#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____০৮
আঙ্গুলের ভাঁজের সিগারেটটা কাচের টেবিলের উপর রেখে সম্পদ দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। আজ সিগারেটের মাত্রা বোধ হয় একটু বেশি হয়ে গেছে। দরজার ওপাশে আবার টুংটাং আওয়াজের হলো। সম্পদ দরজা খুলল না। সে এই মুহূর্তে দরজা খুলতে চাচ্ছে না। রুম জুড়ে সিগারেটের ধোঁয়া আর গন্ধ। এ অবস্থায় সে তিথির মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না৷ এপাশ থেকে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করল,
‘কে?’
প্রশ্নটা করার পর বুঝতে পারলো বোকার মতো প্রশ্ন করা হয়েছে। দরজার ওপাশে তিথি ছাড়া আর কে হবে! তবে কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম হওয়ার পরও যখন ওপাশে থেকে উত্তর এলো না তখন সে কিছুটা ভড়কে গেল। মাথা চুলকে বলল,
‘কে?’
‘আমি! একটু দরজা খুলুন।’
তিথির বিনীত কন্ঠ ভেসে এলো। এত রাতে তিথির আংশিক ঘুমজড়ানো কন্ঠ সম্পদের কানে যেতে বুকের ভেতর তোলপাড়ের সৃষ্টি হলো। আজ তাদের বিয়ের এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। মাত্র সাত দিন হলো একসাথে রয়েছে। তবুও হুটহাট তিথির কন্ঠ শুনলে কেমন যেন লাগে। কোথায় যেন অদ্ভুত এক টান অনুভব করে। সে চাপা স্বরে বলল,
‘খুলছি।’
খুলছি বলেও সে খুলল না। জ্বলন্ত সিগারেটের আগুন নিভিয়ে সেটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলল। ছাই পরিষ্কার করে বিছানার চাদর টান টান করলো। নাক দিয়ে শুঁকে দেখলো রুমে ধোঁয়ার গন্ধ আছে কি না। তার নাকে এলো না। তবুও সেফটির জন্য রুম স্প্রে করলো। তিথির সামনে কোনো অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে চাচ্ছে না। গায়ের টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করলো। চুলে আঙুল চালিয়ে দরজা খুলল সে। দরজার ওপাশে তিথি ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে কপাল কুঁচকে বলল,
‘এত সময় লাগে দরজা খুলতে?’
সম্পদ ভারী অবাক হলো। এই মেয়ে তো তাকে মেজাজ দেখানো শুরু করে দিয়েছে। সর্বনাশ! সে এতটা লাই দিয়ে ফেলেছে? সে থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে? এত রাতে দরজা ধাক্কাধাক্কি করার কারণ কি?’
ঝটপট তিথি নাক চেপে ধরলো। কিছুদূর পিছিয়ে গিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সম্পদের দিকে তাকালো। নাক সিঁটকে বলল,
‘আপনার মুখ থেকে কি বাজে গন্ধ বেরুচ্ছে।’
সম্পদ চুপসে গেল। তিথির নাক কুঁচকানো দেখে ভীষণ অপমানিত বোধ করলো। সেই সাথে সিদ্ধান্ত নিল আস্তে ধীরে সিগারেট ছেড়ে দিবে। একদম স্পর্শ করবে না। এক হাতে মুখ আড়াল করে বলল,
‘ডাকছিলে কি জন্যে?’
‘আপনার বাবা ভিডিও কলে দুজনের সাথে একত্রে কথা বলতে চাইছে।’
‘কি? এত রাতে?’
‘বাবা বাড়ি ছিলেন না। কোনো মিটিং এ ছিলেন তিনদিন। মাত্র ফিরেছে। তাই এখুনি কথা বলতে চাচ্ছে।’
‘ভেতরে এসো তাহলে।’
বলে সম্পদ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। কিন্তু তিথি ভেতরে ঢুকলো না। সম্পদ পেছন ঘুরে দেখলো আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সে আশ্চর্য হয়ে গেল। জিগ্যেস করলো,
‘ভেতরে ঢুকছো না কেন?’
‘আমরা ড্রয়িং রুমে কথা বলি?’
