আটমাসের উঁচু পেটটা নিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো পিহু। ড্রয়িংরুমের সামনে এসে দেখলো শ্বাশুড়ি বই পড়ছে। পিহু বললো,
— “মা আপনাকে চা দেবো? কিছু খাবেন আপনি?”
আনোয়ারা বেগম বই থেকে মুখ তুলে পিহুর দিকে তাকালেন। পিহুকে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাসনের সূরে বললেন,
— “তোকে কতবার বলেছি এভাবে চলাফেরা না করতে। কথা শুনিস না কেনো? রুমে যা৷ ফের এদিকে দেখলে খুব মার দিবো আমি। কিছু লাগলে আমি নিজেই নিয়ে খাবো।”
পিহু মুচকি হাসলো। ধীরে ধীরে হেটে প্রস্থান করার আগেই আনোয়ারা বেগম বললেন,
— “তোর হাতের বাটিতে কি?”
— “উনার জন্য একটা ফেসপ্যাক বানিয়েছি।”
পিহু অনেকটা লজ্জা পেলো। আনোয়ারা বেগম মিটমিটিয়ে হাসছেন। পিহু মাথা চুলকে রুমের দিকে হাটা ধরলো। পিহুর খুব ভালো লাগে আনোয়ারা বেগমের শাসনের সূরে বলা প্রতিটা কথা। তাইতো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই ভুল করে। খুব ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা কাজ করে এই মানুষটার প্রতি। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই তাকে সবসময় পাশে থেকে সাপোর্ট করেছে। অন্য আর পাঁচ-দশটা শ্বাশুড়ির মতো গৃহ রাজনীতিতে যোগ দেয়নি।
রুমে এসে দেখলো ইমন উপুর হয়ে শুয়ে আছে। পিহু রেগে গেলো। এই লোকটা একটুও শোধরাবে না। কত বকেছে এভাবে উপুর হয়ে না শোয়ার জন্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা। পিহু ইমনের পাশে বসে তাকে ঠেলে সোজা করলো। এতেই হাপিয়ে গেছে বেচারি। আটমাসের পেটটা নিয়ে চলতে অনেকটাই বেগ পেতে হয়। ইমনের মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আর দোয়া করছে যাতে এখনি ঘুম থেকে উঠে না যায় ইমন। ফেসপ্যাক শুকিয়ে যাওয়ার পর পিহু ইমনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। এখন ইমনকে দেখতে বনমানুষের মতো লাগছে।
পিহুর হাসির শব্দে ইমন চোখ পিটপিটিয়ে তাকালো। পিহুর হাসিটা দেখে নিজেও হাসলো৷ পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে বললো,
— “এই পিহুরাণী হাসছো কেনো?”
পিহু জবাব না দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চিপে হাসছে। ইমন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। নাকের কাছে আঁষটে গন্ধ লাগতেই লাফিয়ে উঠে বসে বললো,
— “ফের আমার মুখে ফ্যাসিয়াল করেছো তুমি?”
— “ফ্যাসিয়াল করিনি। ওই একটু ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিয়েছি।”
— “কারণ জানতে পারি?”
