#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||৬ষ্ঠ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
সামিয়ার জন্মটা হয়েছিল বেশ নাটকীয় ভাবে। তখন তাদের বসবাস গ্রামে, আটমাসেই যন্ত্রণা শুরু হয় আলিফা খাতুনের। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে সেদিন। দূর সেই সদরে হাসপাতাল, কাঁচা রাস্তা বেয়ে যাওয়া কম কথা নয়। তবুও কোনোরকম যাওয়ার ব্যবস্থা করে।
মাঝ রাস্তায় পৌঁছাতেই প্রসবকালীন বেদনা তীব্রতর হয়। অতঃপর সেই মেঠো পথের পাশে এক দম্পতির বাড়িতে মুনিরা বানু ও সেই বাড়ির বউয়ের সহায়তায় সামিয়ার জন্ম। কী এক ফুটফুটে মেয়ে! সবার যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।
মুনিরা বানু পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বলেই ফেলে,
“মাশা আল্লাহ! সায়রাজের ঘর তো আল্লাহ ওরে দিয়াই আলো কইরা দিল।”
কিন্তু জন্ম হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পর সবার চোখ-মুখ অন্ধকার। বাচ্চা তো কাঁদে না, শব্দও করে না, পিঠে আলতো হাতে চড় দিলেন বার কয়েক মুনিরা বানু, সাধারণত এমনই করা হয়, কিন্তু তারপরও কাঁদে না।
গাটাও ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আলিফা খাতুনের গলা কাঁপছে কথা বলতে পারছেন না। দুই বাড়ি পরেই এক ফার্মেসির মালিকের বাসা। তার কাছেই দৌঁড় দেয় সায়রাজ কবির। তিনি এসে এধটু-আধটু দেখে গম্ভীর গলায় বলেন,
“অবস্থা বেশি ভালা না। সময়ের আগে হইসে বাচ্চা, শ্বাস-প্রশ্বাস আস্তে আস্তে কইমা যাইতাসে। তাড়াতাড়ি হাসপাতাল নিলেই ভালা।”
এসব বলার সাথে সাথে এও বলেন সামনে নাকি বড় দুই খানা বৃক্ষের পতন হয়েছে। তাই যেতে পারবে না সদরে। কবির পরিবারের সকলের মাথায় বাঁশ। কী করবে এখন? একে তো ঝড়ের রাত, আবার রাস্তা বন্ধ, চোর-ডাকাতের কবলে পড়ার ভয়, কোনোরকম যদি সদরে নিয়েও যায় সেখানে ডাক্তার আছে কিনা তারও ঠিক নেই।
অগত্যা বাড়িতে বসেই অপেক্ষা করতে হয় তাদের। কীসের অপেক্ষা? রাত পোহানোর অপেক্ষা কিংবা ছোট জানটার ধীরেধীরে শেষ হওয়ার অপেক্ষা।
সবার চোখ থেকে অবিরাম ধারায় নোনাজল ঝরছে। হুট করেই সায়রাজ কবির মেয়েকে কোলে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হন। পিছন পিছন রমিজ সাহেবও বের হন। বাড়ির ডান দিকেই মসজিদ, আল্লাহর ঘর। মেয়েকে কোলে নিয়ে কিবলা মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“কোনো কিছু পেতে হলে শেষ অবধি চেষ্টা করে যেতে হয় অবিরাম ভাবে, দোয়ার সাথে দাওয়াও নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ, আমার কাছে এখন দাওয়া নেওয়ার কোনো উপায় নেই, মেয়ের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। অথবা, তোমার দরবারে মেয়ের জন্য দোয়া করায় মশগুল থাকা ছাড়া।
বাপ-মায়ের দোয়াই না কি সন্তানের জন্য সবার আগে লাগে, তবে আল্লাহ তুমি আজ আমার ইবাদতে, দোয়ায় আমার সন্তানকে সুস্থ করে দিয়ো। এর বিপরীতে তুমি আমায় ওকে ছাড়া আর কোনো সন্তান না দিলে তাতেও সই।”
বলে তিনি মেয়েকে পাশে মেঝেতে শুয়িয়ে নিজে জায়নামাজ বিছিয়ে নফল নামাজ পড়তে শুরু করেন। আল্লাহর কুদরতে কী খেলা হলো কে জানে, এর কিছু সময় পরই সামিয়া গগনবিদারী কান্না শুরু করে, রমিজ সাহেব এসে নিয়ে যান তাকে মায়ের নিকট। ভাবেন মেয়ের বুঝি শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। দুধ পান করাতেই মেয়েটার কান্না থামে, সেই সাথে শরীরে তাপমাত্রাও ধীরেধীরে শুধরাতে শুরু করে, শ্বাস-প্রশ্বাসও ঠিক হয়।
রমিজ সাহেব খুশি মনে সবাইকে বলতে শুরু করেন ভাইয়ের কথাগুলো। আলিফা খাতুন মেয়ের সুস্থতায় খুশি হলেও মনে মনে ক্ষিপ্ত হন স্বামীর কথায়, তার যে একজন ছেলেও চাই। পরদিন ভোরেই তারা গ্রামে ফিরে। সবাই এক এক করে মেয়ের মুখ দর্শন করতে আসে।
গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ হলেন শামসুন আম্মা। তিনি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়েও নানা ভাবীকথন বলে থাকেন। সামিয়াকেও বেশ বেশ কয়েকবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।
“মেয়ের রূপ কিন্তু এহন যত সুন্দর লাগতাসে বড় হইলে তেমন হইতো না। লাল গায়ের রঙ, কালা হইবো। ভালোভাবে চেহারার যত্ন নিস ছেমড়ি। মেয়ের লগে বরকত আছে, তয় কপালে কষ্ট অনেক, বিনা কারণের কষ্ট। সামলায়া রাহিস মাইয়ারা।”
বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে কথাগুলো বলে তিনি চলে যান, আর আলিফা খাতুনকে ভাসিয়ে যান ভাবনার অথৈজলে। কারণ এমনিতেই সায়রাজ কবিরের এমন কথা আল্লাহর দরবারে আর সন্তান নিয়ে, যদি মেয়েটার কিছু হয়ে যায়…?
