#নয়নতারা_২৮
#জেরিন_আক্তার_নিপা
নয়ন এখন রামিশার সত্যি জানে। ইভানা আপু তাকে সব জানিয়ে গেছে। নয়ন শুধু এটাই ভাবছে নক্ষত্রকে কীভাবে রামিশার আসল রূপ দেখাতে। রামিশা নক্ষত্রর ছোটবেলার বন্ধু। নয়ন যদি বলে রামিশা আমাদের ঘর ভাঙতে এসেছে। আমাদের আলাদা করতে এসেছে তাহলে কি নক্ষত্র তার কথা বিশ্বাস করবে? নক্ষত্র হয়তো রামিশার উদেশ্য কিছুই জানে না।
—-নয়নতারা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
রামিশা সারারাত ভেবেছে। অনেক ভাবার পর নয়নের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা সে খুঁজে পেয়েছে। নয়ন রামিশাকে সহ্য করতে পারছে না। তবুও বলল,
—-করুন।”
—-শুনেছি নক্ষত্র নাকি তোমার বড় বোন ইলাকে ভালোবাসতো। ওদের বিয়ে হতে যাচ্ছিল।”
নক্ষত্র ইলা আপুকে ভালোবাসতো! নয়ন রামিশার চোখের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল নয়ন। রামিশা মিথ্যা বলছে। আপু আর উনার বিয়ে তো ওদের পরিবার ঠিক করেছিল। ইলা আপু যদি উনাকে ভালোই বাসবে তাহলে বিয়ের দিন পালিয়ে গেল কেন? ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে না করে পালিয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। আর নক্ষত্রও যদি ইলাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইত, তাহলে ইলা পালিয়ে গেছে শুনে সে নয়নকে বিয়ে করার জেদ করতো না। আর তার পরিবার এসব জেনে কোনোদিনও নক্ষত্রর সাথে ওর বিয়ে দিতে চাইতো না। রামিশা মিথ্যাই বলছে। ওর আর নক্ষত্রর সম্পর্ক খারাপ করার জন্য এসব করছে।
নয়ন খুব সহজ ও শান্ত গলায় বলল,
—-রামিশা আপু আমি আপনার আসল উদেশ্য জানি। আপনি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেননি। আপনি এসেছেন আমার আর আমার স্বামীর সম্পর্ক খারাপ করতে। সেজন্য আপনি অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি।”
রামিশা স্তব্ধ হয়ে গেল। নয়নতারা তার উদেশ্য ধরে ফেলেছে! নক্ষত্রকে বলে দিয়েছে!
—-আমি জানি আপনি যা বলছেন সব মিথ্যা। আপনি যা কিছুই বলুন না কেন, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করব না। ইলা আপুর সাথে উনার বিয়ে হতে যাচ্ছিল এটা সত্যি। কিন্তু উনি ইলা আপুকে ভালোবাসেন না। যদি ভালোবাসতেন তাহলে কখনও ভালোবাসার মানুষটার ছোট বোনকে বিয়ে করতে পারতো না।”
রামিশা নয়নের কথা শুনে শব্দ করে হাসতে লাগল। নয়ন ওকে হাসতে দেখে বিরক্ত হচ্ছে।
—-গাধা মেয়ে! আরে বোকা, কোন যুগে বাস করছো তুমি হ্যাঁ! চোখের সামনে থাকা সত্য দেখতে পারছো না। নক্ষত্র তোমার বোন ইলাকেই ভালোবাসতো। ইলা পালিয়ে যাবার পর রাগে,জেদে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নক্ষত্র তোমাকে বিয়ে করেছে।”
নয়নের কান্না পাচ্ছে। সে জানে কথাগুলো মিথ্যে। তবুও রামিশার মুখে এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না। যে মানুষটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। যাকে মন থেকে স্বামী স্বীকার করে নিয়েছে। যাকে নিজের সব দিয়ে বসে আছে। সে নাকি তার বোনকে ভালোবাসে। তাকে শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিয়ে করেছে। কখনও তাকে ভালোবাসার চোখে দেখেনি।
কান্না চেপে রেখে নয়ন জোর গলায় রামিশার কথার প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু গলায় জোর পেল না সে। নয়নের হাত-পা কেমন ঝিমঝিম করছে। এটা সত্যি হলে এই সংসারে, নক্ষত্রের জীবনে তার কোন অস্তিত্ব থাকবে না।
—-আপনি কেন এসব করছেন রামিশা আপু? কেন মিথ্যা বলছেন? আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে আপনি কী পাবেন? আমি চলে গেলেও কি উনি আপনাকে বিয়ে করবে? উনি আপনাকে বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। কেন আপনাদের এই সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছেন?”
