পূর্ণতা নাকি শূন্যতা পর্ব -১৩

#পূর্ণতা_নাকি_শূন্যতা
#রেজওয়ানা_রমা
#পর্ব_১৩

– কি হয়েছে ঈশা? কেন কাদছিস? শরীর খারাপ লাগছে?
– না আমি ঠিক আছি। কিছু হয় নি
– তাহলে কাদছিস কেন?
-সখ হয়েছে তাই
-এমন বিহেভ করছিস কেন?
– নাটক তো ভালোই পারো সিদ্ধাত ভাইয়া
-মানে?
– বুঝতে পারছো না? কি দরকার ছিল আমার সাথে নাটক করার? আমি তো এমনিতে ভেঙে রয়েছি তুমি আর যত্ন করে নাইবা ভাঙতে
– কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি নাটক করেছি আমি?
– তুমি কাল সারা রাত কেন ঘুমাও নি সিদ্ধাত ভাইয়া?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– খুব বিভ্রান্তি তে ফেললাম?
– না তা নয়। হঠাৎই জিজ্ঞাসা করলি তাই।
– উত্তর টা দাও
– এমনি ঘুমাই নি।
– এমনি?
– ঈশা

সিদ্ধাত ভাইয়ার কথায় আর কোনো কথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বলতে গেলে পালিয়ে এলাম। নিজেকে সামলাতে পারছি না। চোখেত পানি আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সোজা ছাদে চলে এলাম। দোলনায় হাত পা তুলে গুটি সুটি মেরে বসে আছি। সিদ্ধাত ভাইয়া এমন কিছু করবে কখনও কল্পণাও করি নি।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। আমি এখনো নিচে যাই নি। আমার খোঁজে এতোক্ষন কেউ না করলেও এইবার ঠিকই করেছে। মিতু আর নোভা এসেছে।

মিতু: ওই তো ঈশা আপু
নোভা: কিরে নবাবনন্দিনী এখানে কি করিস? সবাই তোকে খুজে হয়রান আর তুই এখানে লুকিয়ে বসে আছিস?
আমি: লুকিয়ে থাকতে পারলাম কই। খুজেই তো পেয়ে গেলি।
নোভা: হ্যাঁ তা তো পেয়েছি। এখন চল সবাই তোর জন্য বসে আছে।
আমি: কেন?
মিতু: ওমা তুমি ভুলে গেছো? মেহেন্দি অনুষ্ঠান যে আজকে।
আমি: এসবের আর কি দরকার।
সিদ্ধাত: তাই তো কোনো দরকার নেই? ইনফ্যাক্ট এই বিয়ে টার ই কোনো দরকার নেই

হঠাৎ কই থেকে উদয় হয়ে সিদ্ধাতা ভাইয়া রাগী কন্ঠে কথা টা বলে। নোভা মিতু কিছু বলার আগেই সিদ্ধাত ভাইয়া ওদের কে ইশারায় চলে যেতে বলে। অতঃপর সিদ্ধাত ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার কাছে এসে পকেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি তবুও আগেই মতই বসে আছি। যেন তাকে দেখতেই পাই নি।

– সং এর মত বসে থাকবি নাকি? নিচে যাওয়া লাগবে না?
– (নিশ্চুপ। যেন কোনো কথাই আমার কানে পৌঁছায় নি)
– আমি তোর সাথে কথা বলছি ঈশা
– (নিশ্চুপ)

এবার সিদ্ধাত ভাইয়া প্রচন্ড রেগে গেছে। আমাকে দোলনা থেকে টেনে নিচে ফেলে দেয়। আমি ব্যাথা পেয়েছি তবুও নিচেই বসে আছি। একটা টু শব্দ ও করি নি। অন্য সময় হলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলতাম।

– লাগে নাই?
-লাগলে তোমার কি?
– আমার অনেক কিছু।
– এ হৃদয়ে যত আঘাত দিয়েছো সে তুলনায় এ ব্যাথা খুবই নগন্য।

