প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ৬
ছায়ানিকা রাগীস্বরে বলে,
-“হোক উনিশশো কটকটি সালের চিন্তা, তোদের একুশ সালের চিন্তার চেয়ে অনেক ভালো বুঝলি?”
রিদান মাথা নেড়ে বলে,
-“বুঝলাম।”
ছায়ানিকা আর কথা বাড়ায় না, দরজা আটকে শুতে যায়। মিশুকে নিতে কাল পুলিশ আসবে তাই সকাল সকাল উঠতে হবে…
১৩
-“স্যার, মিশুকে কেউ একজন মেরে মোহ দিঘীর কাছে ফেলে রেখে গেছে। সম্ভবত খুন করার আগে ধর্ষন করা হয়েছিলো… ও বাড়ির ছেলেগুলোর কেউ খুন করে নি তো?”
অন্ধকারে বসে থাকা লোকটার ছায়া দেখা যাচ্ছে, লোকটা গম্ভীরস্বরে বললো,
-“কেউ জানার আগে লাশটা গুম করে ফেলো জিহান, এসব কাজ তো নতুন করছো না। কথাটা আমার কান অবধি কেনো আসলো? তুমি দুর্বল হয়ে পড়ছো না তো জিহান? ভুলে যেও না, এ পথে আবেগ ভালোবাসার কোনো দাম নেই।”
জিহানের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়, মিশুকে সে এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভালোবেসেছিলো। স্বাভাবিক জীবনে থাকলে এতোক্ষণে হয়তো মিশুকে ন্যায় পাইয়ে দেবার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করতো অথচ আজ সে নিজেই মিশুর লাশকে গুম করছে… এ বাঁচাকেও কি বাঁচা বলে!
মিশুর লাশটা একটা বস্তায় ভরে গাড়ীর ডিকিতে করে নিয়ে যাচ্ছে জিহান, এর আগেও সে অনেকবার অনেক মানুষের লাশ সরিয়েছে তবে এ প্রথমবার তার মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর জঘন্য মানুষদের একজন যে অন্যের কাছের মানুষের লাশটাও তাদের কাছে পৌঁছতে দেয় না। তার পাপের শাস্তিস্বরূপ হয়তো বিধাতা আজ মিশুর লাশটা তার মাধ্যমেই সরানোর ব্যবস্থা করেছে… “পাপ বাপকেও ছাড়ে না” কথাটার সত্যতা আজ নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছে জিহান।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরে মিশুকে না পেয়ে বেশ অবাক হয় ছায়ানিকা আর রিদান। তুর্জ, তুলি, রাকিব, রায়ান আসার পর কেউই মিশুর ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারলো না। ছায়ানিকা গম্ভীরস্বরে বললো,
-“আমার মনে হয় মেয়েটার সঙ্গী আমরা ঘুমানোর পর তাকে নিয়ে গেছে।”
রিদান রাগীস্বরে বললো,
-“আমরা কি করলাম তাহলে? আসামী ধরে তাকে খোলা মাঠে রেখে ভস ভস করে ঘুমালাম। আমাদের দোষে মেয়েটা পালিয়ে গেলো…”
তুলি হাই তুলে বললো,
-“ঘুমাবো না তো কি করবো? এই ভুতনীর সঙ্গে বসে বসে পিরিতের আলাপ করবো? তাছাড়া যে আগুনরূপী, ছেলে কেনো মেয়েদের নিয়তই খারাপ হতে বেশি সময় লাগবে না।”
তুর্জ বিরক্ত হয়ে বললো,
-“বাজে বকিস না তো তুলি, সুন্দর হলেই গায়ে পড়তে হবে? মানুষের সৌন্দর্য্য তার মনে, শরীরে না। বাজে কথা না বলে বরং আশেপাশে খুঁজি, যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়…”
রায়ান হাত তুলে মাছি মারার মতো করে বললো,
-“সে কি তোর জন্য ক্লু ছেড়ে যাবে? চুপচাপ বসে ভাব এরপর কি করবি… খুঁজতে যাওয়া মানে বোকামি।”
রাকিবকে কিছুই বলতে দেখা গেলো না, তাকে অন্যমনষ্ক লাগছে। রায়ানের কথায় রাকিব বেশ অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলো, ব্যাপারটা কারো চোখে না পড়লেও ছায়ানিকার দৃষ্টি এড়ালো না। ফোনের মধ্যে বিজয়ের নাম্বারটা সার্চ করতে করতে বাড়ির বাইরে চলে গেলো ছায়ানিকা।
-“হ্যালো, ছায়া… কেমন আছো?”
