নয়নতারা পর্ব ৩১+৩২

#নয়নতারা [৩২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইলা জ্ঞান হারিয়েছিল। ইমন তাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে। ইলার জ্ঞান ফিরলে ঝিনুক ওকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ভালো কাপড় পরিয়ে দেয়। নয়ন খাবার নিয়ে এসে ইলাকে খাইয়ে দেয়। ইলার ভেতর থেকে এখনও ভয় দূর হচ্ছে না। পরিবারের সবাইকে চোখের সামনে দেখেও তার ভয় কাটছে না। খেতে পারল না ইলা। বমি হয়ে গেল তার। বাবা,চাচা,জেঠু ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। নয়নের মা তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। ইলাকে এতক্ষণ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। মেয়েটার অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতদিন কেমন পরিস্থিতিতে ছিল না। নক্ষত্র ঘরের বাইরে কতক্ষণ পায়চারি করেছে। নয়নের সাথে কথা বলা দরকার ছিল। সে ধৈর্য ধরতে না পেরে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ে। ইলাকে যত তাড়াতাড়ি বলে দেওয়া যায়, নয়ন আর তার বিয়ে হয়ে গেছে ততই ভালো হবে। শুধু ইলার জন্য না। সবার জন্য ভালো হবে। নয়ন না আবার ভুল বুঝে বসে। নক্ষত্রর একমাত্র ভয় এখন নয়নকে নিয়েই।
নয়নের বাবা এতক্ষণে সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়ে যতই অন্যায় করুক। মেয়েকে কষ্টে দেখে আবার বুক না কেঁদে পারে না। নরম গলায় তিনি বললেন,

—-কী হয়েছিল রে মা? বল আমাদের। তোর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা সবাই তোর কাছে আছি তো মা। তুই বল, এতদিন তুই কোথায় ছিলি? কার কাছে ছিলি? বিয়ের দিন ওভাবে কেন গেলি তুই?”

ইলা ঘরের ভেতর নক্ষত্রকে খুঁজে। সবার মাঝে নক্ষত্রকে না পেয়ে বলল,

—-নক্ষত্র কোথায়? ও কি চলে গেছে? ওকে এ ঘরে আসতে বলো।”

নয়নের ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ বসে রইল। ইমন নক্ষত্রকে ঘরে ডেকে আনে। নক্ষত্র এসেই সবার আগে নয়নকে দেখে। নয়ন তার দিকে তাকাচ্ছে না।

—-হ্যাঁ এবার বল মা।”

—-নক্ষত্র তুমি আমার পাশে বসো না।”

নক্ষত্র শ্বশুরের দিকে তাকাল। নয়ন তো তার দিকে তাকাচ্ছেই না। সে কি এখন ইলাকে বলে দিবে। শ্বশুর মশাই কী করতে বলছে তাকে? নয়নের বাবা চোখে ইশারা করলে নক্ষত্র ইলার পাশে গিয়ে বসল। সাথে সাথে ইলা খপ করে নক্ষত্রর হাত ধরে ফেলে। এদিকে নয়নের বুক ফাটে। তবুও মুখে কিছু বলতে পারে না। নক্ষত্র এই মুহূর্তে ইলার থেকে হাতও সরিয়ে নিতে পারে না। ইলার সাথে যা কিছুই ঘটে থাকুক ভালো কিছু যে ঘটেনি তা নক্ষত্র বেশ বুঝতে পারছে। নইলে বিনা কারণে ইলা এত ভয় পাওয়ার মেয়ে না। ইমন অধৈর্য হয়ে বলল,

—-বল না ইলা। চুপ করে আছিস কেন?”

