প্রাণস্পন্দন পর্ব ৩+৪

#প্রানস্পন্দন
#পর্বঃ৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

একটা পাখির ডানা কেটে যখন তাকে বলা হয় খোলা আকাশে উড়তে তখন তার কেমন অনভূত হয়? আয়েন্দ্রির নিজেকে সেই পাখি মনে হচ্ছে আজ।খোলা আসমান হাতছানি দিলেও সে উড়তে পারবে না।মেঝেতে থাকা পা দুটো থরথর করে কম্পিত হচ্ছে।ক্রমশ সেই কম্পন তরতরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আয়েন্দ্রির সারা শরীরে।ভয়াতুরভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে আয়েন্দ্রি।

কিন্তু সহজ চোখে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ।উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।নরম পায়ে আয়েন্দ্রির সামনে এসে দাঁড়ায়।আয়েন্দ্রি মাথা উঁচু করে সেই পুরুষটির দিকে তাকায় যাকে সাগরের অগাধ জলরাশির মতো ঘৃণা করে।মোলায়েম হাসে নিষ্প্রাণ।আদুরে গলায় বললো–

“আমি ভালো হয়ে গেছি ধ্রুবতারা।একদম ভালো হয়ে গেছি।”

রুষ্ট গলায় ঘোষণা করে আয়েন্দ্রি–

“তোর মতো জানোয়ার কখনো ভালো হতে পারে না।ইউ আর আ সাইকো।”

মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ।শীতল তার অনুভূতি।বিশাল শোবার ঘরে দুটো আলমিরা।একটা ইন্টিয়রের।দেয়ালের সাথে সেটে দেওয়া।অন্যটা সেগুন কাঠের।নিষ্প্রাণ সেই আলমিরাটাই খুলে কিছু পেপার নিয়ে আসে।আয়েন্দ্রির সামনে দিয়ে বলে—

“দেখ,বিখ্যাত ক্লিনিক্যান সাইকোলোজিস্ট সৈয়দ করীম হাসনাতের স্বাক্ষর করা আমার রিলিজ পেপার।আমি একদম ঠিক হয়ে গেছি।”

আয়েন্দ্রি হতচকিতের মতো পেপারটা খাঁমচে নেয়।শশব্যস্ত চোখ দুটো বুলিয়ে কালো কলমের আঁচড়ের সেই স্বাক্ষর দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ তার সামনেই হাঁটু গেড়ে বসে।দুই হাত আয়েন্দ্রির উরুর উপর রেখে বললো–

“এখন তোর বিশ্বাস হয় আমি সুস্থ হয়ে গেছি?বল না ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটো পিটপিট করে তাকায়।নিষ্প্রাণ সাবলীল গলায় বললো—

“তোকে আমি ভালোবাসি ধ্রুবতারা।এই জন্য সেদিন আমি পুলিশের সামনে চুপ ছিলাম।আমি চাইনি পুলিশ তোকে অপদস্থ করুক।”

আয়েন্দ্রি ঝটকা মেরে নিষ্প্রাণের দুই হাত সরিয়ে বললো—

“ছুঁবি না তুই আমাকে।আর কিসের অপদস্থ !তুই খুনি।খুনি তুই।”

ঝরা হাসে নিষ্প্রাণ।ফিকে গলায় বললো–

“খুন তো আমি তোর জন্যই করেছি।ওর সাহস কী করে হয় আমার ধ্রুবতারাকে ওইভাবে দেখার?ওর সাহস কী করে হয় আমার ধ্রুবতারার গায়ে হাত দেয়ার।এই যে কোমল মাখনের মতো দেহ,এতে শুধু তোর প্রাণের অধিকার।শুধু তোর প্রাণের।”

আয়েন্দ্রি কটমটিয়ে বললো–

“না।একদম ছুঁবি না তুই আমাকে।জানোয়ার তুই।তোকে জেল থেকে ছাড়ালো কে?

