#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত
#সাদিয়া_নওরিন
পর্ব—-২২
ডিসিহিলের একপাশের কর্নারের গাছের ছায়ায় একটি বেঞ্চে বসে আছে ইরশাদ। উত্তেজনায় গলা কাঁপছে তার। সাথে কাঁপছে তার হাতও। টেনশনের সাথে পাল্লা দিয়ে যেন বেড়ে চলেছে তার উদ্বেগ। প্রথমবারের মতো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে কিনা এ নিয়ে সংষয় যেন তার হৃদয়ে! পরপর ঢোক গিলে তার থেকে একটু সামনের বেঞ্চগুলোর দিকে তাকালো সে। কয়েকজোড়া কপোত-কপোতী বসে আছে সেখানে। আবার কিছু এসেছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে।
ঘড়িতে দুইটা বেজে চল্লিশ! খুব তাড়াতাড়ি পার্কে এসেছে আজ ইরশাদ। যদিও তিনটা বাঁজে আশার কথা ছিল তার। কিন্তু বারোটা থেকে রেডি হওয়ার তাড়ায় ছিল সে! তার ধারণা ছিল সে সময় মতো বের হতে পারবে না কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সময়ের আধাঘন্টা আগেই পৌঁছে গিয়েছে সে পার্কে!
রিক্সার হুডির আড়ালে আরেকটু চেপে বসলো আরশী।ঘোমটা টি আরেকটু ভালোভাবে মাথায় টেনে ব্যাগটি বুকের সাথে চেপে নিল সে! বুকটি বড্ড দূরদূর করছে তার। আজ জিবনে প্রথম এভাবে সবার অলক্ষ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে সে! মাকেও মিথ্যে বলেছে বেরুবার সময়। আর এইকারনেই হয়তো অদ্ভুত এক খারাপ লাগা মন ভার করে রেখেছে তার।
বারবার কপালের ঘামটুকু মুছচ্ছে আরশী। মনের ভেতরটা কেমন কু ডাকছে তার। কিন্তু তা আর আমলে নিল না সে।বরং পরপর গভীর লম্বাশ্বাস টেনে নিজেকে সামলাতেই লেগে গেল আরশী!
হাতের ঘড়িটির দিকে তাকালো ইরশাদ। তিনটা বেজে পনের। ভয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে তার এখন। আরশী কি আজো আসবে না, এমনটাই ভয় হচ্ছে তার আবার।সে চোখ বুঝে রয় কিছু সময়।
হঠাৎ তার ঠিক পাশে একটি মেয়ে টুপ করে বসে পড়লো তার বেঞ্চে! ইরশাদ আলতো ব্রু কুঁচকে তাকালো মেয়েটির দিকে। তারপর স্বাভাবিক মুচকি হেঁসে বলল,
—– আপু, এখানে একজন আসবেন। আপনি প্লিজ অন্য সিটে বসুন।
মেয়েটি ঠোঁটে হাঁসি ঝুলিয়ে তার দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা তার! ইরশাদ একটু বিষ্মিত হলোএতে। কিন্তু সে নিজের বিষ্ময় লুকিয়ে আবার বলল,
—- আপু, আপনি কি এখানে বসবেন? ওকে বসুন। আমি না হয় চলে যায়।
আরশী পুলকিত ভাবে ইরশাদকেই দেখছে। হলুদ সাদা মিক্স শার্টে দারুন লাগছে তাকে। শার্টের হাতা ফোল্ড করা। হাতে হুয়াইট ওয়াচ। পরনে হোয়াইট ইয়েলো সু! পুরো হুয়াইট প্রিন্সের মতো মনে হচ্ছে এখন তাকে। পুরো পার্কে যেন জ্বলছে সে তার সৌন্দর্যে৷ আরশী আলতো মাথা নুইয়ে নিজের দিকে তাকালো। ছেলেটা যে ছবির চেয়েও সুন্দর! আরশীর এবার ভয় হলো, ছেলেটা যদি তাকে দেখে প্রছন্দ না করে! ঠিক তখনি ইরশাদকে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে যেতে দেখলো সে।আর সাথে সাথে ডাক দিল তাকে আরশী!
