#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
১৫.
খই শুকমরার একপারে হেলানো হিজল গাছের ডালে বসে গাব খাচ্ছে। কখনো পা নাড়িয়ে পানিতে তরঙ্গ তুলছে, গুনগুনিয়ে গান গাইছে মনের সুখে। গাছের গোড়ায় দাড়িয়ে আরো তিনটে বাচ্চা। খইয়ের গোছার গাবগুলোর দিকে অসহায়ের চাওনি স্থির সবগুলোর। খই পা দুলিয়ে গাব মুখে পুরে বললো,
-তারপর? কে কে জানি কইছিলি? গাব আনবি? পুঁটি? তুই? আর জানি কেডা? খুশবু? তুই?
পুঁটি খুশবু দুজনেই মাথা নিচু করে নিলো। একটা হ্যাংলাপাতলা ছেলে সবটুকো শ্বাস নিয়ে বললো,
-আমি কই নাই খই বুবু। আমারে দেও কয়ডা গাব? কাছারীবাড়ির গাব না খাইলে বৎসরডা মাডি হইয়া যাইবো!
-তাও তরে দিমু না মধু। তোরা সুযোগ পাইলেই আমারেও দেস না!
বিশ্বজয়ের হাসি দিলো খই। আজকে চুপিচুপি গিয়ে সব গাব সাবার করে দিয়েছে ও। সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাবে বলেই এখানে আসা ওর। নিচ থেকে সবগুলো ঘ্যানঘ্যান করছে, অনুনয় করছে গাবের জন্য। আর ও মনের তৃপ্তি মেটাচ্ছে। হঠাৎই খালে ঝপাৎ শব্দ! যেনো বড়সর কিছু পরে গেছে। খই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কেউ একজন হাত উচিয়ে পানিতে বারি লাগচ্ছে সমানে। শুধু তার বড়হাতা কালো শার্টের হাতদুটোই দেখা যায়। খুশবু চেচিয়ে বললো,
-আল্লা গো! কেডায় জানি পানিতে পরছে খই বুবু!
খইয়ের চেহারায় আতঙ্ক। সাতার না জানায় আগেরবছর এভাবেই পানিতে পরে ডুবে যাচ্ছিলো পুঁটি। এভাবেই হাতে পানিতেবারি লাগাচ্ছিলো ও। তারপর পুঁটিকে ওর মা বাচিয়েছিলো। কোলে থাকা গাবগুলো খই তীরে ছুড়ে মারলো তৎক্ষনাৎ। ঝাপ দিলো খালে। সাঁতরে পৌছালো ডুবতে থাকা মানুষটার কাছে। এগিয়ে গিয়ে বুঝলো,ওটা রাকীন।
শুকমরার ওপরের বাঁশের সাঁকোটা বেশ বড়। খালের প্রশস্ততা কম না। পায়ের নিচের দুটো বাঁশ, হাতে ধরার একটা বাঁশ নিয়ে ঝুলতে ঝুলতে গ্রামের লোকজন পার হয়। রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে পুরোদমে। গ্রামের লোকজন যথেষ্ট সহযোগীতাপুর্নভাবে সামলে নিচ্ছে সেদিকটা। শুকমরার ওপারে স্কুল। বাচ্চাগুলোর সাঁকো পার হয়ে স্কুলে যাওয়া অসুবিধা হয় ভেবে একটা ব্রিজ করে দেবে, এমন প্লান করেছে রাকীন। অভিজ্ঞতার জন্য নিজেই চড়ে গিয়েছিলো সাঁকোতে। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। মাঝ বরাবর এসে আর ভারসাম্য রাখতে পারেনি। খালের মাঝবরাবর পরেছে একদম। সাঁতার জানেনা বলে ডুবে মরেই যাচ্ছে এমন ধারনায় বদ্ধ হতে যাচ্ছিলো ও। তখনই কেউ এসে ওর কলার টেনে ধরলো ওর। ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলো না সে কে?
একহাতে রাকীনের কলার টেনে আরেকহাতে সাঁতরে কোনোমতে তীরে পৌছালো খই। ঠেলেঠুলে তীরে শুইয়ে দিলো রাকীনকে। কিন্তু রাকীন চোখ খুলছে না। খুশবু,পুঁটি,মধু ছুটে আসলো সেখানে। খুশবু চোখ কপালে তুলে বললো,
-আল্লা গো! এতোবড় মিনষে সাতরাইতে জানেনা?
মধু বললো,
-আরে এইডা তো হেই রাস্তার নকশা আঁকা লোকডা! শহরের মানুষ হ্যায়। সাতরাইবো কেমনে? আহারে। আইছিলো গেরামের ভালো করনের লাইগা। জিন্দা। আর ফিরবো লাশ হইয়া!
খই ব্যস্ত ছিলো রাকীনকে পরখ করতে। এবার ও বিস্ফোরিতচোখে তাকালো মধুর দিকে। খুশবু বললো,
-ইয়া আল্লা! মইরা গেলো তাইলে?