-“একটা সাহায্য লাগবে, করতে পারবে?”
-“কি সাহায্য?”
-“আশেপাশের হাসপাতালে একটু খোঁজ নেবে, কোনো মেয়ে ট্রিটমেন্টের জন্য গেছে কি না… এই ধরো হাত বা পা কেটে যাবার জন্য সেলাই করতে। কাল রাত আর আজ সকালের মাঝে…”
বিজয় উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কিছু হয়েছে ছায়া?”
-“তেমন কিছু না, খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবে? উপকার হতো…”
-“আমি জানাচ্ছি।”
রিদান এসে ছায়ানিকার পেছনে দাঁড়িয়েছে অনেকক্ষণ, ছায়ানিকা ফোন রাখতেই জিজ্ঞেস করলো,
-“মেয়েটা ডাক্তারের কাছে যাবে এমনটা মনে হচ্ছে কেনো তোর?”
-“ঘুড়ি ওড়ানোর সময় অন্যের ঘুড়ি কাটার সুবিধার্থে সুতাতে গ্লু দিয়ে কাঁচের গুড়া লাগানো হয় জানিস তো সেটা?”
-“জানবো না কেনো!”
-“আমার ব্যাগে যে দড়িটা ছিলো ওটাতে কাচের গুড়া লাগানো ছিলো রিদান, খেয়াল করে দেখ, দড়িটা একটা ব্যাগে ছিলো। আর আমি স্কার্ফ দিয়ে ধরে বেঁধেছিলাম। মেয়েটার হাত এবং পা কেটেছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, আর ফাস্টএইড এর জন্য হলেও তার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। লজিক তো এটাই বলে…”
কথাটা বলে যেতে যেতে রিদানের আঙ্গুলের কাটাটা চোখে পড়ে ছায়ানিকার, রিদানকে অবাক করে দিয়ে ছায়ানিকা সে আঙ্গুলটা টেনে একটা চুমু খায়। রিদান এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলে ছায়ানিকা মুচকি হাসে, ছায়ানিকার হাসিটা রিদানের কাছে কেমন অদ্ভুত লাগে। সে ইতস্তত করে বলে,
-“রাতে খুদা লেগেছিলো, আপেল কাটতে গিয়ে আঙ্গুলটা একটু কেটে গেলো। আমার ব্যাগে সবসময় ফল আর ছুরি থাকে জানিস তো… সামান্য কাট, দ্রুত সেরে যাবে। চুমু দিচ্ছিস কেনো?”
ছায়ানিকা কিছু বলে না, সে গুনগুন করে গাইতে গাইতে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।
১৪
-“এতোটা হাত কেটে গেলো কি করে তোর? আর জানিস যখন হাত কেটে গেছে তখন মরিচ ধরলি কেনো?”
তুলির কথায় মুখটা ছোট হয়ে যায় তুর্জর, আমতা আমতা করে বলে,
-“রাতে কেমন একটো ঘোঙরানোর শব্দ শুনলাম, উঠার পর অন্ধকারে হোঁটচ খেয়ে পড়ে গেলাম। কাঁচের টুকরায় হাত কাটলো কিন্তু সকালে কাঁচের টুকরাগুলো পেলাম না। কেমন যেনো গা ছমছম করে বাড়িটায়।”
-“তা আর বলতে, আমার তো দম বন্ধ লাগে। কালকের মেয়েটার ঘটনার পর ভয়টা কমেছে তবে এখনো বাড়িটায় দম বন্ধ লাগে আমার। এই দেখ, গতকাল এখানে একটা ছুরি রেখেছিলাম। আজ নেই… একরাতে কোথায় গেলো বলতো, কাকে জিজ্ঞেস করবো, বাড়িতে তো আমরা কয়জনই…”
-“তুই রান্না কর, ছায়াটা কই দেখে আসি। তুই আর একা কতো করবি…”
তুর্জ বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো রায়ান, তার হাতে ব্যান্ডেজ দেখে তুলি বললো,
-“তোরা একজোটে সবাই হাত কাটলি কি করে বলতো? তোর হাতে কি হলো?”