—– আপনার উঠার দরকার নেই। আমি অন্যকোথাও গিয়ে বসছি।
ইরশাদ দুকদম সামনে পা বাড়িয়ে থমকে দাঁড়ালো! বিষ্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল তার! সে তাড়াতাড়ি পেছনে ফিরে আরশীর দিকে এগিয়ে এলো। ভেতরটা টিপটিপ শব্দ করছে তার যেন। পেটের ভেতরটাও মোচড় দিচ্ছে ইরশাদের। তার সামনের মেয়েটি কি আসলেই “ছন্দ”! আনমনে ভাবলো সে!
গ্রীন ব্ল্যাক কম্বিনেশনের একটি জর্জেট ত্রিপিস পড়েছে মেয়োটি৷ হাতে হুয়াইট কালারের ব্যাগ। হলদে-সোনালি গায়ের রঙ। চোখে চিকন কাজল আর ঠোঁটে কেবল ভ্যাসলিন। কিন্তু তার গোলাপি ঠোঁটের পাশে গাড় তিল! ইরশাদ সেদিকে তাকিয়ে হুট করেই বলে উঠলো,
—- তুমি প্রেম করে বিয়ে করবে ছন্দ। একদম প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যেই বিয়েটা হয়, একদম সবার সাথে লড়ে তেমন বিয়ে করবে তুমি ছন্দ!
আরশী পিটপিট চোখে পলক ফেলল। ছেলেটির কথাগুলো একদমই বোধগম্য হচ্ছে না তার। তাকে হুট করে কিভাবে চিনে নিল সে! আর তার চেয়ে বিষ্ময়ের কথা তাকে কি বলল সে এতোক্ষণ ! সে বিষ্ময়ে একদমই থ বনে গেল!
বড় বড় পলক ফেলে বলে উঠলো সে,
—— তুমি চিনলে কিভাবে আমায়! আর কি বলছো এসব?
—— প্রথমত তোমার কণ্ঠস্বর শুনে। এই স্বর ভোলা সম্ভব নয় আমার জন্য। আর বিয়ের কথাটা দুষ্টুমি করেই বললাম। ঠোঁটের কাছে তিল থাকলে এমনটা হয় শুনেছি।তোমার তো দুইটা আছে একটা কাছে আরেকটা ঠোঁটের ওপর!
লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল আরশী।ইরশাদ মুখে হাসি ঝুলিয়ে তাকালো তার দিকে।নিজের বলা কথাটি ভাবতে তারও যেন বড্ড লজ্জা পাচ্ছে এখন।
একহাতে অন্যহাত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে আরশী। পুরো গা অদ্ভুতভাবে কাঁপছে তার। কথার মালা যেন হারিয়ে যাচ্ছে বারবার তার কন্ঠনালী ছেড়ে। ইরশাদের যে নার্ভাস লাগছে না তাও
কিন্তু নয়৷ সে আঁড়চোখে আরশীর দিকে তাকিয়ে মোলায়েম স্বরে বলে উঠলো,
—- সরি, তোমাকে বিব্রতবোধ করালাম।
—- ইটস ওকে। নো প্রবলেম।
ঝুনঝুনির মতো স্বরে বলে উঠলো আরশী। ইরশাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো এতে। তারপর আবার বলল,
—- আসতে কি বেশী অসুবিধে হয়েছে?
—– নাহ্।
ইরশাদ এবার আরশীর দিকে ঘুরে বসলো। গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো সে। তারপর মুখে হাসি আড়াল করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো ,
—– আমাকে কি পছন্দ হয় নি তোমার? খুব খারাপ দেখতে কি আমি? আমি কি চলে যাব? বেশী ইতস্তত বোধ করছো?
আরশী তাড়াতাড়ি চোখ তুলে তাকালো! চোখে কিছু হারানোর ভয় স্পষ্ট! সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
—– আরে না না। আপনি অনেক সুন্দর। প্লিজ যাবেন না। আমার খুব কষ্ট হবে!
ইরশাদ ডানব্রু টি আলতো বাকালো। মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলছে তার,
“রিয়েলি! ”
আরশী লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো। চোখ বুঝে ভাবলো।
“ইশ কেবল লজ্জা দেয়”!
প্রিয়জনের পাশে সময়টা হয়তো অনেক দ্রুত কাটে। আর তাদের সময়টা কেটে গেল রকেটের গতিতে! আচমকা কিছু ছেলে গোল করে দাঁড়ালো তাদের আশেপাশে! আরশী ইতস্ততভাবে তাকালো তাদের দিকে আর ইরশাদ তাকিয়ে আছে রাগী দৃষ্টিতে!