এরপর থেকে সামিয়াকে বড় হতে হয়েছে প্রচণ্ড কঠোরতার মাঝে। তার জন্মের কয়েক দিনের মাথায়ই সায়রাজ কবির স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে এসে পড়েছিলেন ঢাকা শহরে। এই শহরে পরিবার বলতে সামিয়ার ছিল শুধু বাবা আর মা, মাঝখান থেকে নামমাত্র এক বোন যোগ হলেও তার নাম উল্লেখ না করা মতোই কার্যকলাপ ছিল।
মেয়েটা ভালোবাসা পেতো শুধু বাবার থেকে, তিনিও ব্যবসায় ব্যস্ত থাকতেন বলে তাকেও পেতো না। আর মা…? সে ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মতোন, শুধু শাসনই করে যেতেন, প্রকাশ্যে নূন্যতম ভালোবাসা বা আদর দেখাতেন না। তবে যত্নের নামে অত্যাচার টুকু চলতো।
সামিয়া একটু বেড়ে উঠার সাথে সাথে আলিফা খাতুন দেখতে পেলেন মেয়েটার রূপ আসলেই খসে যাচ্ছে । রূপ বলতে রং। এ নিয়ে তার সৃষ্ট নানা ঝামেলায় পড়তো হতো সামিয়াকে। স্কুল থেকে আসলেই শুনতে হতো,
“এই মেয়ে বরফ দে চেহারায়। গায়ের রঙ আরও কালচে হবে। আরও বিচ্ছিরি লাগবে দেখতে।”
তো বাজারে যেয়ে লাল কিংবা নিয়ন বা ধূসর রংয়ের জামা ধরলে বলতেন,
“উফঃ সামিয়া! এগুলো সুন্দরী মেয়েদের জন্য, তুমি পরলে আরও ক্ষ্যাত লাগবে।”
এসব থেকেই হয়তো সামিয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে সূচনা হচ্ছিল ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স, যাকে বাংলায় বলে হীনমন্যতা। সে নিজেকে রূপহীন ও কুৎসিত ভাবতে শুরু করে। সবকিছুর মূলে মূলত তার ছেলেবেলা।
___
“শামিম হাসান” নামটা চকচক করছে বোর্ডে। এতক্ষণ ধরে সামিয়ার ছেলেবেলার কথা শুনছিল, হঠাৎ সোনালি বোর্ডটির দিকে চোখ যাওয়ায় মনযোগ হারায় আবরার। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শামিম হাসানের ক্যাবিনে বসে আছে সে ও সায়রাজ কবির। গতকালই সামিয়াকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে তারা।
আবরারের মনে যুবতীর ছেলেবেলা শুনে করুণা জাগলেও সমস্যাটা সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না।
“কিন্তু ডাক্তার সাহেব এমন কথা তো প্রায় প্রতিটি বাঙালি মেয়েই শুনে থাকে তাদের ডাস্কি স্কিনের জন্য, নিজের রূপের জন্য। এতে কোনো বড় সমস্যা কী করে?”
