গল্প ঃ পুনম
পুনমকে অামি প্রথম দেখি বিয়ের দিনই!
রেজিস্টৃর পরে যখন মালাবদলে অামাকে ও’র কাছে নিয়ে যাওয়া হলো, ও কিন্তু একবার ও তাঁকায়নি অামার দিকে।
শাড়ি ঠিক করার অজুহাতে নিচু হয়ে টিস্যু চেপে বারবার চোখ মুছছিলো।
ঠান্ডা চোখের মিষ্টি মেয়ে! নাকের উপরে বাঁকানো কাটা দাগ!থুতুনি খাঁজ হয়ে বেশ দেবে অাছে।
অামার এত এত ফ্রেন্ডস ছিলো বিয়েতে, অামি তাদের চোখ এড়িয়ে পুনমের দিকে তাঁকাতে গেলেই ধরা খেয়ে যাচ্ছিলাম। কেউ কেউ বলতে লাগলো, উফ….হিমেল, এত কেনো নজর দিচ্ছিস বলতো?? বৌটা তো তোর সাথেই বাসায়ই যাবে তাই না??সেকথা শুনে চারপাশের সবাই হেসে ফেললো। অার ঠিক তখনি পুনম অামার দিকে তাঁকালো। ছলছল করা স্বচ্ছ চোখে, অামি জানি, অামার ভেতর জানে, কি ভীষণ ভূমিকম্প ঘটেছিলো তখন অামার ভেতরে।
অামার হালকা ঘাবড়ানো অবস্থা এবার ভীষণ ঘাবড়ানো অবস্থায় পরিণত হলো।মালাবদলে হাত কাঁপছিলো অামার। তারপর মিষ্টি খাওয়ানোর সময় তো হাত কেঁপে চামচ পড়ে গেলো।
অাশেপাশে তখন হাসির হিরিক পড়ে গেছে। অামার কান্না পাওয়ার অবস্থা। কিন্তু অামাকে অবাক করে দিয়ে পুনম খুব স্বাভাবিকভাবে মেঝে থেকে চামচ তুলে নিয়ে প্লেটে রাখলো।
অন্য অারেকটা চামচে মিষ্টি গেঁথে দিয়ে বললো,
——–নিন…এবার খাওয়ান!
পুনমের কণ্ঠও তখন অামি প্রথম শুনলাম।
অনেকক্ষণ কাঁদার পর যেরকম ধরে অাসা ভারী গলা হয়, সেরকম চমৎকার অভিমানী কণ্ঠস্বর!
মিষ্টি মুখে নেবার সময় অাবার পুনমের চোখ ভিজলো।
সে অাবারও শাড়ির কুঁচি ঠিক করার অজুহাতে মুখ নিচু করে চোখ মুছলো।
অামার বুকের ভেতরটা তখন কেমন করছিলো তা বুঝাবার ভাষা, অামার জানা নেই।হাত বাড়িয়ে পুনমের চোখ মুছে দেবার হাজার ইচ্ছা অামার ভেতরে তোলপাড় করছিলো।
এই যে নববধূ পুনম, সবাই তাঁকে দেখছে। কিন্তু অামি অাগ্রহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অন্য পুনমকে দেখতে লাগলাম, এই যে মালাবদলের ফাঁকে, এই যে মিষ্টি মুখে নেবার মুহূর্তে, এই যে শাড়ির কুঁচি ঠিক করার সময়, এই যে, ওড়না টেনে ঘোমটা দেবার সময়, এই যে টিস্যুতে গালের ব্লাশন ঠিক করার সময় তাঁর কি অন্য কাউকে মনে পড়ছে?? এত কেনো চোখ ভিজে অাসছে তার??মুখটা এত কেনো ব্যাথাতুর হয়ে অাছে?? নিজের জীবনের এত সুন্দর একটা ঘটনা সে ভালোভাবে উপভোগ কেনো করতে পারছে না?? কেনো কষ্ট পাচ্ছে?
