#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
পূরব সবেমাত্র বাইরে থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে ডিভানের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলো। জিসান ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চেয়ারে বসলো। পূরব স্যালাড চামচে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘কখন ফিরলি?’
‘এইতো আধঘন্টা হবে হয়তো।’
‘কাজ হয়েছে?’
‘হুম। ওখানকার ম্যানেজারকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। ওনার খুব ইচ্ছে তুই নিজে গিয়ে যাতে সবকিছু দেখে আসিস।’
‘সময় হলে যাওয়া যাবে! আপাতত শিডিউল.. ‘
‘তোকে একটা বিষয় জানাতে এলাম।’
পূরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী?’
‘তোর মনে আছে সেহেরের কথা? আরে যে মেয়েটা তোকে চোর বলেছিল?’
পূরব প্রায় সাথে সাথেই মনে করতে পারলো। স্যালাডের বাটিটা রেখে বলল, ‘কী হয়েছে ওর?’
‘ওর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে এলাম।’
‘তা কী জানতে পারলি?’
‘খুবই করুণ ঘটনা।’
‘বল। এভাবে কথা প্যাঁচিয়ে বলবিনা, যা বলবি স্ট্রিক্ট বলে ফেল।’
‘আসলে সেহের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো।’
‘ছিলো মানে? এখন নেই?’
‘পুরো কথাটা তো শোন।’
‘হ্যাঁ শুনছি!’
‘তো ছোটবেলায়ই ওর বাবা-মা মারা যায়।’
পূরব ওকে থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আই মিন ওর কেউ নেই?’
‘হুম।’
পূরব কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। এই কথাটা ও মানতে পারছেনা কিছুতেই। তবে কী সেহেরের সঙ্গে ও অন্যায়ই করেছে? চাকরিটা দেওয়া উচিৎ ছিল কী? ওফ..
জিসান বলতে লাগলো, ‘তারপর ওর জায়গা হয় চাচার বাড়িতে। সেখানে ওর চাচী সংসারের সব কাজ করাতো ওকে দিয়ে। খুব টর্চার করতো, তারপরও সেহের নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে। বৃত্তির টাকা দিয়ে নিজের কাজ চালিয়েছে। এমনিতে খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এই হিংসায় ওর চাচী ওর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে ওকে নিজের কাজের লোক বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। টাকার লোভে জোর করে এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। ওকে রাজি করানোর জন্য দু’দিন ঘরে বন্দী করে অকথ্য নির্যাতনও চালিয়েছে৷ পরে ওর বান্ধবীরা খবর পেয়ে ওকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। চাচা-চাচীকে পুলিশের ভয় দেখায়। এরপর ওর চাচী সেহেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং বলে দেয় যে, ওই সংসারে ওর কখনো জায়গা হবেনা। পারলে ফুটপাতে গিয়ে ঘুমাক, ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খাক, তবু্ও ওর দায়িত্ব ওরা নিবেনা। আত্মসম্মানের জোরে সেহের এক কাপড়ে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এখন টিউশনি করেই নিজের খরচ চালাচ্ছে। এজন্যই সেদিন তোর ওখানে কাজ খুঁজতে গিয়েছিলো, কিন্তু সেখানে তুচ্ছ একটা কারণে ওর চাকরিটা তুই দিসনি। এখন এভাবেই খুব কষ্টে ওর দিনকাল চলছে।’
পূরব সেহের সম্বন্ধে এসব শুনে হতভম্ব। এটাও হওয়ার ছিল? আজকালকার দিনে চাকরি করেও যেখানে সংসার চালানো যায়না, সেখানে টিউশনি করে খরচ চালানো? ও মাই গড! তাও আবার একটা ভার্সিটির! খানিক চুপ থেকে বলল, ‘তোকে এসব কে বললো?’
‘ওর বান্ধবী শেফার কাছ থেকে জেনেছি!’
‘ওহহ!’
ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরছিলো সেহের। গাড়ি ভাড়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা হাতে না থাকায় ঠিক করলো হেঁটেই বাড়ি পৌঁছাবে। কাঠফাটা রোদ্দুরে ছেয়ে আছে রাস্তাঘাট। সূর্যদেবের তপ্ত নিঃশ্বাসে রুক্ষ হয়ে আছে সবকিছু। ঘামে ভেজা কপাল ওড়না দিয়ে মুছে ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে হাইওয়ে পর্যন্ত পৌঁছে। সেখানে রাস্তা পার হওয়ার সময় দেখলো একটা লোক ওপাশ থেকে রাস্তা পেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, যেই না রাস্তার মাঝখানে পৌঁছেছে তখনই বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগামী একটি ট্রাক চলে এলো। লোকটি তা দেখতে পেলোনা। ঘটনাটি দেখে সেহেরের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। সাত-পাঁচ না ভেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকটিকে তড়িঘড়ি করে টেনে নিয়ে এলো ফুটপাতে। লোকটি নিজেকে সামলে নিলেও সেহের গিয়ে বারি খেলো গাছের সাথে। হাত-পা ছিলে, পা মচকে গেলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সেহের। লোকটি ওর কাছে গিয়ে মাটি থেকে ওকে তুললো। সেহের চোখে পানি নিয়ে অবাক হয়ে তাকালো লোকটির দিকে। এতো স্বয়ং ইরফান আহমেদ! এতোদিন শুধু টিভিতে দেখছে, আজ সরাসরি! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না সেহের। পায়ের ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। ইরফান সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথাও লেগেছে তোমার মা? আমি খুবই দুঃখিত!’
সেহের একটু হাসলো। বলল, ‘না স্যার। আমি ঠিক আছি। আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমি এটা বিশ্বাসই করতে পারছিনা!’
‘একথা বলে লজ্জা দিও না মা। আমার খামখেয়ালিপনার জন্য তোমার বড় কোনো ক্ষতি হতে পারতো।’
সেহের মনে মনে বলল, তাহলে তো ভালোই হতো। মরে গেলে আর টেনশন থাকতোনা। বাবা-মায়ের কাছে চলে যেতাম। কারোর বোঝা হতাম না। কেউ আমাকে ছোট নজরে দেখতো না। ভালো থাকতাম তাহলে! কিন্তু মুখে একটা কথাও বললোনা। ইরফান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথাও যাচ্ছিলে?’
‘জি। বাসায় ফিরছিলাম।’
‘পড়াশোনা করো?’
‘জি।’
‘কীসে পড়ো?’
‘সেকেন্ড ইয়ারে। সাইকোলজির স্টুডেন্ট আমি।’
‘কোন ভার্সিটির স্টুডেন্ট?’
‘টিউলিপ ইউনিভার্সিটি।’
এভাবে আরও নানা কথাবার্তা হলো ইরফান আহমেদের সাথে। সেহেরের ব্যবহার এবং নমনীয়তা দেখে ইরফান সাহেবের খুব পছন্দ হলো। কত ভদ্র, ভালো একটা মেয়ে। আজ যদি মেয়েটা না থাকতো তাহলে হয়তো এতক্ষণে গাড়ির নিচে পিষ্ট হয়ে পড়ে থাকতো। আজই খুলনা থেকে কাজ সেরে ফিরেছেন তিনি। সাথে গাড়ি, ড্রাইভার আছে। কিন্তু একটা কাজে এখানে নামতে হয়েছিলো ওনাকে। কাজ শেষে রাস্তা
পার হতে গিয়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে চলেছিলো। ভাগ্যিস মেয়েটা এসেছিলো। সেহেরকে ওনি পানি খেতে দিলেন, মেয়েটাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সেহের ইতস্তত করছিলো। কত বড় একজন মানুষ তিনি, আচার-ব্যবহাত খুবই ভালো। অথচ ওনার ছেলে, ওই পূরব না টূরব নাম! যেন আগুনের গোলা, কিছু বলাই অন্যায়! সেহের ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিতে হেলে ইরফাব সাহেব নিজে ওকে বাসায় পৌঁছে দেন। যদিও সেহের সেটা চাচ্ছিলো না। ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ইরফান সাহেব চলে গেলেন গাড়ি নিয়ে। লোকটাকে ভীষণ ভালো লেগেছে ওর।
বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের রান্না সেরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সেহের। বিকেলের দিকে ওর রুমমেট সুমা আর শিলা গ্রাম থেকে ফিরে এলো। শিলা এসেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে নাকি আজ ব্যবসায়ী ইরফান আহমেদের সাথে দেখা গিয়েছে? বাহ! তুমিতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছো!’