সম্পদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে তিথি তার রুমে ঢুকতে চাইছে না। এখানে আসার পর তিথিকে রুমে ঢুকতে বারণ করেছিল। হয়তো সেই বাক্য এখনো স্মরণে রেখেছে। সে কড়া গলায় বলল,
‘আমার সব কথা বেদ বাক্যের মতো মানবে না তিথি। ড্রয়িং রুমে যাও। আমি আসছি।’
তিথি কিছু না বলে হাঁটা ধরলো। সম্পদ এক পলক তার গমনপথের দিকে চেয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ভালো মতো দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে সে বের হলো। মুখের সামনে হাত নিয়ে শ্বাস পরীক্ষা করলো। নাহ, গন্ধ নেই! আয়নায় এক নজর নিজের উপর চোখ বুলিয়ে সে বাইরে বের হলো।
তিথি কাউচের উপর বসে পড়েছে। মাথায় ভালো মতো ওড়না পেঁচানো। দৃষ্টি ফোনের উপর নিবদ্ধ। সম্পদ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে পড়লো। একটু কাছ ঘেঁষে বসতে বাহুতে বাহু স্পর্শ করল। খুবই ক্ষীণ স্পর্শ! তাতেই তিথি মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। সরে বসানোর জন্য উঠতে নিতে সম্পদ তার হাত টেনে ধরলো। পাহাড়সম চমকে গেল তিথি। বিচলিত কন্ঠে বলল,
‘হাত ধরছেন কেন?’
‘হাতই ধরেছি জাস্ট। খেয়ে ফেলছি না তো। বাবা আমাদের মাঝে এত দূরত্ব দেখলে সন্দেহ করবে না? দূরে সরে যাচ্ছো কেন?’
তিথি প্রতিবাদ করলো না। উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। কিছুদিন যাবত সে লক্ষ্য করছে সম্পদের অদ্ভুত আচরণ। তার মাঝে একটু একটু করে পরিবর্তন আসছে। কিন্তু কেমন পরিবর্তন সেটা ঠাওর করতে পারছে না।
ভিডিও কল এসেছে। সম্পদের থেকে হাত ছাড়িয়ে তিথি কল রিসিভ করলো। বিনীত স্বরে সালাম দিয়ে হাসিমুখে বলল,
‘কেমন আছেন বাবা?’
ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর একটা কন্ঠ ভেসে এলো। সেই সাথে স্ক্রিণে ভেসে উঠলো মধ্য বয়স্ক, কর্মঠ এক পুরুষ অবয়ব। তিথি কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা সম্পদের হাতে ধরিয়ে দিল।
সম্পদ অনেকখানি সময় নিয়ে মা-বাবার সাথে কথা বলল। পুরোটা সময় তিথিকে পাশে বসে থাকতে হলো। সম্পদের এত কাছে বসে থাকতে কেমন যেন আড়ষ্টতা অনুভব করছিল। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে টইটম্বুর হয়ে গেল। অস্থির চোখ জোড়া ছুটে পালানোর জন্য সদা পথ খুঁজতে ব্যস্ত। সে মানুষটার থেকে দূরে দূরে থাকতে চায়। সম্পদ কল কেটে দিতে সে ঝটপট উঠতে নিল। দু পা সামনে এগোতে ওড়নায় টান পড়লো। মাথার পেঁচিয়ে রাখা অংশ খসে পড়লো। বুক কেঁপে উঠলো তিথির। সম্পদ ওড়না টেনে ধরছে কেন? তবে কি পুরনো ক্ষত মিশে যাওয়ার আগেই আবার নতুন করে ক্ষতের সৃষ্টি হবে?
বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলেো তার। হাত পা কাঁপতে লাগলো। বুকের কাছের চেপে রাখা ওড়নাটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখ দুটো জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। পেছন ঘুরে সম্পদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস হলো না। কম্পমান ঠোঁট নেড়ে রুদ্ধ গলায় বলল,
‘ওড়না ছাড়ুন। প্লিজ!’
তিথির জড়ানো কন্ঠের বাক্য সম্পদের বোধ গম্য হলো না। ফোনের স্ক্রিণ থেকে চোখ সরালো না সে। ঠোঁট কামড়ে বলল,
‘কিছু বললে?’
সম্পদের অতিশয় স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে তিথির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। সবুজের দেওয়া আঘাত গুলো, সে দূর্বিষহ মুহূর্তটা মানসপটে ভেসে উঠলো। কিয়ৎক্ষণ পরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। নিস্তব্ধতার মতো থমকে গেল সম্পদ। হাতের ফোন ফেলে রেখে তিথিকে নিজের দিকে ঘুরাল। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘কি হলো আবার? হুটহাট কান্না করছ কেন?’
তিথি দু চোখ বন্ধ করে কেঁদে যাচ্ছে। সম্পদ ভয়ানক চিন্তায় পড়ে গেল। এই তো হেসে হেসে তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বললো। হঠাৎ আবার কি হলো? তক্ষুণি তিথি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘আমার ওড়না ছাড়ুন। প্লি-জ।’
সম্পদের কপালের খাদ আরো গভীর হলো। চোখের দৃষ্টি সামান্য নত করতে দেখতে পেল তিথির ওড়নার একটা কর্ণারের উপর সে বসে আছে। সে ধমকে বলল,
‘আজব তো তুমি। কিছু না জেনে, না শুনে, না বুঝে, না দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছ? তোমার ওড়না টেনে ধরতে গেছে কে?’
