প্রণয়িনী,পর্ব:৪+৫

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ৪

রাতে খাবার সময় তুলিকে বেশ শান্ত দেখা গেলো, রাকিব আর রায়ানের দৃষ্টি তার দিকে স্থির। তুর্জর ভাব বোঝার উপক্রম নেই। ছায়ানিকা আর রিদান মন দিয়ে খাচ্ছে। খাওয়ার মাঝেই রিদান বললো,

—তাহলে কাল আমরা বেক করি? মামুকে আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, এ বাড়িতে ভুত নেই।
—রিদান, ভুত নেই তবে অন্য কেউ তো নিশ্চয়ই আছে তাই না? না মানে এসব ব্যবহার কে করে!
—তুলি, এসব ভেবে আমরা কি করবো? আমাদের কাজ ভুত খোঁজা, যেহেতু এখানে ভুত নেই সেহেতু আমাদের এ বাড়িতে কোনো কাজও নেই। তাছাড়া তোর বাবা-মা তোকে গ্রাম থেকে শহরে পাঠিয়েছে, তোর কিছু হয়ে গেলে তার জবাব কে দেবে? রাকিব আর রায়ানও তো ম্যাসে থাকে, ওদের কিছু হলে তখন ওদের বাবা-মা কে দেখার কেউ থাকবে? তুর্জ আর আমার কোনো সমস্যা নেই কারন আমাদের বাবা-মা কিছু বলবে না। আর ওই যে ম্যাডাম চিকা, সে তো প্রথম দিনই হাত পা ভেঙ্গেছে। তার বাবা-মা দেশের বাহিরে থাকে বলে সে যাচ্ছেতাই ভাবে ঘুরে বেড়াবে তা তো হয় না। যেহেতু আমরা জানি না এ বাড়িতে কে বা কারা থাকে তাই এখানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো।
—তোরা গেলে যা, আমি কোথাও যাচ্ছি না।

ছায়ানিকার কথায় সবাই ওর দিকে তাকালো, রিদান রেগে যাচ্ছে… ছায়ানিকা সে দিকে না তাকিয়ে শান্তস্বরে বললো,

—এতোদিন আমরা যে পুরোনো বাড়িগুলোতে গিয়ে থেকেছি সেগুলো ভেতর বাহির সব দিকেই পুরোনো ছিলো। বলতে গেলে থাকার অযোগ্য, তাই আমরা একদিন থেকে ভুতের অস্তিত্ব না পেয়ে বেক করেছি। কিন্তু এ বাড়িটার স্টোরি ভিন্ন, এ বাড়িটা ভেতরে জীবন্ত আর বাহিরে মৃত। একটা বাড়ি এমনি এমনি এতো ফিটফাট থাকতে পারে না। আমি এ বাড়িটার স্টোরি এবং মিস্ট্রি দুটোই জানতে চাই। বেশ অন্যরকম একটা ব্যাপার মনে হচ্ছে। তাই সবটা না জেনে আমি কোথাও যাবো না। তোরা গেলে চলে যা।
—কেউ বাড়িটা এমনি এমনি তো সাজিয়ে রাখে নি, নিজের কোনো উদ্দেশ্য সফল করার জন্যই নিশ্চয়ই রেখেছে। এখন সে উদ্দেশ্য সৎ নাকি অসৎ তা আমরা কি করে জানবো? এখানে থাকাটা তোর রিস্ক মনে হচ্ছে না?
—নো রিস্ক, নো গেইন।

কথাটা বলেই খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো ছায়ানিকা, তুলিও তার পিছু পিছু গেলো… যেতে যেতে ছায়ানিকাকে বললো,

—দোস্ত, তোর ঘরটায় কোনো সমস্যা হয়?
—তোর ভয় করলে আমার সঙ্গে থাকতে পারিস, ঘরটা সুন্দর আর কোনো সমস্যাও হয় না।
—না, না… আসলে রিদান বললো ওই ঘরটা নাকি এ বাড়ির মালকিন এর। কি যেনো নাম…
—মোহ?
—হ্যাঁ, তুই কি করে জানলি?
—অনুমান করলাম, আচ্ছা বাদ দে সেসব…। প্লেট বাটি সব ধুতে হবে তো, কলে পানি আছে কি না কে জানে! কলে পানি না থাকলে তো দিঘীর জলে থালাবাসন ধুতে হবে।

তুলির চেহারা নিমিষেই বদলে গেলো, সে চোখ মুখ কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