শামিম হাসান একজন হাস্যরসিক, স্বাস্থ্যবান বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি কৌতুক শুনার মতোই হেসে উঠেন আবরারের কথায়। তারপর জবাব দিলেন,
“তোমাদের বাঙালিদের সমস্যা বড় বুঝলে! তুমি ডাক্তার হয়েও এমন প্রশ্ন করলে দেখে বিপুল অবাক হলাম, অবশ্য বাঙালি বলে কথা। বাঙালিরা জানে আজকালকার টিনেজারদের মন-মানসিকতা অন্যরকম, তাদের নমনীয়তার সাথে হ্যান্ডেল করতে হয়। একটু থেকে একটু হলেই আবেগে পটল তুলতে যাবে। তারপরও শুধাবে আমাদের বাপ-মা আরও কত কিছু বলেছে।
বুঝবে না সময় পালটেছে, মানুষের মন-মানসিকতাও পালটেছে। আবার মনোরোগ থাকা মানেই মনে করবে পাগল। টিপিকাল বাঙালি বুঝলে!”
যুবক কটমটে চোখে তাকালো। মনে মনে বলল,
“হ্যাঁ বাপ, আমরাই বাঙালি। আপনি তো উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন বাংলাদেশে।”
বয়স্ক লোকটি ভ্রুঁ বাঁকিয়ে বললেন,
“আমি জানি তুমি আমাকে মনে মনে অহেতুকই বকছো, তবে তা বাদ দিয়ে আমার কথা বুঝো এখন। শোনো শিশু হলো কাঁদামাটির মতোন তাকে যেমন আঁকার দিবে তেমনই হবে, আবার ছেলে বেলায় যেই বিষয়গুলো তার মনে ভালোভাবে ঢুকবে তা তার সাথে সারা জীবনই থাকবে, হোক তা ভয় বা অন্যকিছু। সামিয়ার ছোটবেলা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এবং একাকিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠছিল, সেই সাথে ডিপ্রেশনও সাথে ছিল।”
আবরার কিছু বলল না, সে একটু লজ্জাবোধই করছে তার মনের কথা বুঝে ফেলায়। কিন্তু এই পর্যায়ে সায়রাজ কবির প্রশ্ন করেন,
“তাহলে আগে ধরা পড়েনি কেন?”
“কারণ এগুলো ছিল সুপ্ত অবস্থায়। একটি সার্ভে অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতি পাঁচ জনে একজন মানসিক রোগে বা সমস্যায় জর্জরিত। এখন কথা হল, এত মানুষের সমস্যা হলে তো পৃথিবীর অর্ধাংশ জনগণই মেন্টাল হাসপাতালে থাকতো তাই না? থাকে না কেন? কারণ সমস্যাগুলো সবার মাঝে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। পরবর্তীতে পরিবর্তনীয় পরিস্থিতি ও সময়ের সাথে সমস্যা বেড়ে যেয়ে প্রকাশ্যে আসে।
সামিয়ার সাথেও এটাই হয়েছে। ওর সমস্যাগুলোকে মিলিয়ে তখনই হ্যালুসিনেশন করতে শুরু করে যখন ও ওর প্রেমিকের কাছ থেকে ধোঁকাটা পায়, তখন হয়তো ছেলেটা তাকে তার হীনমন্যতা অনেকাংশ বাড়িয়ে দেওয়ার মতোই কিছু বলেছিল। ”
“ধোঁকা?”
বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে আবরার। সায়রাজ কবির গোপণে এক শ্বাস ফেলেন। তিনি জানেন এই অতীত জানার পর সম্পর্ক জোড়ার আগেই পুরোপুরি ভেঙে যাবে।
“সামিয়া যখন ইন্টার পরীক্ষা দেওয়ার আগ দিয়ে ওকে এক আমার চেনা-জানা সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে দেখে পছন্দ করে ফেলে। আমরা ওকে জিজ্ঞেস না করেই শুধু জানিয়ে ইন্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই কাবিন ঠিক করে ফেলি। কাবিনের দিন ঠিক সকালে দেখি ও বাড়িতে নেই। একটা ম্যাসেজ দেয় আমার ফোনে যে সে পালিয়ে যাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে। আমাদের উপর তখন যেন পুরো পাহাড় পড়েছে।
ছেলের বাড়ির লোকদের কোনোরকম মানা করলাম, কয়েকজন কাছের লোকদের বলেছিলাম তাদের সামনেও মান গেল। সাত-আটটার দিকে দেখি ও ফিরে এসেছে। হাতে সেই ব্যাগ, অশ্রু লেপ্টানো নিস্তব্ধ চেহানা। যদিও মেয়ে আমার মান লুটিয়ে গিয়েছিল, তবুও তো একমাত্র সন্তান আমার ও। বিশ্বাস করো বুক কেঁপে উঠেছিল ঐ অবস্থা দেখে। জানতে পারলাম ছেলেটা তাকে ধোঁকা দিয়েছে, এর বেশি কিছুই জানায়নি।
সামিয়াকে সামলাতে এগিয়েছিলাম, কিন্তু তার আগেই আলিফা চেঁচামেচি শুরু করল। এই মেয়েটা এত বড় হয়েও ধোঁকার ভার, বাবা-মায়ের উপর করা তার অপরাধের অপরাধবোধ, মায়ের লাগানো লাঞ্ছনা সামলদ নিতে পারেনি। সেখানেই জ্ঞান হারায় সে। আমরা খুব একটা ভয় পায়নি। তবে ঐদিনের পর বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা খেয়াল করি মেয়েটার, কারো সাথে রাত-বিরাতে কথা বলা, কিন্তু আসলে কেউ নেই। খোঁজ নিয়ে উনার শরণাপন্ন হয়ে চেক করালে জানতে পারলাম মেয়ে আসলে মনরোগে ভুগছে।”
“কিন্তু তাই বলে এমন হ্যালুসিনেশন যে একটা ক্যারেক্টার ক্রিয়েট করে ফেলেছে!”
