প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ১
১
অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরোনো বাড়িটার সামনে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ছয় বন্ধুর একটা ছোট্ট দল। কলেজে তাদের দলটির নাম দেয়া হয়েছে “ষড়যন্ত্র মানব”! নামটা তাদের ইংরেজীর প্রফেসর দিয়েছিলো কলেজে ভর্তি হবার এক সপ্তাহ পর। যদিও উনি ওদের “ছয় যন্ত্র মানব” বুঝাতেই “ষড় যন্ত্র মানব” নাম দিয়েছিলেন তবে মুখে মুখে নামটা ষড়যন্ত্র মানবই হয়ে গেছে।
নামটা অদ্ভুত হলেও তাদের চরিত্রের সঙ্গে বড্ড বেশিই মানানসই ছিলো কারন তাদের মাঝে না আছে ভয় আর না আছে কোনো আবেগের স্থান। তারা ছয়জন অনেকটা রোবটের মতোই, তাদের উদ্দেশ্য একটা মরিচীকা! যে মরিচীকাকে সাধারন মানুষ ভুত হিসেবে চেনে আর ষড়যন্ত্র মানব চেনে সুপার হিউম্যান নামে। তারা ভুতে বিশ্বাসী নয়, তবে তাদের ধারনা কোনো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষই অন্যকে ভুত সেজে ভয় দেখিয়ে নিজের শক্তিকে গোপন করার আপ্রান চেষ্টা করে… অন্ধকার বাড়িটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনেকটা অধৈর্য্য হয়েই ছায়ানিকা জিজ্ঞেস করলো,
—রিদান, তোর কি মনে হয় এ বাড়িতে আমরা ভুত পাবো?
রিদান, বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। ওদের প্রত্যেকের পারিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো হলেও দলটার বেশিরভাগ ভ্রমণের সকল দায়িত্ব যার ঘাড়ে এসে পড়ে সে হলো রিদান… ছায়ানিকা তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হলেও রিদানের কাছ থেকেই তাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালাতন সহ্য করতে হয়। ছায়ানিকার প্রশ্নে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রিদান বললো,
—উফ, চিকা… তুই সবসময় এমন ভিতুদের মতো কথা বলিস কেনো? আমার মামু বলেছে এ বাড়িতে ভুত আছে, তার মানে নিশ্চয়ই আছে। আমার মামু কখনো ভুল তথ্য দিতেই পারে না, মামুহলো সত্যবাদী!
—রিদান! একদম আমাকে চিকা বলবি না, আমার নাম ছায়ানিকা… আর আমি মোটেও ভিতু নই। আরেকটা কথা, তোর মামু প্রতিবার আমাদের এমন ভাঙ্গাচুরা বাড়িতে পাঠায় আর আমরা যখন সেখানে ভুত নেই এটা নিশ্চিত করি তারপরই বাড়িটা কিনে তিনি সেখানে বড় বড় দালান বানিয়ে চড়া দামে মানুষের কাছে ফ্লাট বিক্রি করে। তাই মামুর ভাগিনা, একদম মামু মামু করবে না বুঝলে? তোমার মামু বহুত শেয়ানা!
অবস্থা বেগতিক দেখে রাকিব আর রায়ান দু’জনে একত্রে বলে উঠলো,
—রিদান, প্লিজ ব্রো… থাম তোরা…
তুলি আর তুর্জ একপাশে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে লক্ষ্য করছে। আজ রাত তারা এ বাড়িতেই কাটাবে, অথচ বাড়ির বাহিরটা দেখে মনে হচ্ছে ভেতরটা এতোটাই নোংরা হবে যে আপাতত তিন চারটা দিন পরিষ্কার করার কাজেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এতোটা পথ জার্নি করে আসার পর শরীরে কাজ করার মতো বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই তাদের। তুলি তুর্জর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—দোস্ত, এগুলা ঝগড়া করে কেন? আমার তো খুদা লাগছে… ওগোরে থামা না ভাই।
—ওদের থামানোর সাধ্য আমার কি আছে রে তুলি! ওরা দুটো হলো এক একটা ঝগড়া পোকা। এরা নাকি আবার বেস্ট ফ্রেন্ড!
—এখন ওই টু ইনই একমাত্র ভরসা।
—হ্যাঁ রে ঠিক বলেছিস, টু ইন যদি পারে ওদের থামাতে।
ওদের একপাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করতে দেখে রাকিব খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—তুলতুলি, তুই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ছায়াকে তোর সঙ্গে রাখ, ইঁদুর বিড়ালের ঝগড়া দেখতে মন চায় না।
—তুলতুলি বলবি না তো রাকিব। এই ছায়া, তুই রাগারাগি বাদ দিয়ে এটা ভাব আজ রাত কি করে কাটাবো! এ বাড়িটা কি নোংরা দেখেছিস? আজ রাতে এখানে থাকলে নির্ঘাত এলার্জি হবে!
