প্রীতিকাহন পর্ব ১১+১২

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১১

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“বিছানাকান্দি মানে জানি না তবে এটা একটা জায়গার নাম।” সামনে তাকিয়ে নির্বিঘ্নে বলে গেল নবাব। এদিকে রাগে কন্ঠ গম্ভীর হলো মিষ্টির, “সাত-সকালে ফাজলামি করছো আমার সাথে? বিছানাকান্দি যে একটা জায়গার নাম সেটা কি আমি জানি না মনে করেছো?”

“যদি না জানো?” বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টির দিকে।

“আশ্চর্য! বিদেশে তুমি থাকো, আমি না।”

“কে থাকে, কে থাকে না? কে ছিল আর কে থাকবে? সেটা না হয় সময়ই বলে দিবে।”

“এমন ভনিতা করে কথাবার্তা বলা আমার একদম অসহ্য লাগে।”

“এখন তো যা বলবো আর করবো সবই তোমার অসহ্য লাগবে কারণ আমিই অসহ্যের পাহাড়, তাই নয় কি?”

চোখ-মুখ খিঁচে বললো মিষ্টি, “আমার না সকাল সকাল এসব একদম ভালো লাগছে না।”

“আমার তো এত ভালো লাগছে ইচ্ছে করছে বাসের ছাদে দাঁড়িয়ে এমন করি।… চুপ থাকতে পারো না? হুম? না খেয়েও এতো ঝগড়া করো কীভাবে?” প্রথম বাক্যে কন্ঠস্বর যতটা নরম ছিল, শেষ বাক্যে ততটাই গম্ভীর শোনালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টিকে দেখলো নবাব মিষ্টিকে কিন্তু মিষ্টি চুপটি করে রইলো।

“খাবার বের করে দিচ্ছি চুপচাপ খেয়ে নাও। আর একটা টুঁশব্দ যদি কানে আসে তবে খাবার নয়, গুলি নামাবো তোমার গলা দিয়ে।” হিসহিসিয়ে বলে নবাব উঠে দাঁড়ালো। দুই মিনিট ধরে ব্যাগ হাতড়িয়ে পাউরুটি আর ঈষৎ মজে যাওয়া কলা নিয়ে ওর সিটে ওপর রাখলো। এরপর পানির বোতল নিয়ে ব্যাগ নাড়াচাড়া বন্ধ করলো। একহাতে পানির বোতল আর অন্য হাতে কলা রুটি নিয়ে সিটে বসে বললো, “খেয়ে নাও।”

নিশ্চুপ মিষ্টি গোমড়া মুখে বাইরে তাকিয়ে আছে চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে। নবাব যখন উঠে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন সে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে নজর দিয়েছিল। আকাশে সূর্য এখনও তেমন করে ভেসে উঠেনি। ঝিলমিল করা রোদের পরিবর্তে হিমহিম বাতাস বইছে। এই বাতাসে মনের রাগ দূর হলেও অভিমান গাঢ় হয়। সেই গাঢ় অভিমান নিয়েই নিশ্চুপ মিষ্টি উপেক্ষা করছে নবাবের কথাগুলো।

“মিষ্টি?” এবারও মিষ্টি উপেক্ষা করলো নবাবকে। এতে নবাব বিরক্ত হলেও সেটা নিজের মাঝে চেপে রেখে জিজ্ঞেস করলো, “কালকে থেকে খাই না। তুমি জানো, তুমি যতক্ষণ না খাবে আমি খাবো না। জেনে-বুঝে কেন এমন করছো আমার সাথে?”

হুট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে। হিজাবে ওর চেহারার প্রতিক্রিয়া বোধগম্য না হলেও চোখ দু’টোতে ভাসছে বিস্ময় আর রাগ অভিমান। কন্ঠে কোনওরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করেই মিষ্টি জানতে চাইলো, “তোমরা ছেলেরা কি নিজের দোষ চোখে দেখতে পাও না? এই যে একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করলে– এটা কি দোষের নয়? তোমরা সাতখুন করলেও বুক উঁচিয়ে চলতে পারো আর আমরা সামান্য ভুল করলেও যেন মহাপাপী হয়ে যাই। আমরা সামান্য ভুলে অপরাধী হলে তোমরা বিরাট ভুলে কেন সাধু হও?”