“এর এক বিশেষ কারণ খুঁজে পেয়েছি। তার ডায়েরি এনে দিয়েছিলেন আমায় সায়রাজ সাহেব। সামিয়া গল্প লিখতে পছন্দ করতো, যেখানে সে ও কাব্য নামক কাল্পনিক চরিত্র থাকতো কেন্দ্রীয় আকর্ষণ। হয়তো সেখান থেকেই। সে আসলে চাইতো কেউ তাকে ভালোবাসুক, সুন্দরী ভাবুক, তার একাকিত্ব দূর করুক। বাস্তবে যেহেতু ছিল না তা-ই কল্পনায় তাকে আঁকতো।
ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্টর হলো ম্যাক্সিমাম এমন কেসে কোনো কাল্পনিক চরিত্র তৈরি হলে সে আরও ভিক্টিমকে সুইসাইডের দিকে ধাবিত করে, কিন্তু সামিয়ার ইলিউশান, হ্যালুসিনেশন তাকে অনুপ্রেরণা দেয় বেঁচে থাকার। ও খুব শিঘ্রই সুস্থ হতে পারে, কারণ ও জানে এটা কল্পনা। অনেকে মানতে চায় না, তাদের হ্যান্ডেল করা মুশকিল। তবে ও মানলেও, আসলে ও চায় অসুস্থ থাকতে।
অসুখটা ওর প্রিয় হয়ে গেছে বুঝলে, প্রিয় অসুখ। ওর কাছে নিজের বাস্তবতার চেয়ে বেশি কল্পনাটাই বা অসুখটাই সুখকর লাগে। কোনো ভাবে যদি মেয়েটার বাস্তবতা শুধরানো যেতো তবে হয়তো…”
বেশ কতক্ষণ লাগিয়ে কথাগুলো বলে থামেন তিনি। গলাটা শুকিয়ে আসছে, পানি পানের দরকার। খাণিক পানি পান করে পুনরায় বলেন,
“ও যে নিজেই চায় না সুস্থ হতে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ও আমার দেওয়া ঔষধগুলো খায়নি। ওর চোখ লাল, রাতে ঘুম হয় না খুব একটা। কোনো পিলস্ খায়নি, যে নিজে অসুখে জড়িয়ে থাকতে চায় তাকে কী করে সুস্থ করব?”
সব শুনে ভাবুকই হয় আবরার। তাকে আরও ভাবনায় ডুবাতে সায়রাজ কবির বলেন,
“সবই তো শুনলে তুমি। আমার মেয়ের অবস্থা নিয়ে কোনো লুকোচুরি করতে চাই না। তুমি ভেবে বলো তুমি কি এখনো সম্পর্কে জড়াতে চাও ওর সাথে?”
___
‘সামিয়া হাঁটছে, চারদিকে ফুলের বিছানা ছেয়ে আছে। হঠাৎ একজোড়া পুরুষালি হাত এসে তার চোখজোড়া বদ্ধ করল। যুবতী উত্তেজিত হয়ে “কাব্য” বলে চেঁচিয়ে পুরুষটিকে জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু পরক্ষণেই হাত সরিয়ে ফেলে। না, এই পুরুষ কাব্য হতে পারে না। কাব্যের শরীরে কোনো সৌরভ নেই, কোনো উষ্ণতা নেই। তবে এই দেহে আলাদা ঘ্রাণ আছে, নিজস্ব এক উষ্ণতা আছে, যা তাকে পুড়াচ্ছে। কে সে?’
