#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____০৬
অন্ধকার থেকে একটা নারীমূর্তি এসে সম্পদের বুকে আছড়ে পড়লো। সম্পদ থমকে গেল। কয়েক সেকেন্ড লাগলো বুঝতে যে কেউ একজন তাকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। মেয়েলি স্পর্শ গুলো থেকে বরাবর সে নিজেকে রক্ষা করেছে। জীবনে প্রথম কোনো রমণীর ছোঁয়া তার ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করলো। নিঃশ্বাস ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে যেন। কেমন দম বন্ধ করা অদ্ভুত অনুভূতি। শরীরে অদ্ভুত শিহরণ! নারীমূর্তি আরো গভীর ভাবে তার বুকে মুখ লুকাতে কেঁপে উঠে সে। নারীমূর্তিকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরালো। নিজেও কিছুটা পিছিয়ে এলো। অস্ফুট স্বরে বলল,
‘তিথি!’
তিথির শরীর কাঁপছে। দাঁতে দাঁত আটকে আসছে। মৃগী রোগীর মতো কেমন ছটফট করছে। অস্পষ্ট ভাবে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে৷ সম্পদের ঘোর কাটলো৷ এগিয়ে এসে তিথির মুখোমুখি দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘তিথি, আমি! এত ভয় পাচ্ছো কেন? কি হয়েছে? আমায় বলো৷’
তিথি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁধে রাখা সম্পদের হাত চেপে ধরে রুমের ভেতরটা দেখাল। ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টাও করলো। সম্পদ বুঝতে পারলো না৷ কপাল কুঁচকে বলল,
‘কি হয়েছে? স্পষ্ট করে বলো। না বললে বুঝবো কি করে? লিসেন, ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আমি আছি!’
তিথি যেন জোর পেল। কম্পমান ঠোঁট জোড়া মৃদু আলগা করে বলল,
‘ও! ও এসেছে৷’
‘ও? কে ও? কে এসেছে?’
‘সবুজ!’
‘সবুজ? কে সবুজ?’
তিথি আর কিছু বলতে পারলো না। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো তার। সম্পদ তাকে আশ্যস্ত করার চেষ্টা করলো। আর প্রশ্নের মধ্যে গেল না। তাকে টেনে নিয়ে রুমের ভেতর গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে সুইচ টিপে আলো জ্বালাল। সঙ্গে সঙ্গে রুমে দিনের মতো ফকফকে আলো ছড়িয়ে পড়লো। সেই আলোতে ঘুরে সম্পদ তিথির দিকে তাকালো। এতক্ষণ তিথির মুখটা ভালো মতো লক্ষ্য করা হয়নি। এখন দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো তার। তিথির বিধ্বস্ত চেহারা। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। মাথার চুল অগোছালো। খোপা ঢিলে হয়ে ঘাড়ের উপর পড়ে আছে। কিছু আলগা চুল গলার ঘামে লেপ্টে আছে। চোখ মুখ ফোলা ফোলা! সে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ রুমে কিছু খুঁজছে।
তিথির হাতটা সম্পদ আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। এবারে কবজির কাছে ধরে চিন্তিত কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
‘এই তিথি? কি হয়েছে? বলো আমায়।’
তিথি ফের কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘সবুজ! ওই জানোয়ার এতক্ষণ রুমে ছিল। আমার গায়ের পোশাক টেনে খোলার চেষ্টা করছিল। আমি চিৎকার করে এত বাঁধা দিলাম কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছিলাম না।’
সম্পদ বুঝতে পারলো তিথি কার কথা বলছে। তার মানে তিথির প্রেমিকের নাম সবুজ ছিল, যে কি না তার সর্বনাশ করেছে। তিথি থরথর করে কাঁপছে। সম্পদ তার হাত আরো শক্ত হাতে চেপে ধরলো। তিথির পা থেকে মাথা অবধি পরখ করে হুট করে চোখ সরিয়ে নিল। তিথির বুকে ওড়না নেই! যা মাত্র খেয়াল করলো। মাথা নিচু করে সে বলল,
‘তিথি তুমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলে। সবুজ নেই! শুধু সবুজ কেন! লাল, নীল, সাদা, কালো কেউ নেই।’
সম্পদের কথা বলার ভঙ্গিতে তিথির কান্না থেমে গেল। আরেক নজর রুমে চোখ বুলিয়ে কনফার্ম হলো। রুমে সত্যি কেউ নেই! তাহলে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে? কিন্তু স্বপ্ন এতটা বাস্তবিক কি করে হয়? সবুজের নখের আঁচড় গুলোতে স্পষ্ট যন্ত্রণা হচ্ছিল তার।