কোথাও কি অাজ এই অনুষ্ঠানে সে অন্য কাউকে ভেবেছিলো?? অাজ এই এত অালো,
এত জাঁকজমকে সে কি অন্য কাউকে পাশে চেয়েছিলো???
বিয়ের রাতে ঘরে এসেছি যখন রাত দুটো পেরিয়ে গেছে। এসে দেখি পুনম চেঞ্জ করে নিয়েছে, গোসল সেরে নিয়েছে। সুন্দর অাকাশি অার গাঢ় নীলের মিশেলে একটা সুতির শাড়ি পড়েছে!
সে অামার টেবিলেই তাঁর ল্যাপটপ খুলে রেখেছে।
অামাকে দেখেই শীতল গলায় বলল,
——-কফিতে অাপনি কটা সুগার কিউব নেন??
——–অামি মানে?? অামি?? কতটা যেনো নিই??? এখন কফি??
পুনম এক মগ কফি বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
———অামি সাথে করে কফিমেকার নিয়ে এসেছি। লিখালিখির বেশিরভাগ কাজই অামায় রাত জেগে করতে হয়! তাই…
কফি হাতে দাঁড়িয়ে পুনমকে দেখতে অামার মনে হলো একটা ঝকঝকে পরিষ্কার নীল অাকাশ অামার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘোর লাগার শুরু অামার তখন থেকেই…
সেরোয়ানি পরে পুনমের দেওয়া কফি হাতে অামি একগাদা ফুল সাজানো বিছানায় বসলাম। পুনম নিজের কফিটা হাতে নিয়ে টেবিলে গিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসলো।
অামি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে তখন। বাসর ঘরে এমন হয়??এরকম বর সেজে কাতর হওয়া কি খুব দরকার??
?পুনম মুখ ঘুরিয়ে অামার দিকে তাঁকালো,
——–কফি ভালো হয় নি???
——–না না, ঠিক অাছে।
———একটা সিপ ও তো দেননি অাপনি! ভালো হয়েছে বুঝলেন কি করে??
অামি সাথে সাথে একটানে লম্বা চুমুকে পুরো কফিটা শেষ করে নিলাম!
পুনম বিরক্ত চোখে কিছুক্ষণ অামার দিকে তাঁকিয়ে থেকে অাবার ল্যাপটপে মনোযোগী হলো।
অামি মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলাম, পুনম.. পুনম…. পুনম….. পুনম…. এক পৃথিবী পুনম….. এক সাগর পুনম….. এক মহাকাশ পুনম….
———অাপনার ঘরটা অামি একটু অন্যরকম করে গুঁছিয়েছি, সরি!
অামি ঘরের চারদিকে তাকালাম, পুনম সবগুলো ফার্নিচারই নতুন করে সেট করেছে! বাহ্!অামি তো খেয়ালই করিনি! কখন করলো??
অামি কিছু বলার অাগেই পুনম বলল,
——–অাপনার দু-জন কাজিন সাহায্য করলো!
অামি যেখানে থাকি সেখানে একটু ঝামেলাই ঘটিয়ে ফেলি।অাবারও সরি!
——–এটা তো তোমারই ঘর পুনম। এত বিব্রত কেনো হচ্ছো??
পুনম অাবার কিছুক্ষণ অামার দিকে তাঁকিয়ে রইলো।চোখের জল এবার অার চোখে থাকলো না পুনমের….
অামি ফিসফিস করে বললাম,
এত কষ্ট কেনো পাচ্ছো পুনম??
পুনম তাঁকিয়ে চুপচাপ কেঁদেই গেলো।
অামার মনে হলো, পুনম ভীষণ শক্ত মেয়ে। এই কান্নাটা সে শুধু অাটকাতে পারছেনা বলেই কাঁদছে!
কান্না যে তা্র চরম অপছন্দের সেই রাতেই বুঝেছিলাম অামি।
তারপরের গল্পটা অামার জন্য ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন!