—-সেদিন আমার বউ সাজা হয়ে গেলে বাইরে যাচ্ছিলাম আমি। গেটে তখন নক্ষত্রর গাড়ি এসেছিল। তখন আমার একটা বন্ধু, তুমি ওকে চিনবে ইমন ভাইয়া। রাসেল আসে আমার সাথে দেখা করতে। আমার সাথে নাকি জরুরি কথা আছে। কথাগুলো বলার জন্যই আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়। আমি ওর সাথে পেছনের দরজায় গিয়ে কথা বলি। ওর থেকে জানতে পারলাম, জিসান আমার জন্য হাত কেটে সুইসাইড করতে চাইছে। ও কলেজ থেকেই আমাকে পছন্দ করতো। কয়েকবার প্রপোজও করেছে। আমি পাত্তা দিই নি। রাসেল বলল জিসানের নাকি অবস্থা খারাপ। তবুও ও হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না। যেহেতু রাসেলের ফ্ল্যাটে ও সুইসাইড করতে চেয়েছে ও মারা গেলে রাসেল ফেঁসে যেতে পারে। জিসান নাকি ওর মৃত্যুর দায় আমাকে দিয়ে একটা চিঠি লিখে গেছে। সেদিক থেকে আমিও ফাঁসব। রাসেল অনেক রিকোয়েস্ট করে আমাকে ওর সাথে যেতে৷ আমি রাজি হই না। কারণ একটু পর আমার বিয়ে। বিয়ের সাজে আমি বাইরে যেতে পারি না। রাসেল আমার পায়ে পড়ে গেল। বলল তুমি না গেলে ও হাসপাতালে যাবে না। ওভাবেই মারা যাবে। তুমি গিয়ে ওকে একটু বোঝালেই ও বুঝবে। শেষ সময় পার করছে ও ইলা। তুমি প্লিজ চলো।
আমি ওর কথায় পড়ে যাই। আমি বুঝতে পারিনি ওটা ওদের পাতানো ফাঁদ ছিল।”

ইলা থরথর করে কাঁপছে। নক্ষত্রর হাতে নখ বসিয়ে দিচ্ছে সে। ইলাকে এতটা ভয় পেতে দেখে নক্ষত্র ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

—-ভয় নেই ইলা। এখন কেউ তোমাকে কিছু করতে পারবে না।”

—-আমি ভেবেছিলাম যাব আর চলে আসব। বাড়ির কেউ জানার আগেই ফিরে আসব। আমি কখনও কল্পনাও করিনি জিসানের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি আমি। আমি বুঝতে পারলে নিজের বিয়ে রেখে কোনোদিনও যেতাম না।”

ইমন ঠোঁট কামড়ে ধরে রাগে টগবগ করে ফুটছে।

—-এই তিনমাস তুই ওদের কাছে আটকা ছিলি!”

ইলা ইমনের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

—-ওখানে নিয়েই ওরা আমাকে অজ্ঞান করে ফেলে। তারপরের কয়দিন আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে নিজেকে অন্ধকার রুমে পাই। সেই থেকে আমি ওখানেই আছি। জিসানকে রিজেক্ট করেছিলাম বলে ও আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসব করেছে।”

ইলার বাবা কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ধরে বসে পড়ল। মেয়েটা এতদিন নরকের ভেতরে ছিল। আর ওরা সবাই ভেবেছে ইলা কারো সাথে পালিয়ে গেছে। রাগে,কষ্টে কেউ ইলাকে খোঁজার চেষ্টা করেনি।

—-আমি এই আশায় বেঁচে ছিলাম তোমরা একদিন আমাকে খুঁজে বের করবে। আমি অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। পালাতে চাইলে জিসান আমাকে অনেক মারতো।”

ইলা কান্নার জন্য সব কথা বলতে পারছে না। ইলার জেঠুর চোখ লাল হয়ে গেছে। কাঁপা গলায় তিনি বললেন,

—-আর বলিস না মা। আর বলিস না।”

ইমন হুংকার ছাড়ল।

—-ওই কুত্তার বাচ্চাদের আমি ছাড়ব না। খুন করে ফেলব। পুলিশের কাছে চল। উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব অমানুষ দুই টাকে।”

নক্ষত্র এবার বুঝতে পারল, ওই মেসেজ ইলা করেনি। ইলার ফোন থেকেই ওই ছেলেটা করেছে। নক্ষত্র সামান্য একটা মেসেজে বিশ্বাস করে ইলাকে অবিশ্বাস করেছে! তার ভালোবাসা এতটাই দুর্বল ছিল! ইলার উপর তার বিশ্বাস এতটা ঠুনকো ছিল! ইলার ওরকম বিপদে নক্ষত্র ইলাকে খোঁজার চেষ্টা করেনি। বরং ইলার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভেবেছে। নয়নকে বিয়ে করেছে। নয়ন! হ্যাঁ, নয়নের কথা মনে পড়ায় নক্ষত্রর অস্থির দুই চোখ নয়নকে খুঁজতে লাগল৷ নয়ন ঘরে নেই। কোথায় গেছে ও?

