#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩৩.
ড্রাইভিংয়ের পুরোটা সময় টমিকে লক্ষ্য করেছিলো ইচ্ছে। প্রাপ্তকে নিয়ে একাএকা অনেককিছুই বলে চলেছে ও এতোটা সময়। যেই টমি প্রাপ্তর নাম শোনা তো দুরে থাক, ওর ঘ্রান শুকলেই ক্ষেপে যেতো, সেই টমিই পুরোটা সময় ওর নামে বলা হাজারটা স্বীকারোক্তি বসে শুনে চলেছে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ব্যাপারটা যেনো পছন্দ হলো না ইচ্ছের। টমিকে ক্ষে’পাবে বলে খানিকটা ঝুকে ওর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-তোকে কি বললাম এতোক্ষন? গ্যাংস্টারকে ভালোবাসি। মানতে পারবি তুই এটা?
টমির নিরবতা বলে দিলো, তুমি পারলে আমিও পারবো। এভাবেও যে প্রাপ্তকে টিজ করে জবাব দিচ্ছে টমি, সেটা বুঝতে ভুল হলো না ইচ্ছের। ও হেসে দিয়ে আবারো সিরিয়াস ভঙিমায় বললো,
-এভাবে চুপচাপ যদি প্রাপ্তকে মেনে নিস, ব্যাপারটা কি ভালো হবে টমি?
…
-তোর কিন্তু সত্যিই আদর কমে যাবে!
এবারে শব্দ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে পরলো টমি। ঠোট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারলো না ইচ্ছে। শব্দ করে হেসে দিলো। টমি লাফিয়ে ওর কোলে উঠে সামনের দুপায়ে স্টেয়ারিংয়ে খামচি লাগালো। চোখ তুলে সামনে তাকালো ইচ্ছে। আচমকাই ওর গাড়ির সামনে চলে এসেছে কেউ। এজন্যই টমি ওমন করছিলো। সামনে কে সেটা লক্ষ্য করার সময় না নিয়ে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে নিলো ইচ্ছে। কাজে দেয়নি তা। মানুষটাকে একপ্রকারে ধাক্কা লাগিয়ে গাড়িটা রাস্তার কিনারার দিকে ঘুরে গেছে। ইচ্ছে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো ব্রেক করার। কিন্তু গাড়ি গিয়ে একটা গাছের সাথে বারি খেয়ে তবেই থামলো। গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে একাকার।
গাড়ির হর্ন নিরবিচ্ছিন্নভাবে বেজে চলেছে। বেশ অনেকটা সময় পর স্টেয়ারিং থেকে আস্তেধীরে মাথা তুললো ইচ্ছে। জ্ঞান হারায়নি ও। তবে কপাল কেটে গেছে। পুরোটা বুঝে উঠতে কয়েকদন্ড পার করে দিলো ইচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে ওর। কোলের উপর থেকে টমি সরে গিয়ে সামনের দিকটা থেকে ঢেকে দিয়েছে ওকে। ভাঙা কাচ ওর গায়ে লাগার উপায় রাখেনি টমি। ইচ্ছে তাড়াতাড়ি সিটবেল্ট খুলে নামালো টমিকে। সারা গা পরখ করে দেখে নিলো কোথাও ওর লেগেছে কিনা। দুটো জায়গায় কাচ ফুটেছে টমির। ইচ্ছে টমিকে ধরে কান্নাপ্রায় গলায় বললো,
-আ্ আ’ম সরি ডুড। আ’ম সরি!
টমি লেজ নাড়ালো। হুহু করে কেদে দিলো ইচ্ছে। কাপাকাপা হাত এগুলো টমির গা থেকে কাচ সরাবে বলে। পারলো না। টমি নিজে থেকেই গা ঝাড়া মারলো নিজের। ইচ্ছের গায়ে গা ঘেষে বুঝালো, ও ঠিক আছে। ইচ্ছে কাদতে কাদতে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো ওকে। বললো,
-ইউ ওকে? হুম?