সেহের কথাটার মানে বুঝতে পারলোনা। সুমা আর শিলা ওকে একটা ভিডিও দেখালো। সেখানে ইরফান আহমেদেকে এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচানোর ক্লিপটা দেখা যাচ্ছে। সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ আর নতুন কী? বড় বড় মানুষের সাথে এরকম ঘটনা ঘটবে তা তো স্বাভাবিকই। তবুও সেখানে নিজেকে একদমই মানাচ্ছেনা তার। সে তো ভাইরাল হতে চায়নি, একটা মানুষকে বাঁচিয়েছে সে। এটাতো ওর দায়িত্ব! যাইহোক, এ বিষয়টা নিয়ে সেহের আর ভাবলো না। সুমা আর শিলা ওর সাথে আজ খুবই ভালো ব্যবহার করলো। এমনকি রাতে নিজেদের খাবারের ভাগও দিলো। রাতে অনেক গল্প করলো৷ সেহের ভাবলো ওদের কী হয়েছে? হঠাৎ করেই এতো আদর-আপ্যায়ন, স্ট্রেঞ্জ! ওই ভিডিও দেখেই ওদের মন গলে গেলো? হা হা।
রাতের মেঘযুক্ত আকাশ! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেহের। মনটা আজ বেশ উৎফুল্ল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ও অনুভব করতে পারলো, এই বিশাল পৃথিবীতে কেউ একা নয় । কারো না কারোর সাথে মানুষের একটা যোগসূত্র থাকে। এই যে, আকাশের সাথে সেহেরের একটা যোগাযোগ আছে। ওর মনের সব অব্যক্ত কথামালা আকাশ জানে। এই বিশাল আকাশটাই ওকে ছুঁতে চাওয়ার প্রেরণা যোগায়, সবাইকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়, আর তা বাস্তবে রূপায়িত করার অনুপ্রেরণা দেয়! ওর সুখ, দুঃখ সবই আকাশের ডাকবাক্সে জমা আছে। তাই আকাশ একাধারে মানুষের দুঃখের সঙ্গী এবং সুখেরও সাথী।
ইরফান সাহেব বাসায় ফেরায় পূরব আজ জমজমাট ডিনারের আয়োজন করেছে। তাঁর বাবার এক্সিডেন্টেত বিষয়টা পুরোটাই শুনেছে এবং ভিডিও দেখেছে। কোনো এক পথচারী হয়তো ঘটনাটা ফোনের ক্যামেরায় রেকর্ড করে নেটে ছড়িয়ে দেয়। সেহেরকে চিনতে ওর একটুও ভুল হয়নি। বরং অবাকই হয়েছে। পূরব ইরফান সাহেবের সাথে খেতে খেতে নানা দরকারি আলাপন সেরে নিলো৷ সেখানে জিসান প্রস্তাব দিলো ওদের কোনো একটা অফিসে বা রেস্টুরেন্টে যদি সেহেরকে চাকরি দেওয়া যায়! ইরফান সাহেব তখনোই রাজি হয়ে গেলেন। মেয়েটি তার জান বাঁচিয়েছে, কিছু একটা করে মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারলে ওনারও খুব ভালো লাগবে। ইতোমধ্যে জিসান সেহেরের সম্পর্কে যেসব তথ্য জানে তা জানালো ইরফান সাহেবকে। ওনি বেশ দুঃখই পেলেন। পূরব সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। এসব বিষয়ে বারবার আলোচনা ভালো লাগেনা, এসব বড্ড বিরক্তিকর! অসহ্য!