তিথি আচমকা চোখ খুলল। সম্পদ সামান্য উঠে ওড়নাটা টেনে বের করলো। সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেল তিথি। ওড়নাটা ভালো মতো গায়ে পেঁচিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। সম্পদের হাত ধরা দেখে সে তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেবে নিয়েছিল আজ রাতে সম্পদ হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটাবে। হারানো নিঃশ্বাস ফিরে পেল যেন। বুকের ভেতর কিছুটা স্বস্তি মিলল। দু হাতে চোখ মুছে ফেলল। মাথা নিচু করে বলল,
‘স্যরি!’
‘আমাদের সম্পর্কের এক সপ্তাহ গড়িয়ে গেছে। সাত দিন মানে কত ঘন্টা জানো? একশ আটষট্টি ঘন্টা। অর্থাৎ দশ হাজার আশি মিনিট। এতবড় সংখ্যা তোমার কাছে যা তা মনে হয়? অথচ দেখো, এত সময় আমার সাথে একত্রে কাটিয়েও তুমি আমায় বিন্দুমাত্র চিনতে পারনি। তুমি ধরেই নিয়েছ, আমি সুযোগ বুঝে যখন তখন তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। কিন্তু ভেবে দেখলে না, আমার এমন ইভিল ইনটেনশন থাকলে প্রথম রাতেই কাছে যেতাম। তখন তুমি জ্বরের ঘোরে অচেতন ছিলে৷ বাঁধা দেওয়ার ন্যুনতম শক্তি অবশিষ্ট ছিল না।’
‘দুঃখীত। আমায় ক্ষমা করবেন।’
সম্পদ উঠে দাঁড়ালো। তিথির ফোনটা কাউচের দিকে ঠেলে দিল। এক পলক আশপাশে তাকিয়ে বলল,
‘আমায় নিয়ে তোমার ভাবনা দেখে ভীষণ আহত হয়েছি। অথচ এটা আমি চাইনি। আমি চেয়েছিলাম তোমার মনের ভেতর আমায় নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ চরিত্রের একটা ইমেজ তৈরি হোক।’
তিথি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সম্পদ হাত বাড়িয়ে তাকে কিছু বলতে নিতেও থেমে গেল। তিথির আবেগপ্রবণ অনুভূতি তাকে স্পর্শ করতে গিয়েও গলাতে পারলো না। চুপচাপ ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। গ্লাসে করে পানি ঢেলে আনলো। তিথির সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘পানি খেয়ে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ো।’
তিথি ভেজা দৃষ্টি দিয়ে সম্পদের দিকে এক পলক তাকাল। তারপর পানির গ্লাসটা হাতে নিল। চোখ বন্ধ করে তাতে চুমুক দিল। সম্পদ মনে মনে বলে উঠলো,
‘এত তুচ্ছ কারণে চোখের জল ফেলো কেন বলোতো? তুমি নিজেও জানো না তোমার চোখের জল ঠিক কতটা মূল্যবান। এক সমুদ্র বুকের রক্ত ঢেলেও এই জল শুধু নিজের করে পাওয়া যায় না।’
পানির গ্লাস খালি হতে সম্পদ সেটা হাতে নিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘অকারণে চোখের জল নষ্ট কোরো না। কিছু জল আনন্দাশ্রুর জন্য রেখে দিও। পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ আপেক্ষিক। দেখা গেল, ভবিষ্যতে আনন্দের জোয়ারে ভাসছো। কিন্তু খুব করে চেয়েও দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারছো না। তখন মরুভূমির মতো শুষ্ক আনন্দে ভেসে বেড়াতে হবে।’
বলে সম্পদ অপেক্ষা করলো না। গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে নিজের রুমে ঢুকে গেল। তিথির অশ্রু বাঁধ মানলো না। এতদিন সবসময়, প্রতিটি মুহূর্তে, ঘুমন্ত অথবা জাগ্রত অবস্থায় যে করুণ মুহুর্তটা মনে পড়তো সেটাই মনে পড়লো। মনে পড়লো সবুজের দেওয়া তিক্ত অনুভূতির বিষ। তার ভেতরের অনুভূতির রাজ্যে আগুন ধরেছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। সেই ছাইয়ের উপর জন্মেছে আবর্জনার স্তূপ। যে অনুভূতির স্তূপ থেকে গন্ধ ছড়ায়। দূর্গন্ধ! কোনোদিন কি এই অনুভূতি বিশুদ্ধ ও চিরন্তন হবে?
হাত পা ভাঁজ করে কাউচেই মাথা এলিয়ে দিল সে।
(চলবে)