#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৬
-“তরী মেয়েটা খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। আফনাদ আহমেদ-এর প্রথম পক্ষের মেয়ে ও। প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন-ই দ্বিতীয় বিয়ে করেন আফনাদ। তরী তখন মাত্র সাত বছর বয়সের বাচ্চা একটা মেয়ে। ক্যা’ন্সা’র আক্রান্ত হয়ে মারা যান তরীর মা। তরীর জায়গা হয় সৎমায়ের সংসারে। প্রথমদিকে তরীকে আদর করতেন তার সৎমা। কারণ তরী সুন্দরী, মায়াবী আর কথা বলার অপারগতার কারণে তরীর প্রতি হয়তো তার মায়া লাগতো। কিন্তু সৎমায়ের সন্তান হওয়ার পর থেকে তরীর সাথে অন্য সব সাধারণ সৎমায়ের মতোই আচরণ করতেন তিনি।মেয়েটা এখন এডমিশন ক্যান্ডিডেট। বিয়ে হয়েছে, যদিও সংসার জীবনে সে সুখী নয় যতটুকু জানতে পারলাম।”
এতোক্ষণ রিয়াদের কথাগুলো খুব মনযোগ দিয়ে শুনলেও শেষের কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকালো প্রহর। অবাক হলো খানিকটা। বললো,
-“মেয়েটা বিবাহিত? ভাবতেও পারিনি!”
বলেই ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহর। সবটা জেনে কিছুটা ক্লু পেয়েছে সে। তাই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু স্বস্তিটা কিছুক্ষণ স্থায়ীত্ব পাওয়ার আগেই রিয়াদ বললো,
-“ইয়েস, স্যার। জানতে পারলাম, নিউলি ইনটার্নড্ কার্ডিও-সার্জন ড. সৌহার্দ্য রায়হানের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। আর ……”
-“হোয়াটটট্!!!”
রিয়াদের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রহর চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। হঠাৎ কথার মাঝে প্রহরের চিৎকার শুনে রিয়াদ ভয় পেল খানিকটা। অবাক হয়ে তাকাতেই প্রহর কম্পিত কণ্ঠে বললো,
-“আর ইউ শিয়র? ড. সৌহার্দ্য রায়হানের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে? ”
-“হ্যাঁ, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছি। তাদের বিয়ের ছবি কালেক্ট করা সম্ভব হয়েছে। এই যে, দেখুন!”
ছবি হাতে ধপ করে বসে পড়লো প্রহর। মাথায় হাত দিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
-“ও মাই গড!”
-“স্যার, আপনি এই সাধারণ মেয়েটাকে নিয়ে এতো কেন ভাবছেন? আমার তো ওকে কোনো দিক দিয়েই সন্দেহজনক বলে মনে হয় না।”
অনেকটা নিশ্চিতভাবেই অকপটে কথাটা বলে ফেললো রিয়াদ। প্রহর জহুরি নজরে তরীর ছবিটা পরখ করতে করতে বললো,
-“সাধারণের মাঝেও অসাধারণ অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে। হয়তো যা আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি, তার পেছনেও অন্য কিছু আছে, যা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে! অনেক যোগসূত্র মিলিয়ে যা অনুধাবন করতে পারছি, তা এই মেয়েটার দিকেই আকৃষ্ট করছে আমাকে। ওর মাঝে বিশেষ কিছু আছে, যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমাদের আরো গভীরভাবে জানতে হবে ওকে। কেন যেন মনে হচ্ছে, সব নাটের গুরু এই মেয়েটা-ই! তরী উরফ মিসেস সৌহার্দ্য রায়হান!”
১৩.
তরীর পাশে বসে চোখের পানি ফেলছেন সুজাতা। তরীর চোখেও পানি টলমল করছে। সে কীভাবে তার মা-তুল্য শাশুড়ীকে সান্ত্বনা দিবে, বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ সুজাতার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার চোখ মুছে দিচ্ছে, আবার কিছুক্ষণ ওটির সামনে পায়চারী করছে।
ঘন্টা তিনেক পর সৌহার্দ্য ওটি থেকে বেরিয়ে এলো। বি”ধ্ব”স্ত দেখাচ্ছে ওকে। ক্লান্তি, বিষাদ আর তিক্ততা আশেপাশে থেকে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। ভাগ্য কিসের পরীক্ষা নিচ্ছে কে জানে!
তরী সৌহার্দ্যের থেকে সবসময় শত হাত দূরে থাকলেও আজ সব ভুলে সৌহার্দ্যের সামনে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ যে মানুষটা মৃ’ত্যু’র মুখে পতিত, সে তো তাকে নিজের বাবার থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছে! তার এই পরিস্থিতি কীভাবে সহ্য করছে, সেটা শুধু তরী নিজেই জানে।
তরীকে দেখে সৌহার্দ্য কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে গেল। মায়ের কান্না দেখে বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো সৌহার্দ্যের! সুজাতার পাশে বসে মাকে নিজের বুকে আগলে নিলো। নিজের চোখের পানিগুলো মুছে বললে,
-“বাবা ভালো আছে, মা। মাথায় আঘাত পেলেও এখন ডে’ঞ্জা’র-জোনের বাইরে আছে। দেখবে, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে, বাবা! সবসময়ের মতো দিনভর আমায় বকাঝকা করবে। দেখে নিও।”
মা-ছেলের কান্ড দেখে তরী কান্নামাখা হাসি দিলো। অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি! এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। যাক! মিস্টার রায়হান ভালো আছেন এখন। আবার সৌহার্দ্যের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
-“এমনিতে তো গোম*ড়া*মুখো! তবে নিজের মা-বাবাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তোর ছেলেমেয়ে তোকে একদমই ভালোবাসবে না। দেখে নিস! এই তরীর অ*ভি*শা*প বিফলে যায় না।”
পরমুহূর্তেই নিজের চিন্তাধারা বুঝতে পেরে চোখ বড়বড় করে ফেললো। এসব কী ভাবছে সে? কী অদ্ভুত ব্যাপার!!