—-বাবলু তোমাকে একটা ছেলের বাইকে উঠতে দেখেছিল ইলা। ও তোমাকে পেছন থেকে ডেকেছে। তুমি শোনোনি।”

—-শুনেছিলাম নক্ষত্র। আমি চাইনি বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক। তাই কাউকে জানিয়ে যেতে চাইনি।”

—-কেন জানিয়ে গেলে না ইলা! কেন যাবার আগে আমাকে বলে গেলে না? তুমি কাউকে জানাতে না পারতে। অন্তত আমাকে ছোট্ট একটা মেসেজ করে যেতে পারতে। তাহলে তোমার সাথে এসব কিছুই হতো না। আমি তোমাকে খুঁজে বের করতাম। কেউ ভাবতো না তুমি বিয়ের দিন পালিয়ে গেছ।”

নক্ষত্র ভাবতে পারছে না। নয়ন এখন কী করবে? বোনের জন্য তাকে ছেড়ে দিবে! ইলার তো এখানে কোন দোষ নেই। নক্ষত্র মনে মনে বলল,

—-তুমি আমাকে বলে গেলে আমাদের তিন জনের জীবন আজ এই মোড়ে এসে দাঁড়াত না ইলা। এখন আমি কী করব? তোমার কোন দোষ না থাকলেও তোমাকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব না। নয়ন আমার বউ। ওকে আমি কারো জন্যই ছাড়তে পারব না। কিন্তু এসবের পরেও কি নয়ন আমার কাছে থাকবে? সত্য শুনে তুমিও সহ্য করতে পারবে না। আমাদের তিন জনের জীবনটা এরকম কেন হলো?”

ইলা অবাক নয়নে নক্ষত্রর দিকে তাকাল। এতক্ষণ তাকিয়েই থাকল।

—-পালিয়ে! তোমরা ভেবেছিলে আমি পালিয়ে গেছি?”

ঘরে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের দিকে দেখতে লাগল ইলা। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না তার নিজের আপন জনেরা ভেবেছে সে পালিয়ে গেছে!

—-বাবা! আমি পালিয়ে গেছি এমনটা ভেবেছিলে তুমি! নক্ষত্র তুমিও! আমার উপর তোমাদের এতটুকু বিশ্বাস ছিল না! আমি নিজের বিয়ে রেখে পালিয়ে যেতে পারতাম!”

ইলা নক্ষত্রর হাত ছেড়ে দিল। মাথায় হাত রেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নক্ষত্র ইলাকে সামলাবে নাকি নয়নের কাছে যাবে বুঝতে পারছে না।

—-ইলা প্লিজ শান্ত হও। আমরা কেউ তখন সত্যিটা জানতাম না।”

—-আমি পালিয়ে গেছি ভেবেই আমাকে কেউ খোঁজার চেষ্টা করোনি! আমিই বোকা। তোমাদের পথ চেয়ে আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। ভেবেছিলাম আমার পরিবার সব সময় আমার পাশে থাকবে। ওরা আমার কিছু হতে দিবে না। আমি বেঁচে আছি কেন বাবা? আমার তো মরে যাওয়াই উচিত ছিল। আমার তো আপন বলতে কেউ রইল না ইমন ভাইয়া। তুমিও তোমার বোনকে অবিশ্বাস করেছিলে তাই না!”

কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ পাগলের মতো হাসতে লাগল ইলা। চুল টেনে ধরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াতে লাগল। হঠাৎ তার এরকম আচরণে সবাই ভয় পেয়ে গেল। ছুটে এসে সবাই ইলাকে থামাবার চেষ্টা করছে। নক্ষত্রর মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। ইলা তাকে ঠকায়নি। পালায়নি ইলা। নয়ন দরজার সামনে ধপ করে বসে পড়ল। আপুর জায়গায় সে এখন নিজেকে কল্পনা করার চেষ্টা করছে। তার সাথে এতকিছু হয়ে গেলে নয়ন কী করতো?
ইলা আপু এখনও এটা জানে না তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ভুল বুঝে তারই ছোট বোনকে বিয়ে করে ফেলেছে। তার বোন তার প্রিয় মানুষটাকে ভালোবেসে সুখে সংসার করছে। সেই মানুষটাও তাকে ভুলিয়ে দিয়ে বসে আছে। এই সত্য জানলে আপু কী করবে? কীভাবে সহ্য করবে?
নয়নের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। এখন তার নিজের কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না সে। এ কোন পরীক্ষায় ফেলে দেওয়া হলো ওকে!
#নয়নতারা [৩২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইলা জ্ঞান হারিয়েছিল। ইমন তাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে। ইলার জ্ঞান ফিরলে ঝিনুক ওকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ভালো কাপড় পরিয়ে দেয়। নয়ন খাবার নিয়ে এসে ইলাকে খাইয়ে দেয়। ইলার ভেতর থেকে এখনও ভয় দূর হচ্ছে না। পরিবারের সবাইকে চোখের সামনে দেখেও তার ভয় কাটছে না। খেতে পারল না ইলা। বমি হয়ে গেল তার। বাবা,চাচা,জেঠু ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। নয়নের মা তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। ইলাকে এতক্ষণ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। মেয়েটার অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতদিন কেমন পরিস্থিতিতে ছিল না। নক্ষত্র ঘরের বাইরে কতক্ষণ পায়চারি করেছে। নয়নের সাথে কথা বলা দরকার ছিল। সে ধৈর্য ধরতে না পেরে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ে। ইলাকে যত তাড়াতাড়ি বলে দেওয়া যায়, নয়ন আর তার বিয়ে হয়ে গেছে ততই ভালো হবে। শুধু ইলার জন্য না। সবার জন্য ভালো হবে। নয়ন না আবার ভুল বুঝে বসে। নক্ষত্রর একমাত্র ভয় এখন নয়নকে নিয়েই।
নয়নের বাবা এতক্ষণে সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়ে যতই অন্যায় করুক। মেয়েকে কষ্টে দেখে আবার বুক না কেঁদে পারে না। নরম গলায় তিনি বললেন,

—-কী হয়েছিল রে মা? বল আমাদের। তোর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা সবাই তোর কাছে আছি তো মা। তুই বল, এতদিন তুই কোথায় ছিলি? কার কাছে ছিলি? বিয়ের দিন ওভাবে কেন গেলি তুই?”

ইলা ঘরের ভেতর নক্ষত্রকে খুঁজে। সবার মাঝে নক্ষত্রকে না পেয়ে বলল,

—-নক্ষত্র কোথায়? ও কি চলে গেছে? ওকে এ ঘরে আসতে বলো।”

নয়নের ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ বসে রইল। ইমন নক্ষত্রকে ঘরে ডেকে আনে। নক্ষত্র এসেই সবার আগে নয়নকে দেখে। নয়ন তার দিকে তাকাচ্ছে না।

—-হ্যাঁ এবার বল মা।”

—-নক্ষত্র তুমি আমার পাশে বসো না।”

নক্ষত্র শ্বশুরের দিকে তাকাল। নয়ন তো তার দিকে তাকাচ্ছেই না। সে কি এখন ইলাকে বলে দিবে। শ্বশুর মশাই কী করতে বলছে তাকে? নয়নের বাবা চোখে ইশারা করলে নক্ষত্র ইলার পাশে গিয়ে বসল। সাথে সাথে ইলা খপ করে নক্ষত্রর হাত ধরে ফেলে। এদিকে নয়নের বুক ফাটে। তবুও মুখে কিছু বলতে পারে না। নক্ষত্র এই মুহূর্তে ইলার থেকে হাতও সরিয়ে নিতে পারে না। ইলার সাথে যা কিছুই ঘটে থাকুক ভালো কিছু যে ঘটেনি তা নক্ষত্র বেশ বুঝতে পারছে। নইলে বিনা কারণে ইলা এত ভয় পাওয়ার মেয়ে না। ইমন অধৈর্য হয়ে বলল,

—-বল না ইলা। চুপ করে আছিস কেন?”