নিষ্প্রাণ ফোঁস করে দম ফেললো।নিস্পৃহ গলায় বললো—

“দাদু ছাড়িয়েছে।আমার দাদু।যার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি।এই যে বাড়িটা দেখছিস সম্পূর্ণ নিউ টেকনোলজিতে করা।গত ছয়মাস আগে এর কাজ শেষ হয়েছে।সেদিন পুলিশ আমাকে থানাতে তো নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমার দাদু আমাকে বেল করিয়েছে।মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে।সেই ক্ষমতা তার আছে।আর সবচেয়ে বড় কথা আমাকে তার প্রয়োজন।আমি ফিরে আসতে চেয়েছি তোর কাছে।তোকে নিজের করে নিতে।কিন্তু দাদু শর্ত দিয়েছে আমাকে, যদি আমি নিজের চিকিৎসা না করাই তাহলে সে তোকে আমার সাথে বিয়ে দিবে না।তাই দুই বছর তোর থেকে দূরে থেকে আমি নিজের চিকিৎসা করিয়েছি।আই এম ফিট নাউ।”

দাঁতে দাঁতে চেপে চিৎকার করে উঠে আয়েন্দ্রি।

“নো।নেভার।তুই যদি সুস্থ হতি তাহলে এইভাবে বিয়ে করতি না আমায়।”

নিষ্প্রাণ শান্ত গলায় বললো—

“তুই আমাকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিলি।আমার অবর্তমানে তুই সারককে বিয়ে করতে চেয়েছিলি।আমি যদি আগে জানতাম তাহলে ওকে মেরেই আমি জেলে যেতাম।কিন্তু আফসোস!
ওর ভাগ্য ভালো।ও তখন তোর প্রতি ইন্টারেস্ট দেখায়নি।
তোর কী মনে হয়,আমি হসপিটাল ছিলাম বলে তোর খবর রাখি নি?প্রতিটি মিনিট,প্রতিটি সেকেন্ড,প্রতিটি পল আমি তরপেছি তোর জন্য।তোকে কাছে পাওয়ার জন্য।তোর ভালোবাসার সাগরে ডুবে মরার জন্য।কিন্তু তুই!বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলি।তাই আমি এইসব করতে বাধ্য হলাম।”

আয়েন্দ্রি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে।ঝিমঝিম করছে তার মস্তিষ্ক।হাতের কাগজটায় আবার চোখ বুলায় আয়েন্দ্রি।তার পাশে উঠে বসে নিষ্প্রাণ।প্রগাঢ় দৃষ্টিতে দেখতে থাকে আয়েন্দ্রি চোখের নীরে ভেজা মুখমণ্ডল।নিষ্প্রাণ নিজেকে আয়েন্দ্রির একদম কাছে নিয়ে আসে।তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় কাঁপন ধরে আয়েন্দ্রির শীতল শরীরে।ছিটকে সরে এসে বললো—

“প্রাণ!
সর এখান থেকে।ছুঁবি না আমায়।”

তীর্যক হাসে নিষ্প্রাণ।পুলকিত তার মন।প্রসন্ন গলায় বললো—

“প্রাণ!
তুই আমাকে তাহলে ডাকলি সেই নামে।তুইও আমাকে ভালোবাসিস তাই না ধ্রুবতারা?এই জন্যই এখনো এই নামে ডাকিস।আর কি বললি?ছুঁবো না তোকে?তা কী করে হয়!
বিয়ে হয়েছে আমাদের।এইবার তুই আমার হবি।শুধু আমার।তোর সারা অঙ্গে শুধু আমার ছোঁয়া থাকবে।এই ফুলবাসরে তোর মধ্যে বিচরণ করবো আমি।আমার সত্তা।”

তেঁতে উঠে আয়েন্দ্রি।সটান করে দাঁড়িয়ে বললো—

“কখনো না।”

নিষ্প্রাণ মুচকি হাসে।আয়েন্দ্রির দুই হাত ধরে ওকে শান্তভঙিতে বিছানায় বসায়।নিজের মোবাইল থেকে একটা ভিডিও বের করে দেয়।আঁতকে উঠে আয়েন্দ্রি।সারক!
সারককে বেঁধে রাখা হয়েছে একটা হাতল ওয়ালা চেয়ারের সাথে।ক্ষীণ আলোয় তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আয়েন্দ্রি।ভীতিকর চাহনিতে ফাঁকা ঢোক গিলে সে।শ্বাস ভারী হতে থাকে আয়েন্দ্রির।হাত কেঁপে যাচ্ছে তার।শ্বাস যেনো আটকে যাচ্ছে স্বরনালিতেই।ঘাম ছুঁটে যাচ্ছে।আয়েন্দ্রি এলোমেলো হাতে মুখের ঘাম মুছে নেয়।ক্রমশ ঘোলা হচ্ছে তার চোখ।প্রসারিত অক্ষিপুটে ভিডিওটি দেখছে।সাবলীল ভঙিতে মোবাইলের সাইড বাটন চেপে ভলিউম ইনক্রেজ করে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি ভড়কে যায়।সারকের আর্তনাদে তার কর্ণরন্ধ্রে যেনো ফাটল ধরে।