সিদ্ধাত ভাইয়া এবার আমার পাশে বসে আমার গাল চেপে ধরে। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠি। ভীষন কষ্ট হচ্ছে। তবুও কোনো কথা বললাম না। এবার সিদ্ধাত ভাইয়া দাতে দাত চেপে বলে,

– এই! কি সমস্যা তোর? কি চাস তুই?
– তুমি কি চাও? ( অনেক কষ্ট করে বললাম।
– আমি কি চাই তুই জানিস না? ( আমাকে ছেড়ে দিয়ে)
– হুম। কেন জানবো না। তুমি গাছের টাও খেতে চাও আবার তলার টাও কুড়াতে চাও
– একটু বলবি কি তোর কি হয়েছে? কেন করছিস এমন? ইগনোর কেন করছিস আমাকে?
– দূরে চলে যাবো সিদ্ধাত ভাইয়া। তুমি ভূমি কে নিয়েই থেকো
– কিহ? ভূমি? কোন ভূমি?
– তোমার গার্লফ্রেন্ড ভূমি। যার সাথে তোমার দীর্ঘদিন সম্পর্ক। এবং কাল সারারাত যার জন্য তুমি ঘুমাতে পারো নি ( উঠে দাঁড়িয়ে )
– তুই কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস ভুলে গেছিস?
– ভুলি নি। একটা দুশ্চরিত্রবান লোকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি
– ঈশা!!!
– ধমকে লাভ নেই। লজ্জা করছে না তোমার? এখনো জোর গলায় কথা বলছো
– কি করেছি আমি? যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছিস
– তোমার মতো লোকের সাথে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘৃণা করি তোমায় আমি। তোমার তো চরিত্র ঠিক নেই। এভাবে কটা মেয়ে নিয়ে খেলেছো?

এবার ঠাস করে একটা থাপ্পর পড়ে আমার গালে। সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম। সিদ্ধাত ভাইয়া ফ্লোর থেকে হ্যাচকা টানে তুলে বলে,

– আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট তোকে দিতে বলেছি? তোর সাহস হয় কিভাবে আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলার? বল ( জোরে ধমক দিয়ে)
– যেভাবে বউ থাকতে আরেক টা মেয়ের সাথে প্রেম করার সাহস তোমার হয় ঠিক সেই ভাবেই আমারও স্ত্রীর অধিকার থেকে সাহস হয় সিদ্ধাত ভাইয়া
– কিহ? আমি প্রেম করছি?
– ন্যাকামি করো না প্লিজ
-শাট আপ ঈশা। অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। এবার কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম
– ভালো কিছু হচ্ছে বুঝি? আর কি খারাপ হবে সিদ্ধাত ভাইয়া? তুমিও মেঘের মত করলে। ছিহ।
-তোর পাগলামি গুলো এবার বন্ধ কর। অনেক হয়েছে। কিসের ভিত্তি তে এসব বলছিস?
– নাটক বন্ধ করো প্লিজ। দাও তোমার ফোন টা। দেখাচ্ছি
– ওয়েট। নে দেখা। ( ফোন টা এগিয়ে দিয়ে)
– এটা নয়। তোমার অন্য ফোন টা কোথায়? রেখে এসেছো?
– অন্য ফোন? আয় আমার সাথে,

বলেই আমার হাত ধরে হন হন করে নিচে এলো। রুমে ঢুকতেই সজোরে ছুড়ে ফেলে দিলো বিছানার ওপর। অতঃপর দরজা লক করে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আমি একটু ভয় পেয়ে যাই। কারন সিদ্ধাত ভাইয়ার রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তা স্পট। সিদ্ধাত ভাইয়া বিছানার ওপর থেকে ফোন টা নিয়ে বলে,
– এই ফোন টা তো?