কেন ছোট হচ্ছে জিজ্ঞেস করবেন না দয়া করে! ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭
সেহেরের কাছে এই প্রস্তাব রাখা হলে ও সোজাসুজি না করে দিলো। দরকার হলে না খেয়ে থাকবে তবু্ও ওই বজ্জাত সেলিব্রিটির কোনো দয়া সে নেবেনা। এখন কেন চাকরি দিতে চায়? যখন ওর প্রয়োজন ছিলো তখন তো দেয়নি, এখন তাঁর বাবাকে বাঁচিয়েছে সেজন্য কি মূল্য পরিশোধ করতে চায়? লোকটা কী জানে মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মূল্যবান কাজের কোনো পুরষ্কার হয়না! জিসান নিজে এই প্রস্তাব নিয়ে ওর বাসায় এসেছিলো৷ কিন্তু সেহের ওকে না করে দিয়েছে। সুমা, শিলা বেশ অবাক হলো। এতবড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি? ওরা হলে অফারটা কখনোই ফিরিয়ে দিতোনা৷ যতইহোক, ওরা বেশ বড় পজিশনের লোকজন! ওদের সাথে কাজ করতে পারলে আর কোনো চিন্তা করার দরকারই ছিলোনা। সেহের মেয়েটা কী বোকা, ইশ! তবে স্বীকার করতে হবে, সেহের মেয়েটা ভালো।
ভার্সিটি শেষে সারাদিনে পাঁচটা টিউশন সেরে বাসায় রওয়ানা দিলো সেহের। হেঁটে হেঁটে ফিরছে। এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। শেফার ফোন।
‘হ্যালো হ্যালো।’
‘হ্যাঁ বল শুনছি।’
‘তুই নাকি পূরব ভাইয়ের দেওয়া চাকরির অফার না করে দিয়েছিস? কেন না করলি?’
‘বুঝলি না? আমাকে দয়া দেখাতে আসছে। আমার ওসবের দরকার নেই। দরকার হলে না খেয়ে থাকবো তবুও ওই লোকের দয়া আমি নেব না।’
‘কিন্তু তোর তো একটা চাকরি পাওয়া ভীষণ জরুরি। এভাবে তো আর চলেনা সেহের। সুযোগ বারবার আসেনা রে।’
সেহের বলল, ‘শোন, ওনাকে আমি মনুষ্যত্বের খাতিরে বাঁচিয়েছি। বাঁচানোর আগ অবধি আমি জানতাম না ওনি ইরফান সাহেব। আমি কোনো আশা রাখিনি, সাধারণ মানুষ ভেবেই হেল্প করেছি কিন্তু এর বিনিময় আমি কি করে নেই? আমাকে জোর করিস না প্লিজ। এতোদিন তো কষ্ট করেছি, আরেকটু না হয় করি। তবুও নিজের যোগ্যতায় আমি একটা কাজ পেতে চাই।’
শেফা হতাশ গলায় বলল, ‘তুই না আসলে একটা বোকা মেয়ে..’
‘বোকা কিনা জানিনা। কিন্তু ওই পূরবের কিছুর সাথে আমি জড়াতে চাইনা।’
‘পূরব ভাই কিন্তু ততো খারাপও নয়।’
সেহের ধমকে বলল, ‘তোর ভাই লাগে? বারবার ভাই ভাই বলিস কেন?’
‘মুখ ফসকে চলে আসে। ওনার চেহারাটা দেখতে ভাই ভাই লাগে!’
সেহের হেসে ফেললো। আরও প্রয়োজনীয় কিছু কথাবার্তা সেরে রাতের রান্নাটা করে নিলো। সুমা, শিলাও এখন ওর সাথে খায়। যাইহোক, তিনজন মিলে রাতের খাবার শেষ করে স্টাডি টেবিলে বসে পড়লো। সেহের নিজের ঘরে বসে পড়ছে৷ ওর টেবিলটা জানালার সাথে লাগোয়া৷ ওখান থেকে রাস্তাঘাট দেখা যায়, চায়ের দোকান দেখা যায়৷ তারপরই আছে একটা খাল। মূলত ওটা বুড়িগঙ্গা নদীর একটা অংশ। এখান দিয়েই প্রবাহিত হয় নদীর পানি। রাতের আকাশে উঠা মস্ত বড় গোল চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে পানিতে। সেখান থেকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে পানিতে। দেখতে খুবই মোহনীয় লাগছে৷ বৃষ্টি হলে ভালো হতো৷ সেহের বইয়ে মনোযোগ দিলো। পড়তে পড়তে একসময় চোখটা লেগে এলো। মাথাটা হেলে পড়তেই গ্রিলে বারি লাগলো। সেহের চমকে উঠলো। জানালার বাইরে দৃষ্টি পড়তেই দেখলো পূরব সেদিনের মতো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে কেউ নেই। মাথায় কালো হ্যাট। দু-হাত ভাঁজ করে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেহেরের বুক ধুকপুক করছে। এই লোকটা কী রাত-বিরেতে ওকে চমকে দিয়ে মেরে ফেলতে চায় নাকি? এখানে কীসের প্রয়োজন আর সেহেরকে জ্বালাচ্ছেই বা কেন? উফ…