একটা বারো ফুট দৈর্ঘ্য আর চৌদ্দ ফুট প্রস্থের কক্ষে বন্দি করে রেখেছে সারককে।কক্ষটির মধ্যে শুধুমাত্র একটাই ষাট ওয়াটের বাল্ব।একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে।সিলিং এর থেকে দুই হাত নিচে একটা লোহার চাকতি ঝুলানো।যার পাটাতনে অসংখ্য ফুটো করা।চাকতিটি ইলেকট্রিক তার দ্বারা সংযুক্ত যার কানেকশন দেয়ালের সুইচ বোর্ডে।চাকতিটির মধ্যে প্যারাফিন রাখা।
প্যারাফিন হল কৃত্রিম মোম। যা পেট্রোলিয়ামের উপজাত পদার্থ। এটি একটি হাইড্রোকার্বন জাতীয় যৌগ, যার গলনাঙ্ক কম। এটি জলে অদ্রাব্য হলেও ইথার, বেঞ্জিন, টলুইন ইত্যাদিতে দ্রাব্য।

সুইচ বোর্ডের সুইচ অন করা বলেই সেই চাকতি উত্তপ্ত ।তাতে প্যারাফিন বিগলিত হয়ে তরলে পরিণত হয়।আর তা সেই ছিদ্র দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় টুপটুপ করে পড়ছে সারকের গায়ের উপর।বদ্ধ কক্ষে তার মৃত্য যন্ত্রণা শোনার কেউ নেই।তীব্র চিৎকারে যেনো ছাতি ফেটে যাচ্ছে সারকের।গলিত প্যারাফিন ঝলসে দিচ্ছে তাকে।সেদ্ধ করে দিচ্ছে তার মাংস।মোবাইল হাতেই ক্রোধে বিহ্বল আয়েন্দ্রি জোর হাতে ঘুষি মারতে থাকে নিষ্প্রাণের বুকে।নির্বিকার নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির দুই হাত নিজের মুষ্টি বদ্ধ করে তাকে বিছানায় শুইয়ে তার উপর নিজের ভর ছেড়ে দেয়।ক্ষণপলেই দীর্ঘ চুমু খায় আয়েন্দ্রির অধরে।ককর্শ গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“ছাড় আমাকে।ইউ সিক।তুই কখনো ভালো হবি না।জানোয়ার !

নিষ্প্রাণ আবারও চুমু খায় আয়েন্দ্রির অধরে।এইবার শুধু চুমু খায়নি।আয়েন্দ্রির নিচের ঠোঁটে আলতো কামড় বসিয়ে দেয়।হেসে হেসে বললো—

“আমি সুস্থ।আমি সুস্থ বলেই সারক এখনো শ্বাস নিচ্ছে।তা নাহলে তোকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর অপরাধে ওর প্রাণনাশ আমিই করতাম।কিন্তু ওর চেয়েও তুই অপরাধী বেশি করেছিস।ওর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে তুইও অপরাধ করেছিস।তার শাস্তি তোকে পেতে হবে।মেনে নে আমাকে।আমাকে বাঁধা দিবি না।তাহলে যে আর্তনাদটুকু সারকের শুনেছিস তাও বন্ধ করে দিবো আমি।”

নিজের অসহায়ত্বে বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ শুঁষে নেয় সেই নোনতা জলের প্রস্রবণ।আবেগী গলায় বললো—

“কাঁদিস না ধ্রুবতারা।এ তো হওয়ার ই ছিলো।ভালোবাস আমাকে।প্লিজ ভালোবাস।তুই তো আমারই।তোর প্রাণের প্রাণস্পন্দন।এই নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন।