ঠিক কিছুসময় পর তাদের মাঝে একজন তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বলল,
—- কিরে হিরো, ঐদিন তো মালিহাকে একটু প্রপোজ করলাম। তেড়ে ফুড়ে মারতে এলি।আর আজ দেখি আইটেম নিয়ে বসে আছিস! আহা তুই করলে রাসলীলা।আর আমরা করলে মামা ক্যারেক্টার ডিলা! এমন ক্যান?
রাগে হাত মুঠো হয়ে এলো ইরশাদের। কিশোরদের রক্ত স্বভাবতই একটু গরম হয়।তার ওপর হুটহাট এমন কথায় যেন তাল হারিয়ে ফেলে তারা! ইরশাদের ক্ষেত্রে ও বিষয়টা এমনই। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
—- মেয়েটার হাত ধরে রীতিমতো টানাটানি করছিলে তুমি। আর আমি তাই করেছি যেইটা ঐসময় একজন প্রকৃত ছেলের করা দরকার।
—- ইশ্ আমার পুরুষরে! তো শালা এই মাইডা কেডা? রেইটে নিয়ে আসছিস নাকি রে? তোর বাপের তো আবার মেলা টাকা।
আরশীর যেন গা গুলিয়ে এলো। সে দুকদম পিছিয়ে গেল। আর ইরশাদ দুম করে ঘুসি লাগিয়ে দিল ছেলেটির নাঁকে! সাথে সাথেই দরদরিয়ে নেমে এলো রক্ত ।
চারিদিকে মানুষের ভীড় জমতে শুরু করছে। মাঝখানে মারামারি করে চলছে সেই বখাটে দলের সাথে ইরশাদ। দর্শক যেন ফ্রিতে বিনোদন নিচ্ছে মারামারির। আার সাথে করছে মনগড়া মন্তব্য! আরশীর ঠিক ডানপাশে ভীড় থেকে এক মেয়ে বলে উঠলো,
——ঝগড়াটা হয়তো এই মেয়েটিকে নিয়েই। হয়রে, মেয়ে দেখ একদম পিচ্চি মেয়ে কিন্তু পোলা জোটাইছে দুইটা তাও আবার একটার চেয়ে আরেকটা কম না।
—– আরে এইসব মেয়ের জন্যই তো ছেলেদের মধ্যে এতো ঝামেলা। দেখিস মেয়োই দুনিয়া নিবে।
আরো কয়েকজনের কথার গুঞ্জন উঠলো সাথে সাথে। আরশী স্তব্ধ বাকরুদ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো সবার দিকে। মানুষের এতো কুরুচিপূর্ণ কথা, তার চরিত্র নিয়ে মনগড়া বিশ্লেষণ ভেতর থেকে যেন নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাকে! ঠিক সেই সময়ই কিছু ছেলে খুব বাজেভাবে গালি দিয়ে উঠলো আরশীকে! এবার ইরশাদ পাশেই পড়ে থাকা গাছের ডাল দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিল ছেলেগুলোর!
রাগে থরথরিয়ে কাঁপছে যেন ইরশাদ।আর আরশী ভয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে টানছে। তখনই বখাটেদের সর্দার মনির বলে উঠলো,
—- এতোই যখন দরদ তোদের মাঝে তো বিয়ে করে নে না।
—– আরে এইসব বিয়ে করবে না কেবল চিপায় চাপায় দেহের সুখ নিবে।
ভিড়ের মাঝে বলে উঠলো আরেক একজন।আর সাথে সাথেই ইরশাদ অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তাদের দিকে। চোখের কোনা ছুইঁয়ে রক্ত পড়ছে তার। আর মুখের কয়েকটি জায়গায় কালসিটে পড়ে গিয়েছে। হাত ছিলেছে কয়েকজায়গা!
ইরশাদ রেগে চিৎকার করে বলে উঠলো,
—- করবো বিয়ে আমরা। একে অন্যকে ভালোবাসি আমরা তাই করবো
—– তাহলে কর বিয়ে।এখনই ডাকো কাজি!
ঠিক তারপরের কয়েকঘন্টা খুবই দুর্বিষহ কাটলো তাদের। কাজি ঢেকে সবার কথার ভিড়ে বিয়ে হয়ে গেল আরশী আর ইরশাদের।আশেপাশের বিদঘুটে কথাগুলো যেন ছুচের মতো বিঁধতে আরশীর হৃদয়ে।আর এতেই অশ্রুসিক্ত হলো আরশীর আঁখি আর ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো তার হৃদয়!
চলবে
সরি রিভিশন দি নি