ঠাস করে ওর গালে চড় লাগিয়ে দিলো খই। গালে হাত বুলাতে বুলাতে খুশবু বললো,
-আমারে মারলা ক্যান বুবু? হ্যায় তো চোখই খুলেনা!
মাথা কাজ করছে না খইয়ের। রাকীনের পেটে চাপ দিয়ে পানিও বের করে দিয়েছে ও। তাতেও জ্ঞান ফিরছে না। পুঁটি এতোক্ষন চুপ থাকলেও এবার বিজ্ঞের মতো করে বললো,
-এরে দম দেওন লাগবো।
খই ওর দিকে তাকালো। বললো,
-দম দেওন লাগবো মানে?
-আমি দেখছিলাম একবার,পানিত পরলে হ্যার মুখে ফু দিলেই হ্যার হুশ আহে। এরও তাই করন লাগবো।
খই তাড়াহুড়ো করে সরে বসে বললো,
-দে দে! ফু দে তাইলে! জলদি দে!
পুঁটি বসে গিয়ে মুখ এগোচ্ছিলো। হঠাৎই ওর থুতনি চেপে ধরলো খই। কি ভেবে বললো,
-সবগুলা হা কর!
সাথেসাথে দাত ক্যালালো তিনজনই। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই চোখমুখ উল্টালো খই। গাব খেয়ে একেকটা বিশ্রি দশা বানিয়েছে মুখের। পানিতে সাতরানোর জন্য শুধু ওরটাই তেমন নেই আর। পুঁটির থুতনি ছেড়ে খই কপাল চাপড়ালো নিজের। এরা কেউ রাকীনকে দম দিলে ওর দম ফেরার বদলে আটকে মারা পরবে। মধু বললো,
-আরো দেরি হইলে লোকডা সত্যই মইরা যাইবো বুবু!
একটা জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো খই। দেরি না করে একহাতে রাকীনের মুখ ধরে, আরেকহাতে ওর চুল মুঠো করে নিয়ে কয়েকবার ফু দিলো ওর ঠোটে ঠোট ছুইয়ে।
রাকীনের কাশি উঠে গেছে। খই ওকে ছেড়ে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে পিছিয়ে বসলো। খুশবু, পুঁটি, মধুও পিছিয়ে দাড়িয়েছে। রাকীন উঠে বসে কাশলো অনেকটা সময়। হুট করেই অনুভব হলো, কি ঘটেছে ওর সাথে। পাশ ফিরে খইয়ের দিকে তাকালো ও। ওর ঠোটে ঠোট ছুইয়ে এতোটুকোও লজ্জাচাওনি নেই খইয়ের। বরং কিছুটা তেজ দেখিয়ে বললো,
-সাঁতরাইতে জানেনা, আইছে শুকমরার ধারে! আমি না থাকলে এতোক্ষনে ম’রার পাঁচ মিনিট পার হইয়া যাইতো! হুহ!
ভেঙচি কেটে ভেজা বিনুনির চুল খুলতে খুলতে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো খই। ওর পেছনপেছন বাকিরাও চললো। ওরা চোখের আড়াল হলে রাকীন মাথার ভেজা চুলগুলো উল্টে ধরলো। জীবনে প্রথমবার এতোবড় ঘটনা ঘটেছে ওর সাথে। কোনো মেয়ের ঠোট ওর ঠোট স্পর্শ করেছে। তা সে যে কারনেই হোক না কেনো! আস্তেধীরে হাত তুলে নিজের ঠোট ছুইয়ে দিয়ে রাকীন আবারো তাকালো খইয়ের চলে যাওয়া ফাকা রাস্তার দিকে। অস্ফুটস্বরে বললো,
-বাচিয়ে গেলো? নাকি মে’রে দিয়ে গেলো?
•
সন্ধ্যে নেমেছে ব্যস্ত শহরের অলিগলিতে। তারই একটায় অসহায়ভাবে দাড়িয়ে রিকশা খুজে চলেছে পিয়ালী। রিকশা করে কোচিং থেকে বাসায় ফিরছিলো ও। কিন্তু রাস্তার মাঝে রিকশাটা খারাপ হয়ে যায়। তাই নেমে দাড়িয়ে অন্যরিকশা খুজছে ও। আগেরটা রিকশাচালক ঠিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না ওটা। এদিকে সন্ধ্যেও গরিয়েছে। রাস্তাটাও শুনশান বিশেষ। ওদের বাসার দিকে প্রাপ্তকে সবাই চেনেজানে বলে ভয় কাজ করে না কখনোই। কিন্তু এদিকটা সেভাবে চেনে না ও। আবাসিক এলাকা ছাড়িয়ে এ রাস্তায় জনচলাচল কম। গেমস খেলে ওর এক বান্ধবী ওর মোবাইলের চার্জ শেষ করে দিয়েছে। কাচুমাচু হয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে,চশমাটা আরেকটু চোখে ঠেলে দিয়ে বললো,
-আর কতোক্ষন লাগবে মামা?