“কথা বললেই কথা বাড়বে। লোককে শুনিয়ে আমি আর তর্ক করতে চাই না মিষ্টি। শেষবার জিজ্ঞেস করছি, খাবে কি না?”

মুখ ফিরিয়ে নিজের মাঝে গাম্ভীর্য এনে জবাব দিলো মিষ্টি, “নাহ।” এতে হঠাৎ ধপ করে জ্বেলে উঠা রাগের বাতিতে প্রজ্বলিত হলো নবাব। নিজের রাগ কোনওমতে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে দাঁতে দাঁত চাপলো। সাত-পাঁচ না ভেবে চলন্ত গাড়ি থেকে হাতের খাবারগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। আচমকা নবাবের এমন কাণ্ডে আঁতকে উঠলো মিষ্টি, “এটা কী করলে? তুমি… তুমি খাবারগুলো ফেলে কেন দিলে?”

মাথার ক্যাপ খুলে চুলে হাত চালালো নবাব। এরপর পুনরায় ক্যাপ লাগিয়ে ফোনে মত্ত হলো। প্রতুত্তরে নবাবকে নিশ্চুপ দেখে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কিছু বলছো না কেন নবাব? খাবারগুলো ফেলে দিলে কেন?”

ফোনে দৃষ্টি রেখে নবাব জবাব দিলো, “যখন খাবেই না, তখন অহেতুক বয়ে বেড়ানোর মানে কী?”

“কেন এমন করলে? আমি রাগ করে…”

ফুঁসে উঠলো নবাব, “রাগ? তো থাকো না সেটা নিয়ে। কে বলে তোমায় রাগ ভেঙে কথা বলতে? অনাহারে থাকবার খুব শখ, তাই না? এবার না খাইয়ে মারবো তোমায়।”

বিনা নিমন্ত্রণে কান্না চলে এলো মিষ্টির মাঝে কিন্তু সেটা অপ্রকাশিত রাখবার তোরজোর করছে সে, “বিশ্বাস করো নবাব আমি…” মিষ্টিকে থামিয়ে দিয়ে নবাব বলে উঠলো, “একটা কথাও বলবে না তুমি আমার সাথে। কালকে থেকে বলছি কিছু একটা মুখে দাও। নিজে না খেয়ে তোমায় সেধেছি আর তুমি আমার কথা ভাববে তো দূর, নিজেও খেলে না।”

মিষ্টির কান্না এবার প্রকাশ পেল সাচ্ছন্দ্যে, “সত্যি বলছি, আমি এমন কিছু চাইনি। বিশ্বাস করো।”

“বিশ্বাস করে আর কী হবে?” এমন একটা বাক্য মিষ্টি আশা করেনি। নবাব তাকে অবিশ্বাস করবে, ভুল বুঝবে সেটাও ভাবেনি সে। তাই হঠাৎ কান্না থামিয়ে নিজে শক্ত হয়ে বসলো, “ঠিক আছে, খাবার তো খাইনি। সামনে যেখানেই বাস দাঁড়াবে তুমি আমাকে এক বোতল বিষই কিনে দিও তাও তোমাকে বিশ্বাস করাতে আমি খাবো।”

তাচ্ছিল্যের সুরে, “বাহ! চমৎকার পরিকল্পনা তো তোমার। না, তুমি যা খাচ্ছো দুইদিন ধরে আমিও তাই খাচ্ছি। সেজন্য এখন পরিকল্পনা করে বিষ খেতে চাইছো যেন আমিও বিষ খেয়ে মরে যাই?”

“না, না, এসব তুমি কী বলছো নবাব?” সশব্দে কেঁদে উঠে মিষ্টি জানতে চাইলো। মিষ্টির কান্নায় নবাবের কন্ঠ নরম হলো, “কাঁদছো কেন সাত-সকাল?”

“তুমি এমন বললে তবে কী করবো?” কান্না মিশ্রিত কন্ঠ প্রশ্ন করে মাথা নুইয়ে নিলো মিষ্টি।

“বিষ খেতে হবে না। বিস্কুট আর কেক খেয়ে নাও।” নবাবের কথায় বিস্মিত মিষ্টির মুখ থেকে নিসৃত হলো ছোট্ট একটা শব্দ, “এ্যা!”