গাড়ি-ঘোড়ার শব্দে সজাগ হয়ে উঠে সামিয়া। পুরোপুরি জাগতেই বুঝতে পারে স্বপ্ন দেখছিল সে এতক্ষণ। পাশের টেবিল তাকাতেই এক গ্লাস পানি দেখতে পায়, দ্রুতো পান করে সে।
নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে অবাক হয় না, সেদিনের ঘটনার পর এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না, সামিয়া জানে নিজেকে। প্যানিক এ্যাটাক তার আসারই ছিল। এটা আত্ম উপলব্ধি বলা চলে।
চলবে…
#Ipshita_Shikdar
#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||৭ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আবরার সবকিছুর মাঝে একটা বিষয় কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। তা হলো, সামিয়া তো কালো বা শ্যামাও নয়, বরং বেশ উজ্জ্বল বর্ণের, তবে আলিফা খাতুন এমন আচারণ করতেন কেন? নিজের মনের কৌতূহল, প্রশ্ন চাপিয়ে না রাখতে পেরে সিদ্ধান্ত নেয় সরসরি তাকেই জিজ্ঞেস করবে সে।
আলিফা খাতুন সবে যোহরের নামাজ পড়ে আল্লাহর নামের জিকির করছে। হাসপাতালের ছোট্ট নামাজ ঘর, ফিনাইলের অপ্রীতিকর গন্ধে বারবার মনযোগ হারালেও ইবাদতে মশগুল থাকার প্রচেষ্টায় সে।
“আসতে পারি?”
দ্বিধা জড়ানো প্রশ্ন আবরারের। আলিফা খাতুন তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় সায় জানায়। নিজের পড়া শেষ করে বলেন,
“জুম্মার নামাজ পড়েছো?”
“হ্যাঁ। কিছু কথা বলতে এসেছিলাম যদি ব্যস্ত না থাকেন।”
“হুম, বলো। আমি শুনছি।”
আবরারের মাঝে জড়তা, কোথা থেকে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকটা ভেবে সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করে ফেলে,
“সামিয়া তো কালো নয় বা শ্যামাও নয়। বরং, একেবারে ফর্সা নাহলেও উজ্জ্বল বর্ণেরই মেয়ে। তবে মেয়েটার সাথে এমন আচারণ… যদিও আঙ্কেল বলেছে আপনি সামিয়ার বর্তমান অবস্থার বিষয়ে কিছু জানেন না, কিন্তু আমি গতকাল আপনাকে আয়নায় দরজার পাশে দেখে ফেলেছিলাম।”
ছোট্ট এক শ্বাস ফেলেন আলিফা, তার দেহ থেকে নির্গত উত্তপ্ত বায়ুতে জড়িয়ে আছে অনেক না বলা কথা, আক্ষেপ, কিছু চাপা কষ্ট।
“আমি ফর্সা হলেও আমার বোন ছিল পূর্ণরূপে কৃষ্ণকলি, আব্বা সখ করে তার নাম রেখেছিলেন রাত্রি। সবার ছোট বলে রাত্রি রে আব্বা-আম্মা বেশ আদরে রাখতেন। রাত্রি ধীরে ধীরে বড় হলো আমার বিয়ে হলেও ওর বিয়েতে নানা ঝামেলা। পাত্রী দেখতে আসলেই একটা না একটা তিক্ত বাণী শুনাই লাগতো। কেউ বলতো এ তো মেয়ে না পাতিলের কালি, তো কেউ এত ময়লা হলে তো হবে না, আর কেউ রাজি হলেও আমাদের সামর্থ্যের বাইরে পণ দাবী করত। আমার বোনও এসব দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
যেই আব্বা-আম্মার চোখের মণি ছিল সে, সেই আব্বা-আম্মারই বোঝা হলো সে। তার চোখের অশ্রু, হৃদয় ভরা যন্ত্রণা সবই আমার এই দুই নয়নে ধরা পড়তো। কিন্তু এই যন্ত্রণা প্রশমিত করার উপায় যে ছিল না, আমি কি চাইলেও পারতাম তার রঙ পরিবর্তন করতে কিংবা লোকের নজরে তাকে সুন্দরী বানাতে। শুধু মাঝেসাঝে মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, তোর জন্যও রাজকুমার আসবে, দেখিস।
একদিন আব্বা কল দিয়ে জানায় রাত্রি বাড়ি নাই। নিজের কাজ ফেলে দৌঁড়ে যাই বাপের বাড়ি। পরে শুনি বোন না কি ভেগে গেছে মোড়লের সাথে না কি… মোড়ল এক অকর্মা, অভদ্র, নেশাগ্রস্ত ছেলে; তার উপর সারা গ্রাম ছেয়ে গেছে এই ঘটনা। আব্বা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। তবুও দুই মাস পর রাত্রি স্বামী নিয়ে গ্রামে ফিরলে মেনে নেয়। এরপর শুরু হয় এক নতুন যন্ত্রণা।