‘আর তোমার জামাকাপড় সব ঠিকঠাক আছে। মানে কেউ খুলে নেয়নি।’
সম্পদের কন্ঠ আবার কানে এলো। তার কথা অনুযায়ী তিথি নিজের দিকে তাকালো। পোশাক ঠিক দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। হুট করে তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। লজ্জায় মুখ কুঁকড়ে গেল। এক ঝটকায় সম্পদের হাত ছাড়িয়ে সে বিছানা থেকে ওড়না গায়ে জড়ালো। সম্পদ আর তার দিকে তাকাল না৷
কিছুক্ষন পর ড্রয়িং রুম থেকে গ্লাসে করে পানি এনে দিল। ডেস্কের উপর রেখে বলল,
‘পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করো। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেউ তোমার আর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। ওটা তোমার জীবনের একটা দূর্ঘটনা ছিল। দূর্ঘটনা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। সবার জীবনেই একটা করে কালো অধ্যায় থাকে। এসব যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায় তত মঙ্গল।’
তিথি পানির গ্লাসটা নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। এক নিঃশ্বাসে গ্লাস খালি করলো। কপালে হাত রেখে দেখলো জ্বর নেই। কিন্তু শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। এক পলক সম্পদের দিকে তাকালো। সম্পদের দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ। তিথি লম্বা করে শ্বাস নিল। দৃষ্টি নত করে বলল,
‘আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সকাল হয়ে যাচ্ছে।’
‘তুমি কি করবে?’
‘আমিও ঘুমিয়ে পড়বো।’
তিথি মিথ্যে বললো। সে আর বাকি রাত টুকু ঘুমাবে না। ঘুমাবে না বলতে, ঘুমাতে পারবে না। চোখের পাতা বন্ধ করলেই সবুজ নামক নরপশুর বিভৎষ্য চেহারা ভেসে উঠে। তার সেই কুটিল হাসি কিছুতেই মন থেকে সরছে না। অথচ প্রথম দেখায় এই হাসির প্রেমে পড়েছিল সে। ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি এই সুন্দর হাসির আড়ালের মানুষটা কতটা নিকৃষ্ট!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে ৷ সম্পদকে আর কষ্ট দিতে চাচ্ছে না। এই মানুষটা তার উপর দয়া করেছে এতেই সে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। সত্যি বলতে বিয়েটা ভেঙে গেলে তার বেঁচে থাকার পথ চিরতরে হারিয়ে যেতো। তার সরল মনের বাবাকে লোকে কটু কথা শোনাতো। তার ভুলের শাস্তি বাবা-মা পেতো যা সে সইতে পারতো না। সে এক পলক সম্পদের দিকে তাকালো। সম্পদ সেই পূর্বের মতো নির্বিকার রয়েছে। সে কৃতজ্ঞতার সুরে বলল,
‘ধন্যবাদ আপনাকে। এখন গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’
সম্পদ নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল,
‘আজ থেকে দরজা খুলে রেখে ঘুমাবে। দুঃস্বপ্ন দেখলে আমি জাগিয়ে দিবো।’
সটান হেঁটে রুমের বাইরে এলো সম্পদ। দরজার বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। এতক্ষণ চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফেলে ঘন ঘন শ্বাস নিল। তিথির সামনে থাকার সময় টুকু সে শ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিল। বুক চেপে নিজের দিকে তাকালো সে। এই প্রথম কোনো নারীর স্পর্শ যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। ওই মুহূর্ত টুকু সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল সে। এক পলক তিথির রুমের দিকে তাকালো। তারপর ড্রয়িং রুমের কাউচে গিয়ে বসে পড়লো। তিথির রুমের দরজা খোলা। এখান থেকে রুমের অনেকখানি দেখা যায়। তবে বিছানার সাইড নয়। ওয়াশরুমের বন্ধ দরজা চোখে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে সে কাউচে পা মেলে শুয়ে পড়লো। তিথির দরজা পানে মুখ রেখে সে চোখ বন্ধ করলো। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। রুমে ঘুমানো যাবে না। তিথি দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করলে সে শুনতে পাবে না। তার চেয়ে এখানে ঘুমানো বেটার হবে। তিথি ভয় পেয়ে চিৎকার করলে শুনতে অসুবিধা হবে না। দ্রুত ওর কাছে পৌঁছাতে পারবে।
নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠলো সম্পদ। এসব কি ভাবছে? কেন ভাবছে? মেয়েটার এত খেয়াল কেন রাখছে সে? রাতের ঘুম হারাম করে সে মেয়েটার জন্য জেগে থাকার বৃথা চেষ্টা কেন করছে? ধপ করে চোখ খুলল সে। ঠিক তখুনি ওয়াশরুমের দরজার সামনে তিথির কালো রঙের ওড়নার এক অংশ দেখতে পেল। তড়িৎ গতিতে উল্টো ঘুরে গেল সে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। মেয়েটা কি না কি ভেবে বসবে। হয়তো ভাববে, লুকিয়ে তার ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আর চোখ খুলল না। মনের মাঝে উদয় হওয়া প্রশ্নগুলো ধামাচাপা দিয়ে দিল। এগুলোর উত্তর তার কাছে নেই। কোনোদিন যদি উত্তর খুঁজে পায় তখন আবার ভাববে। প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে গল্প সাজাবে।
সম্পদ কাউচে উল্টো ঘুরে শুয়ে আছে বলে তিথির উপস্থিতি টের পেল না। তিথি নিজের রুমের দরজা বন্ধ করতে এসে দীর্ঘক্ষণ সম্পদের দিকে চেয়ে রইলো। দরজা বন্ধ করবে নাকি সম্পদের কথামতো খোলা রাখবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। সবুজের সাথে এতদিন পথ চলার পরে তাকে চিনতে পারেনি। সম্পদকেও তার এই মুহূর্তে ভালো মনে হচ্ছে। কিন্তু তিন-চার দিনে মানুষটটিকে কতটুকু চিনতে পেরেছে সে? সে-ও যদি হঠাৎ করে তার ভালোমানুষীর মুখোশ খুলে ফেলে? সবুজের মতো মুখোশের আড়ালের কুৎসিত মুখের পরিচয় দেয়? তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে? সবুজের সাথে তার দেড় বছরের সম্পর্ক ছিল। এই দেড় বছরে যেই ছেলে তার হাত পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেনি, সেই ছেলে বিয়ের আগের দিন তার সব কেড়ে নিল। তিল তিল করে গড়া এতদিনের বিশ্বস্ততার পাহাড় এক নিমেষে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল। অথচ দীর্ঘদিন তার সাথে রাত জেগে কথা বলে, লুকিয়ে দেখা করে, পাশাপাশি হাঁটাচলা করেও তার নোংরা মনটা পড়তে পারেনি। বুঝতে পারি তার নোংরা দৃষ্টির নোংরা ইঙ্গিত। এতগুলো দিন একত্রে থেকেও যাকে চিনতে পারেনি, সেখানে সম্পদ নামক মানুষটাকে কি করে চিনবে? কি করে বুঝতে সক্ষম হবে তার মনে কি আছে! কতটা অন্ধকার লুকিয়ে রেখেছে নিজের মাঝে?
বোঝা সহজ নয়। তার চেয়ে সে সব ছেড়ে দিক। জীবন চলুক জীবনের মতো। মাঝরাতে যদি সম্পদ তাকে জড়িয়ে ধরে অধিকার ফলাতে চায় তবুও সে অবাক হবে না। বাঁধা দিবে না। তার নিজের শরীরের প্রতি ঘৃণা জন্মে গেছে। এই শরীর তাকে বহন করতে হচ্ছে ভেবেই সর্বদা আত্মা পুড়ে উঠে। এই নোংরা, দূষিত শরীরের ভালো মন্দ খেয়াল রাখতে হয় তাকে। এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে? দু চোখ জলে ভরে উঠলো তার। এই দেহ কি আর কোনোদিন পবিত্র হবে না? পৃথিবীতে কোনো ওষুধ কি নেই, যা এই নোংরা স্পর্শ গুলো মুছে দিতে পারবে? চিরতরে মুছে দিতে পারবে? তাকে ভুলিয়ে দিতে পারবে ওই ভয়াবহ মুহূর্তটুকু? হয়তো নেই!
ওড়নার কোণায় চোখ মুছে সে দরজা সামান্য ভিড়িয়ে দিল। অল্প একটু ফাঁক রেখে বিছানায় এসে বসলো। কিছুক্ষণ পর লাইট অন রেখে শুয়ে পড়লো।
৯.
তিথির ঘুম ভেঙেছে অনেক আগে। ইতোমধ্যে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে৷ কিন্তু রুম থেকে বের হয়নি। বিছানায় বসে সে বার বার দরজার পানে তাকাচ্ছে। দরজা সেই পূর্বের মতোই আছে। যতটুকু ফাঁক রেখে শুয়ে পড়েছিল ততটুকুই আছে। বিন্দুমাত্র নড়চড় হয়নি। কিন্তু দরজার ওপাশে সম্পদ কি করছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। এখনো কি ঘুমিয়ে? আর অপেক্ষা করতে পারলো না সে। ভোরের সূর্য উঠে পড়েছে অনেক আগে। ওড়নাটা ভালো মতো পেঁচিয়ে মাথায় দিল সে। তারপর সাবধানে দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিল।
(চলবে)