নিস্তব্ধতা নেমে আসে ফুলের বাসরে। ক্রমশ প্রলীন হতে থাকে নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির শরীরের ভাঁজে ভাঁজে।খুঁজতে থাকে তার প্রাণস্পন্দন।নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের বক্ষতলে।একটু একটু করে নিজের সম্ভ্রম বিসর্জন দিচ্ছে স্বামী নামক এই প্রাণহীন মানুষটির কাছে।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

উষ্ণ বাতাসের ছটা প্রকটভাবে অনভূত হতেই ঝট করে চোখ খুলে ফেলে আয়েন্দ্রি।চোখের সমুখে নিষ্প্রাণের মুখটা দেখেই হুট করেই উঠে বসে।এলোথেলো চুল আর
পাংশুটে মুখ।তড়িৎ বেগে উঠে পড়ায় গায়ের পাতলা চাদরটা সরে যেতেই তা টেনে নেয় আয়েন্দ্রি।নিজেকে আড়াল করার কিছু নেই এখন তার কাছে।আয়েন্দ্রির নিরাবরণ দেহের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে নিষ্প্রাণ।উষ্ণ কন্ঠেই প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—

“কী করছিলি তুই?

অধর হালকা বিস্তৃত করে নিষ্প্রাণ।সরস গলায় বললো—

“তোকে দেখছি।তোকে দেখার স্বাধ আমার এই জীবনে মিটবে নারে।”

অস্বস্তিতে মুখ ঘুরায় আয়েন্দ্রি।তপ্ত গলায় বললো—

“সারক কোথায়?কী করেছিস তুই ওর সাথে?

ফোঁস করে শ্বাস ফেললো নিষ্প্রাণ।নির্বিঘ্নে একদম পাশ ঘেষে বসলো আয়েন্দ্রির।পেছন থেকে আয়েন্দ্রির অগোছালো চুল সরিয়ে কাঁধে চুমু খায়।আয়েন্দ্রির মনে হলো কেউ তার শরীরে সূঁচ বিঁধিয়ে দিচ্ছে।নিমীলিত চোখে হজম করে নিচ্ছে সেই স্পর্শ।নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কানে অধর ছোঁয়ায়।বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে আয়েন্দ্রি।দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে আয়েন্দ্রি।আয়েন্দ্রির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো নিষ্প্রাণ–

“সারক ভালো আছে।শহরের সবচেয়ে বড় হসপিটালে চিকিৎসা হচ্ছে ওর।সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।চিন্তা করিস না তুই।”

আয়েন্দ্রির অনাবৃত পিঠের উপর নিজের নাক ঘঁষতে থাকে নিষ্প্রাণ।অতিষ্ঠ হয়ে বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“প্রাণ!কী করছিস তুই?

নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির চুলে নাক ডোবায়।লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললো—

“তুই একদম বেলি ফুলের মতো।যেমন শুভ্র,তেমন তোর সৌরভ।পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।”

“তোর এই পাগলামি বন্ধ কর।”

তৃপ্তিকর হাসে নিষ্প্রাণ।দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে বিছানায় আলগোছে শুয়ে পড়ে।আদেশের সুরে বললো—

“যা ফ্রেশ হয়ে আয়।ব্রেকফাস্ট করবি।আমি নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট বানিয়েছি তোর জন্য।”

আয়েন্দ্রির চোখ জ্বলে যাচ্ছে।নিষ্প্রাণের লাগামহীন পাগলামোর শেষে নিজের চোখের জল ঝড়িয়েছে বাকি রাত।চাদরটা কোনোরকম শরীরের সাথে পেঁচিয়ে রাখে আয়েন্দ্রি।
ওয়াশরুমে ঢুকেই ঝর্ণা ছেড়ে বসে পড়ে তার নিচে আয়েন্দ্রি।হাত দিয়ে ট্যাপগুলো ছেড়ে গলা ফাটিয়ে বিলাপ করতে থাকে।সব শেষ তার।সব।
পাগলের মতো শরীর ঘঁসতে থাকে আয়েন্দ্রি।নিজের শরীর থেকে ওই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষটির সকল স্পর্শ মুছে দিতে চায় সে।দুই হাতে উন্মাদের মতো গাল,ঠোঁট,গলায় ঘষা মারতে থাকে আয়েন্দ্রি।মাখনের মতো শরীরে ফুলে লাল হয়ে উঠে।বুক কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে।স্বচ্ছ টাইলসের উপর প্রবাহিত পানির স্রোতে উন্মত্তের মতো হাত দিয়ে আঘাত করতে থাকে।সমস্ত ওয়াশরুমের কানায় কানায় যেনো গভীর আর্তনাদ বিচরণ করছে।

