#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___০৭
সাবধানে দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিল তিথি। ড্রয়িং রুমে তাকাতে কাউচের উপর চোখ গেল। সম্পদ শুয়ে আছে। অবাক হলো সে। মানুষটা সারারাত এখানে কেন শুয়েছিল? সে তো ভেবেছিল রাতে ঘরে চলে যাবে। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সে। কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারলো, সম্পদ গভীর ঘুমে। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। এতবড় শরীরটা কাউচে সামলাতে পারেনি। বাম হাতটা ফ্লোর ছুঁয়েছে। ঘাড় ডান দিকে কাত হয়ে আছে৷ মাথার নিচে বালিশ নেই!
সে আর দাঁড়ালো না। রান্নাঘরের দিকে এগোল। তাকে কাজ করতে হবে। রান্না করতে হবে, ঘর পরিষ্কার করতে হবে, সম্পদের টুকিটাকি প্রয়োজনীয় সব কাজ করে দিতে হবে। এসব তার কর্তব্য! তাছাড়া সম্পদের ভালো মন্দ খেয়াল রাখার জন্যই তাকে বিয়ে করানো হয়েছে। শহরে আসার সময় সম্পদের মা অর্থাৎ তার শ্বাশুড়ি মা বার বার করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সে যেন সম্পদের উপর পূর্ণ মনোযোগ দেয়। তার খেয়াল রাখে। সে খেয়াল রাখবে। নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ লুকিয়ে সম্পদের খেয়াল রাখবে। ভালো মন্দের দেখ-ভাল করবে। শ্বাস নিল সে। রান্নাঘরে খোঁজাখুঁজি করে তেমন কিছু পেল না। সবজি নেই, রান্নার সরঞ্জাম নেই! বলতে গেলে কিছুই নেই। কি রান্না করবে তাহলে? ফ্রিজ খুলে দেখলো শুধু ডিম রয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না এই ছেলে নিজে রান্না করে খুব কম খেয়েছে। সারাক্ষণ হয়তো বাহিরের খাবার পেটে পড়েছে।
পাহাড়ি ঢলের মতো সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। হাজারো দুঃখ, কষ্ট ছাপিয়ে ক্ষুধা সময় মতো ঠিক মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে৷ উপায়ন্তর না দেখে সে ভাত আর ডিম ভাজির সিদ্ধান্ত নিল৷ এর চেয়ে সহজ মেনু তার জানা নেই। ভাতের চাল খুঁজে পেতে একটু কষ্ট করতে হলো। বাকি কাজগুলো দ্রুত সমাধা করে সে রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে দিল।
একটুপর ড্রয়িং রুমে এলো। না চাইতেও চোখ সম্পদের দিকে গেল। পূর্বের মতোই শুয়ে আছে মানুষটা। তিথির মনে হঠাৎ করে দয়ার উদ্রেক ঘটলো। সম্পদ বেকায়দায় শুয়ে আছে৷ ঘাড়ের উপর প্রেশার পড়ছে। পরবর্তীতে ঘাড় নিয়ে নড়াচড়া করতে পারবে না। তার চেয়ে মাথার নিচে একটা বালিশ দেওয়া যাক। বালিশ আনার জন্য সম্পদের রুমের দিকে এগোতে গিয়ে তার মনে পড়লো সম্পদ তার রুমে ঢুকতে বারণ করেছে। দো মনা করতে করতে দরজা অবধি গেল। কিন্তু ভেড়ানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সাহস পেল না। সরে এসে নিজের রুমে ঢুকলো। রাতের বেলা তার ব্যবহৃত বালিশটা হাতে উঠিয়ে নিল। বাইরে বের হলো। বাম হাতে সম্পদের মাথা উঁচু করে বালিশ চেপে দিল। মাথাটা বালিশের উপর রাখতে সম্পদ ধপ করে চোখ খুলল।
ভয়ে তিথি চুপসে গেল। বিস্ফারিত চোখে সম্পদের দিকে চেয়ে রইলো। যখন তখন ব্লাস্ট হওয়ার অপেক্ষায় রইলো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সম্পদ ফের চোখ বুজলো। হালকা নড়েচড়ে উঠলো। কয়েক মুহূর্ত পরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
তিথি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সরে এলো। সম্পদ ঘুমের ঘোরে চোখ খুলেছিল। না হলে নিশ্চিত ধমকা ধামকি করতো।
১০.