মোড়লের মা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না আমার কালা বোন রে। নানা ধরনের অত্যাচার, খাওয়ার কষ্টতেই শেষ হয়ে যায় আমার বোনটা। অপুষ্টিতে দুই মাসের বাচ্চা গর্ভে নিয়ে মাটিতে শোয়ায় আসা হয় আমার রাত্রি রে।”
বলতে বলতে কণ্ঠে কেঁপে উঠছে আলিফা খাতুনের। একটু জল হলে ভালো হতো, তবে আশেপাশে যেহেতু নেই, তাই ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়েই আবার বলতে শুরু করেন সে।
“আনোয়ারা আম্মা যখন বলল মেয়ে অসুন্দর হবে আর কপালে অনেক কষ্ট আছে, বিশ্বাস করো আমার রুহু কেঁপে উঠেছিল সেদিন। আমার বোনের কষ্ট আমি দেখেছি। বলো তো কী! সমাজের জন্য মেয়েদের হওয়া লাগে পার্ফেক্ট। না মোটা, না চিকুন, না কালো।
প্রতিটা পাত্রের পরিবার যখন তাদের কথার তীর ছুঁড়ার পর তার টলমলে চোখ আমি দেখেছি, তার দেহে স্বামীর মারের দাগ শাশুড়ির না খেতে দেওয়ায় রুগ্ন দেহ সবই আমি দেখেছি। সন্তান…? সন্তান বড় কষ্টের! এত যন্ত্রণার ফলে পাওয়া সন্তানকে কি কষ্ট পেতে দেওয়া যায়? আমি চাইনি সামিয়া কোনো কষ্ট পাক।
ওর গায়ের রঙ ময়লা নয়, তবুও ভয় লাগতো। তাই নানা রূপচর্চা করতে বলতাম জোর দিয়ে, এমন রঙ পরতে দিতাম না যাতে ওকে কালো লাগতো। যদি মোটা হয়ে যেত শুনতে হতো, কোন গুদামের ভাত খাস, মোটি, হাতি আরও কত কী! তাই পছন্দের ভাজা-পোড়া বা বেশি চর্বিযুক্ত খাবারগুলো দিতাম না বললেই চলে।
শাসনে রাখতাম বড়, সবসময় চোখে চোখে রাখতাম, যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় রাত্রির মতোন, ভুল লোকের সাথে সম্পর্ক জুড়ে বসে… তাছাড়া কথায় আছে অতি আদরে তাঁতি নষ্ট, আমি তা চাইতাম না। সবটাই ওর ভালোর জন্য করতাম। কিন্তু হলো কী বলো তো? মেয়েটা দুইদিনের এক ছেলের জন্য আমার হাত ছাড়লো।”
মুখে বিদ্রূপমাখা হাসি ভদ্রমহিলার। আবরারের চোখ-মুখ কুঁচকে আসে। বিরক্তির সুরে বলে,
“বেয়াদবি নিবেন না আন্টি, দোষটা আসলে সামিয়ার না, অনেকটাই আপনার। শাসনের সাথে যে ভালোবাসা দেখাতে হয় তা ভুলে গিয়েছিলেন। মেয়েটা সারাদিন শুধু পেতো আপনাকে, অথচ আপনি শুধু মেয়েটাকে বকাবকি আর আদেশ-উপদেশেই রেখে গেছেন। কখনো জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন ভালোবাসি আম্মুটা, কখনো কপালে স্নেহ মেশানো চুমু খেয়ে বলেছিলেন ইউ আর মাই প্রিন্সেস, বলেছিলেন যত যা-ই হোক সবসময় পাশে থাকবেন? বলেননি।
বস্তুত, আপনাদের অবহেলা পেয়েই সে বাসার বাইরে নিজের একাকিত্ব কাটানোর সঙ্গী খুঁজতে বেড়িয়েছে। আর সেখানেই হয়তো ভুল মানুষের জীবনে পা দেয় সে। তাই বলে দোষটা তার একার ছিল না। আর কী বললেন? আপনার বোনের কথা? তার অবস্থার কারণ ছিল সমাজ ও তার শ্বশুড়বাড়ি, আর সামিয়ার অবস্থার জন্য দায়ী আপনি। ওর ভালো করতে যেয়ে অনেকাংশই ক্ষতি করে ফেলেছেন…”
খক্ খক্ শব্দে মাঝপথেই কথা থামিয়ে দেয় আবরার। আলিফা খাতুনেরও ঘোর ভঙ্গ, তিনি এতক্ষণ আবরারের তিক্ত বাণী গলাধঃকরণ করছিলেন। দুজনে দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলতেই দেখেন সায়রাজ কবির দাঁড়িয়ে। আবরার কিছু না ভেবেই বলে উঠে,