বৌভাতের পর অামি পুনমদের ওখানে থাকতে এসেছি। পুনম নিজের ঘরে বসিয়ে অামাকে প্রথম যে কথাটা বলল,
——-এটা অামার নিজের ঘর। এই ঘরে অামি কাউকে থাকতে এলাউ করিনা। এমনকি বিয়ের অাগে অামি ঠিক করেছিলাম, অামার যে বর হবে সেও বেড়াতে এলে অামাদের বাড়ির গেস্ট রুমে থাকবে! কিন্তু……
অামি পুনমের চোখে এই প্রথম যেনো অাড়স্টতা দেখতে পেলাম।
——— ——–অামি কাল চলে যাচ্ছি, একেবারে। তাই ভাবলাম শেষবারের মতো থেকে যাই…এখানে!
দেখুন….
এতে অাপনার কোনো দোষ নেই! অামি যাবো এটা অাগে থেকেই ঠিক করা ছিলো। কানাডার এই এপ্লিকেশনটা অামি অনেক অাগেই করে রেখেছিলাম। বিয়ের অাগে অামি অাপনার বাবাকে বলেছিও, তারপর ও তিনি বললেন, হিমেলের জন্য তোমাকেই বৌ চাই! শুধু বৌ হিসেবে কাগজে কলমে একটা সাইন করে দেবে ব্যস!
অামার কিচ্ছু বলবার ক্ষমতা যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো, পৃথিবী থেমে গিয়েছিল, সময় থেমে গিয়েছিল, সেই রাত থেমে গিয়েছিল, কোথাও যেনো অামিও থেমে গিয়েছিলাম। কোনোরকমে শুধু বললাম,
———চলে যাবে, সেটা ঠিক করা ছিলো। তারপরও যে তুমি বিয়েটা করেছো সেটাই অনেক!
পুনম চলে গেলো, সাথে করে নিয়ে গেলো আমার সমস্ত সত্তাকে, অামার ধ্যানজ্ঞানকে …..
অামার অনুভূতিকে……
এরকম কিছু অামার জীবনে ঘটতে পারে ধারণার বাইরে ছিলো।নারী ঘটিত কোনো ব্যাপারেই অামার জ্ঞানত কোনো ভুল ছিলোনা। তাহলে?? মা বিহীন জীবনে বাবাকে অাঁকড়ে ধরে বড় হয়েছি। বাবার ও অন্তপ্রাণ অামি।
অামার পড়াশোনার কিছু অংশ দেশে কিছু অংশ বিদেশে…….
কোথাও স্থির থাকিনি বলে নারী ঘটিত কোনো ব্যাপারে স্থির সম্পর্কও অামার তৈরি হয়নি!
তাহলে?? বাবা জেনে-বুঝে কেনো অামার সব এমন ঠাঁইনাড়া করে দিলেন কে জানে??কিন্তু জীবন অামার এমন রুটিনের মাঝে ছিলো যে, কোনো ধরনের পাগলামি করা অামার পক্ষে সম্ভব হয়নি!তারপরের সময়টা শুধু বেঁচে ছিলাম আমি, অথবা বেঁচে থাকার ভান করছিলাম!
এর মাঝে পুনম অামাকে নিজে সাইন করে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলো! অামি জানি কাগজ কোনো সম্পর্ক শুরু ও করতে পারে না, শেষ ও করতে পারেনা।সম্পর্কের শুরু অন্য জায়গা থেকে! এটা শুধু হৃদয় জানে, হৃদয়ের অনুভূতি এর পরিচালক।
যে সম্পর্কের অনুভূতিতে অামি অাটকা পড়ে গেছি তা থেকে মুক্তি অামার নেই।এই থেকে মুক্তি অামায় কেউ দিতেও পারেনা!
যা তোমার বয়ে বেড়ানোর, তা তো তোমাকে বইতেই হবে! অামি শুধু বয়ে বেড়াচ্ছিলাম!
(কাল বাকিটা)