প্রণয়ের_দহন পর্ব ২০

#প্রণয়ের_দহন
#পর্ব_২০
#তাসনিম_জাহান_রিয়া

আমরা দুইজন গাড়িতে ওঠে পড়লাম। গাড়ি চলছে আপন গতিতে কারো মুখে কোনো কথা নাই। দুই জনই নিরাবতা পালন করছি। আমি বার বার আরিয়ানের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছি। কিন্তু উনি একবারের জন্যও আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। উনার দৃষ্টি সামনের দিকে। এমন একটা হাব ভাব করছেন জেনো আমার দিকে তাকালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার অসহ্য লাগছে। এভাবে গাড়িতে চুপ চাপ বসে থাকা যায়।

কিছুক্ষণ পর গাড়িটা এসে থামে একটা কবরস্থানের সামনে। আমি অবাক হয়ে একবার আরিয়ানের দিকে তাকাই তো আরেকবার কবরস্থানের দিকে। আমি বুঝতে পারছি না উনি আমাকে কবরস্থানে কেনো নিয়ে আসলেন?

আমি উনার দিকে প্রশ্ন সিক্ত দৃষ্টিতে তাকাই। কিন্তু উনি বরাবরের মতোই আমার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করলেন। উনি গাড়ি থেকে নেমে আমার সাইডের দরজাটা খুলে দিলেন। উনি আমাকে ইশারায় নামতে বলছেন কিন্তু আমি নামছি না। মৃত ব্যক্তি, কবরস্থান বরাবরই এই দুটো জিনিস আমি ভীষণ ভয় পাই। কেনো পাই? সেই উত্তরটা আমার অজানা।

কী হলো নামছো না কেনো?

আরিয়ান তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসলে কেনো? আরিয়ান আমার ভীষণ ভয় করছে। প্লিজ এখান থেকে চলো। ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আরিয়ান আমার কোনো কথা না শুনে আমার হাত ধরে কবরস্থানে ঢুকে গেলো। আমার ভীষণ ভয় করছে। মাথা ঘুরছে। আরিয়ান আমাকে একটা কবর সামনে নিয়ে দাঁড় করালো। কবরটা অনেক পুরোনো। কবরের পাশের নেইম প্লেইট দেখে চমকে যায়। তাহলে এই কবরটাই তানহার।

জানো আয়না এই দিনেই তানহার জন্ম হয়েছিল। আমিই প্রথম তানহাকে কোলে নিয়েছিলাম। আনহা ছিল একটা পুতুলের মতো। কিন্তু তানহা যথেষ্ট বড় ছিল। হুট করেই কেউ দেখে বলতে পারতো না যে কিছুক্ষণ আগে বাচ্চাটার জন্ম হয়েছিল। আজকেই সেইদিন যেদিন তানহা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

কথাগুলো বলতে বলতে আরিয়ান হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কবরের পাশে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র অশ্রু। আরিয়ান কান্নারত অবস্থায় বলছে,

তানহা তুই দেখতে পাচ্ছিস না তোর আরিয়ান কাঁদছে। তোর কষ্ট হচ্ছে না আমি কাঁদছি। প্লিজ ফিরে আয় না তানহা। তোকে ছাড়া যে আমার ভালো লাগে না। আমার চোখের পানি মুছে দে না।

আরিয়ানের কান্না দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেছে। আরিয়ান তানহাকে কতোটা ভালোবাসতো। আমি মারা গেলোও হয়তো ভাইয়াও এভাবেই কাঁদতো। আরিয়ানের কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। আরিয়ানকে নিয়ে কবরস্থান থেকে বের হয়ে আসলাম। আরিয়ানকে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসিয়ে দিলাম। আমি ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লাম। আমি ড্রাইভিংটা মোটামুটি ভালোই পাড়ি।

_________________

বাসার সামনে আসতেই আরিয়ান আমাকে রেখেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আমি ও আরিয়ানের পিছু পিছু চলে এলাম। আরিয়ান রুমে ঢুকেই সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। আমি আরিয়ানকে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না। আরিয়ান যখন একা থাকতে চাইছে। থাকুক না একটু একা।