— “আপনাকে যাতে সুন্দর লাগে। এটাই কারণ। আমার কি ইচ্ছে করেনা আমার স্বামীকে সুন্দর লাগুক? তার সৌন্দর্য্য মন ভরে দেখি?” পিহু নাক ফুলিয়ে বললো।
— “হু হু আপনার পুরো অধিকার আছে আপনার স্বামীর উপর। কিন্তু মহারাণী পিহু, আপনাকে তো নিজের শরীরের দিকে একটু নজর দিতে হবে তাইনা? এভাবে হেটে বেড়ালে তো আপনি ব্যাথা পাবেন। সেই ব্যাথা আমার এবং আমার বাবুর হৃদয়ে লাগবে।”
— “অনেক ফ্ল্যার্ট করেছেন। এবার গিয়ে মুখ ধুয়ে আসুন।”
— “ভালো বললেও দোষ৷ হুহ..।” বিড়বিড় করে বললো ইমন।
পিহু বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ইমনের জন্য অপেক্ষা করছে। ইমন মুখ ধুয়ে বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ফেসপ্যাকটা দারুণ কাজ করেছে। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ইমন এমনিতেই সুন্দর। গায়ের রঙ হলদে ফর্সা। তারমধ্যে পিহুর ঘষামাজায় আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ইমনের ত্বকের রঙ। ইমনের তুলনায় পিহুর গায়ের রঙ অনেক চাপা। মধ্যম পর্যায়ের শ্যামলা বলা চলে। পিহু পলকহীন তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। গায়ের সাদা শার্টে আরো সতেজ লাগছে মানুষটাকে। পিহু নিজের ভারী পেটটা নিয়ে উঠে বসলো। বিছানা থেকে নামতে চাইলে ইমন তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো পিহুর দিকে। নিজের মুখটা পিহুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— “এই নাও নিজের কাজ করো। তবুও এই শরীর নিয়ে বেশি নড়াচড়া করো না মহারাণী।”
— “আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি এখন এরকম কিছুই চাইছিলাম?” লাজুক হাসলো পিহু।
— “তুমি তো আমার হৃদয়ের রাণী। তোমার মনের কথা আমি বুঝবো না তো কে বুঝবে?”
_______________________
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতীত থেকে বেরিয়ে এলো পিহু। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ইমনের দিকে। এই ইমনকে চিনতে বেশ কষ্ট হয় পিহুর। কেমন বদলে গেছে মানুষটা। ইমনও একই সময়ে পিহুর দিকে ফিরলো। পিহুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
— “কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছো?”
— “কিছুনা।”
— “কাছে আসো। কতদিন দূরে ছিলে জানো?”
ইমনের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শুনে পিহু খুশি হলো। আনন্দিত মনে এগিয়ে এলো ইমনের দিকে। আবদ্ধ হলো প্রিয়তমের বাহুডোরে। ঠিক পাঁচ কি ছয় মিনিট পরেই মেয়েটা কেঁদে উঠে। মেয়ের কান্নার শব্দ কর্ণগোচর হতেই ইমনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে। মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে পিহু। এদিকে ইমন বেশ বিরক্ত। মুড নষ্ট হওয়ায় বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। রেগে ঘুমিয়ে পরে। মেয়েকে ঘুম পারিয়ে খাটের কাছে আসতেই দেখলো ইমন ঘুমিয়ে গেছে। মনটা বিষন্ন হলো পিহুর।
আগে মেয়েটা কাঁদলে ইমন নিজেই মেয়েকে নিয়ে হাটতো। পিহুকে বলতো রেস্ট নিতে। বলতো সারাদিন খাটনির পর শরীর খারাপ করবে রাতে না ঘুমালে। অথচ এখন যেনো বুঝেও বুঝেনা পিহুর মনের কষ্ট। বিষন্ন মন নিয়ে নিজেও শুয়ে পরলো ইমনের দিকে ফিরে।
.
সকালবেলা তাড়াতাড়ি উঠে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত পিহু। একটু পরেই ইমন উঠে যাবে অফিসে যাওয়ার জন্য। মেয়েকে শ্বাশুড়ির কাছে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব কাজ করে। আজকে উঠতে খানিকটা দেরি হয়ে গেছে। গতকাল রাতে মেয়েটা বেশ জ্বালিয়েছে। তাইতো ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি বেচারি।
ইমনকে টেবিলে আসতে দেখে তড়িঘড়ি করে চায়ের কাপে চা ঢালতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেললো। সেখানে দশ মিনিটের মতো লেইট হয়ে গেছে। নাস্তার প্লেট গুছিয়ে ইমনের সামনে দিতেই বেশ বিরক্ত হলো ইমন। পরোটা মুখে পুড়ে নিজের বিরক্ত প্রকাশ করলো পিহুর উপর। রেগে বললো,
— “কি ছাতার নাস্তা বানিয়েছো লবণ হয়নি ঠিকমতো।”
পিহু রান্নাঘর থেকে দৌড়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে দাড়ালো। ইমনকে বললো,
— “সরি। আসলে শরীর বেশ খারাপ করছিলো তাই কিরকম হয়েছে সেটা বুঝতে পারিনি।”
— “সারাদিন ঘরে কি এমন কাজ করো যে শরীর খারাপ করে তোমার? যখনই বাসায় আসি তখনই শুনি তোমার শরীর খারাপ। তোমার শরীর ভালো থাকে কোনদিন?”