—আমি ওসব ধুতে পারবো না। আমার হাত খসখসা হয়ে যাবে…।

কথাটা বলে এক মিনিটও দাঁড়ালো না তুলি, ছায়ানিকা মুচকি হাসলো। হাঁড়ি পাতিল ধৌয়ার অভ্যাস তারও নেই, তবে প্রয়োজনে কোনো কাজ করতে তার আপত্তি নেই। রান্নাঘরের বাঁ পাশের কলটা ছাড়ার চেষ্টা করলো সে, পানি নেই… রান্না করার সময় অবশ্য পানি ছিলো। ছায়ানিকার মনে হলো পানির মটর কাছে কোথাও হবে, তাই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলে গেলো।

চারদিক অন্ধকারাবৃত, দূরে কোথাও একটা ভুতুড়ে শব্দ হচ্ছে… অর্ধ পূর্ণিমার চাঁদের আলো আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে ছায়ানিকার অন্তর মোহাবিষ্ট। এতো সুন্দর রাত সে কখনো দেখে নি, মটর ছাড়ার কথা সে বেমালুম ভুলে গেলো। ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়ালো তারপর আস্তে আস্তে রেলিং বেয়ে দাঁড়ালো…।

ছায়ানিকার দু’হাত দুদিকে প্রসারিত, ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত হাসি, সে যেনো ঘোরের মাঝে আছে। হঠাৎ হাতে টান পড়তেই নিজেকে কারও বক্ষবন্ধনে আবিষ্কার করলো ছায়ানিকা। কিছুক্ষণ আগের ঘোরটা কাটতে সময় লাগলো তার, নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে একপলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলো ছায়ানিকা। মানুষটাকে আজকাল বড্ড বেশি দুর্বোধ্য মনে হয় তার, আজকাল তার চোখের ভাষাও বোধগম্য হয় না। সবসময় কেমন করে যেনো তাকায়, বিশেষ করে এ বাড়িতে আসার পর থেকে তো তার ব্যবহারের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। এই যেমন এখনকার চাহনী, এ চাহনী কোনো সাধারন চাহনী তো হতেই পারে না… এ চাহনী মাদকতাপূর্ণ, এদিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকলে শ্বাস আটকে আসে, মন কেমন করার অসুখ হয়।

টর্চ হাতে ছাদে এসে রিদান আর ছায়ানিকাকে মুর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো রাকিব আর রায়ান। তারা ভেবেছিলো বন্ধুদের লুকিয়ে সিগারেট খাবে কিন্তু তার সুযোগ হলো না বলে রায়ান বিরক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে বললো,

—সালার তোদের সঙ্গে কোথাও গিয়ে কোনো শান্তি নেই। একটু প্রাইভেসিও পাওয়া যায় না।

রাকিব চাইছিলো না তাদের সিগারেট এর ব্যাপারটা বন্ধুরা জানুক তাই পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাবার আগেই রায়ানকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

—তোদের কখন থেকে তুলি খুঁজছে আর তোরা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কি দরকার এতো রাতে ছাদে তোদের?
—কলে পানি নেই, এঁটো প্লেটগুলো ধুতে হতো। মটরের সুইচ কোথায় তা খুঁজতে এসেছিলাম। পরে আমাকে একা আসতে দেখে রিদানও সঙ্গে এলো।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা সুকৌশলে বন্ধুদের থেকে লুকিয়ে গেলো ছায়ানিকা। রিদান কিছু বললো না, চুপচাপ ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে যেতে যেতে একবার থামলো, ছাদের দরজার কাছের একটা সুইচ অন করে হনহন করে নিচে নেমে গেলো। রিদানের হঠাৎ এরূপ ব্যবহারে অবাক হলো রায়ান এবং রাকিব দুজনেই। যদিও ছায়ানিকার চোখে মুখে ছিলো রহস্যময় হাসির ঝলক… যা বোঝার ক্ষমতা সামনের মানুষগুলোর নেই বললেই চলে।

—এটা আপনার বাড়ি? দারুন কিন্তু।
—আপনার নামটা তো এখনো জানা হলো না মিস…
—ছায়ানিকা, মি. বিজয়।
—দয়া করে আমার সঙ্গে ফরমালিটি করবেন না… আপনি আমাকে জয় ডাকুন। বিজয় শুনলে কেমন পর পর লাগে, জয় ডাকুন না…
—আপনার আসল পরিচয় হলো আপনি বিজয়, জয় ডাকলেই তো আপনি জয় হয়ে যাবেন না। আমি আপনাকে বিজয়ই ডাকবো।
—চা না কফি?
—আপনি কোনটা বানাতে পারেন?
—একটাও না।
—তাহলে বলুন রান্নাঘর কোনদিকে, আমি বানাচ্ছি।
—ছায়া সুন্দরীর হাতে তো আমি বিষপান করতেও রাজি, চা পাওয়া তো আমার সৌভাগ্য!