দেয়ালের সাথে হেলান দেয় আয়েন্দ্রি।শান্ত সে।চোখ দিয়ে স্মিত ধারার প্রস্রবণ মিলিয়ে যাচ্ছে ঝর্ণার জলে।প্রায় আধাঘন্টা পরও যখন আয়েন্দ্রি ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে না উঠে বসে নিষ্প্রাণ।ক্ষীপ্ত চোখে তাকায় ওয়াশরুমের দরজার দিকে।অচঞ্চল পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে ওয়াশরুমের দিকে।ডান হাতের তর্জনী দিয়ে করাঘাত করে বললো—

“ধ্রুবতারা,কী করছিস তুই?বেরিয়ে আয়।বেশিক্ষণ পানিতে থাকলে ঠান্ডা লাগবে তোর।”

ভেতর থেকে কোনো সাড়া এলো না।নিষ্প্রাণ গম্ভীর গলায় বললো—

“বেরিয়ে আয় ধ্রুবতারা।বেরিয়ে আয় বলছি।”

আয়েন্দ্রি দুম ধরে বসে রইলো ভেতরে।নিষ্প্রাণ ক্ষেপে যায়।গায়ের জোর দিয়ে এক লাথি মারে ওয়াশরুমের দরজায়।দাঁতখামটি মেরে বললো—

“বেরিয়ে আয় ধ্রুবতারা।আর এক মিনিট দেরি হলে আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ফেলবো।”

রাগে বিহ্বল নিষ্প্রাণ যেইনা পা উঠিয়েছে তখনই ধীরগতিতে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিষ্প্রাণ।গাঢ় চোখে তাকাতেই মেজাজ চটে যায় নিষ্প্রাণের।ক্রোধিত কন্ঠে বললো—

“এইটা কী পরেছিস?সালোয়ার -কামিজ কেন পরেছিস?বিয়ে হয়েছে তোর।শাড়ি পরবি এখন থেকে।”

আয়েন্দ্রি দুর্বল গলায় বললো—

“আমার কাছে শাড়ি নেই।

নিষ্প্রাণ নাক ফুলায়।কড়া গলায় বললো—

“আয় আমার সাথে।”

নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রিকে নিয়ে আলমিরার সামনে দাঁড় করায়।আলমিরা খুলতেই চক্ষু হতভম্ব আয়েন্দ্রির।অক্ষিপল্লব দৃঢ় করে চেয়ে আছে সে।নিষ্প্রাণ কোমর জড়িয়ে ধরে আয়েন্দ্রি।কানের লতিতে ছোট কামড় বসিয়ে বললো—

“এইটা তোর।চারশত প্লাস শাড়ি আছে এখানে।সব রঙের।তোর যেইটা ইচ্ছে পরে নে।পরে নে ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রির শীতল গালের সাথে নিজের তপ্ত গাল ছুঁইয়ে রাখে নিষ্প্রাণ।নিষ্প্রাণকে ছাড়িয়ে একটা লাইট ব্রাউন রঙের শাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতেই থমকে যায় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ অদ্ভুত আবদার করে বসে।আঁখুটে গলায় বললো—

“এইখানেই চেঞ্জ কর।”

ক্ষুন্ন গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“না।”

আয়েন্দ্রি এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে।নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির হাত টেনে ধরে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়।আয়েন্দ্রির মুখে লেপ্টে থাকা তার ভেজা চুল সরিয়ে তার গালে হাত রাখে নিষ্প্রাণ।নিষ্প্রাণের বুকের সাথে মিশে আছে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ শান্ত কিন্তু শক্ত গলায় বললো—