-বুঝতাছি না।
রিকশাওয়ালা আবারো নিজের মতো খোটাতে লাগলেন রিকশা। পিয়ালী এদিকওদিক তাকালো। খানিকটা দুরেই রাস্তার কয়েকটা ছেলে একজোট হয়ে দাড়িয়ে। মাঝেমধ্যে ওর দিকে তাকাচ্ছে আর বলাবলি করছে। দুজন সিগারেটও টানছে। পিয়ালী আর সেদিকে তাকালো না। ঠিক করলো উল্টোপথে এগোবে। ওদিকে আবাসিক এলাকা আছে। লোকজনও আছে। ব্যাগ থেকে তরিঘরি করে ভাড়া বের করে এগিয়ে দিলো রিকশাওয়ালার দিকে। কিছু বলতে যাবে,কেউ ওর পাশ থেকে বললো,
-আজকাল এই রাস্তায় রিকশাও নষ্ট হয়? আগে তো কোনোদিন দেখি নাই রে!
ঝাকি দিয়ে উঠলো পিয়ালীর পুরো শরীর। সেই ছেলেগুলো এগিয়ে এসেছে। পিয়ালী তাড়াতাড়ি বললো,
-ম্ মামা? এইযে আপনার ভাড়া!
ছেলেগুলোর একটা বিদঘুটে হেসে বললো,
-ওমা! ভাড়া এখনই মিটিয়ে দিচ্ছো যে? একাকীই চলে যাবে বুঝি?
রিকশাওয়ালা নিচে হাটুগেরে বসে ছিলো। চোখ তুলে তাকিয়ে অবস্থা বুঝে দাড়িয়ে গেলো সে। খানিকটা সরু গলায় বললো,
-কি হইছে বাবা? কি চাও?
-তোমার রিকশা নিয়ে তুমি চলে যাও মামা। আমাদের যা চাই,আমরা রেখে দিচ্ছি।
এটুকো বলে একটা ছেলে পিয়ালীর দিকে তাকালো। আরো দুজনের কাধে দুহাত রেখে ভর ছেড়ে দিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিলো পিয়ালীকে। পিয়ালী ভয়ার্তচোখে আরো গুটিয়ে গেলো। প্রাপ্তর জন্য কোনোদিনও বাজে পরিস্থিতি দেখতে হয়নি ওকে। আশেপাশে কোনো জনমানবের ছায়াটাও চোখে পরলো না। এখন কি করবে,কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও। রিকশাওয়ালাকে বললো,
-ম্ মামা? আপনার ফোনটা…
রিকশাওয়ালা ফোন বের করলো বুকপকেট থেকে। হুট করেই একটা ছেলে রিকশাওয়ালার হাত থেকে তার মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে রাস্তায় ছুড়ে মারলো নির্বিকারভাবে। পিয়ালী আতকে উঠলো। ছেলেটা মাথার বড়বড় চুলগুলো ঝাকি মেরে পেছনে দিয়ে তাকালো পিয়ালীর দিকে। আফসোস করে বললো,
-ইশ! মামার ফোন তো ভেঙে গেলো! এবার কি হবে?
-আমারটা নাও।
পিয়ালীর সামনে কেউ মোবাইল তুলে ধরলো। মেয়েলি কন্ঠ শুনে যেনো প্রান ফিরে পেলো পিয়ালি। সামনের ফর্সা হাতের কব্জিতে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে গিটারের ট্যাটুটা একদম জ্বলজ্বল করছে। পিয়ালী দ্রুত পাশ ফিরলো। ওর দিকে নিজের মোবাইল এগিয়ে দিয়ে একদম স্বাভাবিক ভঙিমায় দাড়িয়ে একটা মেয়েটাকে দেখে প্রসারিত হলো পিয়ালীর চাওনি। রকস্টার ইনায়াত নিক্কন। উরফ,ইচ্ছে!
উল্টোপিঠের রাস্তায় ব্রিজের ওপর চড়ে বসে কোক খাচ্ছিলো ইচ্ছে। মাঝের দুরুত্ব বেশ অনেকটাই। নিচের স্থির পানিতে অস্পষ্ট অবয়বটা আর আকাশের তারা। দুটোকে তুলনা করছিলো নিজের সাথে। টমিকেও সাথে নিয়ে এসেছিলো ও। ইচ্ছেকে চুপ দেখে টমি শুয়ে ছিলো চুপচাপ। হঠাৎই দাড়িয়ে গিয়ে শব্দ করতে শুরু করলো ও। ইচ্ছে টমির দৃষ্টি অনুসরন করে আশেপাশে তাকিয়েও কিছু পেলো না। পরে আরো ভালোভাবে লক্ষ্য করে বুঝলো ওপাশের রাস্তায় ছেলেগুলোর অবয়ব কোনো এক মেয়ের অবয়বকে ঘিরে রেখেছে। ভাবনা ভাবার মতোন দেরিটুকো না করে চলে এসেছে দ্রুতপদে। ওকে দেখেই ছেলেগুলো বিপাকে পরে গেলো যেনো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝাতে একজন ফোকলা হেসে বললো,
-আরে? ই্ ইনায়াত ম্যাম? আপনি? আমাদের এলাকায়? ওই সবাই সবাইরে ডাক! দেখ রকস্টার ইনায়াত…
ইচ্ছে আগে পিয়ালীকে দেখলো। ভয়ে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে পিয়ালীর মুখচোখ। এমন পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়া যেকোনো মেয়ের জন্যই স্বাভাবিক। সেখানে পিয়ালী তো বাচ্চা মেয়ে। অভয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইচ্ছে হেসে বললো,
-হেই কিউটি! চশমাটা খুব মানিয়েছে তোমাকে। কতো পাওয়ারের এটা?