মুচকি হাসলো ছায়ানিকা, সে হাসি তাচ্ছিল্যের নাকি রহস্যের বোঝার উপক্রম নেই। ঠিক সকাল দশটায় মোহদিঘীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো বিজয়, তার বাইকে করেই এ বাড়িতে এসেছে ওরা। বাইকের একটা সুবিধা আছে, ত্রিশ মিনিটের পথ পনেরো মিনিটে পাড়ি দেয়া যায় খুব সহজে।

ছায়ানিকা চা বানাচ্ছে আর সেদিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিজয়। তার ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি, দূর থেকে দেখে যে কেউ নিঃসংকোচে তাকে রূপবান পুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারবে। দূর থেকে একজোড়া চোখ তাদের এ বাড়িতে প্রবেশের পর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে আর বারংবার কপাল কুঁচকে ফেলছে।

বিজয়ের ফোনটা বেজে উঠলো, ছায়ানিকাকে চা ছাকতে বলে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ফোনে কথা বলার সময় আড়চোখে বারবার ছায়ানিকাকে দেখছিলো বিজয়, হঠাৎ বিকট একটা শব্দ তার কানে লাগলো। কল কেটে দৌঁড়ে রান্নাঘরে গেলো বিজয়, ছায়ানিকা পাথরের মুর্তির মতো স্থির দৃষ্টিতে রান্নাঘরের জানলার থাই গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরন করে সেদিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো বিজয়, এ চিহ্ন তার চেনা।

কেউ জানলার থাই গ্লাসে গুলি করেছে, বুলেট লেগে গ্লাস ফুটো হয়ে গেছে। কিন্তু গ্লাসে কেউ কেনো গুলি ছুঁড়বে! আর রান্নাঘরে তো একা ছায়ানিকা ছিলো, সে’ও এ বাড়িতে আজই প্রথম এলো। তাকেই বা কেউ কেনো মারতে চাইবে! সে মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না বিজয়। পরমুহূর্তে তার মনে হয়, এসময় এসব না ভেবে ছায়ানিকাকে সামলানো প্রয়োজন। মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়েছে…

স্তম্বিত ছায়ানিকার কাঁধে হাত রাখতেই সে কেঁপে উঠলো, তারপর গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

—আপনার বাড়িতে অতিথি আসলে বুঝি গুলিবর্ষণ করে বরণ করা হয়? আসার আগে বলেন নি তো!
—আপনি ঠিক আছেন? আসলে কিভাবে কি হলো বুঝতে পারছি না। আপনি বসার ঘরে আসুন, বসবেন।
—আমি বসবো না, বাড়ি যাবো। আপনি দিয়ে আসবেন?
—সবে তো মাত্র এগারোটা বাজে ছায়া।
—বললাম তো বাড়ি যাবো, আর শুনুন, ছায়ানিকাকে ভয় দেখানো এতো সোজা না।

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না ছায়ানিকা, দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বসার ঘর পেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। তাকে অনুসরণ করে বিজয়ও বের হয়ে গেলো। তাদের যাবার পথে একজোড়া চোখ স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলো, “আজকের ঘটনাটা সাবধান বার্তা ছিলো মেয়ে, বিজয়ের আশেপাশে থাকলে পড়বর্তী বুলেটটা গ্লাসে নয় বরং সরাসরি তোমার খুলিতে লাগবে। মরবে, সব মরবে, বিজয়ের পাশে যে আসবে সে’ই মরবে”!

১০

মায়াজাল এর সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই রিদানের অগ্নিমুর্তির সম্মুখীন হলো ছায়ানিকা। রিদান রেগে গেলে তার মাথার দু’পাশের সিরাগুলো ফুলে যায়, চোখগুলো রক্তবর্ণ ধারন করে। কেমন ভয়ঙ্কর দেখায় তাকে, যদিও ছায়ানিকা তাকে কখনোই ভয় পায় না। এগিয়ে গিয়ে রিদানের চোখে চোখ রাখে ছায়ানিকা, সহজ ভাবে প্রশ্ন করে,

—সকাল সকাল রেগে আছিস কেনো রিদান?
—ছেলেটা কে ছিলো, যার বাইকে চড়ে তুই বাড়ি ফিরলি? আমি তো জানতাম তুই কেবল আমার বাইকে চড়িস, এতো উন্নতি কবে হলো?