সম্পদের ঘুম ভাঙলো বিকট একটা শব্দে। কিছু ভাঙার ঝনঝন শব্দে! সে একলাফে কাউচ ছেড়ে উঠে পড়লো। শব্দের উৎসমুখ খুঁজতে আশপাশে তাকালো। ঘুম ঘুম চোখে দেখলো আশপাশে কেউ নেই। কিন্তু স্পষ্ট শব্দ শুনেছে সে। রান্নাঘরের দিকে ভালো মতো তাকাতে তিথির ওড়নার এক অংম দেখতে পেল। ফ্লোরে উবু হয়ে কি যেন করছে। তড়িঘড়ি করে উঠে রান্নাঘরের দিকে দৌঁড় দিল।
‘এত শব্দ হলো কেন?’
চমকে তিথি পেছন ঘুরে তাকাল। দেখলো সম্পদ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে হাতের কাচের টুকরোটি পড়ে গেল। সে নিচু স্বরে বলল,
‘হাতের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেছে। পানি খেতে নিয়েছিলাম একটু।’
মেঝে জুড়ে কাচের টুকরো। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সম্পদ তিথির দিকে তাকালো। তিথির ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেল হঠাৎ। সামান্য গ্লাস ভেঙে গেছে। অথচ মেয়েটা ভয়ে এতটা কুঁকড়ে গেছে যেন পুরো পৃথিবী ভেঙে ফেলেছে৷ এই ভয়কেই সে কাজে লাগাতে চাইলো। মুখটা গম্ভীর করে বলল,
‘একটা গ্লাসের দাম কত নিয়েছে জানো?’
তিথি মাথাটা আরো নিচু করে ফেলল। কাতর স্বরে বলল,
‘স্যরি! অন্যমনস্ক ছিলাম।’
‘আমার জিনিসপত্র ছোঁয়ার আগে পূর্ণমনস্ক থাকবে। কেমন?’
তিথি শুধু মাথা নাড়লো। সম্পদের চোখ গেল পাশের টেবিলটার উপর। ধোঁয়া উঠা গরম ভাত। সাথে ডিম ভাজির কড়া একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে। তিথির অবস্থার উন্নতি দেখে ভেতরে ভেতরে পুলকিত অনুভব করলো সে। কাজের মধ্যে থাকলে দ্রুত মানসিক অস্থিরতা দূর হবে৷ তিথি ভাঙা কাচের টুকরোতে হাত দিতে নিতে সম্পদ বাঁধা দিল। ভেতরে ঢুকে বলল,
‘তুমি বাইরে যাও তো। আমি পরিষ্কার করছি।’
‘আপনি পরিষ্কার করবেন?’
‘কেন? এত তাচ্ছিল্যের সুরে বলছ কেন? আমি পারবো না ভেবেছ? এতটা অকর্মণ্য মনে করেছ? সরো তো! উঠে পড়ো। দেখতে থাকো আমি পারি কি না!’
তিথি পুরো বেকুব বনে গেল। সম্পদের ধমক শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ হঠাৎ রেগে গেল কেন? সে তো রাগের মতো কিছু বলেনি। বিস্মিত হয়েছে। সে চুপচাপ সরে এলো।
মিনিট দশেক পর সম্পদ ফ্লোর থেকে কাচ সরাতে সক্ষম হলো৷ হাতে পলিথিন পেঁচিয়ে কাচ তুলতে গিয়েও অল্প একটু জায়গা কেটে গেছে। এজন্য সে তিথিকে দিয়ে কাজটা করাতে চায়নি। ময়লার ঝুড়িতে সব রেখে সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে পড়লো। তিথি প্লেটে ভাত নিয়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে ভাত মাখাচ্ছে। খাওয়ার প্রতি মনোযোগ নেই। সে গলার স্বর উঁচু করে বলল,
‘তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো৷ আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি।’
তিথি কৌতূহল দমাতে না পেরে বলে ফেলল,
‘আপনার ওয়াশরুম যাওয়ার সাথে আমার তাড়াতাড়ি খাওয়ার কি সম্পর্ক?’