— “রাগ করবেন না প্লিজ। আপনি একটু বসুন আমি এক্ষুনি আপনার জন্য নুডুলস করে আনছি। পাঁচ মিনিট লাগবে শুধু।”
— “আমি পাঁচ মিনিট বসি আর ওইদিকে আমার অফিসের কাজ তুই করে দিয়ে আসবি?”
রেগে চেচিয়ে বললো ইমন। ইমনের বজ্রকন্ঠ শুনে পিহু একেবারে চুপসে গেছে। নাস্তার প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়ালো। অফিসের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ইমন। পিহু ব্যথিত মন নিয়ে নিরবে সব দেখে গেলো।
.
যতটুকু সম্ভব পিহু চেষ্টা করে ইমনের মন রক্ষা করে চলার। তবুও পেরে উঠছে না। আজকে তো কেঁদেই ফেলেছে বেচারি। এখন মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ইমন আজ ঘুড়তে যেতে চেয়েছিলো। পিহু নিজেও খুব খুশি ছিলো। রেডি হয়ে বের হওয়ার সময়ই মেয়েটা প্রস্রাব করে দিলো ইমনের শার্টে। ইমন রেগে বললো,
— “মেয়েকে ডাইপার পরালি না কেন? দেখ তো প্রস্রাব করে ভিজিয়ে দিয়েছে।” বিরক্ত হয়ে বললো ইমন।
— “ইশ একদম ভুলে গেছিলাম। ইশপি তো এখন অল্পসল্প খাবার খেতে পারে। ওর প্রস্রাব নাপাক। আপনার তো গোসল করা লাগবে। আমি সব রেডি করে দিচ্ছি আপনি তাড়াতাড়ি গোসল সেরে আসুন।”
— “তুই আসলেই কোনো কাজের না। অশান্তি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিস না তুই আমাকে।”
রেগে গিয়ে বলেই ফেললো ইমন। পিহু একেবারেই থমকে গেছিলো। শুধু চেয়ে দেখেছিলো ইমনের চলে যাওয়া। ইমন যাওয়ার পরেই নিজের মনকে বেশ বকেছে। কেন সে ভুলে গেলো এই বিষয়টা? সব ঠিকঠাকই ছিলো শুধু নিজের বেখেয়ালিপনার কারণেই মানুষটা রেগে বেরিয়ে গেছে। নিজেকে বকেও শান্তি পায়নি পিহু। মনটা একদম ভেঙে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেছে। সে কি একটুও সুখ দিতে পারেনি ইমনকে? কিভাবে এটা বললো ইমন?
.