“এইখানেই চেঞ্জ কর ধ্রুবতারা।আমি তোকে দেখবো।আমার চোখ ভরে দেখবো।”

ছলছল করে উঠে আয়েন্দ্রির চোখ।জমাট গলায় বললো—

“ছাড় আমায় প্রাণ।এমন করিস না।”

আয়েন্দ্রির ভেজা,পাতলা ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায় নিষ্প্রাণ।মোহবিষ্ট গলায় বললো—

“রাগাস না আমায়।এখানেই চেঞ্জ কর।”

আয়েন্দ্রিকে ছেড়ে বিছানায় বসে নিষ্প্রাণ।উপায়হীন আয়েন্দ্রি অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না।আয়েন্দ্রির নিরাবরণ দেহের দিকে তাকালো না নিষ্প্রাণ।চোখ দুটো নিবদ্ধ করে রাখলো সামনে আয়েন্দ্রির ওয়াল পেইন্টিং এ।চোখে প্রশান্তি নেমে আসে নিষ্প্রাণের।এই মেয়েটাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবে না।সে মরতে চায় না।হাজার বছর বাঁচতে চায় তার ধ্রুবতারার সাথে।
,
,
,
খাচ্ছে নিষ্প্রাণ।তার দিকেই গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ খাওয়ার ফাঁকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো—

“বসে আছিস কেন?খেয়ে নে।কাল থেকে তো কিছুই খাসনি।”

শক্ত গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“আমাকে বাসায় দিয়ে আয়।”

মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ।নির্মল গলায় বললো—

“কালই তো এলি।এখনই চলে যেতে চাইছিস?ওকে নিয়ে যাবো।খেয়ে নে এখন।আর শোন,আমাদের রিসিপশনটা এখন হচ্ছে না।সারক সুস্থ হোক।আর আমাদের বাকি ফ্রেন্ডদেরও আসতে বলবো।ওরা আমাকে অপছন্দ করলেও তোকে পছন্দ করে।”

আয়েন্দ্রি গুমোট গলায় বললো—

“তোর দাদু কী করে?

“কিছু না।”

ভ্রু নাচিয়ে ফের প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—-

“তুই তো কখনো বলিস নি তোর কেউ আছে?

“প্রয়োজনবোধ করিনি।এখন করছি।”

“এইসব হলো কী করে—

টেবিলে রাখা এপেল জুসটা শেষ করে নিষ্প্রাণ।চেয়ারটা ফাঁক করে আয়েন্দ্রির দিকে ফিরে তাকায়।চেয়ারসহ আয়েন্দ্রিকে টেনে নিজের কাছে আনে।তার হাতদুটো নিজের অঞ্জলিতে নিয়ে মোলায়েম গলায় বললো—

“এই বাড়িটা আমি তোর জন্য বানিয়েছি।তোর আগে এই বাড়িতে আমি কাউকে আসতে দেই নি।এখানে শুধু তুই আর আমি থাকবো।
দাদু আপাতত কিছু করে না।সব সামলায় তার বিশ্বস্ত কর্মচারি আই মিন ম্যানেজার।দাদুর বিশাল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারী আমি।তার বংশ টিকিয়ে রাখতে আমাকেই প্রয়োজন তার।দাদু আমাকে একটা কোম্পানি কিনে দিয়েছে।নতুন নয়।একটা ফল কোম্পানিকে টেক ওভার করেছে।আমি তার এম ডি।কিন্তু আমি আগামী ছয় মাস তোর সাথে থাকবো।তোর ছায়া হয়ে থাকবো।তোর সাথে সময় কাটাবো।কোম্পানির সাথে সরাসরি যুক্ত হবো না।”

নিষ্প্রাণ নিচু হয়ে আয়েন্দ্রির বুকের উপরের কামড়ের দাগে গভীর চুমু খেলো।আয়েন্দ্রি কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।করতে ইচ্ছে হলো না তার।কারণ,এছাড়া আরও অসংখ্য দাগ আছে আয়েন্দ্রির শরীরে। নিষ্প্রাণ তার পৌরষসত্তার ছাপ ফেলেছে তার কোমল দেহে।আহ্লাদী গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“খেয়ে নে।নিয়ে যাবো তোকে।”

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here