রামিশা হাসতে হাসতে নয়নের চোখ বেয়ে পড়া এক ফোঁটা পানি মুছে দিল।
—-তুমি কাঁদছো নয়নতারা! তার মানে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করেছ। বিশ্বাস করো নয়নতারা, আমার এখন বলা একটা কথাও মিথ্যে বলিনি। নক্ষত্র সত্যিই তোমার বোন ইলাকেই ভালোবাসতো। এখনও হয়তো বাসে। তুমি তো এখনও অনেক ছোট তাই হয়তো বুঝতে পারোনি। বা পারছো না। আচ্ছা, আমার কথা মানতে পারছো না তো তুমি? তাহলে নক্ষত্রকেই জিজ্ঞেস করে দেখো না ও কী বলে।”
নয়ন অবশ পায়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবতে লাগল, রামিশার কথা তার বিশ্বাস করা উচিত? সত্যিই কি ইলা আপু আর উনার মাঝে কিছু ছিল?
নয়ন আর ভাবতে পারে না। চোখ ভরে পানি আসে তার। কাল রাতের কথা মনে পড়ে। পুলকিত হয় সে। নক্ষত্র তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অনেক কথাই বলেছিল। তার মধ্যে থেকে নয়নের যে কথাগুলো এখন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে তা হলো,
—-আমি তোমাকে ভালোবাসি নয়নতারা। জানি না তুমি আমাকে ভালোবাসো কি-না। আমি তোমার কাছে একটা সুযোগ চাই। আমাদের সম্পর্কটাকে ঠিক করতে চাই। তুমি কি আমাকে সেই সুযোগ দিবে? আমার ভালোবাসায় তোমাকে রাঙিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ দিবে? প্লিজ তারা। আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার সাথেই বাকিটা জীবন কাটাতে চাই আমি। তোমাকে ছাড়া থাকা এখন আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি চাইলেও আমি তোমাকে যেতে দিতে পারব না। তুমি আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছো।”
নয়ন মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলে। নক্ষত্রর বলা কথাগুলো কি তাহলে মিথ্যা ছিল! সে যদি ইলাকে ভালোবেসে থাকে তাহলে নয়নকে এই কথাগুলো কীভাবে বললো? একসাথে কি কখনও দু’জন মানুষকে ভালোবাসা যায়!
নয়ন ঘরে আসে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নক্ষত্রকে দেখে। নক্ষত্র এখনও ঘুমিয়ে আছে। নয়ন এই মানুষটার উপর থেকে চোখ সরাতে পারে না। নক্ষত্রর প্রতি ওর এতটা মায়া কীভাবে তৈরি হলো! কবে,কখন তৈরি হলো? নক্ষত্রর একপাশে বিছানায় বসে থাকে নয়ন। তার মাথা কাজ করছে না। অনেকক্ষণ পর নক্ষত্রর ঘুম ভাঙে। চোখ খুলেই সে নয়নকে দেখে। ওকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে, হাত ধরে নয়নকে কাছে টেনে নেয়। নয়ন আড়ষ্ট থাকে। নক্ষত্র নয়নের কাঁধে থুতনি রেখে দু’হাতে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে রাখে। কানে কানে বলে,
—-গুড মর্নিং বউ। কালকের রাতটাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত বানিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কখন ঘুম ভেঙেছে?”
নয়ন কথা বলে না। তার কী করা উচিত বা কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না সে। রামিশার কথাগুলো মনে মনে খোঁচাচ্ছে। আবার নক্ষত্রকে অবিশ্বাসও করতে পারছে না। নয়ন কি নক্ষত্রকে জিজ্ঞেস করবে, ইলা আপুর সাথে পারিবারিক ভাবে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল? নাকি ওরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো। আচ্ছা নক্ষত্র যদি স্বীকার করে নেয় সে ইলাকে ভালোবাসতো তাহলে কী করবে নয়ন? নক্ষত্র কেন তাকে এই কথা জানায়নি তার জন্য রাগ করবে? ঝগড়া করবে? এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? নক্ষত্র যদি সত্যিই ইলাকে ভালোবেসে তাকে প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করে তাহলে তো নক্ষত্র তাকে ঠকিয়েছে। ধোঁকা দিয়েছে নক্ষত্র তাকে। নয়নকে একরকম চুপ থাকতে দেখে নক্ষত্র ওকে নিজের দিকে ফেরালো।
—-কী হয়েছে তারা?”