‘সব জায়গা সম্পর্ক খুঁজতে বলেছে কে তোমাকে? আমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টেবিল ফাঁকা চাই। তোমার সাথে একত্রে খেতে পারবো না।’
‘আমিও পারবো না। সেজন্য আগেভাগে খেতে বসেছি।’
তিথি অস্পষ্টতার সহিত বলল যার সবটা সম্পদের কানে পৌঁছাল না। সে হাঁটা ধরলো৷ কিছুদূর গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। তিথিকে শাসিয়ে বলল,
‘প্লেটে যা খাবার নিয়েছ সম্পূর্ণটা শেষ করবে। এখানে রান্না করা খাবার ফেলার জায়গা নেই। খবরদার শুকনো ময়লার ঝুড়িতে ফেলবে না যেন। পঁচে দূর্গন্ধ বের হবে।’
বলে সে নিজের রুমে ঢুকে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকে সময় নিয়ে দাঁত ব্রাশ করলো। ফ্যানাযুক্ত থুথু বেসিনে ফেলে সে আয়নার দিকে তাকালো। আয়নায় ভেসে উঠা নিজের গৌড় বর্ণের চেহারার দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হাসলো। কেন জানি আজকের সকালটা অন্য দিনের চেয়ে আলাদা মনে হচ্ছে। কোথাও তো সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন ঠিক ঘটেছে। যা সে ধরতে পারছে না। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেশ দেখা দিল। আচমকা তার কপাল কুঁচকে গেল। আয়নার ভেতর দিয়ে নিজের গলার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটুপর বাম হাত দিয়ে গলায় হাত রাখলো। হাতে উঠে এলো লম্বা একটা নারীচুল। চোখের সামনে চুলটা ধরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে। এই চুল তার গায়ে এলো কিভাবে? এটা তো তিথির মাথার মনে হচ্ছে।
ব্রাশ ফেলে রেখে সে দৌঁড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। তিথির সামনে গিয়ে হাতটা উঁচু করে ধরলো। চেঁচিয়ে বলল,
‘এসব কি?’
তিথির খাওয়া শেষ হয়নি। সে অবাক হয়ে বলল,
‘কোনসব কি?’
‘তোমার মাথার চুল আমার গায়ে কেন?’
‘আমি কি করে বলবো?’
সম্পদকে হেলাফেলা করে তিথি এক লোকমা ভাত মুখে দিল। সম্পদ চুলটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি কিভাবে বলবে মানে? রাতের বেলা জড়িয়ে ধরেছিলে মনে নেই?’
ভাতের প্লেটে তিথির হাত থেমে গেল। মুখের খাবার চিবানো বন্ধ হয়ে গেল। ওই মুহূর্তটা সে মনে করতে চাইছিল না। দুঃস্বপ্নের অংশ বলে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সম্পদ ঠিক স্মরণ করিয়ে দিল। তাকে চুপ থাকতে দেখে সম্পদ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তার নিজেরও বুকের ভেতরে গতকাল রাতের মতো কেমন অদ্ভুত অনুভূতির উদয় হলো। হাতের চুলটা ফেলে দিয়ে সে তিথির মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে পড়লো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল,
‘আমাকে নাস্তা দাও তো!’
তিথি পানি দিয়ে মুখের খাবারটুকু গিলে ফেলল। সম্পদের দিকে না তাকিয়ে বলল,
‘আপনি ফ্রেশ হবেন না? ঠোঁটের কোণে পেস্টের ফ্যানা জমে আছে। কুলি করবেন না?’
‘করবো না। তোমার কোনো সমস্যা?’
‘না!’