বলেই ফ্লোরে একটা আছাড় মারে। ফোন টা ভেঙে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। সিদ্ধাত ভাইয়া তখন বলে,

– আরে ওটা তো সিফাত ইউজ করে। আর তুই আমাকে সন্দেহ করে এই সব করছিস? তুই কি করে ভাবলি আমি অন্য কারো কে ভালোবাসতে পারি? বল কি করে?
ঈশা এই ফোন টা গত এক সপ্তাহ যাবত সিফাত ইউজ করছে। আর এই যে মেসেজ গুলো, এগুলো সব সিফাত আর সিফাতের গার্লফ্রেন্ডের। আমার নয়
– মিথ্যা কথা। এখন নিজেকে বাচাতে সিফাত ভাইয়ার ওপর দোষ দিচ্ছো
– বিশ্বাস কর আমায়
– না করি না। ঘৃণা করি তোমায় আমি
– আরে পাগলী সত্যি বলছি। একদম সত্যি। তুমি ছাড়া আমি অন্য কারো নই। আমার এ জীবনে শুধু ঈশা। আর কারো জায়গা নেই( ঈশার দুই গালে হাত রেখে)

সিদ্ধাত ভাইয়ার এমন কথায় ফুপিয়ে কেদে দিলাম। আর সিদ্ধাত ভাইয়া আমাকে পরম আদরের সাথে বুকে জড়িয়ে নিলেন। খুব কষ্ট লাগছিলো। কিন্তু সেই কষ্ট মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেলো সিদ্ধাত ভাইয়ার বুকে ঠাই পেয়ে। এই মানুষ টা ছাড়া সত্যি আমি অসম্পূর্ণ। কখনও পারবো না ছেড়ে থাকতে। হারানোর ভীষন ভয় কাজ করছে।

-আচ্ছা সত্যি কি সিদ্ধাত ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে নাকি এটাও নাটক। না সিদ্ধাত ভাইয়া নাটক করতেই পারে না। উনি শুধু আমাকেই ভালোবাসে।শুধু আমাকে। – (মনে মনে)
নিজেকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করছি তবুও মন মানছে না। একটা ভয় মনের ভিতরে রয়েই গেলো। হয়তো সিদ্ধাত ভাইয়া সত্যি বলছে। হয়তো বা আমি ভুল বুঝেছিলাম। সিদ্ধাত ভাইয়া কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

– আমাকে ছেড়ে যেও না সিদ্ধাত ভাইয়া
– যাবো না পাগলী
– প্রমিজ করো আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না। আমাদের মাঝে আর কেউ আসবে না সিদ্ধাত ভাইয়া। কাউ কে আসতে দিও না প্লিজ
– শুধু তুই আর আমি। আমাদের মাঝে আর কেউ আসবে না। প্রমিজ
-সত্যি
– হুম। ওহ না আসবে একজন।
– কিহ😡 কে আসবে ( সিদ্ধাতের বুক থেকে মাথা তুলে)
– আমাদের ছোট্ট ঈশা ( ঈশার নাক টেনে)
– তুমি তো একটু বেশি এডভ্যান্স সিদ্ধাত ভাইয়া। ( লাজুক স্বরে)
– কেন তুই চাস না?
– বিয়েটা হোক আগে
– বিয়ে তো হয়েই গেছে।
– হুম ভালো ভাবে হোক তার পর।
– আমার কিন্তু তো অনেক গুলো বেবী চাই
– কিহ
– হুম। অনেক অনেক বেবী হবে আমাদের
– এতো গুলো কি তুমি পালবা? ( সিদ্ধাত কে একটা ধাক্কা দিয়ে )
– তুই আছিস না
– আমি যখন মরে যাবো তখন?
– ঈশা ( ধমক দিয়ে)
– এমনি মজা করছি ( ঢোক গিলে)
– এই সব মজা একদম ভালো লাগে না। আমকে ছেড়ে যাওয়ার কথা একদম ভাববি না।
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। বাড়িতে আলো ঝলমল করছে। আমি সিদ্ধাত ভাইয়ার পছন্দ করা গোল্ডেন কালারের লেহেঙ্গা পরলাম। পার্লারের কয়েকজন আপু এসেছে তারা আমাকে সাজিয়ে দিলো। মুখে হালকা মেকআপ, ম্যাচিং জুয়েলারি, চুল গুলো কার্ল করা। ফটোগ্রাফার ও রেডি। নিচে মেদেন্দি অনুষ্ঠানের সব আয়োজন করা হয়েছে। সিদ্ধাত ভাইয়ার পরনে সাদা শার্ট, সাদা কোর্ট, সাদা প্যান্ট। হাতে সিলভার কালারের ওয়াচ, ব্লাক সু, । আমার রাক্ষস বর টাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। ক্রাস খাইলাম। ভারী লেহেঙ্গা পরে হাটতে কষ্ট হচ্ছে। উফফ এখনই এই ভারী ড্রেস। আল্লাহই জানে বিয়ের দিন আমাকে কি ভুতনি সাজায়। নোভা আর ইতি আমাকে নিচে নামতে হেল্প করছিলো।আমি রাক্ষস টার দিকে তাকিয়ে নিচে নামছি আসলে রাক্ষস টা কে একটু দেখছিলাম কিন্তু সারাদিনব্যাপী বকা ঝকার ওপর গেছে সন্ধ্যার শুরু যদি বকা দিয়ে না হয় তাহলে কেমন হয় না? তাই ঠিক রাক্ষসের সামনে গিয়ে হোচট খেলাম। রাক্ষস টা ধরলো ঠিকি কিন্তু বকাও ফ্রি।