তুলি তার ত্বক নিয়ে একটু বেশিই সচেতন, তার মুখে এলার্জির কথা শুনে না পারতেই হেসে দিলো রাকিব তারপর বললো,
—তোর ওই গোলু গালদুটোর জন্যই তোকে তুলতুলি বলি বুঝলি? আর শোন, তোর এলার্জি হবে না। আমার ব্যাগে ফোল্ডিং টেন্ট আছে, ভেতরে বেশি ধুলো হলে তুই আর ছায়া ওটাতে ঘুমাতে পারবি।
তুলি মুহূর্তেই হেসে দিলো তারপর ছায়ানিকার দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভেবে বললো,
—এই ছায়ার মুখটা তো শুকিয়ে গেছে রে, বেচারি এমনিই শুকনা তার ওপর যদি আরও শুকিয়ে যায় তবে তো পরের বার দেশে এসে ওর বাবা মা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে!
ছায়ানিকার দেশ ছাড়ার কথা শুনতেই মুহূর্তেই রিদানের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, দাঁতমুখ খিঁচে সে বললো,
—চিকার মোটা হবার দায়িত্ব আমি নিলাম, তোদের এসব ভাবতে হবে না। এখন ভেতরে চল তো…
তুর্জ এককোনে দাঁড়িয়ে হাসছে। তার হাসিটা অন্যকারও চোখে না পড়লেও ছায়ানিকার চোখ এড়ালো না। তার নিজেরও অবশ্য হাসি পাচ্ছে কারন সে জানে তার মুখ না বরং তুলির মুখটাই শুকনো। আসার সময় গাড়িতে বসেও তুলি কয়েকবার তাকে ক্ষুদার কথা বলেছে।
রাকিব আর রায়ান জমজ ভাই, একটা অদ্ভুত ব্যপার হলো তাদের পছন্দ অপছন্দ একই রকম… তাদের দুজনেরই তুলির জন্য সফ্ট কর্ণার আছে আর দুজনেই তুলিকে তুলতুলি ডাকে। অবশ্য তার একটা কারনও আছে, তাদের দুজনের চেহারার পার্থক্যটা অন্য কেউ ধরতে না পারলেও তুলি খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারে। তাদের আলাদা করতে তুলির কখনো ভুল হয় না।
২
বাড়ির ভেতরে পা রেখে রীতিমতো চমকে গেলো ওরা! বাড়িটা বাহিরে থেকে যতোটা নির্জীব ভেতর থেকে ঠিক ততোটাই জীবন্ত। ভেতরে ঢুকতেই সামনে পড়ে বিশাল বসার ঘরে পাতা খানদানী সোফা আর একটা কাঁচের টি-টেবিল। টি-টেবিলটা বরাবর ঠিক উপরের দেয়ালে নানা রঙের ক্রিস্টাল পাথরের ঝালর বাতি। বাতিটা থেকে আলো এসে বাড়ির দেয়ালের মারবেল পাথরে পড়ছে। এতো সৌন্দর্য, আভিজাত্য তাদের কেউই আগে কখনো দেখে নি।
মুগ্ধ হয়ে তারা বাড়িটার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো, হঠাৎ করেই ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেলো! নূপুরের ঝুমুর ঝুমুর ধ্বনি এসে তাদের কানে লাগতে লাগলো। নূপুরধ্বনি যতো কাছে আসতে লাগলো ততো যেনো পরিবেশটা থমথমে হয়ে যাচ্ছিলো, ছায়ানিকা অন্ধকারে হাতড়ে তুর্জের হাতটা চেপে ধরলো। ঠিক সে সময় ছায়ানিকা তার বাহুতে কারও স্পর্শ টের পেলো, মাথা উঁচু করে পাশে তাকাতেই বুঝলো রিদান তাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।মুচকি হাসলো ছায়ানিকা, কে বলবে এতোক্ষণ তারা ঝগড়া করছিলো। এটাই হয়তো বন্ধুত্ব, হাজার ঝগড়া মনোমালিন্যের পরও বিপদে একে অপরের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়… হাতে থাকা টর্চ লাইটগুলো জ্বালানোর চেষ্টা করলো তারা এবং অদ্ভুতভাবে লাইটগুলো জ্বলতে গিয়েও নিভে গেলো। এমন ঘুমোট অন্ধকারের মাঝেই হঠাৎ নূপুরের শব্দটা থেমে গেলো এবং এক টুকরো আলোকরশ্মি ঘরের কোনে জ্বলে উঠলো।
মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ষোলো কিংবা সতেরো বছরের এক অপরূপ সুন্দরী যুবতী। ঠোঁটের কোনে তার মৃদু হাসি, চোখে টানটান করে কাজল পরা, আটপৌরে সাদা শাড়ীটার আচল মেঝেতে পড়ে আছে, কপালে লাল টিপ আর হাতভর্তি লাল চুড়ি, পায়ে গাঢ় লাল আলতা… দেখে যে কোনো মানুষ তাকে দেবী সম্বোধন করবার আগে দ্বিতীয়বার ভাববে না। তাদের দিকে মোমবাতি হাতে এগিয়ে আসছে মেয়েটি, তার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে নূপূরের ধ্বনি যেনো পুরো ঘরটায় ঝুমুর ঝুমুর তাল তুলছে। রাকিব মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—আপনি কি এ বাড়িতে থাকেন?
মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তারপর সোফার পাশের টেবিলটায় মোমবাতিটা রেখে বললো,
—নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাই বলুন তো?
শহুরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষগুলোর সামনে অতি সাধারন তবুও অসাধারন এক যুবতী দাঁড়িয়ে যখন কথা বললো তখন তাদের মনে হলো কানের কাছে যেনো কোনো সুর বাজছে। এতোটা শ্রুতিমধুর শব্দ তারা এ জীবনে শুনে নি, এ যেনো কোনো কণ্ঠস্বর নয় বরং এক মনোমুগ্ধকর ধ্বনি!
ছায়ানিকার দিকে মেয়েটা এগিয়ে এসে ওর গালে হাত রাখলো, সঙ্গে সঙ্গে ঘোর কাটলো ছায়ানিকার। মেয়েটার হাতটা অসম্ভব রকমের ঠান্ডা, ঠান্ডায় গাল অবশ হয়ে যাচ্ছে তার। কিছুটা দূরে সরে গেলো সে মেয়েটার থেকে তারপর নিজের গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
—বাহির থেকে দেখে এ বাড়ির ভেতরকার সৌন্দর্য সত্যিই বোঝা যায় না। আমরা ভেবেছিলাম বাড়িটা খালি তাই…
মেয়েটা রহস্যময় হাসি হাসলো তারপর ছায়ানিকার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—পৃথিবীর সকল মানুষই বাহিরের চাকচিক্য দেখে ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করে। অথচ তারা জানে না, সব সৌন্দর্য্য মধুর হয় না… কিছু সৌন্দর্য্য বিষাক্তও হয়! আবার সব অসুন্দরকে অসুন্দর বলা যায় না বরং খুঁজে দেখলে গোবরেও সুন্দর পদ্ম পাওয়া যায়!
মেয়েটার কণ্ঠে কি ছিলো বুঝতে পারে না ছায়ানিকা তবে মুহূর্তেই তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে আর কিছু সময়ের জন্য সে তাকিয়ে থাকে তার বন্ধুদের দিকে। তার বন্ধুরা শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কারও শরীরে যেনো প্রাণ নেই বা প্রাণ থাকতেও তারা নিষ্প্রাণ!
ছায়ানিকা রাকিবের পাশে দাঁড়ানো তুলিকে দেখে থমকে যায়, তার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে অথচ সে কোনো সাড়া শব্দ করছে না। বরাবরই শব্দ করে কাঁদার স্বভাব তুলির, তার আজকের নিরব কান্নার কোনো মানে খুঁজে পায় না ছায়ানিকা… রিদানের কাছে গিয়ে তার বাহু ধরে ঝাকায় সে, রিদান তার দিকে তাকিয়ে ধরে আসা গলায় বলে,
—দোস্ত কোনো মানুষ এতো সুন্দর হয়!
তুর্জ মেয়েটার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে,
—পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য যেনো এই একটা মানুষের উপর বারিধারার মতো বর্ষিত হয়েছে!
রাকিব আর রায়ানও ততোক্ষণে এগিয়ে এসেছে, মেয়েটার দুপাশে দুজন দাঁড়িয়ে একত্রে বলে উঠে,
—সৌন্দর্য্যের স্বরূপ আজ নিজ চোখে দেখলাম!
মিতু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
—আহা কি সুন্দর, কি সুন্দর… আমি কেনো এতো সুন্দর হলাম না!
মিতুর কন্ঠে আক্ষেপ স্পষ্ট, অথচ যে কেউ তার দিকে একবার তাকানোর পর আরেকবার তাকাতে বাধ্য হবে। তার মুখে এ কথা অন্তত মানায় না। ছায়ানিকা মুহূর্তের জন্য থমকে যায় বন্ধুদের দেখে। তারা ছোটবেলার বন্ধু, আজ এতো বছরের জীবনে তার বন্ধুদের কোনো সৌন্দর্য্য বশ করতে পারে নি অথচ এই কয়েক মুহূর্তে তারা মেয়েটির সৌন্দর্য্যে বশ হয়ে গেলো! মেয়েটি নিঃসন্দেহে অপরূপা তবে কোনো সৌন্দর্য্য কি আধও মানুষকে এভাবে বশ করতে পারে! এ কি আধও সম্ভব! স্তম্বিত ছায়ানিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তার বশীভূত বন্ধুদের আর তার কানের কাছে বাজছে যুবতী মেয়েটির ভয়ঙ্কর সুন্দর হাসি! ঘরের কোনের গ্রামোফোনে বেজে চলছে রবী ঠাকুরের সেই সুন্দর গীতি,
“চিত্ত পিপাসিত রে
গীতাসুধার তরে।
তাপিত শুষ্কলতা বর্ষণ যাচে যথা
কাতর অন্তর মোর লুণ্ঠিত ধূলি পরে
গীতসুধার তরে…”
চলবে…