-“তেমন কিছু না, পিচ্ছিল বাথরুমে পড়ে হাত ছিলে গেছে। তুই তো জানিস, আমার আবার অল্পতেই ভয়…”
-“হাসালি রায়ান, তোর এই মেয়দের মতো স্বভাবগুলো দেখলে হাসি পায়।”
-“ছেলেদের মতো স্বভাবগুলো দেখতে চাস নাকি? দেখবি? দেখতে চাইলে অবশ্য আমার আপত্তি নেই…”
কথা বলতে বলতে রায়ান তুলির খুব কাছে চলে এসেছিলো, হঠাৎ রায়ানকে নিজের এতোটা কাছে দেখে তুলি চিৎকার করে বললো,
-“সমস্যা কি তোর? মজা করবি দূর থেকে কর, গায়ে ঘেষছিস কেনো?”
তুলির চিৎকার শুনে রাকিব বসার ঘর থেকে উঠে এসেছিলো, রায়ানকে তুলির সঙ্গে দেখে রাকিবের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো। দাঁত কটমট করে রায়ানকে বললো,
-“তোর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে রায়ান, ঘরে চল।”
কথাটা বলেই রাকিব বেরিয়ে যায়, রায়ানও তার পিছুপিছু বেরিয়ে যায়। ঘরে গিয়ে রাকিবের অগ্নিমুর্তি দেখে রায়ান উপহাস করে বলে,
-“আমাকে তুলির পাশে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে তোর? তোকে আর মেধাকে এক বিছানায় দেখে আমারও কষ্ট হয়েছিলো রাকিব… কিন্তু সেদিন তুই কি বলেছিলি? মেধার মতো মেয়েরা সারাজীবনের না, এক রাতের সঙ্গী হবার যোগ্য। আমার ভালোবাসা এক রাতের সঙ্গী হবার যোগ্য হলে তোর ভালোবাসা সারাজীবনের সঙ্গী হবার যোগ্য হয় কি করে?”
রাকিব দেয়ালে জোরে ঘুষি মারে, রায়ানের কলার ধরে বলে,
-“তুলির দিকে তাকাস না রায়ান, ওর কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাই না। ওকে ছেড়ে দে…”
-“তুই যেমন মেধাকে ছাড়তে পারিস নি তেমনি আমিও তোর ভালোবাসাকে ছাড়তে পারবো না। একই চেহারার হওয়ার লাভটা যেমন তুই কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিয়েছিস তেমনি আমিও বুঝে নিতে জানি রাকিব। ভাবিস না, ভাই বলে তোকে ছেড়ে দিবো। তুলি যদি হয় তবে আমাদের দুজনের হবে, বেশি না একরাত, তারপর তোর তুলিকে তুই রাখিস… ”
-“ছিহ, রায়ান… তুলি আমাদের বন্ধু।”
-“মেয়ে বন্ধু, যাকে তুই ভালোবাসিস। রায়ান নিজেকে সংযত করতে জানে রাকিব, কেবল তোর মনে তুলির জন্য ভালোবাসা আছে বলেই আমি ওকে টার্গেট করেছি। নতুবা রায়ানের মেয়ের অভাব হয় না…”
রাকিব নিজের রাগ সংবরন করতে না পেরে দেয়ালে ঘুষি দিলো, তা দেখে রায়ান মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রাকিব পরপর কয়েকবার দেয়ালে লাথি মারলো, একসময় ব্যাথায় ছটফট করতে করতে পা ধরেই মেঝেতে বসে পড়লো। বিড়বিড় করে বললো, “পাপ বাবকেও ছাড়ে না…”
চলবে…