– স্টুপিড গার্ল। ঠিক করে হাটতে পারো না? নাকি চোখে কম দেখো?
– বকছো কেন? আমার চেয়ে ড্রেসের ওজন বেশি আমার কি দোষ?

সিদ্ধাত ভাইয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফুপি বলে,

ফুপি: থাক হয়েছে। এতো আর দোষ দেখতে হবে না। মেহেদী পরে নাও পার্লারের লোক বসে আছ।
আমি: হুম চলো

নোভা আর ইতি আমাকে স্টেজ বসিয়ে দেয়। সামনের স্টেজে সিদ্ধাত ভাইয়া। একটু পর পর খালি আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে, চোখ টিপ মারছে, ভ্রু নাচাচ্ছে, মুচকি মুচকি হাসছে, রাক্ষস একটা আর এদিকে দুইজন আপু আমাকে মেহেদী পরাচ্ছে। আমি মাঝে মাঝে সিদ্ধাত ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি আমি কি সত্যি ভুল বুঝলাম নাকি সিদ্ধাত ভাইয়া সত্যি অন্য কাউ কে ভালোবাসে। এতো কিছু অভিনয় নয় তো? এতো আনন্দের মাঝেও একটা ভয় কাজ করছে। এই অনুভূতি টা সত্যি অন্য রকম। আমি কি সত্যি এতো টা লাকি? প্রিয়জনের সাথে বিয়ে। এতো ধুমধাম করে। পুরো বাড়িতে আলোর ছড়াছড়ি। গান বাচছে। হইচই সারাক্ষণ। আজকের অনুষ্ঠানে সবাই গান গাইছে। এমন কি আব্বু আম্মু ও। ওয়াও কি সুন্দর। সবাই কত্ত হ্যাপি। আর আমি? আমিও অনেক হ্যাপি। তবে যেন ভয় টা সত্যি না হয়।

সুন্দর পরিপাটি ভাবেই শেষ হলো আমাদের সংগীত ও মেহেন্দি অনুষ্ঠান। সিফাত ভাইয়া ও ছিলো তবে সিফাত ভাইয়ার কাছে ভূমির কথা জিজ্ঞাসা করার সাহস পাই নি। কিভাবে জিজ্ঞাসা করি যেখানে সিদ্ধাত ভাইয়া বলছেই। হয়তো সিদ্ধাত ভাইয়া সত্যি বলেছে। অনুষ্ঠান শেষ হতেই সিদ্ধাত ভাইয়া আর সিফাত ভাইয়া দুইজন ই চলে যায়। আমি আর ইচ্ছা করেই সিদ্ধাত ভাইয়ার সাথে কথা বললাম না। রুমে চলে এলাম। আমার দুই হাত ভর্তি মেহেদী। হাতে সিদ্ধাত ভাইয়ার নাম লিখে নিয়েছি খুব ভালো লাগছে। তবে ভয় ও লাগছে। জানি না এতো সুখ সয়বে কি না।
.
.
.
.
.
.
.
#চলবে_কি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here