দু-তিনদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পরেও সেহের খেয়াল করলো পূরব প্রতিদিন রাতে এসে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো ব্যাপারটা সেহের শেফা আর রিমিকে জানালে ওরা হেসেই উড়িয়ে দিলো, কিন্তু শেফা জিসানকে জিজ্ঞেস করার পর এই ঘটনা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো। ওর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা সুমা আর শিলাও খেয়াল করলো। পূরবের মতো ম্যাচিউরড এবং স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ীর এরকম আচরণ এরকম হতে পারে তা কেউ মানতেও পারলোনা। এটাতো ষোলো বছর বয়সী কিশোরের আচরণ, প্রেমিকাকে একনজর দেখার জন্য রাত-বিরেতে এভাবে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, কাউকে তোয়াক্কা না করা!
এটা নিয়ে সুমা, শিলা ওরা যখন হাসাহাসি শুরু করে দিলো তখন সেহের ভীষণ রেগে গেলো। পেয়েছেটা কী ওই পূরব? যা খুশি তা-ই করে ওকে হ্যারেজ করবে? আজ আচ্ছামত একটা শিক্ষা দিয়ে আসবে! যাতে সেহেরের দশ মাইলের কাছাকাছি আসার সাহসও পায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই সেহের বাসা থেকে বেরুলো। অনেক হয়েছে আর নয়। এই বাসায় কোনো মালিক বা কেয়ারটেকার নেই। মাসের ভাড়া মাস শেষে এসে নিয়ে যান, ওনারা ধানমন্ডিতে থাকেন। তাই এসবের ঝামেলাও নেই। সেহের মাথায় ইয়া বড় এক ঘোমটা টেনে ধীরপায়ে রাস্তা পার হলো। পূরব ওকে দেখলো ঠিকই কিন্তু ভাবতেও পারেনি সেহের এভাবে নিচে নেমে আসবে! সেহের ওর দিকে এগিয়ে গেলো। পূরব ওকে দেখে আচমকা হতভম্ব। এই মেয়েকে তো একটু আগেই জানালার পাশে দেখেছিলো, নিচে নেমে এলো কখন? ওতো সেটা লক্ষ্য করেনি! ড্যামেট..
সেহের গলায় রাগী ভাব এনে বলল, ‘আপনি এখানে? এতো রাতে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
পূরব বোকা বনে গেলো। এখন কী বলা উচিৎ তাঁর? তবুও নিজেকে সামলে নিলো। ভাব নিয়ে বলল, ‘হাওয়া খেতে এসেছি।’
‘তো হাওয়া খেতে আমারই বাসার সামনে কেন? এটাতো আপনাদের মতো বড়লোকদের এলাকা নয়। এখানকার বাতাস দুর্গন্ধযুক্ত, আপনার ভালো লাগবেনা।’
‘সেটা আমার ব্যাপার!’
সেহের কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তো গত তিনদিনও আপনি এখানে হাওয়া খেতে এসেছিলেন? মিথ্যে বলার আর জায়গা পান না?’
‘ওফফ..তোমার এতো কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’
‘মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ লোক কোথাকার!’
পূরব রেগে বলল, ‘কী বললে তুমি? আবারও বেয়াদবি শুরু করেছো? সেদিনের কথা ভুলে গেলে?’
‘সেহেরের সঙ্গে মিথ্যা বলা? আবার আপনি আমাকেই চোখ রাঙাচ্ছেন? আসলে আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো? কোনো মতলব টতলব আছে নাকি? আমি যে চাকরিটা ফিরিয়ে দিয়েছি সেটা কী আপনার ইগোতে লেগেছে? তাহলে আ’ম সো স্যরি মিস্টার পূরব। আমি কারোর দয়া নেই না!’