“আঙ্কেল, আমি সামিয়াকে বিয়ে করতে চাই আজই। কাজি ডাকান। তবে এই বিয়ের বিষয়ে কাউকে জানাইয়েন না আর।”
সায়রাজ কবির মন্ত্রমুগ্ধা হয়ে সায় জানায়। বলা বাহুল্য, তিনি মনে মনে বেশ খুশি আবরারের কথাগুলো শুনে কারণ এমনই এক রাজপুত্রের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি সামিয়ার জন্য।
___
সামিয়া স্তব্ধ হয়ে বসে আছে শয্যায়, কয়েক মুহূর্ত পূর্বেই তাকে বাসর ঘরে রেখে গিয়েছে তার কিছু কাজিন ও নিশা। সামিয়ার সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। ঘণ্টা খাণেক আগেই তার বিয়ে হয়েছে। কার সাথে হয়েছে সে জানে না, কারণ গভীর ঘোরে ডুবে থাকায় কাজীর বচনও সে শুনতে পায়নি, বাবার ডাকে শুধু কবুল টুকুই বলেছে। তার জানার ইচ্ছেও নেই। বরং, অজানা এক ঘোরে ডুবে আছে, নিস্তব্ধতা তাকে গ্রাস করছে।
নিশা এসে যা জানালো তাতে সে আরেকদফা ভেঙে চুরমার।
“শোন সামি, তোর বর মানে আবরার সাহেবের নাকি জরুরি কাজ পড়েছে তাই আসতে পারবে না। আসলে বল তো কী কাজ না ছাই! সব দূরে যাওয়ার ধান্দা, এত সুন্দর ছেলে কী আর এমন অসুখে বদসুরত মেয়ে চায়! নিতান্তই আঙ্কেলের চাপে হুট করেই কাজটা করে বসেছে সে। তুই মন খারাপ করিস না! মানিয়ে নে।”
এই কয়েকদিন টানা হাসপাতালে ট্রিটমেন্টে থাকায় তার বিপি এবং সবকিছুই অনেকটাই নর্মাল। তাই নিশার বিষাক্ত কথা কষ্ট হলেও গ্রহণ করে ফেলে সে। তাছাড়া এমনটাই আশা করছিল সামিয়া। মনে মনে ভাবে,
“তার মানে ঐ সুদর্শন যুবকের সাথেই বিয়ে হয়েছে আমার। ঠিকই আছে কোথায় সে…”
তখনই টুং শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হয় তার, ফোন হাতে নিয়ে দেখে অজানা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ।
“ঘুমিয়ে পড়ুন, আধ ঘণ্টা পরই একটা সার্জারি করতে হবে আমার। তাই আজ থাকতে পারলাম না।”
বুঝতে পারে এটা আবরারের নম্বর। তাচ্ছিল্যের হাসির ঝংকার দেখা দিল যুবতীর মুখশ্রীতে। অন্যসময় হলে সে আর মুখোমুখি হতো না জটিলতা বাড়ার ভয়ে। কিন্তু আজ কেন যেন ম্যাসেজ দিয়েই ফেলল,
“মিথ্যে না বললেও পারেন, আমি রাগবো না।”
“আশ্চার্য মিথ্যের কী হলো! কাল তো ভালোবাসি বললেও বলবেন নাটকীয়তা বাদ দাও। আপনারা মেয়েরাও না…”
“বাবার চাপেই তো বিয়ে করেছেন আমার। ভালোবাসা নেই, শুধুই দায় এখানে। জানি বলেই বলছি।”
ভার মন নিয়েই আবরার টাইপ করল,
“চাপ মোটেও ছিল না। আপনার বাবার কাছে এমন কোনো হাতিয়ারই ছিল না যা দিয়ে আমায় চাপ দিবে।আচ্ছা, ধরেন বললাম, ভালোবাসি, ভালোবাসা থেকেই সব তবে?”
“যা হওয়ারই নয় তা ধরবো কেন? তাছাড়া ‘ভালোবাসা’ বড্ড ভারী শব্দ, এটুকু সাক্ষাতে তার ব্যবহার বোকামি ছাড়া কিছুই না। আর ভালো তো আমিও বাসি, তবে অন্যকাউকে। খুব বেশি, পাবো না, পাওয়ার নয় জেনেও।”
“সে যে কল্পনা। আমি বাস্তবতা আপনার।”
চোখ-মুখ শক্ত আবরারের। অনেকটাই আপন করে নিয়েছে সে সামিয়াকে। সেই প্রেয়সীর মুখে অন্য পুরুষের নামও বিষাক্ত তীরের মতো লাগে বুকে, ছিদ্র ছিদ্র করে দেয় ভিতরটা, যতোই হোক সে কাল্পনিক চরিত্র।
“উহু কয়েকদিনের সঙ্গী আপনি আমার, সে চিরদিনের। এক লোকের বেশ বড়সড় ভয়ানক রোগ হলো, শরীর থেকে মাংস পচে পচে পড়তে লাগল। এমন অবস্থা দেখে আত্মীয়, আপন, স্বজন মানুষগুলো ভয়ে ছেড়ে চলে গেল। অথচ, তার অসুখ তাকে ছাড়েনি মৃত্যুর আগ অবধি ছিল, তার সাথেই শেষ হয়েছে। অসুখগুলো এমনই হয়।”
