প্রণয়িনী,পর্ব:৭

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ৭

১৫
রাতে সাড়ে বারোটা কি একটা হবে, পানি নিতে এসে অন্ধকারে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে তুলি, চিৎকার করতে গিয়েও চিৎকার করতে পারছে না সে। ভয়ে তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না… পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই কেউ শক্ত করে তুলির চোখ বেঁধে দিলো। তুলির হাতে থাকা জগটা মেঝেতে পড়ে চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে গেলো। চোখের বাঁধা খোলার পর সামনে রায়ানকে দেখে বিস্ময়ে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিলো না তুলির। রাকিবকে পাশে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুলি চিৎকার করে বললো,

-“তুই দাঁড়িয়ে ওর এসব নোংড়া কর্মকান্ড দেখছিস রাকিব? ও না তোর ভাই, ওকে আটকাচ্ছিস না কেনো? আমার সঙ্গে ও এসব করার কথা ভাবে কি করে?”

তুলির হাত তখনো রায়ানের হাতে বন্দী, তুলি হাত ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে রায়ানের সামনে মিনতি করে তুলি বলে,

-“প্লিজ তুই আমার সঙ্গে কিছু করিস না রায়ান, রাকিব ওকে আটকা প্লিজ… আমি তো তোদের বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস করেছিলাম, আমার বিশ্বাস তোরা ভাঙতে পারিস না।”

রাকিব রায়ানের হাত থেকে তুলির হাত ছাড়িয়ে ওকে বিছানায় বসালো, ভয়ে তখনো কাঁপছে তুলি। পানির জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে তুলিকে খাইয়ে দিয়ে শান্তস্বরে বললো,

-“দেখ তুলি, আমি অতীতে একটা অন্যায় করেছিলাম। রায়ান আর আমার একই চেহারার হওয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ওর প্রেমিকা মেধার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়েছিলাম। যার কারনে মেধা পরবর্তীতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, আর শুধু তা’ই নয়, হুট করে মেধা গায়েব হয়ে যায়। অনেক খুঁজেও আর মেধাকে পাওয়া যায় নি… এরপর থেকেই রায়ান আমার কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে তাকে টার্গেট বানিয়ে নিজের ক্ষোভ মেটায় মেয়েটার উপর। আমার জীবনে যে কেউ নেই তার একমাত্র কারন রায়ান। গতরাতের মেয়েটার সৌন্দর্য্য আমাকে মুগ্ধ করেছিলো, আর তাই রায়ান মেয়েটাকে ধর্ষণ করে আর তারপর বাড়ির পিছে জঙ্গলে ফেলে আসে। মেয়েটা হয়তো জ্ঞান ফেরার পর কোথাও চলে গেছে… আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসি তুলি, আর সে কারনে রায়ানের নেক্সট টার্গেট তুই। দেখ তুই না চাইলেও রায়ান তোকে ছাড়বে না, তাই বলি কি একটা রাতেরই তো ব্যাপার। অমত করিস না, ওর কাজ করে ওকে চলে যেতে দে, এখান থেকে ফিরে আমি তোকে বিয়ে করবো।”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না তুলি, তার বন্ধুদের মন মানসিকতা এতোটা নিচু! এ মুহূর্তে নিজেকে নিজেরই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে, এমন করেও একজন মানুষ ভাবতে পারে! তুলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, তার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো রাকিবও। রাকিবের গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলো তুলি, চেঁচিয়ে বললো,

-“নিজের চেহারাকে ব্যবহার করে একটা মেয়েকে ভোগ করবি তুই আর তার জন্য ভুগবে নিষ্পাপ মেয়েরা! কেনো? আর আমি তো তোকে ভালোবাসি না রাকিব, তাহলে তোকে বিয়ে করার জন্য আমি রায়ানের অন্যায় আবদার মেনে নেবো কেনো? না আমি তোকে ভালোবাসি আর না রায়ানকে… আর ভালোবাসা তো দূরের কথা, আজ এ মুহূর্ত থেকে আমি তোদের দুজনকে ঘৃণা করি। বন্ধু তো বহুদূর তোরা মানুষ নামের কলঙ্ক…”

কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো তুলি, রায়ান তার হাত মচকে ধরলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-“এতো দেমাগ কিসের তোর হ্যাঁ? আজ তোর সব দেমাগ ছুটাবো আমি। এই রাকিব, তুই এই দেমাগী মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছিলি? আর দেখ তার তেজ দেখ। বলি কি, দুই ভাই মিলে সারারাত ফুর্তি করি?”

এতোক্ষণে রাকিবের লোভাতুর দৃষ্টিও তুলির উপর পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্য তুলির নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় মনে হতে লাগলো। জানলার বাড়িরে তুর্জকে দেখে কিছুটা সাহস পেলো তুলি, হাতের কাছে থাকা একটা ফুলদানি নিয়ে জানলার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মুহূর্তেই জানলার কাঁচ ভেঙ্গে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেলো, তুর্জকে দেখে তুলির হাত ছেড়ে দিলো রায়ান। রায়ানের হাত আলগা হতেই দরজা খুলে বেরিয়ে তুর্জের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো তুলি। তুলির বিধ্বস্ত চেহারা দেখে তুর্জর হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো। তুর্জ এগিয়ে এসে রায়ানের কলার ধরে বললো,