আমি আনহার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলাম। রুমে এসে দেখি আরিয়ান এখনো ওয়াশরুম থেকে বের হয়নি। আমি বেলকনিতে চলে গেলাম। তখনি আনহা ফোন করে। আনহার সাথে যখন ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত তখন রেলিংয়ের ওপর রাখা আমার হাতের ওপর আরেকটা হাতের অস্তিত্ব অনুভব করি।

আমি চমকে গিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ানের দৃষ্টি আকাশের দিকে। আমি আনহাকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। তারপর আমি আকাশের দিকে তাকালাম।

আরশি আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। আমার জীবনের অনেক কিছুই তোমার অজানা।

আরিয়ানের কথাটা শুনে চমকে আমি আরিয়ানের দিকে তাকালাম। আরিয়ানের জীবনের কী আমার অজানা। আরিয়ানকে আমার বড্ড রহস্যময় লাগে। আরিয়ান নামটাই আমার কাছে ধোঁয়াশার মতো। আমি আরিয়ানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। বোঝার চেষ্টা করছি আরিয়ানকে। কিন্তু বরাবরের মতোই আমি ব্যর্থ। আরিয়ানকে বোঝার সাধ্য সত্যিই আমার নেই।

আরিয়ান নামক ব্যক্তিটাই তোমার কাছে রহস্য। তোমার জীবনে আমার আগমন রহস্যময়। তোমার জীবন থেকে আমার হারিয়ে যাওয়াও হবে রহস্যময়।

________________

কেটে গেছে পাঁচটা মাস। পাল্টে গেছে সবার জীবন। আনহা আর ভাইয়ার প্রণয় সম্পর্কে সবাই জেনে গেছে। আনহা আর ভাইয়ার বিয়েও ঠিক করা হয়েছে। আনহার এইচ এস সি এক্সামের পর পরই আনহার সাথে ভাইয়ার বিয়ে হবে।

আমি আর আরিয়ান আমাদের জীবনে সুখী। আমার জীবন আরিয়ানের ভালোবাসায় ভরপুর। আমাদের দুজনের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে আরও একটা জীবন। আমার শরীরে বেড়ে ওঠছে আরিয়ানের অস্তিত্ব। হ্যাঁ আমি প্রেগনেন্ট। দুই দিন হয়েছে আমি জানতে পেরেছি আমি মা হতে চলেছি। আর আমি দুই মাসের প্রেগনেন্ট। এই কথা আমি বাসার কাউকে বলি নাই ইনফ্যাক্ট আরিয়ানকেও না।

আমার কেমন জানি লজ্জা লাগে বলতে গেলেই। তবে আজকে আরিয়ানকে বলবো। তবে একটু অন্য ভাবে। আমার ভাবনা অনুযায়ী রুমটা সাজিয়ে ফেললাম। সাজাতে সাজাতে রাত ৮ বেঁজে গেলো। আরিয়ান সাড়ে ৮ টা দিকে বাসায় চলে আসবে।

এখন যখন ৮ টা বাজে তাহলে আমার হাতে ৩০ মিনিটের মতো সময় আছে। আমি নিজেও একটু সেঁজে নিলাম। নিচে গাড়ির আসার আওয়াজ শুনে রুমের লাইট অফ করে দৌড়ে
বেলকনিতে চলে এলাম।

উফ আমার এতো লজ্জা লাগছে কেনো?এতো লজ্জা পেলে আরিয়ানকে বলব কী করে কথাটা? আরিয়ান রুমে ঢুকে নিশ্চয়ই অবাক হবে। বাচ্চাদের রুমের মতো নিজের রুমকে সাঁজানো দেখে সব বুঝে যাবে।

উত্তেজনায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। ১০ মিনিট পার হয়ে গেলো কিন্তু আরিয়ান আমার কাছে আসলো না দেখে আমি কিঞ্চিত অবাক হলাম। আরিয়ানের তো আমাকে রুমে না পেয়েই এখানে আসার কথা ছিল। আরিয়ান কী এখনো রুমে আসেনি?