বিপরীতে আবরার কিছু বলবে তার আগেই একজন এসে জানায় অপারেশন শুরু হতে চলেছে। মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে ফোন হাত থেকে রেখে দেয় সে। সামিয়াও আর কোনো ম্যাসেজ না পেয়ে হতাশ হয়, হয়তো লোকটার তার উপর থেকে আশা ছেড়ে দিয়েছে নাহয় বলার কিছু পায়নি।
রাত প্রায় তিনটে, আবরার দরজায় করাঘাত না করেই সোজাসুজি ঢুকে পড়ে। ঢুকে কিছুটা ভ্রুঁ কুচকে যায় তার, এমন নয়া বউ যে আজ প্রথমই দেখলো। আনমনেই তার মুখ থেকে নিচু গলায় নির্গত হয়,
“নাউজুবিল্লাহ! এর লোমে লোমেই যে সর্বনাশ লুকিয়ে আছে আমার।”
সামিয়ার লেহেঙ্গার আঁচল স্থান ছাড়িয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে ধূসরা মেঝেতে, চুলের বেণী অর্ধাংশ খোলে এদিক-ওদিক উড়ছে, নীল কাজলের কথা নাই বলা হলো, সে তো সবসময়কার ন্যায় ল্যাপটানো। সামিয়া হাত-পা বিছিয়ে শুয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে। কানের দুলটা খুলে দরজার দিকে ছুঁড়ে মারতেই আবরারের বুকে লাগে তা। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দেয় সে।
লাজুক চোখে বালিশ দ্বারা নিজেকে ঢেকে নিয়ে চটজলদি আঁচলে দেহে তোলে। তারপর মেঝেতে পা দিয়ে আঁচড় কাটতে কাটতে আমতা আমতা ভাব নিয়ে বলে,
“আসলে অনেক অস্থির লাগছিল তো, তাই আর কী। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম, আমার মতোন মেয়ের সাথে শুতে আপনি আসবেন না।”
“আপনার মতো মেয়ে মানে?”
কিছুটা গম্ভীর হয় সামিয়ার মুখভঙ্গি। স্পষ্ট কথাবার্তা তার।
“আমি জানি আপনি আমায় চাপে নাহলেও করুণা করে বিয়ে করেছেন। আমার মতোন মেয়েকে কেউ ভালোবাসাবে তা তো নিতান্তই এক দুর্ভাবনা। আমি কুৎসিত, শ্রী হীন তা আমি…”
বলতে বলতেই তর্জনী দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে আবরার। রিনরিনে গলায় শুধালো,
“না, না, এত কথা নয়। তুমি বড় বেশি বলো আর এই দুটো অতিরিক্তই নড়েচড়ে বুঝলে? একদম কড়া রৌদ্রেও কচি তরুলতা যেমন দুলে হরিণের চিত্তে লোভ জমায় তা গ্রহণের, ঠিক তেমনটাই লোভ জমায় আমার বুকে এ দুটো।”
সামিয়া কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে শুধু। এমন ভাবে কেউ কভু তার প্রশংসা করেনি। হুট করেই খেয়াল করল, তার বুকটা ধড়াস ধড়াস শব্দ করছে। কিন্তু কেন? ওনেক খুঁজেও প্রশ্নটার উত্তর পেল না।
“ভাবাভাবি বাদ দাও, ওজু করে আসো নামাজ পড়া লাগবে না না কি?”
আবরার জায়নামাজ বিছাতে বিছাতে বলল। সামিয়া কিছু না ভেবেই ওজু করে এসে নামাজ পড়ে নিল। সালাত শেষে আবরার সোজা বিছানায় যেয়ে পটলের মতো পড়ল, আর সাড়া নেই তার। এর আগে জায়নামাজ ভাজ করতে করতে শুধু দুই খানা বাক্যই বলেছিল নিজের প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে,
“নিজেকে এতও ছোট কোরো না নিজের চোখে, হয়তো কারো নিকট তুমি তার মাথার তাজ হতেও বেশি কিছু। যদি এতোই নিজেকে শ্রী হীন মনে হলে নিজের পা দুটো একবার আলতা রাঙিয়ে দেখো কিংবা নিজের কাজল রাঙানো চোখের গভীরত্ব মাপার চেষ্টা কোরো। মায়ায় যদি না পড়ো নিজের তবে তুমি অন্ধ! বড়োই অন্ধ!”
আবরার তো ঘুমালো কিন্তু সামিয়ার সারাটা রাত্রি কাটলো বিস্ময়কর সব ভাবনায়। রাতের তিনটের দিকে তার কী হলো কে জানে? সত্যিই আলতায় পা সাজাতে বসে পড়ল সে। অথচ, জীবনের কোনো পর্যায়েই তার আলতা রাঙাতে ইচ্ছে হয়নি একদম।
চলবে…