“এ্যা নয়, হ্যাঁ।… রাতের আর সকালের জন্য খাবার কিনেছিলাম কিন্তু রাতে তো খাওয়া হয়নি তাই রয়ে গেছে। তবে কেক বিস্কুট ফেলে দিলে আর খাবার নেই।” সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর আগে নবাব জানতে চাইলো, “বিস্কুট খাবে না-কি কেক?”

নাক টেনে মিষ্টি বললো, “পানি দাও।”

নবাব নিঃশব্দে পানির বোতল এগিয়ে দিতে মিষ্টি বোতল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নবাব যখন কেক আর বিস্কুট নিয়ে সিটে বসলো, তখন দেখলো মিষ্টি মুখের হিজাব তুলতে গিয়েও থেমে গেছে, “কী হলো?”

নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, “মুখ খুলবো?”

মৃদু হেসে, “না খুলে খাবে কীভাবে?”

“ঠিক আছে।” বলেই মুখের কালো হিজাব তুলে মাথার পিছনে চালান করলো মিষ্টি। ঘুম আর কান্নায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা মিষ্টির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো নবাব। কালকে দুপুরে শেষবারের মতো নবাব দেখেছিল মিষ্টির মুখখানা। পরপর ঘটে যাওয়া বিষয়ে মেয়েটার চেহারায় মলিনতা কেবল বেড়েই চলেছে। এসব ভাবতে গিয়ে বুকে চিনচিনে ব্যথায় কুঁকড়ে যেন উঠলো নবাব। নিজের মাঝে অপরাধী বোধ জাগ্রত হতে মাথা নুইয়ে নিলো সে। দৃষ্টি হাতের খাবারের ওপর কিন্তু এই দৃষ্টি শূন্য বলে খাবার ছেড়ে মিষ্টির মলিন মুখ ভেসে উঠছে। ভাসমান মিষ্টির মুখকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে জিজ্ঞেস করলো নবাব, “মিষ্টি, পারবে কি কোনওদিন আমায় ক্ষমা করতে?”

.

বেশ কয়েক ঘন্টা অনাহারে থাকার পর নাস্তা করে এখন নিজেকে বেশ অসুস্থ বোধ করছে মিষ্টি। খাওয়া শেষ হতেই হিজাবে সে মুখ ঢেকে নিয়েছিল চটজলদি। এখন বাসের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবছে, “জীবন এত দ্রুত দৌড়াচ্ছে কেন এই চলন্ত বাসের মতো?”

খাওয়ার সময় একটা বিষয় খেয়াল করেনি কিন্তু এখন সেটা মনে পড়তে মিষ্টি মুখ ঘুরালো নবাবের দিকে। সকালে ঘুম থেকে জেগে মিষ্টি নবাবের মুখে মাস্ক আর মাথায় ক্যাপ দেখেনি। পরে যদিও ক্যাপ লাগিয়ে নিয়েছিল কিন্তু মাস্ক ছিল না। তবে খাওয়া শেষ করে আবার সেগুলো লাগিয়ে নিয়েছে। মাথা বাসের সিটে লাগানো আর বুজে রাখা চোখ হয়ত কল্পনার রাজ্যে করছে বিচরণ। পূর্ণ দৃষ্টিতে নবাবকে দেখে ডাকলো মিষ্টি, “নবাব?”

মিষ্টির ডাকে অতিদ্রুত সোজা হয়ে বসে বললো, “খেয়েছো এবার বিশ্রাম নাও৷ ঝগড়াগুলো বিছানাকান্দির জন্য জমিয়ে রাখো।” হিজাবের মাঝে ভাসা ক্লান্ত চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলো মিষ্টি নবাবের দিকে। ওর এমন চাহনিতে নবাব জানতে চাইলো, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আগে দেখোনি আমায়?”

তেমনই দৃষ্টি রেখে কাঠ গলায় মিষ্টি বললো, “এক হাতে তালি বাজে না। ঝগড়া আমি একা নিশ্চয়ই করি না। তুমি নিজেই ঝগড়া শুরু করো। এই যে এখন…এখন কি আমি ঝগড়া করার মতো কিছু বলেছি?”