আজকাল পিহুকে নিজের আশেপাশে দেখলেই রাগ উঠে যায় ইমনের। সাথে বেশ বিরক্তবোধ হয়। নিজেকে খুব অসুখী লাগে। কত ফ্যান্টাসি ছিলো বিয়ের আগে। বউকে নিয়ে এটা করবে, ওটা করবে। বউ শাড়ি পরবে, মাথায় বেলীফুলের মালা গুজে দুজনে একসাথে রিকশায় ঘুড়বে। অথচ পিহু এসবের যেনো ধার ধারেনা। বাহিরে বের হলে বস্তার মতো বোরকা একটা পরে বের হবে। ইমনের ভালোলাগা সব এক নিমিষেই হারিয়ে গেছে যেনো। সব তিক্ত লাগে এখন। বিশেষ করে পিহুকে আরো বেশি তিক্ত লাগে।
গত ফ্রাইডে দেখেছে তাদের অফিসের এক কলিগ-কে। কতটা হ্যাপি তারা। ফেসবুকে কত সুন্দর ছবি আপলোড করে। তার ওয়াইফ তাকে কত সুন্দর গিফট দেয়। অথচ পিহু! একটা বিরক্তিকর নিশ্বাস ফেললো ইমন। তাছাড়া এখন ইমনের মনে হয় পিহুকে তার পাশে একদমই মানায় না।
এইতো সেদিন অফিস শেষে সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলো। ইমনও ছিলো সেখানে। খাওয়া-দাওয়া শেষের দিকে একপর্যায়ে ইমনের সাথে কাজ করে লিজা নামের এক মেয়ে কলিগ প্রপোজ করে ইমনকে। বেশ অবাক হয়েছিলো সেদিন ইমন। তবে কিছুই বলেনি। ইমনের সাথের অনেকেই বলেছে লিজাকে ইমনের পাশে বেশ মানায়। হাই সোসাইটির মেয়ে। দেখতে বেশ। হাই সোসাইটির ভাষায় বলতে গেলে দেখতে হট। কথাবার্তাও মার্জিত। ইমন সেদিনই পিহুকে লিজার সাথে কম্পেয়ার করা শুরু করেছে। তারপর থেকেই পিহুকে সহ্য হয়না। নিজেকে অসুখী মনে হয়।
তাছাড়া পিহুর গায়ের রঙ বেশ চাপা। মেয়েটা হওয়ার পরে স্বাস্থ্য বেড়ে গেছে অনেকটাই। দেখতে বেশ বেমানান লাগে। অথচ অন্যদিকে ইমনকে দেখলে বুঝাই যায়না সে বিবাহিত এবং একটা বাচ্চা আছে। তার সাথের মেইল কলিগরা তো সেদিন বলেই দিয়েছিলো ইমনের সাথে লিজাকেই মানায়। দুজনেই একই স্ট্যান্ডার্ডে আছে। ইমন সেদিন বেশ ভেবেছে এটা নিয়ে। যদিও কোনো সমাধানে পৌছাতে পারেনি। অফিসে মেয়ে কলিগরা যখন ইমনের সাথে কথা বলে স্মার্টলি তখন বাসায় এলে পিহুর কথাবার্তা একেবারেই আনস্মার্ট এবং গ্যাঁয়ো লাগে। পিহুর ড্রেসাপ দেখলেও ইমনের মন বলে উঠে এমন গ্যাঁয়োকে কিভাবে জীবনসঙ্গী করলি?
এসব হাজারো চিন্তা বাদ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমন। নিজেকে এখন কিছুতেই পিহুর সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না। তাছাড়া মেয়েটা ওকে ঠিকমতো টাইম দিতে পারে না। যখনই একান্ত কিছু সময় কাটাতে চায় তখনই কোনো না কোনো কাজ এসে পরবে অথবা মেয়েটা কেঁদে উঠবে। অথবা মায়ের সেবার কথা মনে পরবে। এইতো গতকালের কথা। নিজের মনকে জোর করে ইমন পিহুর সাথে সময় কাটানোর জন্য কিছু সময় চেয়েছিলো। ওমনি মায়ের ডাক পরেছে। মায়ের মাথায় যেনো তেল দিয়ে দেয়। মায়ের মাথায় তেল দেয়ার পর ইশপিকে খাওয়ালো। সন্ধ্যার নাস্তা বানালো। সবশেষে ইমনের জন্য আর সময় রইলো না পিহুর কাছে। গতকাল বেশ রাগ হয়েছিলো সাথে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌছে গেছে ইমন। এবার ইমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। আজ রাতেই মায়ের সাথে কথা বলবে ভাবছে।
__________________________
আনোয়ারা বেগম সোফায় বসে বই পড়ছেন৷ এমন সময় দরজায় নক পরলো। বই রেখে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “ভেতরে এসো।”
আনোয়ারা বেগমের স্বামী দুইবছর আগেই মারা গেছেন। তারপর থেকেই অবসর সময়ের সঙ্গী হয়েছে বই। ইশপি হওয়ার পর থেকে ইশপিকে নিয়েও অনেক সময় পার করে দেন। অথবা পিহুর কাজে সাহায্য করেন। ইমনকে ভেতরে আসতে দেখে পা গুটিয়ে নিলেন আনোয়ারা বেগম। ইমনকে বসার জায়গা করে দিলো। ইমন মায়ের কাছে বসলো। ইমনের মাথায় হাত বুলিয়ে আনোয়ারা বেগম বললেন,
— “কিছু বলবি বাবা?”