এমন পরিস্থিতিতে এমন প্রশ্ন শুনে আটকে রইলো পিয়ালী। একে তো ইচ্ছের মতো স্টার এমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চলে আসলো,তার উপর এভাবে এতোটা ফ্রি লি কথা বলছে। ইচ্ছে আবারো বললো,
-বললে না?
-ই্ ইটস্ টু পয়েন্ট ফাইভ।
পিয়ালীর কাপা গলা শুনে ইচ্ছে বুঝলো এখনো ভয় কাটেনি ওর। পিয়ালীর একগালে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,
-রিল্যাক্স! আ’ম হেয়ার। বাসায় কল করে কাউকে আসতে বলো। আমি গাড়ি আনিনি। নইলে আমিই পৌছে দিতাম তোমাকে।
দম ছাড়লো পিয়ালী। ইচ্ছে ওর ফোন গুজে দিলো পিয়ালীর হাতে। এবার ছেলেগুলোর দিকে ফিরলো ও। বয়স দেখেই বোঝা যায়,একেকটা কলেজের গন্ডি পেরিয়েছে কিনা সন্দেহ। এদের মার লাগাবে,নাকি পুলিশে দেবে,নাকি সতর্ক করবে,বুঝে উঠলো না ও। মাঝের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বললো,
-মামার ফোনটা ভাঙলে কেনো?
-হ্ হাত থেকে পরে গেছে ম্যাম।
ওর গালে সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো ইচ্ছে। স্বাভাবিক গলায় বললো,
-আমার সামনে একদম সাহিত্য রচনা না। দুদিন পুলিশ কাস্টাডিতে থাকলে সবরকমের সাহিত্যের ধারা বেরিয়ে যাবে। শুধুমাত্র তোমাদের মা বাবার কথা ভেবে আজকে ছেড়ে দিচ্ছি। নেক্সট টাইম এ রাস্তায় কেনো, এই এলাকার কয়েকমাইল আশেপাশেও যদি কোনো হ্যারাসমেন্ট ঘটে,আই’ল ডিরেক্ট গেট ইউ গাইস হ্যাংড্! এন্ড আই মিন ইট!
ছেলেগুলো স্তব্ধ হয়ে গেছে একদম। ইচ্ছে শান্তকথায়, আজকের জন্য ছেড়ে দিয়ে আগামীর সবকিছুর জন্য দায়বদ্ধ করে দিলো ওদেরকে। কিছু বলতে যাবে ওদের একজন, ইচ্ছে বললো,
-আমার কোনো এক্সপ্লেনেশন চাইনা। ব্যাখা দিতে এসে আমাকে আর রাগিও দিও না। যা বললাম, মাথায় রেখে এলাকায় থেকো। এদিকওদিক সবকিছুর দায়ে তোমাদেরই কিন্তু জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো আমি। নাও গেট লস্ট।
দু দন্ড মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দৌড় লাগালো সবগুলো মিলে। টমি শব্দ করতে লাগলো। ইচ্ছের ফোনটা তখনো পিয়ালীর হাতে। রাস্তায় থাকা রিকশাওয়ালার ভাঙা মোবাইলটা তুললো ইচ্ছে। সাইডব্যাগ থেকে হাজার টাকার কয়েকটা নোট বের করে তার হাতে গুজে দিয়ে বললো,
-মোবাইলটা ঠিক করিয়ে নিও মামা। একেবারে চুর্নবিচুর্ন হয়ে গেছে। অনেক টাকা লাগবে এটা সারতে।
টমি আবারো শব্দ করে উঠলো। ওর শব্দ অনুসরন করে ইচ্ছে,পিয়ালী দুজনেই পাশ ফিরলো। সামনে দাড়ানো সাদা টিশার্টের উপর চেইক শার্ট পরিহিত মানুষটাকে দেখে কিঞ্চিত ভ্রু কুচকে তাকালো ইচ্ছে। হাত শক্তমুঠো করে দাড়ানো ব্যক্তিটির দিকে পিয়ালী দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-ভাইয়া!
#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
১৬.