-“তোর সাহস কি করে হয় তুলির সঙ্গে এসব করার? তুলি আমাদের ভরসায় এখানে এসেছে আর তোরা তার সুযোগ নিচ্ছিস? এখনো সময় আছে, তুলির কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। এ কথা রিদানের কানে গেলে তোদের সঙ্গে কি ঘটতে চলেছে তা তোরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছিস।”

তুলিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো তুর্জ, ওর মাথায় হাত রেখে বললো,

-“কিছু হয় নি, একদম কাঁদবি না। চুপচাপ শুয়ে পড়, আমি এখানেই আছে।”

তুলির দৃষ্টিতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, তা লক্ষ্য করে তুর্জ বললো,

-“তুই দরজাটা ভেতর থেকে ভালোভাবে আটকে দে তুলি, আমি বাইরেই আছি। একদম ভয় পাবি না, কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিবি।”

তুলি অপলক তুর্জর দিকে তাকিয়ে রইলো, মুখে কিছুই বললো না। তুর্জ তুলির একটা হাত নিজের দু’হাতের মাঝে নিয়ে বললো,

-“আজ তোর সঙ্গে যা ঘটেছে তারপর আমাকে অবিশ্বাস করা অস্বাভাবিক কিছু না তুলি। এটাই স্বাভাবিক… তুই নিজেকে একদম অপরাধী ভাববি না। তুই সেটাই করছিস যেটা একজন সাধারণ মানুষ করে। ঘুমিয়ে পড়…”

তুর্জ ঘর থেকে বের হবার সময় দরজা টেনে দিলো, দরজার পাশেই মেঝেতে বসে মোবাইলে গেম খেলতে লাগলো সে। তুলি কিছুক্ষণ মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে একসময় দরজা না আটকেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। দরজার ফাঁক দিয়ে তুলিকে দেখে মুচকি হাসলো তুর্জ…

মাঝরাতে রিদানকে নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছায়ানিকা বেশ বিরক্ত হলো। হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলো,

-“সমস্যা কি তোর? রাতেও ঘুমাতে দিবি না?”

রিদান হাতে থাকা স্ক্রুগুলো ছায়ানিকার সামনে ধরে বললো,

-“এগুলো আমার ঘরের কোনায় পড়ে ছিলো, এগুলো কিসের বলতো?”
-“আমি কি স্ক্রু বিশেষজ্ঞ? কি করে বলবো এগুলো কিসের স্ক্রু? পুরোনো বাড়ি, হবে কিছু একটার।”

কথাটা বলেই রিদানের হাত থেকে স্ক্রুগুলো নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ছায়ানিকা। রিদান ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

-“ভাবলাম এটা কোনো ক্লু, আর তুই পাত্তাই দিলি না!”
-“তুই দয়া করে কোনো ক্লু খুঁজতে যাস না, কাজের কাজ তো হবেই না উল্টো কাজ নষ্ট হবে। যা গিয়ে ঘুমা আর আমাকেও ঘুমাতে দে।”

রিদান কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো, যাবার সময় ছায়ানিকাকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। ছায়ানিকা দরজা আটকে চুপচাপ শুয়ে পড়লো, বেকার বেকার কয়েকটা স্ক্রুর জন্য রাতের ঘুম নষ্ট করার মানে হয় না।

১৬
তুলির দরজার সামনে বসে থাকতে থাকতে তন্দ্রমতো এসেছিলো তুর্জর তাই দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলো সে। শেষরাতে বিকট শব্দে লাফ দিয়ে মেঝেতে বসে গেছে তুর্জ, ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে এসেছে তুলিও। টর্চ হাতে ছায়ানিকা আর রিদানকে এগিয়ে আসতে দেখে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায় তুর্জ। ছায়ানিকা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

-“তোরা ঠিক আছিস? কিসের শব্দ হলো হঠাৎ!”

কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না, সবাই একে অপরের মুখের দিকে দেখছে। হঠাৎ রিদান বললো,

-“রাকিব আর রায়ান কোথায়?”

ওদের নাম শুনে তুলি কিছুটা ভয় পেলেও তুর্জ চোখের ইশারায় তাকে শান্ত থাকতে বললো। চারজন একত্রে পা বাড়ালো রাকিব আর রায়ানের ঘরের দিকে। ওই মুহূর্তে তারা জানে না ঠিক কি ভয়াবহ চিত্রের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে তারা…

রাকিব আর রায়ানের ঘরের সামনে গিয়ে পায়ের নিচে কোনো তরল পদার্থ বয়ে যেতে দেখে সেদিকে টর্চ মারে ছায়ানিকা। রক্তের স্রোত দেখে তুলি থরথর করে কাঁপছে, ছায়ানিকা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“দরজাটা ভেঙে দে রিদান।”

অনেক চেষ্টা করে রিদান আর তুর্জ দরজা ভাঙলো। ভেতরে গিয়ে দেখলো ছাদ থেকে ফ্যানটা খুলে সরাসরি রায়ানের বুকের উপর পড়েছে, বুকের হাড় ভেঙ্গে চামড়া দিয়ে শিকের মতো বেরিয়ে আছে। মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, জিহ্বাটায় অদ্ভুতভাবে কামড় পড়ে কেটে মুখের বাইরে ঝুলে আছে। রাকিবের পেটের দিকে ফ্যানের একটা পাখা লেগে পেট কেটে গেছে বেশ কিছুদূর… ওদের দুজনকে দেখে তুলি চিৎকার করে তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারিয়েছে। বাকিরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো দীর্ঘক্ষণ…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here