—-সেদিন আমার বউ সাজা হয়ে গেলে বাইরে যাচ্ছিলাম আমি। গেটে তখন নক্ষত্রর গাড়ি এসেছিল। তখন আমার একটা বন্ধু, তুমি ওকে চিনবে ইমন ভাইয়া। রাসেল আসে আমার সাথে দেখা করতে। আমার সাথে নাকি জরুরি কথা আছে। কথাগুলো বলার জন্যই আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়। আমি ওর সাথে পেছনের দরজায় গিয়ে কথা বলি। ওর থেকে জানতে পারলাম, জিসান আমার জন্য হাত কেটে সুইসাইড করতে চাইছে। ও কলেজ থেকেই আমাকে পছন্দ করতো। কয়েকবার প্রপোজও করেছে। আমি পাত্তা দিই নি। রাসেল বলল জিসানের নাকি অবস্থা খারাপ। তবুও ও হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না। যেহেতু রাসেলের ফ্ল্যাটে ও সুইসাইড করতে চেয়েছে ও মারা গেলে রাসেল ফেঁসে যেতে পারে। জিসান নাকি ওর মৃত্যুর দায় আমাকে দিয়ে একটা চিঠি লিখে গেছে। সেদিক থেকে আমিও ফাঁসব। রাসেল অনেক রিকোয়েস্ট করে আমাকে ওর সাথে যেতে৷ আমি রাজি হই না। কারণ একটু পর আমার বিয়ে। বিয়ের সাজে আমি বাইরে যেতে পারি না। রাসেল আমার পায়ে পড়ে গেল। বলল তুমি না গেলে ও হাসপাতালে যাবে না। ওভাবেই মারা যাবে। তুমি গিয়ে ওকে একটু বোঝালেই ও বুঝবে। শেষ সময় পার করছে ও ইলা। তুমি প্লিজ চলো।
আমি ওর কথায় পড়ে যাই। আমি বুঝতে পারিনি ওটা ওদের পাতানো ফাঁদ ছিল।”

ইলা থরথর করে কাঁপছে। নক্ষত্রর হাতে নখ বসিয়ে দিচ্ছে সে। ইলাকে এতটা ভয় পেতে দেখে নক্ষত্র ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

—-ভয় নেই ইলা। এখন কেউ তোমাকে কিছু করতে পারবে না।”

—-আমি ভেবেছিলাম যাব আর চলে আসব। বাড়ির কেউ জানার আগেই ফিরে আসব। আমি কখনও কল্পনাও করিনি জিসানের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি আমি। আমি বুঝতে পারলে নিজের বিয়ে রেখে কোনোদিনও যেতাম না।”

ইমন ঠোঁট কামড়ে ধরে রাগে টগবগ করে ফুটছে।

—-এই তিনমাস তুই ওদের কাছে আটকা ছিলি!”

ইলা ইমনের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

—-ওখানে নিয়েই ওরা আমাকে অজ্ঞান করে ফেলে। তারপরের কয়দিন আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে নিজেকে অন্ধকার রুমে পাই। সেই থেকে আমি ওখানেই আছি। জিসানকে রিজেক্ট করেছিলাম বলে ও আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসব করেছে।”

ইলার বাবা কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ধরে বসে পড়ল। মেয়েটা এতদিন নরকের ভেতরে ছিল। আর ওরা সবাই ভেবেছে ইলা কারো সাথে পালিয়ে গেছে। রাগে,কষ্টে কেউ ইলাকে খোঁজার চেষ্টা করেনি।

—-আমি এই আশায় বেঁচে ছিলাম তোমরা একদিন আমাকে খুঁজে বের করবে। আমি অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। পালাতে চাইলে জিসান আমাকে অনেক মারতো।”

ইলা কান্নার জন্য সব কথা বলতে পারছে না। ইলার জেঠুর চোখ লাল হয়ে গেছে। কাঁপা গলায় তিনি বললেন,

—-আর বলিস না মা। আর বলিস না।”

ইমন হুংকার ছাড়ল।

—-ওই কুত্তার বাচ্চাদের আমি ছাড়ব না। খুন করে ফেলব। পুলিশের কাছে চল। উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব অমানুষ দুই টাকে।”

নক্ষত্র এবার বুঝতে পারল, ওই মেসেজ ইলা করেনি। ইলার ফোন থেকেই ওই ছেলেটা করেছে। নক্ষত্র সামান্য একটা মেসেজে বিশ্বাস করে ইলাকে অবিশ্বাস করেছে! তার ভালোবাসা এতটাই দুর্বল ছিল! ইলার উপর তার বিশ্বাস এতটা ঠুনকো ছিল! ইলার ওরকম বিপদে নক্ষত্র ইলাকে খোঁজার চেষ্টা করেনি। বরং ইলার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভেবেছে। নয়নকে বিয়ে করেছে। নয়ন! হ্যাঁ, নয়নের কথা মনে পড়ায় নক্ষত্রর অস্থির দুই চোখ নয়নকে খুঁজতে লাগল৷ নয়ন ঘরে নেই। কোথায় গেছে ও?