কাঁধ নাচিয়ে বললো নবাব, “আহা! আমি কি সেটা বলেছি?”

“সুযোগে তো কিছু বলতে বাকি রাখো না।” বলেই সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি।

“ঠিক আছে, আমিই ঝগড়া করি। এখন কী বলতে চেয়েছিলে, সেটাই বলো।”

“কিছু না।” অভিমান ভাসলো মিষ্টির কন্ঠে আর সেটা টের পেয়ে নবাব প্রতুত্তরে বললো, “এবার কিন্তু ঝগড়া শুরু করতে দেরি করবো না।”

হা-হুতাশ করে বলে উঠলো মিষ্টি, “নবাব, আমি ক্লান্ত। আমার শান্তির প্রয়োজন। জীবন নিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। ভাবিনি কোনওদিন আমার জীবন নামক নৌকা বৈঠা বিহীন যেখানে-সেখানে বয়ে বেড়াবে।”

“বৈঠা বিহীন কেন বলছো? আমাকে কি তোমার জীবন নৌকার মাঝি করতে পারো না?” নবাবের কন্ঠ মায়া জড়ানো।

“ঝড়ে ডুবতে যাওয়ার নৌকার মাঝি কেন হতে চাইছো? এখনও কেন নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে পারছো না। তুমি তো বাচ্চা নও, পাগলও নও। তাহলে কেন এমন নির্বোধ হলে তুমি?”

মাথা নুইয়ে নিলো নবাব। মিষ্টি ওর চেয়ে বয়সে বড় সেক্ষেত্রে ওকে ছোট বলতে পারে। কিন্তু বাচ্চা বলবার কোনও যুক্তি নেই কারণ সে নিজের ভালো-মন্দ বুঝে শিখেছে বহুদিন আগেই, “হয়ত বাচ্চা নই কিন্তু পাগল তো হয়েছি সেই কবে থেকে।”

নবাবের মুখ নিসৃত বাক্যে মনে মনে হাসলো মিষ্টি কিন্তু সাধারণ গলায় বললো, “তোমার এই কথার ফাঁদেই সকলে পড়ে, না?”

চোখ তুলে নবাব খোশমেজাজে বললো, “সবাইকে দিয়ে কী হবে? তোমাকে ফাঁদে ফেলতে পারলেই বাজিমাত।”

কয়েক মূহুর্ত মিষ্টি নবাবকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। এরপর ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, “কত-শত চিন্তার মাঝেও তুমি এমন হাসো কীভাবে? আমি তো পারি না হাসতে। বারংবার কেবল মরতে ইচ্ছে করে।”

“মৃত্যুকে ইচ্ছের মধ্যেই আবদ্ধ রাখো কারণ বাস্তবায়ন করতে গেলে কঠিন শাস্তিকে নিমন্ত্রণ জানালে।” এই প্রসঙ্গে চুপ থেকে মিষ্টি অন্য প্রসঙ্গ টানলো, যেই প্রসঙ্গে কথা বলতে মিষ্টি নবাবকে ডেকেছিল, “কেকটা কি কাকতালীয় ছিল না-কি জেনে-শুনে?”

“কী মনে হয়?” ভ্রু নাচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো নবাব।

“মনে তো হয় জেনে-শুনে কিনেছো।… এতো আগের কথা এখনও মনে আছে?”
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১২

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

চিবুক নামিয়ে হালকা হাসলো নবাব কিন্তু কোনও জবাব দিলো না। মিষ্টি উত্তরের প্রতীক্ষা করলেও নবাবকে কোনও তাড়া দিলো না। পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে মিষ্টি নবাবের মাঝে সেই ছোট্ট নবাবকে খুঁজে পেল, যে ছোট্টবেলায় তাকে ‘আপু’ সম্বোধনে ব্যাকুল করে তুলতো।

“মা, আমাকে দুই প্যাকেট দাও।”

মেহমানদের জন্য খাবার সাজাতে ব্যস্ত নিঝুম মেয়ের কথায় ফিরে তাকালেন। হাতে থাকা কেকের প্যাকেটগুলো নামিয়ে রেখে বললেন, “একটার বেশি তো হবে না। সবাইকে দিতে হবে। আমি না হয় তোর বাবাকে বলে পরে তোকে এক বাক্স আনিয়ে দিবো।”

কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে কোনওমতে বোঝালেন কিন্তু মেয়ের এখনই কেক চাই। তাই পরে একগাদা কেক পাওয়ার সংবাদও তার মনঃপুত হয়নি।

“ওহ।” ছোট্ট জবাবে মিষ্টি রান্নাঘর ত্যাগ করলো। গোমড়া মুখে যখন ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিজের ঘরে দিকে হাঁটছে, তখন সেটা লক্ষ্য করে নবাব ওর পিছু নিলো। ঘরে এসে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো মিষ্টি। হাতে থাকা কেকের প্যাকেটে অহেতুক শব্দ করতে লাগলো। সেই দৃশ্য দেখে নবাব বলে উঠলো, “মিষ্টি আপু, কী হয়েছে?”

নিজের গোমড়া মুখ আড়াল না করে বরং অভিমান ভাসিয়ে মিষ্টি জবাব দিলো, “কিছু না।”

বিছানার এককোণে বসে নবাব বললো, “মিথ্যা কথা কেন বলছো? আমি তো বুঝতে পারছি তোমার মন খারাপ। আমাকে বলবে না?”

ডান দিকে ঘাড় কাত করে নবারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি জানতে চাইলো, “তোমাকে বললে কী হবে?”

“আমায় বললে আমি তোমার মন ভালো করে দিবো।”

হালকা হেসে একটু সময় নিয়ে ভাবলো মিষ্টি। এরপর ধীরে ধীরে বললো, “মাকে বলেছিলাম আমাকে দুইটা কেক দিতে কিন্তু মা একটা কেক দিলো।”

“ওহ, এই ব্যাপার?”

সামনে পিছনে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মিষ্টি। নবাব জানতে চাইলো, “কেক তোমার পছন্দ?”

“ভীষণ, আর Dan Cake হলে তো কোনো কথাই নেই। বিশেষ করে Chocolate Muffin Cake আমার অনেক পছন্দ। একটা কেক খেলে আমার একবেলার খাবার খাওয়া হয়ে যায়।”

“অনেক দামী কি?” কপাল ভাঁজ পড়লো নবাবের নিজের করা প্রশ্নে।

“অনেক দামী কিনা জানি না। তবে আমার বড় সাইজের কেকটা বেশি ভালো লাগে। এক প্যাকেট ত্রিশ টাকা।” বলেই হাতের প্যাকেট দেখিয়ে আবার বললো, “এই যে এটাই।”

“আমি কিনে দিলে খাবে?”

অবাক হয়ে, “তুমি কেন কিনে দিবে? তোমার কাছে টাকা আছে?”

“কেন? বড় হয়ে কিনে দিবো। যখন আমি বাবার মতো টাকা রোজগার করবো, তখন তোমাকে অনেকগুলো কেক কিনে দিবো।”

“ঠিক আছে ভাই।” হালকা হেসে মিষ্টি রাজি হলো।

“আমার আবার কেক, চকলেট এসব ঠিক পছন্দ না।” হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তে নবাব আবার বললো, “আচ্ছা আপু, তুমি কি খাবে আমার ভাগের কেক?”

সাত-পাঁচ না ভেবে মিষ্টি দ্বিমত পোষণ করলো, “উঁহু।”

“এই কেন, কেন?”

“তোমরাটা কেন খাবো? তুমি তো বেড়াতে এসেছো। অতিথিদের ভাগের খাবার খাওয়া ঠিক নয়। তাছাড়া মা জানলে রাগ করবে।”

একটু অভিমানী সুরে নবাব বলে উঠলো, “তুমি আমাকে অতিথি বানিয়ে দিলে আপু? যাও, আর তোমাদের বাসায় আসবো না।”

“না, না, আমি কি সেটা বলেছি না-কি?”

