প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -২৩

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২৩

ক্লান্ত অপরাহ্নের শেষ প্রহর! গুমোট আবহাওয়ায় জনসমাগমের গুনগুন কোলাহলে পরিবেশটা আমোদিত। আকাশের সিঁদুররাঙা মেঘের আনাগোনার ফাঁকে ফাঁকে উড়ে চলা পাখির ঝাঁক বার বার চোখে ঠেকছে তরীর। বটতলায় বসে বসে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে সে। সৌহার্দ্য ক্লান্তি নিয়ে হঠাৎ এসে তরীর পাশে বসলো, তরী টেরও পেল না। সৌহার্দ্য গালে হাত দিয়ে অতি মনযোগী হয়ে তরীর মুখের দিকে তাকালো। তার প্রসারিত ঠোঁটের প্রান্তভাগে লেগে থাকা হাসিটায় সৌহার্দ্যের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে রইলো কেবল। হাসিমুখে আশেপাশে চোখ ঘুরাতেই সৌহার্দ্যের মুগ্ধ দৃষ্টি চোখে পড়লো তরীর। হেসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো সে,

“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

সৌহার্দ্য একটুও নড়লো না। একইভাবে বসে থেকে বললো, “দেখছি! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটাকে। চোখ সরাতেই মন চাইছে না!”

“বলেছে তোমাকে? পৃথিবীতে আরো অনেক সুন্দর মানুষ আছে। আমার থেকেও বেশি সুন্দর! ”

সৌহার্দ্য মুখে হাসি বজায় রেখে বললো, “হোক। কিন্তু আমার চোখে তো তুমি-ই সবচেয়ে বেশি সুন্দর! তুমি দেখতে যদি অসুন্দর হতে, তবুও আমার চোখে সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা শুধু তুমিই! হাজারো সৌন্দর্যের ভীড়ে এই দুটো চোখ শুধু তোমাকেই খুঁজবে!”

“কেন?”

“কারণ ভালোবাসা মানেই সুন্দর! তুমি তো বুঝবে না আমার কথার মানে! আমি জানি।”

সৌহার্দ্য গম্ভীরভাবে কথাটা বলে সোজা হয়ে বসলো। তরী হাসলো। সৌহার্দ্যের কথার প্রেক্ষিতে কোনো কথা না বলে বললো,

“সব পেপারস জমা দেওয়া শেষ? আর কোনো কাজ নেই?”

সৌহার্দ্য কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, “নাহ্! ভাইবা তো দিলেই! ভর্তির সব ঝামেলা শেষ। সাথে সাথে আমার এনার্জিও!”

তরী সৌহার্দ্যের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। প্রকৃতিতে এখন হালকা হালকা শীতের আমেজ। শির শির করে উত্তরে হাওয়া বইছে। কিন্তু এই পরিবেশ থেকেও সৌহার্দ্যের শরীর ঘেমে একাকার! শুভ্র-সুন্দর মুখটা লালচে আভায় র*ক্তি*ম। কপালের ওপর চুলগুলো লেপ্টে আছে। সাদা শার্টটাও ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।

তরী সৌহার্দ্যের কাছ ঘেঁষে বসলো। ওড়নার প্রান্তদেশ হাতের মধ্যে নিয়ে সৌহার্দ্যের ঘর্মাক্ত কপাল ও গন্ডদেশ মুছতে মুছতে বললো, “সবে মাত্র অসুস্থতা থেকে রেহাই পেলে। কী দরকার ছিল ওভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার? তুমি কিন্তু চাইলেই সহজে সবটা করতে পারতে। এতো কষ্ট করার কোনো মানে হয়?”

সৌহার্দ্য তরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। চোখে মুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বললো,

“তোমার জন্য করেছি!”

তরী অবাক চোখে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য অমায়িক হাসলো। বললো, “তুমি সবে মাত্র বললে কেন? প্রায় একমাস হয়ে গেছে আমার এ*ক্সি*ডে*ন্টে*র। আজ সন্ধ্যার পর থেকে আমি হসপিটালেও জয়েন করছি। আচ্ছা, তুমি এখানে বসো। আমি একটু ঠান্ডা কিছু খেয়ে আসি। প্রচুর গরম লাগছে আমার!”

তরীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সৌহার্দ্য চলে গেল। তরী কিছু না বলে আশেপাশে তাকালো। এখানে-সেখানে অনেক মানুষের আনাগোনা। জাহাঙ্গীরনগরের ক্যাম্পাস যেন প্রাণে ভরা! অদূরে পরিচিত একটা মুখকে দেখে তরী চোখ ছোট ছোট করে ফেললো। ভালো মতো পরখ করে বুঝলো, ঐটা মধু। মেয়েটার সাথে যোগাযোগ হয় না অনেক দিন ধরেই! ওর ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা যায় না। আজ দেখা হওয়ায় ভালোই হয়েছে। এতো মানুষের ভীড়ে ডাকাডাকি করলে মধু শুনবে না। তাই এগিয়ে গেল মধুর দিকে।

মধু উল্টো দিকে ফিরে থাকায় তরী ওর কাছাকাছি গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। মধু চকিত ভঙ্গিতে তরীর দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো,

“তুই? এখানে? কেন? কখন? কীভাবে?”

বলতে বলতেই তরীকে ঝাপটে ধরলো মধু, “আরে, ইয়ার! কত দিন দেখি না তোকে!!! আই মিসড ইউ সো মাচ, ইয়ার!”

“কত যে মিস করেছো, সেটা তো বুঝতেই পারছি!”

মধু চমকালো। তরীকে ছেড়ে দিয়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বললো, “কেউ কি আমার কথার উত্তর দিলো? নাকি আমিই ভুল শুনলাম?”

তরী বিরক্ত হয়ে বললো, “আমিই বলেছি। ভুল শোনোনি।”

বিস্ময়ে মধুর মুখ হা হয়ে গেল। গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো, “মানে? এটা… তুই… কথা… মানে কী হচ্ছে এসব? এম আই ড্রিমিং?”

“না, ঠিকই দেখেছো! আমি কথা বলেছি।”

“এটা কীভাবে সম্ভব? তুই তো কথা বলতে পারিস না! তাহলে আজ কীভাবে?”

তরী মলিন হাসলো। বললো, “এমনিতেই! সত্যটা আর গোপন করে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই মুখ খুলতেই হলো।”

মধু সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো, “তার মানে এতো দিন তুই নাটক করেছিস সবার সাথে! তুই এভাবে সবাইকে ঠকাতে….”

মধুকে থামিয়ে দিয়ে তরী বললো, “তুমি ভুল বুঝছো, মধু! কোনো নাটক ছিল না। জাস্ট আমার কথা বলার ইচ্ছেটা-ই ম*রে গিয়েছিল। সে অনেক কাহিনী! আমি সবকিছু শেয়ার করতে পারবো না। সেজন্য সরি!”

মধু তরীকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, “ইট’স ওকে! আই আন্ডারস্ট্যান্ড। সবারই কিছু প্রাইভেট বিষয় থাকে। তোর সবকিছু শেয়ার করার দরকার নেই। তবে আমার খুব ভাল্লাগলো তোর মুখ থেকে কথা শুনে। এখন আমাকে এটা বল যে, তুই এখানে করছিসটা কী?”

“ভর্তি হতে এসেছি! তুমি কেন এসেছো?”

“আমিও তো! তুই এখানে চান্স পেয়েছিস? ও মাই গড!! কোন ডিপার্টমেন্টে?”

“ফার্মেসি!”

“ওয়াও! ডাক্তারি রিলেটেড বিষয়ই। আমি তো একটা পরীক্ষা-ই দিয়েছিলাম! ল এন্ড জাস্টিস ডিপার্টমেন্টেই চান্স হয়েছে।”

তরী খুশি হলো। বললো, “ভালো সাবজেক্ট তো! ভালোই হয়েছে আমরা সেইম ক্যাম্পাসে।”

“হুম! এখন থেকে সারাক্ষণ আমার সাথে থাকবি। বুঝলি? আচ্ছা, আমার টিউশন আছে। তুই যাবি? চল আমার সাথে।”

তরী মুখ ছোট করে বললো, “না! আমি একা আসিনি।”

“ওহ! তোর বর এসেছে। আচ্ছা, তাহলে আমি যাই।”

মধু ওর স্কুটারে উঠে ঝড়ের গতিতে স্থান ত্যাগ করলো। তার পাঁচ মিনিটের মাথায় সৌহার্দ্য তরীর কাছাকাছি এসে বললো, “তুমি এখানে কী করছো? কতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমায়!”

“ঐ তো! এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হলো। তাই দেখা করতে এলাম!”

“ওহ! আচ্ছা, চলো তাহলে। যাওয়া যাক!”

