#নয়নতারা_১৩
#জেরিন_আক্তার_নিপা
ঝিনুকের অতগুলো কথা শুনে নয়নতারা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। জীবনে এতগুলো কথা কেউ বলেনি তাকে। ঝিনুক আপু তো না-ই। কেঁদেকেটে নয়নতারা চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলল। থাকবে না সে এই বাড়িতে। চলেই যাবে। হোক কষ্ট। ঝিনুক আপু তাকে এভাবে বকতে পারল!
সন্ধ্যার পরপরই নক্ষত্র এসে হাজির হলো। সে ভেবেছিল শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে দেখে মুখ মুচড়ে এড়িয়ে যাবে। তাকে সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু এখানে এসে তার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। ওরা পারলে তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। জামাই আদর করে জান বের করে নেওয়ার উপক্রম করল। একটা মানুষেরও মুখ ভার দেখল না সে। বিয়ের দিনের ওই ঘটনা সবাই বেমালুম ভুলে গেছে। সে বাড়ির প্রথম এবং একমাত্র জামাইয়ের আসন জয় করে নিয়েছে। তাকে নিয়ে সবার কত আহ্লাদ। এরা কত খাতিরযত্ন করছে ওকে। অথচ সকালেও ইমন তাকে ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দেয়। নক্ষত্র মনে মনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখল। রাতে খাবার টেবিলে বসে ওদের আয়োজন দেখে নক্ষত্রর চোখ কপালে উঠে গেল। এত খাবার কে খাবে? তাকে এরা রাক্ষস মনে করেছে নাকি? দুইটা আস্ত মুরগী। মাছ, মাংস, ডিম ভাজাভুজি তো আছেই। এতকিছু খাওয়া তো পরের কথা, দেখেই নক্ষত্রর পেট মুচড় দিয়ে উঠল। ওরা জোর করে খাইয়ে খাইয়ে তাকে মারার প্ল্যান করেছে নাকি? শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো তার উপর এভাবে প্রতিশোধ নিতে চাইছে!
রাতের খাওয়া শেষে তারার বাবা ওকে একান্তে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। মানুষটা বেশ আন্তরিক ভাবে ওর সাথে কথা বলছে। যেন কোন বাবা তার অবুঝ ছেলেকে কোনোকিছু সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছে। অজানা সম্পর্কে তাকে জানাচ্ছে।
—-আমার নয়নতারা বাকি সবার থেকে একটু আলাদা। ওকে ছোটবেলা থেকে সবাই এতটা আদর দিয়েছে যে, নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সামান্য জ্ঞানও রাখে না সে। ছোট ভেবে সবাই আশকারা দিয়েছে। কেউ ধমক দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দেয়নি।’
নক্ষত্র বুঝতে পারছে শ্বশুর মশাই তাকে কী জানাতে চাইছে। সে নিজেও ব্যাপারটা জানে। তাই সে বলল,