প্রাপ্ত পিয়ালীকে একসাথে দেখে, পিয়ালীর প্রাপ্তকে ভাইয়া ডাকতে দেখে ইচ্ছের বুঝতে বাকি রইলো না ওরা দুজন ভাইবোন। টমি তখনও প্রাপ্তকে দেখে চেচাচ্ছে। ইচ্ছে ঠোট টিপে হাসলো। এই টমিটা একদমই সহ্য করতে আারে না প্রাপ্তকে। যেখানে প্রাপ্ত ওর প্রান বাচিয়েছে দুদিন আগে। ইচ্ছেকে হাসতে দেখে দাতে দাত চেপে টমির দিকে তাকালো প্রাপ্ত। একটা রাগী শ্বাস ফেলে পিয়ালীকে শান্তভাবে বললো,
-ফোন কেনো দিয়েছি তোকে? সুইচড্ অফ করে রাখার জন্য?
পিয়ালী মাথা নিচু করে নিলো। ও এখন যাই বলবে, তাতে প্রাপ্তর এই শান্তস্বর মুহুর্তেই তুলকালাম বাধানোর মতো মেজাজে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। ইচ্ছে ভাইবোনের কথার মাঝে থাকবে না ভেবে “টমি কাম” বলে চুল নাড়তে নাড়তে উল্টোদিকে হাটা লাগালো। পিয়ালী একপলক চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ইচ্ছে চলে যাচ্ছে। তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ভাইয়া, ইচ্ছে ম্যাম চলে যাচ্ছে তো! ওকে কিছু বল? আজকে ম্যাম না থাকলে কিন্তু…
-কিছুই হতো না তোর। আমি এসে গেছি না?
-তুই তো এতোক্ষনে এলি! আর ইচ্ছে ম্যাম…
-কি ম্যাম ম্যাম শুরু করেছিস! তোর ম্যাম বুঝি বডিগার্ড হয়ে সবসময় থাকে তোর সাথে?
পিয়ালী অবাক হলো। কিসের কথায় কি তুলছে প্রাপ্ত? ওর ভাইকে ভালোমতোই চেনে ও। যাই কিছু হোক, এভাবে অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলার ছেলে প্রাপ্ত না, সেটা ও ভালোমতোই জানে। অবিশ্বাসের স্বরে বললো,
-এভাবে বলছিস কেনো? ম্যাম না থাকলে এতোক্ষনে সত্যিই কিন্তু আমাকে বাজে পরিস্থিতিতে থাকতে হতো ভাইয়া! কয়েকটা ছেলে…
ইচ্ছে খানিকটা দুর চলে গেলেও টমি একচুলও নড়েনি। দু সেকেন্ড পরপর প্রাপ্তকে লক্ষ্য করেই শব্দ ছুড়ছে ও। ওউ যেনো মতামত দিচ্ছে, ইচ্ছেকে ধন্যবাদ না দিয়ে চরম পাপ করছে প্রাপ্ত। সরু দৃষ্টিতে টমির দিকে তাকালো প্রাপ্ত। দাতে দাত চেপে বললো,
-ওকে সরি বলেছি। ওটা ওর প্রাপ্য ছিলো। থ্যাংকস্ দেবো না! এটা ওর প্রাপ্য না! সো উইল ইউ প্লিজ কিপ কোয়াইট?
পিয়ালীর দৃষ্টি আবারো প্রসারিত হলো। প্রাপ্ত সরি বলার মতো কাজ করতে পারে, এটাও ওর ধারনায় ছিলো না। আর সেটাও ইচ্ছেকে সরি বলেছে! ঘটনার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকলো না পিয়ালীর। টমি প্রাপ্তর কথা শুনে আরো দুবার জোরে চেচিয়ে উঠলো। প্রাপ্ত এবার ধমকে বললো,
-স্টপ ইট!
ইচ্ছে সবে হুইস্টলিং শুরু করেছিলো। প্রাপ্তর ধমক শুনে পেছন ফিরলো ও। প্রাপ্তর রাগী চাওনি টমির দিকে। বুঝলো ধমকটা টমিকেই দিয়েছে প্রাপ্ত। টমি তখনো থামেনি। ওর মতে, প্রাপ্ত ইচ্ছেকে থ্যাংকস্ না দিয়ে আগে বড়সর দোষ করেছে, এরপর ওকে ধমক দিয়ে আরোবড় দোষ করে ফেলেছে। টমি নিজেও যে ধমক দিতে পারে, সেটা প্রদর্শন করা জায়েজ আছে ওর। ইচ্ছে বিরক্ত হলো ভালোমতো। এই দুটোতে মানুষ-পোষ্যর সম্পর্ককে সাপে-নেউলে সম্পর্ক কেনো বানিয়ে দিচ্ছে, কে জানে? এগিয়ে গিয়ে আগে টমিকে বললো,
-টমি চুপ। আর একটুও আওয়াজ করবে না তুমি। একটুও না! গট ইট?