“তাহলে আমার কেকটা খেয়ে নাও।”

মা জানলে বকা দিবে এমন ভয়ে মিষ্টির মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু কেক না নিলে নবাব রাগ করবে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। সম্মতি পেয়ে নবাব উঠে দাঁড়ালো, “গ্রেট! তুমি বসো। আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।”

বাচ্চাদের আগেই কেক দেওয়া হয়ে গিয়েছিল আর নবাব তার ভাগের কেক মাকে দিয়ে রেখেছিল। ড্রয়িংরুমে নিজের মাকে খুঁজে না পেয়ে নবাব পায়ে পায়ে রান্নাঘরে চলে এলো আর পা রাখতেই নবাব শুনতে পেল, “ভাবী, মিষ্টির কথাগুলা উড়িয়ে দিবেন না। ছেলেটা ফুল না দিলেও ঘুরঘুর তো করেছে। এমনিতেই তো ওরে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তাই আমি বলছিলাম কি, এই বিষয় নিয়ে ভাইজানের সাথে আলাপ করেন।” নবাব তার মায়ের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। মিষ্টির মা অর্থাৎ তার মামী কিছু বলতে যাবে তার আগেই নবাবকে দেখে ওর মা জানতে চাইলো, “কী রে?”

“কেকটা দাও।”

“সোফার উপরেই রাখা আছে।”

“ঠিক আছে।” বলেই ড্রয়িংরুমে চলে এলো নবাব। মাকে যদিও সে বুঝতে দেয়নি মিষ্টিকে নিয়ে বলা কথাগুলো সে শুনেছে। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে সে কথাগুলো খুব করে ভাবছে। কেক হাতে মিষ্টির রুমে ঢুকে বলে উঠলো, “এই নাও।”

মিষ্টি হাত বাড়িয়ে কেকটা নিয়ে জানতে চাইলো, “এটা কি ঠিক হচ্ছে ভাই?”

“এত কথা বলো না তো। দিয়েছি যখন চুপচাপ খেয়ে নাও।”

“ঠিক আছে, খাচ্ছি কিন্তু আমার সাথে তোমাকেও খেতে হবে।”

“এই না, না, আমার সত্যিই কেক ভালো লাগে না আপু।”

“বেশি অংশ আমিই খাবো। তুমি শুধু একটু খাও প্লিজ।”

অগত্যা রাজি হলো নবাব, “আচ্ছা দাও।”

কেকের চার ভাগের তিন অংশ মিষ্টি নিজের কাছে রেখে এক অংশ নবাবকে দিলো তবু নবাব বলে উঠলো, “এতখানি কেন দিলে?”

নবাবের মাথায় হালকা চাটি মেরে মিষ্টি বললো, “এতখানি কোথায়?”

মাথায় হাত বুলিয়ে নবাব মুখ কুঁচকালো, “খালি মারে।” নবাবের মুখ নিসৃত শব্দযুগলে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো মিষ্টি। কিন্তু হাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হলো নবাব। কেক চিবিয়ে মুখের ডান পাশে রেখে মিষ্টি প্রশ্ন করলো, “নবাব, খাচ্ছো না কেন?”

শান্ত গলায় নবাব পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আপু, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করলে রাগ করবে?”

“নাহ, রাগ কেন করবো তাও তোমার ওপর?”

ইতস্তত করে নবাব বললো, “তোমাকে কে ফুল দিতে চেয়েছে?”

আচমকা এমন প্রশ্ন হতভম্ব হয়ে গেল মিষ্টি, “তোমাকে এসব কে বলেছে?”

“কেউ বলেনি। যখন কেক আনতে গেলাম, তখন মা আর মামীকে কথা বলতে শুনলাম। বলো না আমায় পুরো বিষয়টা।”

“তুমি বাচ্চা মানুষ এসব শুনে কী করবে?” একটু হাসার চেষ্টা করলো মিষ্টি।

“এই আপু, কী বললে তুমি? ক্লাস এইটে পড়ি আমি। তুমি আমাকে বাচ্চা কেন বলছো?”

“আমার চেয়ে তো ছোট, তাই না?”