—–আপনি চিন্তা করবেন না। আমিও হুট করেই ওর উপর কোনোকিছু চাপিয়ে দেব না। নয়নতারার সবটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে।’
তিনি এক ধ্যানে নক্ষত্রর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসলেন।
—-আমি জানি। তবুও মাঝে মাঝে তুমি হয়তো আমার মেয়েটার আচরণে বিরক্ত হবে। আমি তোমাকে ওকে শাসন করতে বারণ করছি না। তোমার স্ত্রীকে তুমি যেভাবে সংসারী করে নিতে পারো। নয়নের মত মেয়েরা এক সময় দক্ষ গৃহিণী হয়। ওকে নিয়ে তাই আমার তেমন চিন্তা নেই। তবে ওকে সেই সময়টা দিতে হবে।’
—-দেব। আমি ওকে সেই সময় দেব। আপনাকে কথা দিচ্ছি, ওর কোন কাজেই আমি বিরক্ত হব না। ঠিক যতটা কঠিন হলে নয়নতারা নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হবে, আমি ওর সাথে ততটাই কঠিন হব। ওর ভুলে ওকে ধমকালেও পরমুহূর্তে ওর বুঝদারিতে ওকে বাহবা দেব।’
ফেরার সময় নক্ষত্রর নয়নতারাকে আসার কথা বলতে হলো না। সে নিজেই রেডি হয়ে নক্ষত্রর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নক্ষত্র মনে মনে কম অবাক হয়নি। সে সকালেই তারার চোখ দেখে বুঝতে পেরেছিল আজ এই মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে ফিরবে না। কিন্তু যাবার সময় যে নিজে থেকেই রওনা দিবে তা কে জানত? তাইতো আজ সে বাইক নিয়ে এসেছে। গাড়িতে চলাফেরা করতে তার ভালো লাগে না। থমথমে মুখে সবার থেকে বিদায় নিল নয়নতারা। নক্ষত্র বাইক স্টার্ট দিয়ে ওকে পেছনে বসতে বলল।
—-আমার কাঁধে ধরে বসো। নইলে বাড়ি ফেরার পর দেখা যাবে আমি একা ফিরেছি। পেছনে তুমি নেই। রাস্তায় কোথাও পড়ে আছো।’
নয়নতারা ধরল না। নক্ষত্রও শয়তানিতে শয়তানকে পেছনে ফেলে। সে ইচ্ছে করে অন্য রাস্তা ধরল। এই রাস্তাটা যথেষ্ট খারাপ। মাঝে মাঝেই বড় বড় গর্ত। চালাচ্ছেও সে বেশ দ্রুত গতিতে। বাধ্য হয়ে নয়নতারা নক্ষত্রের কাঁধের শার্ট খামচে ধরল। বাজে লোক! ইচ্ছে করে এভাবে চালাচ্ছে। সে পড়ে গেলে খুশি হবে ইতর লোকটা।
ঘরে ফিরেই নয়নতারা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। চেঞ্জও করল না। আজ ওর মনটা ভীষণ খারাপ। ঝিনুক আপু বকেছে। আর সে চলে আসার সময় কেউ তাকে থাকতে সাধেনি। মা’ও বলেনি, নয়ন আজকের রাতটা থেকে যা। সবাই একদিনে তাকে এমন পর করে দিল! তাকে রেখে সারাক্ষণ ওই লোকটাকে নিয়েই মাতামাতি করেছে। নক্ষত্র নয়নতারাকে ডাকল,
—-চেঞ্জ করে শোও তারা।’
