমের চোখজোড়া বড় হয়ে যায়। তুষার উঠে দাঁড়ায় এবং মিমকে দরজা খুলে দিয়ে বলে,
‘যাওয়া যাক? এমনিতেও আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে।’
মিম একটু হেসে উঠে দাঁড়ায় এবং তুষারের সাথে বাহিরে যায়। মিমের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক দেখে দু’পরিবার সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। সেদিন মিমের সম্মতি পেয়ে তুষার তাকে আঙটি পরিয়ে দেয়।
মিম তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কলেজ, পড়ালেখা, পরিবার এবং সারাদিনে দশমিনিট সময় তুষারের সাথে কথা বলাটাই তার নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১ম বর্ষ উত্তীর্ণ করে ২য় বর্ষে উঠেছে সে। হঠাৎ একদিন মিমকে কিছু না জানিয়ে তুষার বাড়ি ফিরে। তুষারের পরিবার পর্যন্ত জানত না যে আজ সে ফিরবে।
পরদিন দুপুর হতে না হতে তুষার বেরিয়ে যায়। উদ্দেশ্য তার মিমের কলেজ। কলেজ গেটের সামনে বিশাল এক সড়ক। সড়কের অপরপাশে একটি বিশাল বটগাছ। সেখানে বসে মিমের অপেক্ষা করছে সে। ঘড়িতে সময় দেখে বুঝতে পারে এখন তার ছুটি হবে। সে মুহুর্তে তুষার মিমকে মেসেজ দেয়। মেসেজে লেখা ছিল, ‘আমি কলেজের সামনের বটগাছটায় বসে আছ তোমার অপেক্ষায়।’
শেষ ক্লাস সম্পন্ন হলে ছুটির বেল বেজে উঠে। টিচার কক্ষ ত্যাগ করামাত্র মিমের অভ্যাস নিজের মোবাইলফোন লুকিয়ে চেক করা। কলেজ সময় ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। তাই সে দেখে নেয় কেউ তাকে কল করেছে কি-না। তুষারের এ-ই মেসেজ দেখামাত্র মিম বেশ খুশি হয়। দ্রুতগতিতে সকলকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়েই সে কলেজ থেকে বের হয়ে তুষারের বলা স্থানে তাকিয়ে দেখে সত্যিই সে সেথায় দাঁড়িয়ে আছে। খুশিমনে সে রাস্তা পার হতে থাকে।
তিনবছর পর,
তুষারের ভাই এখন বেশ বড় হয়েছে। হাই স্কুলে পড়ছে সে। কোন এক বিকালে তার ভাই একা একা ছাদে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় তুষার নিজেও সেখানে আসে। তার ভাইকে প্রশ্ন করে,
‘একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস?’
‘উপভোগ্য আকাশের সৌনদর্যতা,’ মিমের মতো এমন অভাবার্থক বাক্যে উত্তর দেয় তুষারের ভাই। তুষার মলিন হেসে প্রশ্ন করে,
‘কখনও অনুভব করেছিস, এর নীল শূন্যতা!’
তুষারের ভাই তার দিকে বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। তুষারের মনে পড়ে যায় তিনবছর আগের ঘটনা।
সে অন্যদিকে মনোযোগী ছিল। দু’টো ফড়িং একত্রে বসে ছিল কোথা থেকে হঠাৎ একটি ব্যাঙ এসে একটি ফড়িংকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও তুষারের বেশ খারাপ লাগল। পাশ ঘুরে তাকানোর আগে সে হৈ চৈ শুনে রাস্তার দিকে তাকায়। কলেজের শিক্ষার্থীসহ আরো অনেকেই রাস্তার মাঝখানে ভীড় জমিয়েছে। তুষারের এমনিতেও রাস্তা পার হতে হতো। তাই সে সেদিকটার ঘটনা দেখার জন্য এগিয়ে যেতে লাগল। কিছুদূর যাবার পর রাস্তায় রক্ত দেখে তুষার বুঝতে পারে এখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে। তুষার ভীড় ঠেলে সামনে এগোতে লাগল। কিছুদূর যাবার পর তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। একটি মেয়েলি হাত সে দেখতে পায় যা রাস্তায় পড়ে আছে। হাতের একটি আঙুলে একটি আঙটি যা তুষারের বেশ চেনা। মনে মনে নিজেকে নিজে ধমক দিয়ে মন্দ চিন্তা দূর করতে করতে এগিয়ে যায়। কিন্তু রাস্তায় পড়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে তুষার থমকে যায়। ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তার দৃষ্টি ভরে যায় অশ্রুজলে। ধপাস করে সেখানে বসে পরে তুষার। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পরে আছে মিম। তার চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা নোনাজল বের হয়। কলেজের পাশেই প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ। সেখানকার ডাক্তাররা দ্রুত এগিয়ে আসেন। কিন্তু কোন লাভ হয় না। মিম ইতোমধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। অতিরিক্ত আনন্দের জন্য রাস্তা পার হবার সময় সে গাড়ি-ঘোড়া খেয়াল করেনি, যার ফলাফল স্বরূপ একটি অতিরিক্ত গতির বাস এসে তাকে মৃত্যুর দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে যায়। যখন ডাক্তাররা বলল যে মিম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে, ঠিক তখন তুষার নিজেও জ্ঞান হারায়।
বর্তমানে,
অসীম নীল শূন্যতার পানে অশ্রুসিক্ত নয়নে মলিন হেসে দাঁড়িয়ে আছে তুষার। তার অশ্রুজলে কোন এক অদৃশ্য বাঁধ বাধা দিয়ে রেখেছে। তার বারংবার মিমের বলা একটি কথা মনে হচ্ছে,
‘প্রিয়, নীল আকাশের মাঝের সাদা মেঘের ভেলার সৌন্দর্য তো সবটুকু উপভোগ করো। কিন্তু, এই নীলের মাঝে লুকায়িত শূন্যতা কেন অনুভব করতে চাও না! বলতে পারো?’
তুষারের গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে নোনাজল। কিন্তু সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে নীল শূন্যতা উপভোগে ব্যস্ত। যেন নীল শূন্যতার সাদা মেঘমালা মিমেরই মুখমন্ডল।
সমাপ্ত।