—-বাবলু তোমাকে একটা ছেলের বাইকে উঠতে দেখেছিল ইলা। ও তোমাকে পেছন থেকে ডেকেছে। তুমি শোনোনি।”

—-শুনেছিলাম নক্ষত্র। আমি চাইনি বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক। তাই কাউকে জানিয়ে যেতে চাইনি।”

—-কেন জানিয়ে গেলে না ইলা! কেন যাবার আগে আমাকে বলে গেলে না? তুমি কাউকে জানাতে না পারতে। অন্তত আমাকে ছোট্ট একটা মেসেজ করে যেতে পারতে। তাহলে তোমার সাথে এসব কিছুই হতো না। আমি তোমাকে খুঁজে বের করতাম। কেউ ভাবতো না তুমি বিয়ের দিন পালিয়ে গেছ।”

নক্ষত্র ভাবতে পারছে না। নয়ন এখন কী করবে? বোনের জন্য তাকে ছেড়ে দিবে! ইলার তো এখানে কোন দোষ নেই। নক্ষত্র মনে মনে বলল,

—-তুমি আমাকে বলে গেলে আমাদের তিন জনের জীবন আজ এই মোড়ে এসে দাঁড়াত না ইলা। এখন আমি কী করব? তোমার কোন দোষ না থাকলেও তোমাকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব না। নয়ন আমার বউ। ওকে আমি কারো জন্যই ছাড়তে পারব না। কিন্তু এসবের পরেও কি নয়ন আমার কাছে থাকবে? সত্য শুনে তুমিও সহ্য করতে পারবে না। আমাদের তিন জনের জীবনটা এরকম কেন হলো?”

ইলা অবাক নয়নে নক্ষত্রর দিকে তাকাল। এতক্ষণ তাকিয়েই থাকল।

—-পালিয়ে! তোমরা ভেবেছিলে আমি পালিয়ে গেছি?”

ঘরে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের দিকে দেখতে লাগল ইলা। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না তার নিজের আপন জনেরা ভেবেছে সে পালিয়ে গেছে!

—-বাবা! আমি পালিয়ে গেছি এমনটা ভেবেছিলে তুমি! নক্ষত্র তুমিও! আমার উপর তোমাদের এতটুকু বিশ্বাস ছিল না! আমি নিজের বিয়ে রেখে পালিয়ে যেতে পারতাম!”

ইলা নক্ষত্রর হাত ছেড়ে দিল। মাথায় হাত রেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নক্ষত্র ইলাকে সামলাবে নাকি নয়নের কাছে যাবে বুঝতে পারছে না।

—-ইলা প্লিজ শান্ত হও। আমরা কেউ তখন সত্যিটা জানতাম না।”

—-আমি পালিয়ে গেছি ভেবেই আমাকে কেউ খোঁজার চেষ্টা করোনি! আমিই বোকা। তোমাদের পথ চেয়ে আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। ভেবেছিলাম আমার পরিবার সব সময় আমার পাশে থাকবে। ওরা আমার কিছু হতে দিবে না। আমি বেঁচে আছি কেন বাবা? আমার তো মরে যাওয়াই উচিত ছিল। আমার তো আপন বলতে কেউ রইল না ইমন ভাইয়া। তুমিও তোমার বোনকে অবিশ্বাস করেছিলে তাই না!”

কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ পাগলের মতো হাসতে লাগল ইলা। চুল টেনে ধরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াতে লাগল। হঠাৎ তার এরকম আচরণে সবাই ভয় পেয়ে গেল। ছুটে এসে সবাই ইলাকে থামাবার চেষ্টা করছে। নক্ষত্রর মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। ইলা তাকে ঠকায়নি। পালায়নি ইলা। নয়ন দরজার সামনে ধপ করে বসে পড়ল। আপুর জায়গায় সে এখন নিজেকে কল্পনা করার চেষ্টা করছে। তার সাথে এতকিছু হয়ে গেলে নয়ন কী করতো?
ইলা আপু এখনও এটা জানে না তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ভুল বুঝে তারই ছোট বোনকে বিয়ে করে ফেলেছে। তার বোন তার প্রিয় মানুষটাকে ভালোবেসে সুখে সংসার করছে। সেই মানুষটাও তাকে ভুলিয়ে দিয়ে বসে আছে। এই সত্য জানলে আপু কী করবে? কীভাবে সহ্য করবে?
নয়নের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। এখন তার নিজের কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না সে। এ কোন পরীক্ষায় ফেলে দেওয়া হলো ওকে!

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here