টমি শব্দ করে ইচ্ছের কপালের দিকে মুখ উচিয়ে ধরলো। হাত তুলে স্পর্শ করে বুঝলো, অনেকটাই কেটে রক্ত ঝরছে কপাল থেকে। একটা ক্ষুদে শ্বাস ফেলে ড্রয়ার থেকে সেলোটেপ বের করতে যাচ্ছিলো ও। হঠাৎই মনে পরলো, গাড়িটা কাউকে ধাক্কা লাগিয়েছিলো। তৎক্ষনাৎ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ইচ্ছে। গাড়ির আশেপাশে খুজতে লাগলো তাকে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় লক্ষ্য করলো, কিছুটা দুরেই কেউ একজন রাস্তায় পরে আছে। ইচ্ছে লেহেঙ্গা উচিয়ে দৌড়ালো। টমিও নেমেছে গাড়ি থেকে। মানুষটার নিকটতর হতেই ইচ্ছে টের পেলো, ওটা কোনো মেয়ে। এগিয়ে গিয়ে রাস্তায়ই বসে পরলো ও। উপুর হয়ে পরে থাকা শাড়ি পরিহিত মেয়েটাকে কোলে সোজা করতেই দিশেহারা হয়ে গেলো ইচ্ছে।
শ্যামবর্নের মেয়েটার পরনে থাকা খয়েরী পাড়, সাদা শাড়ি র’ক্তে ছেয়ে গেছে একদম। অনেক বাজেভাবে মাথা ফে’টে গেছে। হাতেপায়ে স্ক্র্যা’চ। ইচ্ছে কি করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তাড়াহুড়োয় মোবাইলও আনেনি। পুরো জায়গাটা জনমানবশুন্য। সাহায্যের জন্য কারো কাছে যাবে, মেয়েটাকে একা ছাড়ার সাহসও হয়ে উঠলো না ওর। আবারো গাড়ির কাছে এসে গাড়ি স্টার্ট নেয় কিনা, সেটা চেইক করলো ইচ্ছে। গাড়ি তখনো চলার মতো ছিলো। থ্যাংক গড বলে একহাতে নিজের কপাল চেপে ধরে আরেকহাতে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি নিয়ে মেয়েটার কাছে আসলো আবারো। কোনোমতে গাড়িতে মেয়েটাকে তুলে সোজা হসপিটালে চলে আসলো। নামার সময় টমিকে গাড়িতেই আটকে দিয়েছে ইচ্ছে। হসপিটালে যারা ছিলো, মোটামুটি সবাই চেনে ইচ্ছেকে। ইচ্ছে বলে দিয়েছে মেয়েটার সবরকমের চিকিৎসা করতে। বাকিসব ও দেখে নেবে। ওর কথামতোই হচ্ছিলো সবটা। মেয়েটার তখনো জ্ঞান ফেরেনি। অবস্থা গুরুতর দেখে মেয়েটাকে সরাসরি ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু মেয়েটা সেই যে হসপিটালে আসার পর থেকে ইচ্ছের হাত ধরেছে, আর ছাড়ছেই না। ইচ্ছে চেষ্টা করেছে নিজের হাত ছাড়ানোর। পারেনি। ওকে দেখে এক নার্স বলে উঠলেন,
-ম্যাম ইউ আর অলসো ব্লিডিং! আপনারও এইড প্রয়োজন!
জোরপুর্বক মেয়েটার হাত থেকে ইচ্ছের হাত ছাড়িয়ে দিলো নার্সটা। এতোক্ষন অজ্ঞান থাকলেও এবার দুটো ঢেকুর তুললো মেয়েটা। র’ক্তবমির সাথে অস্ফুটস্বরে উচ্চারন করলো,
-ই্ ইচ্ছে…
অবাকচোখে তাকালো ইচ্ছে। মেয়েটা ওর নাম কেনো নিলো? নাকি ওই ভুল শুনলো? নার্স ওকে এনে কেবিনে বসিয়ে দিলো। তারপর কপালে ঠিকঠাকমতো পরিষ্কার করে, ঔষুধ লাগিয়ে দিলো। কেবিনে স্থির থাকতে পারলো না ও। সারা শরীরে অস্বস্তি, অস্থিরতা। বিয়ের সাজ, মেয়েটার চিন্তা, প্রাপ্তর কাছে যাওয়ার ভাবনা। সবটা ভুলে করিডরে আসলো ইচ্ছে। আগে এই মেয়ের সুস্থ্যতার কোনো খবর পাক, তারপরই প্রাপ্তর কাছে যাবে ও। এরমধ্যে তিনজন পুলিশি পোষাক পরা লোক আসলো ওখানে। এগিয়ে এসে ইচ্ছেকে বললো,
-আপনার গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছে ম্যাডাম?
ইচ্ছে বুঝলো এক্সিডেন্ট কেইস বলে পুলিশ এসেছে ওকে ক্রসকোশ্শেন করতে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে নিচু গলায় বললো,
-জ্বী।
-কোথায়? কিভাবে?
ঘটনাক্রম বলে দিলো ইচ্ছে। পুলিশ মনোযোগ সহকারে সবটা শুনলো। ইচ্ছের বলা শেষে ওটি থেকে বেরিয়ে আসলো ডক্টর। আগ্রহ নিয়ে তাকালো ইচ্ছে। পুলিশ এগিয়ে গিয়ে বললো,
-পেশেন্ট কেমন আছে ডক্টর?