মুচকি হাসলো ছায়ানিকা, তার বন্ধুদের মধ্যে রাগ, হিংসা, আবেগ এসব অন্যদের থেকে তুলনামূলক কম। নেই বললেও ভুল হবে না। অথচ এ বাড়িটায় আসার পর থেকে তার মনে হচ্ছে তার বন্ধুরা বদলে যাচ্ছে, যদিও অন্যদের কোনো প্রকার পরিবর্তন তাকে প্রভাবিত করে না তবে নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর এই পরিবর্তন তাকে ভীষণ আনন্দ দিচ্ছে। যেমন এ মুহূর্তে রিদানের ঈর্ষান্বিত রাগী চেহারা দেখে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার পাশাপাশি আলতো করে রিদানের গালদুটোও টেনে দিতে মন চাইছে। মনের ইচ্ছে মনের মাঝে দমিয়ে রাখার মতো মেয়ে ছায়ানিকা নয়, রিদানকে চমকে দিয়ে সে সত্যি সত্যিই তার গালদুটো টেনে দিলো তারপর খিলখিল শব্দে হাসতে হাসতে নিজের থাকার ঘরটার দিকে একছুটে চলে গেলো। রিদান হতবম্বের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছায়ানিকার চাঞ্চল্যতা উপভোগ করলো আর নিজের অজান্তেই হেসে দিলো।

দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো তুলি, রিদানের রাগ পড়ে গেছে দেখে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখলো। তুলিকে দেখে রিদান মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,

—কি রে শুচি বায়ু রোগী, কি খবর তোর?
—পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ, তোমাদের মতো শরীরে হাজার টন ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে ঘুরি না বুঝেছো? তা কাহিনী কি? ট্রিট দেয়ার ভয়ে মনের কথা মনে চেপে রেখেছিস নাকি?
—কিসের কাহিনী!
—বুঝো না ময়না? ছায়া অন্যের বাইকে চড়লে তোমার এতো জ্বলে কেনো? গাড়ি কতোদূর মামা?
—বাজে বকা বন্ধ কর। কার না কার সঙ্গে ঘুরছে, কোনো বিপদ-আপদ হলে কার ঘাড়ে দোষ পড়বে হ্যাঁ?
—শোন রিদান, ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষকে মনের কথা সময় থাকতে বলে দে। নতুবা দেখা যাবে তোর ভালোবাসাও আছে, ভালোবাসার মানুষটাও আছে তবে তোর পাশে নয়, অন্য কারো পাশে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এতো বছরে ভালোবাসা, হিংসা এ শব্দগুলো আসে নি বলে ভবিষ্যতেও যে আসবে না তা তো না। ছায়াকে ভালোবাসলে বলে দে, নতুবা পরে না পস্তাতে হয়।

তুলির কথার প্রত্যুত্তর করে না রিদান, তার পরিবর্তীত ব্যবহার নিয়ে সে নিজেই দোটানায় ভুগছে। ছায়ানিকা ভালো ছাত্রী, ক্লাসের কতো ছেলেকেই তো সে পড়া বুঝিয়ে দিয়েছে, কই তখন তো তার হিংসে বা রাগ কোনোটাই হয় নি। তবে আজ হঠাৎ এতো রাগ হলো কেনো! গতকাল রাতে ছায়ানিকাকে ছাদের রেলিং এ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও তার রাগ হয়েছে সঙ্গে ভয়ও, ছায়ানিকাকে হারিয়ে ফেলার ভয়! মূলত এ ভয়ের সৃষ্টি এ বাড়িতে আসার পরদিন সকালের বিধস্ত ছায়ানিকাকে দেখার পর থেকে! কিন্তু এই রাগ, ঈর্ষা, ভয় এ অনুভূতিগুলোকে ভালোবাসার নাম দিতে রিদান নারাজ। জন্মের সময় যার মা মারা যায় সে যতো আভিজাত্যের মাঝেই বড় হোক না কেনো তার দ্বারা ভালোবাসার ভাষা বোঝা সম্ভব নয়। রিদান ভালোবাসার ভাষা বোঝে না, সে বোঝে বন্ধুত্বের ভাষা, দায়িত্ববোধের ভাষা, সহানুভূতির ভাষা… অথচ সে জানে না প্রতিটি সম্পর্কের ভাষা একটিই আর তা হলো ভালোবাসা!

চলবে…

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ৫

১১

চিত হয়ে শুয়ে মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটাকে দেখছে ছায়ানিকা, আর একহাতে বিছানের পাশে রাখা টেবিলের উপরের ফুলদানীটা ঘুরাচ্ছে। তার মনে একটাই ভাবনা বিজয়ের বাড়িতে যাবার পর কে তার উপর গুলি ছুড়লো, আর কেনোই বা ছুড়লো! আর যদি তাকে উদ্দেশ্য করে গুলি করেই থাকে তবে তার গায়ে লাগলো না কেনো? সে রাতের মেয়েটাকেও আর দেখা যায় নি, গেলো কোথায় মেয়েটা! মাথার মাঝে হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে কিন্তু উত্তরের খাতা শূণ্য। হঠাৎ ছায়ানিকা খেয়াল করলো তার ঘরে থেমে থেমে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে। আওয়াজটা কিসের তা প্রথম প্রথম না ধরতে পারলেও পরে খেয়াল করলো আওয়াজটা তার ফুলদানী ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গেই হচ্ছে। আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে তা জানার জন্য এদিক সেদিক তাকাতেই খেয়াল করলো ঘরের বড় আয়নাটা সরে যাচ্ছে। অনেকটা থাই গ্লাসের দরজাগুলোর মতো স্লাইড করছে ফুলদানীর নড়াচড়ার সঙ্গে আয়নাটা। ছায়ানিকার বরাবরই কৌতুহল বেশি, তাই উঠে আয়নার ভেতরের অন্ধকার জায়গাটায় গেলো, কিছুই স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না তা ঘরে এসে টর্চ হাতে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলো। টর্চটা জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা ঝলমল করে উঠলে। কথায় আছে, আয়না মানুষের প্রতিবিম্ব দেখায় কিন্তু আয়নার পেছনেও যে রহস্য লুকিয়ে রাখা যায় তা ছায়ানিকার ভাবনায়ও ছিলো না!