তিথির উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না সম্পদ। সে কি চাইছে সেটাই জানে না। তিথির মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। আবার বেশিক্ষণ না তাকিয়েও থাকতে পারছে না। সবকিছু কেমন অগোছালো মনে হচ্ছে। তিথিকে সে নিজে দূরে দূরে থাকতে বলছে। আবার নিজেই নানা অজুহাতে তার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করছে। একা ফ্ল্যাটে সে দিনের পর দিন কারো সাথে কথা না বলে থেকেছে। নিজেকে চুপচাপ হিসাবে জানে সে। কিন্তু এখন বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এমন কেন হচ্ছে?
তিথি আলাদা প্লেটে দেড় চামচ ভাত আর ডিম ভাজি দিয়ে সম্পদের দিকে বাড়িয়ে দিল। সম্পদ খাবার দেখে চমকে উঠলো। বলল,
‘এত সকালবেলা ভাত খাব? ভাত কেন?’
‘ভাত ছাড়া অন্য কিছু আছে নাকি? খুঁজে তো পেলাম না। রুটি বা নুডলস করতে চাইলাম। চাল ছাড়া কিছু পেলাম না।’
‘আমি এক্ষুণি বাজারে যাচ্ছি।’
সম্পদ যেন সুযোগ খুঁজছিল। সটান উঠে পড়লো। তিথির দিকে আর তাকাল না। হাঁটা ধরলো। কাউচের পাশ দিয়ে আসার সময় বালিশের দিকে নজর গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়ালো সে। এটা তো তিথির রুমে থাকার কথা। কাউচের উপর কি করছে? বালিশের কাভারের উপর দু-তিনটা লম্বা চুল ছড়িয়ে আছে। সম্পদের বুকের ভেতর ফের কেমন যেন করে উঠলো। দ্রুতলয়ে রুমে ঢুকে গেল সে।
১১.
তুমি নিশাচর হয়ে এসো,
কোনো একদিন এসে আমার দরজায় কড়া নেড়ো! আমি সৃষ্টিলগ্ন থেকে প্রতীক্ষায় আছি।
অন্তত একবার!
তুমি জোনাকি হয়ে এসো!
আমার রাত জাগা অপেক্ষার বাক্সে শেষ পেরেক গেঁথে দিতে।
না হয় তুমি সন্ধ্যা আকাশের শুকতারা হয়ে এসো,
এক ঝলক দেখা দিয়ে আবার,
মুখ লুকিয়ো মেঘের আড়ালে!
পারলে ঝড়ো বৃষ্টির রাতে একবার এসো!
বিজলির মতো আমার অামিত্বের অন্ধকার,
ক্ষণিকের জন্য আলোকিত করতে।
সর্বোপরি, কোনো এক রাতে এসো তুমি,
আমার সব রাত তোমার নামে বরাদ্দ।
রাতের বেলা তোমায় আবিষ্কারের নেশায়
মত্ত হয়ে যাই এই আমি!
মনে থাকবে? কোনো এক রাতের আঁধারে,
তুমি তুচ্ছ কিছু হয়ে এসো।
আমি দরজার পাশে প্রতীক্ষায় আছি।
কি? আসবে তো?
-অজান্তা অহি
রাতের বেলা বিছানায় বসে সম্পদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিল আর কাব্যিক চিন্তা ভাবনা করছিল। ইদানীং বেশি দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে তার। ভার্সিটি লাইফের সিগারেটের নেশাটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে রাত ছাড়া সে স্মোক করছে না। তিথিকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফেরার পর থেকে একটা রাতও সে ঘুমাতে পারেনি। তার ভাবনার মাঝে বন্ধ দরজার ওপাশে কেউ কড়া নাড়লো। কপাল কুঁচকে গেল তার। অনেক রাত হয়ে গেছে। তিথি এখনো ঘুমায়নি? আঙুলের ভাঁজের সিগারেটটা কাচের টেবিলের উপর রেখে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
(চলবে)
সব সমস্যা মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। এখন থেকে ইনশাআল্লাহ রেগুলার গল্প পাবেন। রাতের বেলা ‘অনুভবের প্রহর’ দিবো।