টমি গুটিয়ে লেজ নেড়ে ইচ্ছের পায়ে গা ঘেষলো। প্রাপ্ত মনেমনে খুশি হয়েছে ইচ্ছের ওকে ধমকাতে দেখে। তবে প্রকাশ করলো না সেটা। “ঝামেলা তৈরী করে এখন ভালো সাজা হচ্ছে!” ইচ্ছের পায়ে টমিকে গা ঘেষতে দেখে মনেমনে এ কথাটাও নাড়া দিলো ওর। ইচ্ছে প্রাপ্তর দিকে ফিরলো। তুড়ি বাজিয়ে আগে প্রাপ্তর চাওনি টমির থেকে নিজের দিকে ফেরালো। অতঃপর সিরিয়াসনেস দেখিয়ে বললো,
-আর এইযে মিস্টার গ্যাংস্টার! কাকে ধমকাচ্ছো তুমি? হ্যাঁ? কাকে ধমকাচ্ছো? আমার আগে টমিই তোমার বোনকে দেখেছিলো। আজ টমি না থাকলে ওই ছেলেগুলো…
ইচ্ছেকে শেষ করতে না দিয়ে প্রাপ্ত পিয়ালীর কাধ থেকে ওর ব্যাগ কেড়ে নিলো। ব্যাগের ভেতরের এক চেইন থেকে একটা ডিভাইস বের করলো দু সেন্ডের ভেতর। ইচ্ছে কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। আচমকাই প্রাপ্ত ইচ্ছের ডানহাতের কনুইয়ের উপরে ধরে টান লাগালো ওকে। ইচ্ছে চমকে উঠতে বাধ্য হলো। হাত দিয়ে কোনোমতে দুরুত্ব গুজলো দুজনের মাঝে। পিয়ালীর চোখ এবার বেরিয়েই আসবে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় ও। টমি নিজেও যেনো করনীয় বুঝতে পারছে না। ইচ্ছের সাথে এভাবে কাউকে দেখেনি বলেই হয়তো। প্রাপ্ত চোয়াল শক্ত করে ওর হাতে ডিভাইসটা গুজে দিয়ে বললো,
-একটা থ্যাংকসের জন্য ক্রেডিট নেওয়ার এতো চেষ্টা করে লাভ হবে না মিস রকস্টার। কিভাবে বোনকে প্রোটেকশন দিতে হয়, তা প্রাপ্ত খুব ভালোমতোই জানে! আ’ম নট গোয়িং টু থ্যাংক ইউ!
ইচ্ছে একপলক হাতে থাকা ট্র্যাকারের দিকে তাকাচ্ছে, তো আরেকবার প্রাপ্তর দিকে। প্রাপ্ত তখনো রাগী চেহারা করে ওর হাত ধরে আছে। আর পিয়ালী ভয়ার্ত চেহারা করে দুজনকেই দেখছে। ও যেমন ওর ভাইয়ের রাগকে চেনে, তেমন ইচ্ছের ক্ষমতাও জানে ও। কিজানি এর পর কি ঘটেছে। ওদের দু ভাইবোনকে অবাক করে দিয়ে কয়েকমুহুর্ত পর শব্দ করে হেসে দিলো ইচ্ছে। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত, পিয়ালী। ইচ্ছে শব্দ করে হাসতে হাসতে প্রাপ্তর কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের। বেশ কিছুক্ষন হাসার পর টমিকে কোলে তুলে হাসতে হাসতে বললো,
-ইগো দেখানো কেউ তোমার কাছ থেকে শিখুক মিস্টার গ্যাংস্টার! সরিটা এক্সেপ্ট করতে একটু দেরি কিনা করে দিলাম, তুমি তোমার ইগো দেখাতে এখন থ্যাংকস্ দেওয়া নিয়েও এতোকিছু বলছো? ওয়াও! ইউ আর সামথিং এলস্ ম্যান! লেটস্ গো টমি! এখানে থাকলে আমাকে জোর করে থ্যাংকস্ আদায় করার দায়ে লকাপে যেতে হতে পারে। তারচেয়ে বরং চল এখান থেকে যাই! আফটার অল, বেচারা থ্যাংকস্ দেবে না বলে কতোবড় যুক্তি দেখালো বল?
টমিকে কোলে নিয়ে কথাগুলো বললো ইচ্ছে। আরেকবার প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে ঠোট টিপে হেসে চলে গেলো ও। পিয়ালী ঠাস করে নিজেই নিজের কপালে চড় লাগালো একটা। প্রাপ্ত একধ্যানে ইচ্ছের চলে যাওয়া দেখছে। ওর মস্তিষ্কে এখন শুধু একটা কথাই ঘুরছে, ইচ্ছে এর আগে কোনোদিন কি এভাবে প্রানখুলে হেসেছে? হাসবে হয়তো! কিন্তু ওর এমন কেনো মনে হলো, এই অভুতপুর্ব হাসিটা দেখার সৌভাগ্য বুঝি একমাত্র ওরই হলো। মায়ের স্মৃতিকে মনে করে, রাতের সেই চাপা কান্নাগুলোর মতো অন্য কেউই হয়তো দেখেনি ইচ্ছের এই প্রানোচ্ছল হাসি। প্রাপ্ত ছাড়া আর কেউ না। কেউই না!