“তুমি কি বলবে না আমায়?” নবাবের মুখের টানটান পেশী রাগের সাক্ষ্য বহন করছে।

“উফ, সবসময় এমন জেদ দেখাও কেন? ঠিক আছে, বলছি।” একটু থেমে মিষ্টি বলতে শুরু করলো, “কালকে যখন কলেজে যাবো বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রধান সড়কে, তখন দুইটা ছেলে এসে খানিকটা দূরে হাসাহাসি করছিল। আমি যখন তাকিয়ে বিষয়টা দেখেছি, তখন মনে হলো দুইটা ছেলেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজনের হাতে আবার গোলাপও ছিল।” এইটুকু শুনেই নবাবের চোয়াল শক্ত হলো, “তোমাকে কি কিছু বলেছে?”

“নাহ।”

“পরবর্তীতে কিছু বললে আমাকে জানাবে।”

“কেন?” বুঝতে না পেরে।

“গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিবো।” নবাবকে রাগে ফেটে পড়তে দেখে মিষ্টি সশব্দে হেসে আবার চাটি মারলো। এতে নবাবের রাগের উন্নতি হতে সে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “ধ্যাত! আবার মারলে কেন?”

“তোমার কথা শুনে। বয়সে বড় হওনি অথচ কথা শুনলে আমার চেয়েও বড় মনে হয়।”

“কথায় নয়, একদিন কাজেই প্রমাণ দিবো আমি তোমার বড়।”

হঠাৎ নবাবের ফোন বেজে উঠতে মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলো। আকাশে এখন সূর্য ভাসছে ঝলমলে রোদ নিয়ে। বেলা যত বাড়বে, ততই সূর্য দীপ্তি ছড়িয়ে পৃথিবীর বুক থেকে শীতলতা শুষে নিবে। চলন্ত বাসে বসে অবশ্য বাতাসকে তপ্ত মনে হচ্ছে না। বরং সূর্যের তাপ সরিয়ে ঠান্ডা বাতাসই মিষ্টির মন ভরাচ্ছে।

“দেরি হয় না সেটা জানা ছিল। আসলে কালকে রাতে বোধহয় জ্যামে আটকে ছিল বাস। তাই এতো দেরি হচ্ছে।” নবাব ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। সেদিকে কান পেতে মিষ্টি কথাগুলো শোনবার প্রচেষ্টা করলো। কিন্তু নবাব কোনও নামধাম উল্লেখ করলো না বিধায় সে ঠাওর করতে পারলো না, নবাব কার সাথে কথা বলছে?

“এত ফোন করিস না। যদি ধরা পড়িস তবে খবর হয়ে যাবে।” একটু চিন্তা ভাসলো নবাবের কন্ঠে। নবাব আবার বললো, “হয়ত বেশিক্ষণ লাগবে না। ধরে নে আর আধঘন্টা।”

অপর পাশের মানুষের কথা শুনতে পেল না মিষ্টি কেবল নবাবই একে একে বলে যাচ্ছে, “হ্যাঁ, কত কাহিনির পর খাবার পেটে পড়লো।” তাচ্ছিল্যের সুরের আভাস পেতে মিষ্টি নবাবের দিকে মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মিষ্টি এমন দৃষ্টি নবাবের চোখ এড়ায়নি। সেও তাকিয়ে রইলো মিষ্টির দিকে।

“হুম।” এই বলে নবাব কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখতেই মিষ্টি জানতে চাইলো, “খোঁচা না দিলে কি তোমার পেটের খাবারে বদহজম হতো?”

মিষ্টির মুখের এমন তিক্ত প্রশ্নে চোখ সরিয়ে নিলো নবাব। ওকে অহেতুক ফোনে ব্যস্ত হতে দেখে মিষ্টি জানতে চাইলো, “চুপ করে আছো কেন?”

“এই কথার প্রেক্ষিতে বলবার মতো বাক্য আমার মস্তিষ্কে আপাতত আসছে না। একবার বিছানাকান্দি পৌঁছাতে দাও এরপর কোমড় বেঁধে ঝগড়া করবো। দেখবো কত ঝগড়া তুমি করতে পারো?” কপট রাগে কথাগুলো বলে নড়েচড়ে বসলো নবাব। মিষ্টি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো। তার মনে হলে পথেঘাটে এভাবে ঝগড়াঝাঁটি করে লোক জানালে পরবর্তীতে নিজেরাই বিপদে পড়তে পারে।

…চলবে

গ্রুপ: ❤️কথা চৌধুরীর গল্পরাজ্য❤️

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here