আয়নার পেছনের ঘরটা অদ্ভুত সুন্দর, পুরো ঘরের দেয়াল আয়না দিয়ে বাঁধানো… আয়নাঘর বললে ভুল বলা হবে না। আয়নাঘরটা মেয়েলি জামাকাপড় আর গহনায় পরিপূর্ণ। এসব জিনিসে ছায়ানিকার বরাবরই আগ্রহ কম, তাই তার মধ্যকার কৌতুহলও কিছুটা দমে গেলো। ছায়ানিকা যখন আয়নাঘর থেকে বের হবে ঠিক তখন তার চোখ গেলো ঘরের কোনায় পড়ে থাকা সিন্দুকের মতো দেখতে বাক্সটার দিকে। এ বাড়ির প্রতিটা জিনিসে আভিজাত্য ও রুচিশীলতার ছাপ পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে বলা চলে, এ বাড়ির ভেতরটা কারও আদুরে হাতে গড়া। সিন্দুকটিও তার ব্যতিক্রম নয়। রূপোলী রঙের উপর রঙ বেরঙের মারবেল পাথর দিয়ে কারুকাজ করা। ছায়ানিকা কৌতুহলবশত এগিয়ে গিয়ে বাক্সটা খুললো… সিন্দুকের ভেতর তেমন কিছু নেই বললেই চলে, কেবল এক ডজন ঝর্না কলম আর লাল কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা। লাল কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি হাতে তুলে খুলছিলো এমন সময় ঘরের বাতিগুলো একবার জ্বলছিলো তো আরেকবার বন্ধ হচ্ছিলো। তারপরেই বসার ঘরের গ্রামোফোনটায় গানের সুর বেজে উঠলো। ছায়ানিকা হাতের জিনিসটা রেখে নিজের ঘরে ফিরে এসে আয়নাঘরের দরজা বন্ধ করে নিচে গেলো। উপর থেকে দেখলো তার বন্ধুরা সেদিনের মেয়েটির সামনে বশীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে… ছায়ানিকা পেছন থেকে গিয়ে মেয়েটির দু’হাত একহাতে চেপে ধরে অন্যহাতে ফোনের টর্চ জ্বেলে বন্ধুদের চোখে ফেললো। চোখে আলো পড়তেই সবার ঘোর কাটলো, ছায়ানিকা চিৎকার করে বললো,

—তোদের সবার ফোনের লাইট জ্বালা…

একে একে প্রত্যেকের ফোনের লাইট জ্বলে উঠলো, সবার সামনে মেয়েটিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছায়ানিকা। তুলি রাকিব আর রায়ানের মাঝে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো,

—নিজে এতো সুন্দর হবার পরও এ মেয়ের সামনে নিজেকে ফিকে মনে হচ্ছে। কি সুন্দর রে ভাই!

রাকিব তার গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,

—যা বলেছিস, মেয়েটা কিন্তু হেব্বি সুন্দরী।

রায়ান মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

—এমন মেয়েকে নিজের পাশে পেলে দিন দুনিয়া ভুলে যেতাম। সারাদিন এর সঙ্গে লেপ্টে থাকতাম…
—চুপ কর, এতো সখ হলে বিয়ে কর না।

তাচ্ছিল্যের সুরে বললো তুলি। রিদান আর তুর্জ অবাক হয়ে একত্রেই জিজ্ঞেস করলো,

—এটা কে! এমন মাঝরাতে সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেনো?

ছায়ানিকা ওদের কথার জবাব না দিয়েই তুলিকে বললো,

—তুলি, একটা চেয়ার আর দড়ি আনতো। দড়ি আমার ব্যাগে আছে, তোর একা যেতে ভয় করলে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যা… কিন্তু জলদি।

তুলির পিছু পিছু রাকিবও গেলো, প্রথমে ছায়ানিকার ঘরে গিয়ে দড়িটা নিয়ে তারপর ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার নিয়ে বসার ঘরে আসে তারা। মেয়েটাকে চেয়ারে বসিয়ে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে ছায়ানিকা। তারপর মিশুর সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

—নাম কি তোমার?