বাড়ির গেইটের সামনে গাড়ি থামালো সৌহার্দ্য। তরীর দিকে তাকিয়ে বললো, “পৌঁছে গিয়েছি। ভেতর থেকে আমার এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপটা এনে দাও।”

তরী অবাক হয়ে বললো, “তুমি ভেতরে আসবে না?”

“নাহ্! ডিউটি শেষে একেবারে আসবো।”

তরী মুখ কালো করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ভেতর থেকে সৌহার্দ্যের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এনে দিতেই সৌহার্দ্য হাসিমুখে সেগুলো হাতে নিলো। বললো,

“একটু হাসো! এভাবে মুখ অন্ধকার করে রেখেছো কেন?”

“তাড়াতাড়ি এসো। তাহলেই আমার হাসিমুখ দেখতে পাবে।”

বলেই তরী সাথে সাথে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সৌহার্দ্য হাসলো। মনে মনে বললো, “এখন পালিয়ে গেলে! কালকে থেকে পালাতে দেবো না আর।”

তরী ঘরের ভেতরে ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে টেবিলের কাছাকাছি যেতেই সৌহার্দ্যের ডায়েরিটা চোখে পড়লো। বইয়ের ওপরেই রাখা আছে ডায়েরিটা। তরী বুঝতে পারলো, সৌহার্দ্য সম্প্রতি ডায়েরিতে কিছু লিখেছে। তাই ডায়েরিটা হাতে নিল। সৌহার্দ্য জানতে পেরেছে যে, তরী-ই ওর চাঁদ! এটা তরী নিজেও জানে। কিন্তু ওর প্রশ্ন হলো, সৌহার্দ্য ঠিক কতটুকু জেনেছে ওর ব্যাপারে? সেটা জানার জন্যই তরী ডায়েরিটা খুললো। নতুন কোনো লেখা চোখে পড়লো না। কিন্তু কয়েকটা ফাঁকা পৃষ্ঠা উল্টোতেই দুদিন আগের তারিখ চোখে পড়লো তরীর। সাথে সৌহার্দ্যের গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

“আমার চাঁদ এখন থেকে শুধুই আমার। একান্তই আার নিজের! আমি জানি না, কেন আমার চাঁদের মনে এতো কষ্ট ! কিন্তু আমার চাদকে আর কষ্ট পেতে দেব না আমি।”

তরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক! সৌহার্দ্য তাহলে কিছুই জানে না।

৩৪.
প্রায় একমাস পর দেশে ফিরলো প্রহর। রিয়াদ ওকে রিসিভ করতে এসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতেই রিয়াদ বললো,

“কেমন আছে আপনার বোন এখন, স্যার?”

প্রহর বিরক্ত হয়ে বললো, “ও ভালোই আছে। শুধু শুধু জেদ ধরে আমাকে নিয়ে গেল ওর কাছে। একদম সুস্থ ও। আমাকে নাকি দেখতে ইচ্ছে করছিল ওর। তাই মিথ্যে বলে কানাডা নিয়ে গেল! ভাবা যায়!”

“আপনিও তো! এক মাস থেকে এলেন!”

“অর্থী আমার একমাত্র বোন। ও ছাড়া আপাতত এই দুনিয়ায় কেউ আছে আমার? ওর জন্য সব করতে পারি আমি। শুধু সমস্যা একটাই! আজাদ চাচার বাড়ি থেকে আনা কাগজ গুলো দেখার সুযোগ পেলাম না এখনো। একটু তাড়াতাড়ি বাসায় চলো তো!”

প্রহর বাড়িতে ঢুকেই ওর আলমারি থেকে কাগজের ব্যাগটা বের করলো। সেদিন তরী কথা বলার পর প্রহর আর এই ব্যাগটা ছোঁয়ারও সুযোগ পায়নি। অর্থী হসপিটালে এডমিটেড শুনে মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল ওর! কিন্তু এখন আর দেরী করা যাবে না। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়েই গিয়েছে। প্রহর কাগজগুলো হাতে নিয়ে সেগুলোতে কোনো লেখা পেল। সব কাগজই সাদা! প্রহর তন্নতন্ন করে কাগজ গুলো বের করলো। কিন্তু কোনো কাগজেই কোনো লেখা পেল না। প্রহর হতভম্ব হয়ে নিজেই নিজেকে বললো,

“আচ্ছা, ব্যাগটা কি বদলে দেওয়া হয়েছে? আসল সত্যিটা জানার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট রইলো না তাহলে? কীভাবে উদঘাটন হবে তাহলে তরীর মধ্যকার রহস্যগুলো?”

-চলবে…

(/)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here