১৪.
বিছানায় বসে বসে অংক করছে মধু। ভাঙা বাঁ হাতটা নিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছে সে! হাত ভালো থাকলেও পড়ায় মনযোগটা বসাতে পারতো না সে। পড়াশোনায় প্রচন্ড অনীহা তার ছোটবেলা থেকেই। অংক না পারার বিরক্তি হাতের ওপর ঢেলে বিরবির করে বললো,
-“এইসব ম্যাথ যে আবিষ্কার করেছে, তার জীবনে বিয়ে হবে না। ধুরর!! আর এই ভাঙা হাত কত বছর গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে ঘুরতে হবে কে জানে?”
বই-খাতা সরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে তরীকে একটা টেক্সট করলো মধু। একমাস পর কোচিংয়ে ক্লাস করতে গিয়েছিল আজকে সে। কিন্তু তরীকে কোথাও দেখতে পায়নি। তরী তো এমনি এমনি ক্লাস মিস দেওয়ার মেয়ে না!
ভানার মাঝেই কল এলো মধুর ফোনে। আননৌন নাম্বার। মধু কল রিসিভ করে বললো,
-“হ্যালো! কে বলছেন?”
-“কল রিসিভ করে ভদ্রতার সাথে সালাম দিতে হয়। মিনিমাম কমনসেন্স আর ভদ্রতা কি তোমার মধ্যে নেই?”
মধু অবাক হওয়ার আগেই রেগে গেল। মেয়েটা এমনই! ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেওয়ার বৈশিষ্ট্যটা তার ব্যক্তিত্বের কোথাও নেই!
-“কে রে তুই? রাত-বিরেতে মেয়েদের কল দিয়ে বিরক্ত করিস! আবার ভদ্রতা শেখাতে এসেছে আমাকে? তুই নিজে ভদ্র? ভদ্র হইলে কখনো অপরিচিত মানুষদের কল করে ‘তুমি’ সম্বোধন করতি না!”
ওপাশ থেকে অবাক কন্ঠ শোনা গেল,
-“মানে? আমি তো তাও ‘তুমি’ সম্বোধন করে কথা বলছি! তুমি তো একেবারে ‘তুই’-তে চলে গেলে! আশ্চর্য!! তুমি জানো, তুমি কার সাথে কথা বলছো?”
মধু বিরক্তি নিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললো,
-“না, জানি না। কার সাথে কথা বলছি জানিয়ে দিয়ে ফোন কা*ট্!”
ওপাশ থেকে দাতে দাত চেপে প্রহর বললো,
-“আমি প্র… মানে অভীক শাহরিয়ার। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার।”
-“তো আমার কী? তোকে চিনি না, জানি না! ভয় কেন পাবো রে? আর বড় কথা হলো, আমি জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হবো না! আমি মেডিক্যালের জন্য পড়াশোনা করছি।”
প্রহর একগাল হাসলো। বললো,
-“মেডিক্যাল? হা হা হা! আর হাসিও না আমায়। তোমার মাথাভর্তি গোবর। এ দিয়ে মেডিক্যালে চান্স হবে তোমার? আর আমাদের ভার্সিটি তুমি চান্স পেলে তো ভর্তি হবে?”
মধু রাগী কন্ঠে বললো,
-“দেখ! আমি জানি আমি কোথাও চান্স পাবো না। দরকার হলে আমি প্রাইভেটে পড়বো। তাতে তোর কী বে?”
-“ইস, পুরো গোল্লায় গেছো দেখছি। মুখের ভাষা শুনে আমার মাথা ঘুরছে!”
-“প্যাঁচাল শোনার মুড নাই আর। তুই ফোন কাটবি? নাকি তোর মাথা ফাটাবো আমি?”
প্রহর বিরক্ত হয়ে ‘চ্’ ধরণের শব্দ করে বললো,
-“তোমাকে এখন আমার সাথে দেখা করতে হবে। হোস্টেলের গেস্টরুমে বসে আছি আমি।”
-“মগের মুল্লুক। তোর সাথে দে…..”
মধুর চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই প্রহর বললো,
-“তুমি না এলে কিন্তু আমি এখানে নিজেকে তোমার হাসবেন্ড বলে পরিচয় দেব। আমি সাথে একটা নকল রেজিস্ট্রি পেপার নিয়ে এসেছি। কীসের রেজিস্ট্রি পেপার, জানো? তোমার আর আমার বিয়ের!”
প্রহর গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলছে। মধু প্রচন্ড অবাক হলো। রেগেও গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“আজ তোর একদিন, নয়তো আমার একদিন! ”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এই ছেলের আজ বারোটা না বাজালে ওর শান্তি নেই। গেস্ট রুমে এসে দেখলো, শুধু একটা ছেলে বসে আছে। ছেলেটার মুখ দেখে মধু থমকালো। অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
-“আপনাকে এতো চেনা চেনা লাগছে কেন? আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো!”
-চলবে…..
[।]