মিশু নিঃসংকোচে উত্তর দেয়,

—মিশু।
—এখানে কেনো এসেছো?
—এ বাড়ির মানুষকে ভয় দেখাতে।
—এ বাড়ির মানুষকে ভয় দেখিয়ে তোমার লাভ?
—এ বাড়ির মালিক বাড়ির সুরক্ষার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন আর তাই আমি মানুষকে ভয় দেখিয়ে এ বাড়িকে তাদের কুনজর থেকে রক্ষা করি। এতে কোনো অন্যায় নেই নিশ্চয়ই…

শব্দ করে হাসে ছায়ানিকা, রিদানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে’ও হাসছে। হাসিটা যেন ছোঁয়াছে, এক এক করে ঘরে উপস্থিত সকলের মাঝেই হাসি দমকা ছড়িয়ে পড়লো। একদিকে গ্রামোফোনে বাজছে করুন সুর অন্যদিকে সারা বাড়ির আলো একবার নিভছে তো আরেকবার জ্বলছে… তারমধ্যে সকলের হাসির শব্দে মিশুর ভয় করছে, এ মানুষগুলো তার সঙ্গে খারাপ কিছু করে দেবে না তো! অবশ্য সে যে রাস্তায় পা বাড়িয়েছে সে রাস্তায় মৃত্যু সর্বদা দরজায় কড়া নাড়তে থাকে, যখন তখন মৃত্যু তাকে বরণ করে নিতে পারে। চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো মিশুর… ছায়ানিকা হাসি থামিয়ে মিশুর সামনে কিছুটা ঝুঁকে বলে,

—এ বাড়িটা বর্তমানে কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়, আমরা খবর না নিয়ে আসি নি। আর একটা কথা, আমাদের মিথ্যে বলেছো তাতে কোনো সমস্যা নেই কারন সত্যিটা তোমাকে বলতেই হবে… কাল সকালে পুলিশ আসবে, আর তারপর তারা বুঝবে তোমার মুখ দিয়ে সত্যটা কি করে বলাতে হয়… আর তো মাত্র একটা রাত, তারপর এ বাড়ি আর তোমার রহস্য এ দুই এর মাঝে কোনো পর্দা থাকবে না।

তুলি এগিয়ে এসে ছায়ানিকার পাশে দাঁড়ায় তারপর ফিসফিস করে বলে,

—আলোটা কি সারারাত এমন জ্বলবে আর নিভবে? মানে, কেমন ভুতুড়ে লাগছে! আর ওইটা কি যেনো বলে… ওটার প্যানপ্যানানিও কি সারারাত চলবে?

রাকিব এগিয়ে এসে তুলির মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

—ওটাকে প্যানপ্যানানি না, সুর বলে…
—এমন সুর শুনলে মরা মানুষও ভয়ে উঠে দৌঁড় দিবে। আমার ভীষণ ভয় করছে, চল না বাড়ি ফিরে যাই…
—তুলি মাই ডিয়ার, এই মেয়েটাকে কাল পুলিশ নিয়ে যাক তারপর আমরা যার যার বাড়ি চলে যাবো।

রিদানের কথায়ও আশ্বস্ত হয় না তুলি, ন্যাকা কান্না শুরু করে… রিদান বিরক্তি নিয়ে ছায়ানিকার দিকে তাকায়, ছায়ানিকা চোখের ইশারায় তাকে শান্ত থাকতে বলে। তারপর গ্রামোফোনটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার পেছন দিকে থাকা তারটা অনুসরণ করে এগিয়ে যায়… তুর্জ টর্চ ধরে আছে আর ছায়ানিকা তারটা অনুসরন করে এগিয়ে যাচ্ছে, এক পর্যায়ে তারা ছাদের কোনায় রাখা সুইচ বোর্ডটার কাছে পৌঁছে গেলো। ছায়ানিকা একটা সুইচ অফ করতেই গ্রামোফোনের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো। তুর্জ মুচকি হেসে বললো,

—তোর না ডিটেক্টিভ হওয়া উচিত ছিলো, কি করে বুঝলি এটা এভাবে বন্ধ হবে?
—এ তারটা আমি যেদিন এসেছি তার পরের দিন রান্নাঘরে যাবার সময়ই দেখেছি… তখন বলে দিলে হয়তো মেয়েটাকে ধরতে পারতাম না তাই বলি নি। আর লাইট অন অফ কেনো হচ্ছে জানিস?
—কেনো?
—এই দেখ, পুরো বাড়ির যে মেইন ইলেক্ট্রিক লাইন সেই লাইনটা লুজ করা… তাই একবার কানেকশন আসছে তো আরেকবার চলে যাচ্ছে।
—ব্রিলিয়ান্ট! তবে ছায়া, যতো যা’ই বলিস, মেয়েটা কিন্তু সত্যিই দারুন দেখতে।