—-কিছু না।”
নক্ষত্র হেসে নয়নকে আরও শক্ত করে ধরলো। মুখ বাড়িয়ে নয়নের ঠোঁটে চুমু খেতে গেলে নয়ন সরে গেল। নক্ষত্রর হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ নয়নের চরিত্রের এই পরিবর্তনে নক্ষত্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বিস্মিত চোখে হাঁ করে নয়নকে দেখল। কিছুই বুঝতে পারল না সে। কাল রাত পর্যন্ত তো মেয়েটা ঠিকই ছিল। সকালে উঠে কী হয়েছে? রাতে যখন নক্ষত্র ওকে জড়িয়ে ধরেছিল তখন ভেবেছিল সাথে সাথে একটা চড় খাবে। কিন্তু নয়ন চড় মারেনি। কাল ওদের সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আজ তাহলে চুমু খেতে দিচ্ছে না কেন? মাঝে মাঝে কী হয় এই মেয়ের? নক্ষত্রও থতমত মুখে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। নয়নের সামনে এসে দাঁড়ায়। নক্ষত্র নয়নকে দেখলেও নয়নের দৃষ্টি অন্য দিকে। নক্ষত্র নয়নের হাত ধরে আলতো করে ওকে কাছে টেনে আনে। গভীর যত্নে জানতে চায়,
—-কী হয়েছে তারা? আমাকে বলো। আমার থেকে লুকানোর মতো তোমার কোনো কথা নেই। আমরা দু’জন দু’জনের সব জানব। মুখে বলা কথাগুলো। আর না বলা কথাগুলোও বোঝার চেষ্টা করব। আমি তোমাকে বুঝতে চাই। তোমার যদি কোন সমস্যা থাকে সেটা আমাকে বলো। আমি তোমার সব সমস্যা, সব কষ্ট সবকিছু দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করব।”
নয়ন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। হু-হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে৷ নয়নকে কাঁদতে দেখে নক্ষত্র অস্থির হয়ে যায়। কী হলো নয়নের বুঝতে পারে না সে। কে নয়নকে কী বলেছে? কোন জিনিসটা নয়নকে কষ্ট দিচ্ছে? কাঁদছে কেন নয়ন?
নয়ন কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে। নক্ষত্র অস্থির হয়ে ওর পাশে বসে ওর চোখের পানি মুছে দেয়। বিচলিত গলায় বারবার জানতে চায়,
—-এই তারা, কাঁদছো কেন তুমি? কী হয়েছে আমাকে বলবে তো। মা তোমাকে কিছু বলেছে? তারা প্লিজ এভাবে কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হয়৷ কেন বুঝো না তুমি। বলো না প্লিজ। কী হয়েছে বলো?”
নয়ন ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে দু’হাতে নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মুখ রেখে কেঁদে কেঁদেই বলে,
—-আমাকে ছেড়ে কোনোদিনও যাবেন না আপনি। আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। আমাকে কখনও ঠকাবেন না। ধোঁকা দিবেন না কখনও। আমি সব সহ্য করতে পারব। কিন্তু আপনার থেকে ধোঁকা সহ্য করতে পারব না। আমি যেদিন জানব আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন সেদিনই মরে যাব আমি। অনেক ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে। সারাজীবন আপনাকে পাশে চাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনাকে ভালোবেসে মরতে চাই। আপনি আমার বিশ্বাস ভাঙবেন না।”
নয়নের কথাগুলো শুনে নক্ষত্র বরফের মতো জমে গেল। পাথর হয়ে বসে রইল সে। আজ তার ভয় হচ্ছে। নয়নকে হারানোর ভয়। এই মেয়ে তার থেকে ধোঁকা সহ্য করতে পারবে না। নয়নকে আগেই সব জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল ওর। ওর আর ইলার কথা জানতে পারলে এখন নয়ন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না। নক্ষত্র ভাবছে আজ হঠাৎ এসব কথা বলছে কেন নয়ন? তাকে ঠকানোর কথা, ধোঁকা দেওয়ার কথা কেন বলছে? তবে কি নয়ন কোনোভাবে জেনে গেছে? না,না। কে জানাবে ওকে? ইলার সাথে ওর সম্পর্ক ছিল এটা ঝিনুক, আকিব ছাড়া নয়নদের বাড়ির আর কেউ জানে না। ঝিনুক নয়নকে কিছু জানাবে না। আকিব নয়নকে সব বলে দিয়েছে? নাকি দূরে কোথাও বসে ইলা তার সুখ সহ্য করতে না পেরে এসব শয়তানি করছে। ভাবতে পারছে না নক্ষত্র। বড় ভুল হয়ে গেছে। তারই নয়নকে আরও আগেই বলে দেওয়া উচিত ছিল।
চলবে___