পূরব এবার বেজায় রেগে গেলো। মেয়েটা তখন থেকে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। ও কী করে বুঝাবে এই ঠাস ঠাস করে কথা বলা মেয়েটিকে একনজর দেখার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে? কী করে বলবে? মেয়েটার ব্যবহার বারবার ওকে রাগিয়ে দিচ্ছে, তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে পূরব। রাগ মানুষের চরম শত্রু, তাই ও চাচ্ছে আগেরবারের মতোন এবারেও যাতে রাগ এসে সব নষ্ট না করে ফেলে। একই ভুল বারবার করা মানে নিজেকে বোকা প্রমাণ করা। পূরব ঠান্ডা মাথায়, খুব শান্তভাবে বলল, ‘আমি তোমাকে দয়া করিনি। আব্বু তোমাকে খুব পছন্দ করেছে কারণ তুমি তাঁকে বাঁচিয়েছো। জানি এর মূল্য শোধ করার নয়, কিন্তু তোমাকে হেল্প তো করতে পারে ওনার ছোট্ট একটা সাহায্য! বাট তুমি অফারটা এক্সেপ্ট করোনি, দ্যান ওই ব্যাপার ওখানেই শেষ। আর আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটা আমার ইচ্ছে। তুমি এখানে কেন ইন্টারফেয়ার করছো ইডিয়ট?’
‘আমি কোনো ইন্টারফেয়ার করছিনা৷ দাঁড়াতে হলে অন্যকোথাও দাঁড়ান। আমার জানালার বরাবরই কেন? আপনি জানেন, আমার রুমমেটটা আপনাকে নিয়ে কতোটা হাসাহাসি করে?’
পূরব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বলে?’
‘আপনাকে কেন বলতে হবে?’
‘বিকজ আমার ফ্যানেরা আমাকে নিয়ে কী বলে তা জানার আমার খুব ইন্টারেস্ট৷ পৃথিবীতে বোধহয় তুমিই আমার প্রথম হেটার্স! যে এইরকম বাহাদুরি দেখাও আমার সাথে। অন্যান্য হেটার্সরা আড়ালে যা করার করে, কিন্তু আমার সামনে কখনো নয়।’
সেহের বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনি এখানে আর দাঁড়াবেন না কখনো৷ এবার আসতে পারেন।’
পূরব ভাব নিয়ে বলল, ‘যাবোনা। আমার শুধু একজনের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে কারোর রেগে যাওয়া লাল নাকটাকে!’
সেহের অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে সে?’
পূরব হ্যাটটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে!’
সেহের হতভম্ব। এই দুইনাম্বারি লোকের কথা শুনে ওর গা জ্বলে গেলো। আবার ওর নামেই যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। এতোটা বেহায়াও কোনো মানুষ হতে পারে?আবার ওকে ভালোবাসার কথাও বলছে! ওদের প্রেমে পড়া আর আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা৷ ওরা ভালোবাসার কী বোঝে? যত্তসব মিথ্যুকের দল! সেহের কটমট করে বলল, ‘মিস্টার ইফরাজ পূরব, আপনি জানেন এই মুহূর্তে আমি আপনার কী অবস্থা করতে পারি?’
পূরবের চোখ হাসছে। সেহেরের রেগে যাওয়া মুখটা দেখে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। হাসি আটকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করতে পারো শুনিতো?’
‘এলাকার লোক ডেকে আপনার হিরোগিরি ছুটিয়ে দিতে পারি৷ এদিকে সব খেটে খাওয়া, কর্মঠ লোকেরা
থাকে। আশা করি ওনাদের হাতের ডান্ডার বারি খেলে আপনার মাথা থেকে এসব প্রেম-ভালোবাসার কথামালার চিরসমাপ্তি ঘটবে।’
‘বাহ, খুবই ভালো। তাহলে তো এই ডান্ডার বারি খেয়ে যেতেই হয়৷ নাহয় হাত-পা একটু ভাঙলোই। নো প্রবলেম। প্রেমের স্বাদ বোঝার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই তাইনা? সো এলাকাবাসীদের কী তুমিই ডাকবে? নাকি আমি ডাকবো?’
ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে..ইনশাআল্লাহ!’