— “হ্যাঁ মা।”
— “তো বল।”
— “আসলে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটাই তোমাকে জানাতে এলাম।”
— “কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
— “আসলে মা আমি মাসনা করতে চাই।”
আনোয়ারা বেগম অবাক হলেন। অবাক হয়ে বললেন,
— “হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?”
— “অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাই। পিহু-ও থাকবে সমস্যা নেই।”
আনোয়ারা বেগম গম্ভীর স্বরে বললেন,
— “এক্সেক্ট কারণ জানতে চাই। যেটার উপর ভিত্তি করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছো তুমি।”
ইমন কিছুক্ষণ চুপ থেকে লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে বলতে শুরু করলো,
— “মা পিহু আমার স্ট্যান্ডার্ডেরই না। চলাফেরাও কেমন গ্যাঁয়ো টাইপের। তাছাড়া সে আমাকে সময় দিতে পারেনা। যখনই আমি একটু সময় চাই তখনই সে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। রাতেও ঠিকমতো সময় দেয়না। হয় পিহু ক্লান্ত থাকে আর নয়তো ইশপিকে নিয়ে পরে থাকে৷ আমি যেনো ওর জীবনে ফেলনা ছাড়া কিছুই না। ওর এসব অবহেলায় আমি তিক্ত হয়ে গেছি। আমার কত ফ্যান্টাসি ছিলো কিন্তু পিহু সেসবের কিছুই পূরণ করতে পারেনি। তাই আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাই। এখন তুমি পারমিশন দিলেই হবে। আমি নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে চাই।”
আনোয়ারা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “ঠিকাছে তোমাকে আমি পারমিশন দিলাম। তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
— “কি শর্ত?”
— “আগামী একসপ্তাহের জন্য ছুটি নিবে অফিস থেকে। সারাদিন পিহু যেসব কাজ করে আগামী একসপ্তাহ তুমি সেসব কাজ করবে। অর্থাৎ ঘরের সব কাজ তোমাকে করতে হবে। বাজার থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, ঘরমোছা, কাপড় ধোয়া এভরিথিং। এমনকি ইশপিকেও তুমি রাখবে। পিহুকে আমি আমার কাছে রাখবো। সবকাজ শেষ করে যদি তুমি এক্সট্রা টাইম বের করে নিতে পারো তাহলে তুমি দ্বিতীয় করতে পারো নির্দ্বিধায়। রাজি আছো?”
—” এটা কেমন শর্ত মা?”
— “এটাই আমার শর্ত। শর্ত মোতাবেক সব করলে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য তোমাকে বাঁধা দেবনা। এখন তুমি ভাবো তুমি কি করবে।”
— “ঠিকাছে আমি শর্তে রাজি।”
— “যাও এখন। আর হ্যাঁ। তোমার দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপার যেনো পিহুর কানে না যায়।”
ইমন বেরিয়ে এলো রুম থেকে৷ শর্তটা কঠিন মনে হয়নি তার কাছে। মনে হচ্ছে এসব আর কি এমন কাজ। এক নিমিষেই করে নিতে পারবে৷ রুমে এসে ঝটপট করে অফিসের বসের কাছে ফোন দিয়ে ছুটি চেয়ে নিলো আগামী একসপ্তাহের।
রাতে সবার খাওয়া-দাওয়া শেষে পিহু ইশপিকে খাইয়ে দিলো। সবকিছু গুছিয়ে ধুয়েমুছে রুমে যাওয়ার আগেই শ্বাশুড়ি ডাক দিলো। পিহু সেদিকে এগিয়ে গেলেই আনোয়ারা বেগম পিহুকে নিয়ে তাদের রুমে গেলেন। ইমন অফিসের কাজ করছিলো। মাকে দেখে সেসব রেখে স্থির হয়ে বসলো। আনোয়ারা বেগম নাতনির সাথে কিছুক্ষণ দুষ্টামি করে ইমনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “রাত বারোটা বাজলো। এই মুহুর্ত থেকেই তোমার শর্ত মোতাবেক কাজ করা শুরু হবে। ইশপিকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। পিহুকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি আমার রুমে।”
পিহু বেকুবের মতো মা-ছেলের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে। তবে এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। আনোয়ারা বেগম পিহুর হাত ধরে বললেন,
— “চল। আজকে থেকে তুই রেস্ট করবি। কোনো কাজে হাত দিবি না। এমনকি ইশপিকেও ধরতে পারবি না। আমার কথার যদি হেরফের করিস তো সেদিন তোর একদিন কি আমার যেকদিন লাগে।”
— “মা এসব কি বলছেন?”