আমার এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই এক জোড়া হিম শীতল করা হাতের স্পর্শ পাই নিজের শরীরে। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা আরিয়ান। আরিয়ান আমার গাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে নাক দিয়ে গাড়ে স্লাইড করতে থাকে। আরিয়ানের এমন স্পর্শ পেয়ে আমি একটু কেঁপে ওঠি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,

আরিয়ান কী করছো?

আমার কিউট বউটাকে আদর করছি।

আরিয়ান তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।

হুম বলো।

আরিয়ান আমি……

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না তার আগেই আরিয়ানের ফোনটা বেঁজে ওঠে। আরিয়ান আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। আরিয়ান ফোনটা কানে ধরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেছে খুব তাড়াতাড়ি এসে যাবে আর এসে আমার কথা শুনবে। আমার কপালে একটা চুমু এঁকে বেরিয়ে গেছে।

আমি আশাহত হলাম। আজকেও আরিয়ানকে কথাটা বলতে পারলাম না। আরিয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘড়ির কাটা ৯ টা পেরিয়ে ১০ টা, ১০ টা পেরিয়ে ১১ টা। ১১ টা পেরিয়ে ১২ টা বেজে গেলো কিন্তু আরিয়ানের আসার কোনো নামগন্ধ নেই। আমি আরিয়ানকে ফোন দিলাম কিন্তু আরিয়ানের ফোন বন্ধ।

আরিয়ানের টেনশনে আমার কান্না পাচ্ছে। ঘড়ির কাটা যখন রাত ৩ টাই অবস্থান করছে তখন আর নিজের টেনশন চেপে রাখতে পারলাম না। বাসার সবাইকে ডাকলাম। আব্বু, আম্মু আনহা সবাই আসলো। আমি সবাইকে সবটা বললাম। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আমি কেঁদে দিলাম। আব্বু হসপিটালে ফোন করে। হসপিটাল থেকে জানায় আরিয়ান হসপিটালে যায়নি।

এটা শোনার পর আমার কান্নার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। আব্বু ভাইয়াকে ফোন করে। ভাইয়া আমাদের বাসায়। ভাইয়া তাদের বন্ধুদের ফোন করছে আর আব্বু আত্নীয় স্বজনদের। কিন্তু আরিয়ান কারো কাছে যায়নি।

এক সময় কাঁদতে কাঁদতে অঙ্গান হয়ে যায়। ঙ্গান ফিরতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করি। সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। খুশিতে সবার চোখ মুখে চকচক করছে। বুঝতে পারলাম সবাই জেনে গেছে গ্রেগনেন্সির বিষয়টা। আরিয়ানের কথা জিঙ্গেস করতেই সবার মুখ কালো হয়ে যায়।

____________

আজ তিন দিন হলো আরিয়ান নিখোঁজ। এই তিন দিন আরিয়ানকে অনেক খোঁজা হয়েছে কিন্তু আরিয়ানকে কোথাও খোঁজে পাওয়া যায়নি।

এই তিন দিনে আমার অবস্থা সূচনীয়। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। অক্ষি জোড়া লাল হয়ে ফোলে গেছে। এই গুলো আমার কান্না আর নির্ঘুম রাতের সাক্ষী।

চলবে………..

( ব্যস্ততা আর অসুস্থতা কোনটাই আমার পিছু ছাড়ছে না। হুট করেই গতকাল রাত থেকেই আমার ডান হাত প্রচন্ড ব্যথা করছে। ব্যথার জন্য হাত নাড়াতে পারছি না। আজকে সারাদিনে বাম হাতে দিয়ে গল্পটা লিখছি। রিচেইক করি নাই ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ইনশাল্লাহ আগামীকাল গল্পটা শেষ করে দিব। হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here