তুর্জর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ছায়ানিকা, গালের নিচে একটা হাত রেখে গম্ভীরভাবে বলে,

—আচ্ছা! তাহলে ও কে পুলিশে দিয়ে লাভ নেই, বরং তোর সম্বন্ধ করি মেয়েটার সঙ্গে কেমন? ওর সঙ্গে তোর বিয়ে করিয়ে এ বাড়ির স্থায়ি বাসিন্দা বানিয়ে দেই তোকে? তখন দু’জনে মিলে মানুষকে ভয় দেখাবি… বাড়ির নাম মায়াজাল থেকে তুশু করে দেই? তুর্জ প্লাস মিশু, ইজ ইক্যুয়াল টু তুশু… ওয়াও, সো কিউট!

তুর্জ ছায়ানিকার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, তার ভীষণ রাগ হচ্ছে এ মুহূর্তে… নিজের রাগ দমিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,

—তোকে তো সামান্য কথাও বলা যায় না, সব কথায় এমন গরম পাতিলের মতো চ্যাত করে উঠিস কেনো? আর কি সব মানে খুঁজে বের করিস! তোর জন্য রিদানই পারফেক্ট!
— রিদান সম্বন্ধে ভালো বা মন্দ কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।

১২

ছাদে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে ওরা ছয় বন্ধু, মিশুকে বসার ঘরে বেঁধে রাখা হয়েছে… রিদান বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে ছায়ানিকার কাঁধে শুয়ে আবেগী সুরে বলে,

—হায়, আমার পাগল মনটা প্রেমে পড়লো তাও কি না এক ভূতনীর! এ মেয়ে ক্রিমিনাল না হলে আমি নিশ্চিত তাকে প্রথম দেখায় বিয়ের প্রস্তাব দিতাম। আহ, কি সুন্দর চোখ দু’টো… যেনো সুইমিংপুল। সারাদিন সাঁতরাবো কিন্তু ডুববো না!

রিদানকে নিজের কাঁধের থেকে ধাক্কা দিয়ে সরায় ছায়ানিকা, তারপর কৌতুকের সুরে বলে,

—আসছেন আমার মর্ডান কবি রে… চোখ নাকি সুইমিংপুল! ওই বলে না, মোল্লার দৌঁড় মসজিদ পর্যন্ত তোরও সেই দশা। এবার বাড়ি ফিরে একটা পোস্টার লাগাবি নিজের ঘরে, বড় বড় করে লিখবি, “রিদানের দৌঁড় সুইমিংপুল পর্যন্ত”!
—আচ্ছা, আমি মানুষের প্রশংসা করতে পারি না! তো তুই বল, কি করে মেয়েদের প্রশংসা করতে হয়…

ছায়ানিকা বসা থেকে উঠে ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে,

—যেদিন কাউকে ভালোবাসবি সেদিন তার চোখে তুই তোর শান্তির ঠিকানা খুঁজে পাবি। তার দৃষ্টির গভীরে তুই তোর জন্য একটুখানি চিন্তা খুঁজে পাবি, তার হাসির পিছনে লুকিয়া থাকা দুঃখটা খুঁজে পাবি। তার কাছ থেকে তোর কোনো কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা থাকবে না বরং সারাজীবন এক পাক্ষিক প্রদানেও তুই ক্লান্ত হবি না। তার প্রতি কখনো বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হবে না। ভালোবাসা কখনো শারিরীক গঠন বা রূপ দেখে হয় না, ভালোবাসা হয় মনের সঙ্গে মনের। একবার মনের মিল হয়ে গেলে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটাকেও বিশ্বসুন্দরী মনে হয়। নিঃসন্দেহে বসার ঘরে উপস্থিত মেয়েটা অপরূপ সুন্দরী, তাকে দেখে তোদের প্রত্যেকের মনেই কোনো না কোনো বাসনা জেগেছে তবে সেটা সাময়িক। সাময়িক চাহিদা বা সুখকে প্রাধান্য না দিয়ে যদি স্থায়ি সুখের জন্য অপেক্ষা করা হয় তবে নিশ্চিত আশার থেকেও বেশি কিছু পাওয়া যায়। আর হ্যাঁ, কাউকে ভালোবাসলে তার প্রশংসা করার জন্য অগ্রীম পাঠ পড়ে প্রস্তুতি নিতে হয় না… ভালোবাসা তার নিজস্ব ভাষা স্থান, কাল, পাত্রভেদে নিজেই ঠিক করে নেয়! আমাদের কাজ কেবল উপলব্ধি করা, একবার উপলব্ধি করে ফেললে ভালোবাসা নিজের রাস্তা নিজেই বানিয়ে নেয়…