উত্তর দিল না নয়ন। এই লোকের জন্য সবাই তাকে পর করে দিয়েছে। নক্ষত্র জোড়াজুড়ি করল না। সবাইকে ছেড়ে এসে মেয়েটার মন খারাপ। সোফার দিকে তাকিয়ে সে আঁতকে উঠল। আজ সারাটাদিন শরীর ব্যথা করেছে। আজ আর সে সোফায় শুবে না। নক্ষত্র বাইরে থেকে এসে দেখে নয়নতারা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে তারাকে ডাকল না। সাবধানে শব্দ না করে ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন নয়নতারার ঘুম ভাঙার আগে সে উঠে গেল।
বিয়ের ঠিক দুইদিন পর শাশুড়ির সাথে নয়নতারা মুখোমুখি হয়। নয়নতারা প্রথমে শাশুড়িকে দেখে অবাক হয়েছে। কেউ বলবে এই মহিলার এত বড় একটা ছেলে আছে! ছেলে আবার বিয়েও করে ফেলেছে। কিন্তু মা’কে এখনো কলেজে পড়ুয়া তরুণী মনে হয়। হিন্দি ফিল্মের নায়িকা গুলো এতটা সুন্দর, স্লিম হয়।
—-শোন মেয়ে, আমার ছেলে তোমাকে বিয়ে করলেও আমি তোমাকে ছেলের বউ মানি না। প্রথমে তোমার বোন আমার ছেলেকে পাগল বানিয়ে প্রেমিকের সাথে ভেগেছে। তোমার পরিবারও কম চালাক না। সুযোগ বুঝে বড় মেয়ের জায়গায় ছোটাটকে আমার নক্ষত্রের গলায় ঝুলিয়েছে। নক্ষত্রর মত ছেলেকে হাতছাড়া করতে চাইবে কেন? ওর বাপের টাকা দেখেছে। লোভী পরিবার।’
টুপ করে নয়নতারার চোখ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ল। তার পরিবারকে নিয়ে এত বাজে কথা নয়নতারা কখনো শুনেনি।
—-মেয়েকে শিক্ষা দিতে পারেনি ওরা নাকি আবার বাবা মা! তোমাদের জন্য আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি পারো আমার ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে এবাড়ি ছেড়ে চলে যাও। তুমি চলে গেলে আমার ছেলের বউয়ের অভাব হবে না।’
মহিলা নয়নকে কথা শুনিয়ে গটগট করে চলে গেল। নয়ন অসহায় বেচারি ঘরে এসে কেঁদে বুক ভাসাল। শাশুড়ির অপমানজনক কথাগুলোর জবাবে সে কিছুই বলতে পারল না। ফোঁপাতে ফোপাঁতে নয়নতারা বলছে,
—-বিয়ে কি আমার বাবা মা জোর করে দিয়েছিল! আপু পালিয়ে যাওয়ায় আমার পরিবারের তো কোন হাত নেই। আপুর পরিবর্তে উনার ছেলেই তো জোর করে আমাকে বিয়ে করেছে। এখন উনি আমার বাবা মা’কেই খারাপ ভাবছে। চলে যাব। থাকব না এই বাড়িতে। ডিভোর্স দিয়ে নিজেকেই এই মিথ্যে সম্পর্ক থেকে মুক্ত করব। এরকম দজ্জাল শাশুড়ি কারো হয়!’
কথাগুলো বলে অবুঝের মত কাঁদছে নয়নতারা।
নক্ষত্র যতক্ষণ বাড়ি থাকে সারাক্ষণই দরকারে অদরকারে নয়নতারাকে ডাকাডাকি করে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। ওর কোন জিনিস কোথায় আছে খুঁজে বের করে দিতে বলে। নয়ন বাধ্য মেয়ের মত নক্ষত্রর সব কথা শুনে। ওর কোন কথার অবাধ্যই হয়না। আজ নক্ষত্র বাড়ি ফিরে নয়নতারার ফোলা চোখ দেখে জিজ্ঞেস করে,
—-কী হয়েছে?’
—-কিছু না।’
—-কিছু না হলে কান্না করেছ কেন?’