— “বাংলায় বলেছি বুঝতে পারছিস না? চল আমার সাথে।”
শ্বাশুড়ির ধমক শুনে পিহু চুপসে গেলো। আনোয়ারা বেগম পিহুকে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় পেছন ফিরে বললেন,
— “কাল সকাল থেকেই সব কাজ শুরু করবে।”
_________________________
মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে গিয়ে একটা বেজে গেলো ইমনের। এই একঘন্টা মেয়েকে নিয়ে হাটতে হয়েছে। ইশপিকে শুয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে গেলো। চোখটা একটু লেগে এসেছিলো ইমনের। এরমধ্যেই ইশপি আবার কেঁদে উঠে। লাফ দিয়ে উঠে বসে ইমন। পুরো শরীর থরথর করে কাপছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে দেখলো প্রস্রাব করে দিয়েছে। ইশপির জামা, প্যান্ট এমনকি কাঁথা আর বিছানাসহ ভিজে গেলো।
খাট থেকে নেমে ইশপির জামা-কাপড়ের ড্রয়ার থেকে কাপড় নিয়ে সেগুলো পালটে দিলো। মেয়ের জামা-কাপড় পাল্টাতে গিয়ে একরকম যুদ্ধ করতে হয়েছে। কাঁথা পালটে দিলো। আবারও একঘন্টার মতো হাটতে হয়েছে মেয়েকে নিয়ে। ইশপি ঘুমাতেই মেয়েকে শুকনো জায়গায় শুয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পরলো। বিছানায় শরীর রাখতেই ইশপির প্রস্রাবের জায়গা থেকে গন্ধ এসে নাকে লাগলো ইমনের। কোনো রকমে চাদর পালটে আবার শুয়ে পরলো। কিন্তু এবার আর ঘুম আসছেনা। মোবাইলে সময় দেখলো। রাত সাড়ে তিনটা বাজে। এদিক-সেদিক করতে করতে ফজরের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছিলো ইমনের। তার একটু পরেই ইশপি আবারও কেঁদে উঠে। এবারও লাফিয়ে উঠে ইমন। মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটতে থাকে। এরমধ্যেই গায়ে প্রস্রাব করে দিলো মেয়েটা। ইমন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “বাবাইকে একটু ঘুমাতে দাওনা মামুনি।”
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে। বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো ইমন মেয়েকে নিয়ে। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগতেই শিরশির করে উঠে শরীর। পিহুর সাথে মনমালিন্য হওয়ার পর থেকেই সালাতের অনিয়ম করে আসছে ইমন। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। তাছাড়া এখন সালাতে দাড়ালে কিছুতেই সালাতে মন দিতে পারেনা। কিসব হাবিজাবি চিন্তা আসে। আগের মতো সেই অনুভূতি কাজ করেনা সালাতে দাড়ালে।
ছয়টার দিকে ইশপি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ইমন এবার বেশ বিরক্ত হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়ে পিহুকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেছে। মেয়েকে নিয়ে অনেকক্ষণ হাটার পরেও কান্না থামাতে পারলো না। কেনো কাদছে সেটাই বুঝতে পারছে না ইমন। অনেক ভেবে চিন্তে বুঝতে পারলো ইশপির হয়ত ক্ষিদে পেয়েছে।
ইশপিকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গেলো। ইশপির খাবার খুজে বের করতে বিশ মিনিটের মতো সময় চলে গেলো। খাবার বানিয়ে আনতে আরো কাঠখড় পোড়াতে হলো ইমনকে। অবশেষে খাবার বানিয়ে রুমে এলো। দোলনার দিকে চোখ যেতেই দেখলো ইশপি সেটা ধরে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করছে। খাবারগুলো ড্রয়ারের উপর রেখে দৌড়ে মেয়ের কাছে গেলো ইমন। তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। আরেকটু হলেই পরে যেতো মেয়েটা। বুকটা ধড়ফড় করছে এখনো ইমনের।
ইমনের হঠাৎ মনে পরলো কয়েকদিন আগের ঘটনা। ইশপিকে দোলনায় রেখে পিহু রান্নাঘরে গেছিলো। বারবার বলে গেছে ইশপিকে যেনো একটু দেখে। ইমন বেশ বিরক্ত হয়েছিলো। রান্নাঘর থেকে এসে দেখলো ইশপি একটু হলেই পরে যাবে। তাড়াতাড়ি করে সেদিকে যেতেই কিছু চা ইমনের অফিসের কাগজে ছিঁটকে পরেছিলো। তাতেই কি রাগটাই না দেখিয়েছিলো ইমন। পিহু এককোণে মেয়েকে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো। কোনো প্রতিউত্তর করেনি ইমনের ভয়ে।
সেসব মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশপিকে খাবার খাওয়াতে লাগলো। উফ! বাচ্চাদের খাবার খাওয়ানো মানে একটা যুদ্ধ জয় করার মতো। অনেক চেষ্টা করে অল্প খাবার খাওয়াতে পেরেছে ইমন। এই অল্প খাবার খাওয়াতে গিয়ে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চক্ষু কপালে উঠলো ইমনের। কোথায় ভেবেছিলো একটু ঘুমিয়ে নিবে। তা আর হলো না। মেয়েকে কোনোরকমে ঘুম পারিয়ে শার্ট গায়ে দিয়ে বের হলো বাজার করতে। বাজার করে এসে হাপিয়ে গেছে ইমন। একগ্লাস পানির জন্য পিহুকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলো। নিজের মনে মনে ঠিক করেই নিলো যেভাবেই হোক এই শর্তে সে জিতবেই। তার মাকে দেখিয়ে দিবে সেও পারে।
জিদের বসে উঠে গিয়ে নিজের পানি নিজে নিয়েই খেলো। ঘড়িতে নয়টা বাজতে দেখে বেক্কল হলো ইমন। বিড়বিড় করে বললো, ‘অদ্ভুত! সময় যেনো দৌড়ে পালাচ্ছে।’ তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা বানাতে শুরু করলো। পরোটার জন্য আটা মাখতে গিয়ে পানি বেশি হয়ে গেলো। কোনোরকমে আটাকে ঠিক করে রুটি বেলা শুরু করলো। রুটিগুলো একটাও গোল হলো না। এতে বেশ বিরক্ত হলো ইমন। বিড়বিড়িয়ে বললো, ‘পিহু কিভাবে গোল রুটি বানায়? আমার তো হচ্ছেই না।’ রুটি চুলায় দিতেই ইশপি কেঁদে উঠলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে এসে দেখলো রুটি পুড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে নামাতে গিয়ে হাত পুড়ে ফেললো ইমন। চুলাটা ঝট করে বন্ধ করে ফোস করে নিশ্বাস ফেললো। বেশ বিপাকে পরলো এবার। মেয়েকে রাখবে নাকি রুটি গরম করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। মনে মনে ভাবলো পিহু কিভাবে যে সামলায় এতোদিক। নিজের চিন্তায় বিরক্ত হয়ে ফের কাজে মন দিলো।
~ “প্রিয়”
চলবে,,
® ‘নুরুন নাহার’
#মেঘমালার_গল্পকথা_নুরুন_নাহার