রায়ান ছায়ানিকার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তা কেউ লক্ষ্য না করলেও রিদানের চোখ এড়ালো না। রিদান ইচ্ছে করে ছায়ানিকাকে আড়াল করে রায়ানের সামনে বসলো তারপর মুচকি হেসে বললো,

—এসব ভালোবাসা রূপকথার বইয়ে পাবি…

তুলি বসে বসে বাদাম চিবুচ্ছে, রিদানের কথায় সে বলে,

—কেন রে? বাস্তবেও হয়। আমার তো একটাই উইশ, যে আমাকে ভালোবাসবে সে সারাদিন আমার সুনাম করবে আর আমার আগে পিছে ঘুরঘুর করবে… এই তুর্জ, ভালোবাসায় তোর উইশ কি রে?
—তেমন কিছু না রে, আমি সারাজীবন আমার ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখতে চাই। আমি কিছুটা চাপা স্বভাবের জানিস তো, তাই তার থেকে এটুকুই চাইবো যেনো সর্বদা আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করে। বাকিরা চুপ কেনো? তোরাও বল…

রায়ান গালের নিচে হাত দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,

— কি সব ভালোবাসা ভালোবাসা লাগাই রাখছিস! ভালোবাসা মানে কিছু নেই, বিছানায় যার পারফর্মেন্স যতো ভালো তার জীবন ততো গুছানো। গিয়ে দেখ বেশির ভাগ পারিবারিক কলহের কারন তো এসবই… এজন্যই তো শহরের অলিতে গলিতে, বাসে, টেম্পুকে কলিকাতা হারবালের পোস্টার দেখা যায়।

রাকিব হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, বাকিরাও হাসছে… তুলি হাসতে হাসতেই বলে,

—কি রে রাকিব, তুইও কি তোর ভাইয়ের মতো ভালোবাসায় অবিশ্বাসী? না কি এ দিক দিয়ে তোর লজিক ভিন্ন?
—কিছু ভালোবাসা সুপ্ত থাকে, আমি ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করতে পারি তবে স্বীকার করার মতো সৎ সাহস দেখাতে পারি না। আমার ভাগ্যে আমার ভালোবাসার মানুষ নেই আর কখনো আসবেও না… আমার অতীতের কৃতকর্ম আমার কাছ থেকে ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্যের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এ জন্মে আর আমার ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া হলো না…

কথা শেষ হতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় রাকিব, তারপর হনহন করে নিচে নেমে যায়। উপস্থিত সবাই কিছু সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় তারপর এক সময় রায়ানের দিকে তাকিয়ে রিদান জিজ্ঞেস করে,

—রাকিবের হঠাৎ কি হলো? ওর জীবনে কি কেউ আছে? কোনো সমস্যা থাকলে বলতে পারিস, হয়তো আলোচনা করে সমাধানে আসা যাবে…
—কিছু সমস্যার কোনো সমাধান হয় না রিদান, তোরা থাক আমি নিচে গেলাম। বড্ড ঘুম পাচ্ছে…

রাকিব চলে যাবার পর তুলি আর তুর্জও যাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়লে সবাই একত্রে নেমে যায়। ছায়ানিকা তার ঘরে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে পিছু ডাকে রিদান, মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,

—ভালোবাসার উপর বড়সড় লেকচার দেবার পর নিজে কেমন ভালোবাসার মানুষ চান তা না বলেই ঘুমাতে যাচ্ছেন চিকা ম্যাডাম…
—উফ… কতোবার তোর সঙ্গে চিকা বলার জন্য ঝগড়া করবো বলতে পারিস? যাই হোক, এখন এসব বাদ দিয়ে ঘুমাতে যা।
—না, তুই আগে বলবি তারপর আমি যাবো। নতু্বা তোর ঘরে তোর সঙ্গেই থেকে যাবো। ভেবে দেখ, শুনশান বাড়ি, একটা কুমার ছেলের সঙ্গে একা তুই… সামলাতে পারবি তো নিজেকে, ইস আমার তো ভয় করছে…
—হয়েছে? আমি এমন একজনকে নিজের জীবনে চাই যে আমাকে প্রতিমুহূর্তে ভালোবাসি বলবে না তবে তার কাজে প্রতিনিয়ত নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে যাবে। আমি না শুনেই তার ভালোবাসা উপলব্ধি করবো, নিজের অনুভূতির মাঝে…

রিদান মাছি তাড়ানোর মতো করে হাই তুলে বলে,

—বোরিং, দুই হাজার একুশে থেকে উনিশশো কটকটি সালের চিন্তা! ইউ আর ইম্পসিবল…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here