•
জমির হুজুরের খালি গলায় ফজরের আযান শুনে ঘুম ভেঙে গেছে খইয়ের। দুহাতে জরিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকালো ও। ওকে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে গভীর ঘুমে আছন্ন সাহেরা। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে খই। খই মায়ের হাতদুটো থেকে আস্তেধীরে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। উঠে বসে আরেকপলক তাকালো মায়ের দিকে। সাহেরা তখনও ঘুমোচ্ছে। খইয়ের ঠোটে হাসি। বেরোবে ও। এ সময় শুকমরার তীর দিয়ে টাকি মাছ ঘোরাঘুরি করে। স্বচ্ছ পানির নিচে আবছা আলোতে দেখা যায় সে মাছ। কোঁচ দিয়ে একেবারে মাথা বরাবর ঘা লাগিয়ে টাকি ধরা যায় অনায়াসে। উঠোনের লাউয়ের মাচায় দুটো কচি লাউ ঝুলছে দুদিন হলো। টাকি-লাউয়ের তরকারীর কথা ভেবেই জ্বিভে জল চলে আসলো খইয়ের। ঘরের এককোনে দেয়ালে ঠেকানো কোঁচ হাতে করে নিশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো ও।
খই হেলতে দুলতে খালিপায়ে শুকমরার দিকে এগোলো। যদিও শীতকাল না,তবুও ঘাসের ডগা ভিজে আছে পায়ের তলার। খালি পায়ের তালুতে ভেজা ঘাসের ডগা স্পর্শ করতেই শিরশিরিয়ে ওঠে পুরো শরীর। খই আস্তেআস্তে পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে এগোচ্ছিলো। ভোর হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে আলো ফুটবে চারপাশে।খই নির্দ্বিধায় পা চালালো। কিন্তু খানিকটা যাবার পরই থেমে গেলো ওর পা। সামনে কোনো মানুষের অবয়ব। কোনো পুরুষের অবয়ব। টিশার্ট, প্যান্ট তার পরনে। তার পাশেই পাইপের মতো কিছু একটা পূর্ব আকাশের দিকে তাক করা। আর সে মানুষটা পাশে দাড়িয়ে পকেটে দুহাত গুজে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে ভাজ পরলো খইয়ের। এ সময় এদিকে নিতুন জেলে ছাড়া আর কারো আসার কথা না। কিন্তু এটা কোনোমতেই জেলেবেশ না, সেটা স্পষ্ট বুঝলো ও। কাধে রাখা কোঁচটা সামনে তাক করে বললো,
-কেডায় ওইহানে?
পাশ ফিরে কোঁচ হাতে আবছা আলোয়া খইকে দেখে ছোট্ট একটা দম ছাড়লো রাকীন। মেয়েলি গলা শুনেই আন্দাজ করেছিলো এটা খইই হবে। গ্রামের এই শুকমরা খালটা একদম পুর্ব পশ্চিমে আড়াআড়িভাবে গেছে। রাকীন ভেবেছিলো ভোরের শুকতারা আর সুর্যোদয়, দুটোই শুকমরার তীর থেকে দেখবে। তাই চলে এসেছে এদিকে। মনেমনে শুকমরাকেই নির্বাচন করার আরো একটা কারন ছিলো। গত রাতে ঘুম হয়নি ওর। পুরোটা রাত হাশফাশ করেছে ও বিছানায় শুয়ে শুয়ে। চোখ বন্ধ করলেই বারবার খইয়ের একদম সন্নিকটে থাকা চেহারাটা ভেসে উঠেছে ওর চোখের সামনে। সেই অনুভবের পরিনামে তৈরী হওয়া একরাশ অস্থিরতার জেরেই হয়তো পা বাড়িয়েছিলো ও শুকমরার দিকে। খইয়ের দেখা পেয়ে আচমকাই ভালো লাগছে ওর ভেতরটায়। প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে, কিছু না বলে খইয়ের দিকে দুপা এগোলো ও। রাকীনের চেহারা স্পষ্টতর হতেই ভ্রু কুচকালো খই। কোঁচটা আবারো কাধে আটকিয়ে একহাত কোমড়ে রেখে বললো,
-ওহ্! আপনে?
-অন্যকেউ হলে ভয় পেতে?
-খই কাউরে ডরায় না! এ গেরামের কেউ আমার ক্ষতি করনের চিন্তাও করবো না। সেখানে আপনারে তো আমি বাচাইছি। আপনারে দেইখা ডরামু ক্যান? আইজ নতুন আমি কোঁচ নিয়া বাইর হইছি এমন না!