—-কাঁদিনি।’
—-এখন আবার মিথ্যেও বলছো! তোমার চোখ দেখে আমি বুঝতে পারছি না মনে করেছ? এতটা বোকা ভাবো নাকি আমাকে। তোমার মুখের চেহারা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে একটু আগেও তুমি কেঁদেছ। কী হয়েছে? কেন কেঁদেছ আমাকে আসল কারণ বলো।’
নয়নতারা কিছুই বলল না। নক্ষত্র অনেক চেষ্টা করেও ওর পেট থেকে সত্যি কথা বের করতে পারল না। শেষমেশ নিজেই রেগে গিয়ে বলল,
—-থাক বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি তুমি মনের সুখে কেঁদেছ। ইচ্ছে হয়েছে তাই কেঁদেছ। এখন আমার সামনে থেকে যাও।’
পরমুহূর্তে আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে নয়নতারাকে মানানোর জন্য ওর পেছনে ছুটে গেল।
এভাবেই ওদের একসাথে দু’টা সপ্তাহ কেটে গেল। সম্পর্ক আগের থেকে কিছুটা সহজ হয়েছে। দুই সপ্তাহে নক্ষত্র বউ নিয়ে ছয় সাত বারের বেশি শ্বশুরবাড়িতে চক্কর দিয়েছে। সে এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, বউ না। সে আসলে আস্ত একটা ঝামেলার বোঝা মাথায় নিয়েছে। এখন সেই বোঝা নামানোর উপায় নেই।
নয়নতারা ইদানিং নক্ষত্রর এতটা বাধ্য হয়েছে যে, মাঝে মাঝে নক্ষত্র নিজেরই খটকা লাগে। এটা সেই আগের তারা তো! যে বিয়ের দ্বিতীয় দিনই তাকে পাত্তা না দিয়ে ভাই বোনের সাথে চলে গিয়েছিল। এখন নয়নতারা যদি বাবার বাড়ি যেতে চায়। আর নক্ষত্র যদি বলে, আজ আমার সময় হবে না। কাল নিয়ে যাব। বিনা বাক্যব্যয়ে তারা সেটা মেনে নেয়। জেদ করা একদমই করিয়ে দিয়েছে। কোনোকিছু নিয়ে কষ্ট পেলেও এখন তা প্রকাশ করে না। তারার বুঝদারিতেও নক্ষত্র আজকাল বিরক্ত হয়। তার এই তারাকে ভালো লাগে না। আগের সেই জেদি অবুঝ পিচ্চি তারাই ভালো ছিল। কথায় কথায় জেদ করত। তারাকে মানাতে তার জান বেরিয়ে যেত। তবুও ওই তারাকেই দেখতে চায় নক্ষত্র।
—-নক্ষত্র বাবা! পাগল হয়ে যাচ্ছ তুমি। তুমি কি বুঝতে পারছ তোমার মাথা অর্ধেকটা গেছে। তখনও বিরক্ত হতে। এখনো হচ্ছ। তুমি নিজে কী চাচ্ছ সেটাই তো পরিষ্কার বুঝতে পারছ না। নিজের মন নিয়ে এরকম কনফিউজড থাকলে চলবে?’
আর একটা সপ্তাহ কেটে যায়। নক্ষত্রর খালাতো বোনের বিয়ে। খালামনি তাকে কল করে যেতে বলে। মা’র সাথে খালামনির সম্পর্ক তেমন একটা ভালো না হলেও খালামনি তাকে অনেক ভালোবাসে। দুই বোন হয়েও দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। খালামনির কাছে স্বামী সন্তান সংসার সব। মা’র কাছে তার স্ট্যাটাস, ফিটনেস, পার্টি সব৷ স্বামী ছেলের প্রতি কোন টানই নেই।
—-নক্ষত্র আব্বু তুমি কিন্তু আসবে। তোমার মা’র সাথে আমার ভালো সম্পর্ক না থাকুক। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমার বিয়েতে তোমার মা আমাকে জানায়নি। ও আমার বোন হয়ে এরকম কীভাবে হলো ভেবে পাই না। তুমি আসবে তো বাবা?’
—-আসব খালামনি। মনিকার বিয়ে কবে?’
—-সামনের সপ্তাহে। তুমি আব্বু আজ কালের মধ্যেই তোমার বউকে নিয়ে চলে এসো। ওকে তো আমি এখনো দেখিনি।’
—-আচ্ছা।’
—-তোমার মা আসতে না দিলে ওর কাছে বলে আসতে হবে না। ও যখন আমাকে বোন মানে না তাহলে আমিও ওর কাছে আর ছোট হতে চাই না। ওকেও আমি আমার মেয়ের বিয়েতে ডাকব না।’
নক্ষত্র হেসে ফেলল। তার মা খালা দু’জনই পাগল। নানার বাড়িতে অতীতে কেউ পাগল ছিল কিনা জানতে হবে। নইলে এই দু’জনের ভেতর পাগলামির ছিট কোত্থেকে এলো।
—-আচ্ছা।’