রাকীন খুশি হলো এটা ভেবে যে, ওকে নিয়ে খইয়ের কোনো নেগেটিভ ধারনা নেই। এটাও হতে পারে, মেয়েটা বেশিই সরল। ওর সাথে কোনোদিন বাজে কিছু ঘটেনি বলেই হয়তো এতোটা আত্মবিশ্বাস ওর। ওকে আনমনে হাসতে দেখে খই কপাল কুচকে বললো,
-তা আপনে এইহানে ক্যান? আবারো ম’রার শখ জাগছে নাকি? ভোরবেলায় শুকমরার তীরে যে?
-শুকমরার তীরে শুকতারা দেখতে এসেছিলাম।
বড়বড় চোখে তাকালো খই। আকাশে তাকিয়ে দেখে শুকতারা তখনইও জ্বলজ্বল করছে। চাঁদও আছে। রাকীনের চাওনি ওর নথে নিবদ্ধ। সবে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে চারপাশ। এটুকো আলোয় সামনের শ্যামাঙ্গীর চেহারা একেবারে স্পষ্ট না হলেও ওর নাকের নোলক ঠিকই দেখা যায়। আচমকাই ওর নথ ছুইয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা হলো রাকীনের। একধ্যানে তাকিয়ে এগোলো আরেকপা ও। এরইমাঝে খই বলে উঠলো,
-খালি চোখে শুকতারা দেখতাছিলেন?
রাকীন থামলো। কিছুটা চমকালো যেনো। যেনো কোনো ঘোর থেকে বেরোলো। স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলো,
-আব…না। দুরবীক্ষন আছে আমার আছে।
চকচক করে উঠলো খইয়ের চোখ। না দেখা এই একটা জিনিসের প্রতিই বরাবর ঝোক বেশি ছিলো ওর। চাঁদ দেখা যন্ত্রের নাম স্কুলের আপার থেকে শুনে মুখস্থ করে রেখেছে ও একদম। শহর থেকে কেউ আসলেই মাকে বারবার করে বলতো,দুরবীক্ষন এনেছে কিনা কেউ। খই চঞ্চলভাবে এগিয়ে গেলো রাকীনের দিকে। হুট করে বেশ অনেকটাই কাছে চলে যাওয়ায় আবারো চকিত হলো রাকীন। খই উৎসাহ নিয়ে বললো,
-আমারে দেখাইবেন?
-কি?
-শুকতারা! দুরবীক্ষন!
-মানে?
-ছোটবেলা থাইকাই আমার মেলা শখ! দুরবীক্ষন দিয়া চাঁদতারা দেখুম! দেখাইবেন? আমি না আপনারে পানিতে পইরা ম’রা থাইকা বাচাইলাম! দেখাইবেন না আমারে?
রাকীনের দৃষ্টি থেমে রইলো। এই শখ চেনা ওর। এই শখ পুরনের আবদারটাও ওর চেনা। শুধু মানুষটা অচেনা। খই ওকে চুপ থাকতে দেখে আবােরো তাড়া দেখিয়ে বললো,
-আরে চুপ কইরা আছেন ক্যান? দেখাইবেন? একটুপরেই চাঁদ ডুইবা যাইবো! আইজকা না দেখলে এ জীবনেও আর কাছ থাইকা চাঁদ দেখা হইতো না আমার! দেখান না আমারে দুরবীক্ষন দিয়া চাঁদ! দেখান একটু?
কিছু না বলে রাকীন কয়েকমুহুর্ত তাকিয়ে রইলো খইয়ের দিকে। খই শশব্যস্ত চোখে পরখ করছে,চাঁদ শুকতারা ডুবে না যায়! রাকীন টেলিস্কোপটা ঠিকঠাকমতো সেট করে দিয়ে বললো,
-এইযে নাও। এখানে চোখ রাখো।
কাধের কোঁচটা মাটিতে ফেলে তৎক্ষনাৎ টেলিস্কোপে চোখ রাখলো খই। রাকীন পাশ থেকে মুগ্ধচোখে দেখতে লাগলো ওকে। মৃদ্যু বাতাসে খইয়ের বিনুনির বাইরে থাকা ছোটছোট চুলগুলো উড়ছে। চোখে এসে পরছে বলে বিরক্ত হচ্ছে খই। রাকীন আস্তেকরে চুলগুলো খইয়ের কানে গুজে দিলো। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হেসে আবারো টেলিস্কোপে চোখ রাখলো খই। রাকীন বুকে দুহাত গুজে পিছিয়ে দাড়ালো। তাকিয়ে রইলো খইয়ের দিকে। দুরের কোনো এক মসজিদের মাইক থেকে আযানের শব্দ শোনা যায়। একটুপরেই এই চাঁদ থাকবে না আকাশে। এই শুকতারাও থাকবে না। সেভাবে ওউ তো এ ভাদুলগায়ে থাকতে আসেনি। ওকেও ওর চেনা শহরে ফিরতে হবে। কিন্তু এই মুহুর্তগুলো? শুকমরাকে সাক্ষী করে তৈরী হওয়া এ স্মৃতিগুলো? এগুলো কি আদৌও ফেলে যাওয়া সম্ভব? কে জানে!
#চলবে…
#চলবে…
❤ ]