-অনেকটা ব্লাডলস হয়েছে। ব্লাড দিতে হবে এই মুহুর্তে! নইলে মেয়েটাকে বাচানো অসম্ভব।
বাচানো অসম্ভব শুনে একপা পিছিয়ে দেয়ালে লেপ্টে গেলো ইচ্ছে। মাকে হারানোর পর থেকে মৃত্যুতে বরাবর ভয় ওর। কেউ মারা গেলে, সে তো আর ফেরে না। কিন্তু এই পৃথিবীতে তার ভালোবাসার মানুষগুলো কতো যন্ত্রনা নিয়ে বেচে থাকে, সে ধারনা আছে ওর। ইন্সপেক্টর বললো,
-তো ব্লাড দিচ্ছেন না কেনো আপনারা?
-একচুয়ালী ইন্সপেক্টর, মেয়েটার ব্লাডগ্রুপ ও নেগেটিভ। আর আমাদের ব্লাডব্যাংকে এই ব্লাডগ্রুপের ব্লাড নেই বর্তমানে। আমরা…
-আমার ব্লাডগ্রুপ ও নেগেটিভ। আমি দেবো ব্লাড ওকে!
জোর গলায় বললো ইচ্ছে। উপস্থিত সবাই বিস্ময়ে তাকালো ইচ্ছের দিকে। ডক্টর বললেন,
-বাট ইনায়াত ম্যাম, আপনি…
-দেয়ার ইজ নো স্কোপ ফর ইউর বাট ডক্টর! আপনি আপনার কাজ করুন! মেয়েটাকে বাচান! যতো ব্লাড প্রয়োজন, আমি দেবো। আপনি ব্যবস্থা করুন!
ডক্টর পুলিশের দিকে তাকালেন একপলক। মাথা নেড়ে পুলিশ সম্মতি বোঝালে ইচ্ছেকে নিয়ে চলে গেলেন সে। সবরকম টেস্ট করিয়ে, দু ব্যাগ রক্ত দিলো ইচ্ছে। ডক্টর ব্লাড নিয়ে গেছে। এরমধ্যে একজন পুলিশ এসে পাশে বসেলো ইচ্ছের। বললেন,
-বাসায় জানিয়েছেন? প্রেসমিডিয়া?
-না। এক্সিডেন্ট নিয়ে এখনো কেউ কিছু জানে না। বিয়ের আসর ছেড়েছি, এটা নিয়েই ব্যস্ত আছে হয়তো। হসপিটালেও স্পেশাল রিকুয়েস্ট করেছি বিষয়টাকে এখনই পাব্লিক না করার জন্য।
মুচকি হেসে ইচ্ছে উঠে বসলো। নার্স এসে খানিকটা সেবাযত্ন করে গেলো ওর। পুলিশ আর কিছু বলেনি ওকে। বেশ খানিকটা সময় পর ডক্টর এসে হাসিমুখে বললেন,
-শি ইজ আউট অফ ডেন্জার। আধঘন্টার মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে বলে আশা করা যায়। তবে আরেকটু দেরি হলে বোধ হয় আরো খারাপ কিছু হয়ে যেতো। থ্যাংকস্ টু ইউ মিস ইনায়াত। আজকে আপনি যদি ব্লাড না দিতেন তবে হয়তো মেয়েটাকে বাচানো যেতো না।
স্বস্তির শ্বাস ফেললো ইচ্ছে। হুট করেই কানের ভেতর সুরসুর করতে লাগলো ওর। পাশের টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে কানের দিকটায় ডলা মেরে বললো,
-দেখা করা যাবে ওর সাথে?
-যেহেতু পেশেন্ট সেন্সলেস, দেখা করেও লাভ নেই কোনো। ভেতরে একজন যেতে পারবেন।
ইচ্ছে কিছু বলার আগেই পুলিশ বলে উঠলো,
-আগে আমি দেখা করতে চাই ডক্টর!
বাধা দিলো না ইচ্ছে। ও চেয়েছিলো মেয়েটার সাথে দেখা করে প্রাপ্তর ওখানে চলে যাবে। কিন্তু পুলিশ তো তার ডিউটি করবেই। ইচ্ছের সম্মতি বুঝে একটা ক্ষুদে শ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালো সাফোয়ান। ইচ্ছের হাতে হওয়া এক্সিডেন্ট কেস বলে কেউই আসতে চাইছিলো না। বাধ্য হয়ে ওকেই আসতে হলো হসপিটাল। কিন্তু এখানে রকস্টার ইচ্ছের তো আলাদাই এক রুপ। আস্তেধীরে ওটিতে গিয়ে পেশেন্টকে দেখে আরেকদফায় আতকে উঠলো সাফোয়ান। মেয়েটা আর কেউ না, খই! এনগেইজমেন্টের সাজের বদলে আজ ওর মাথাভর্তি ব্যান্ডেজ, হসপিটালের পোশাক পরনে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক! মিষ্টিঘর বা প্রাপ্তদের বাসার পরিবর্তে ও ইচ্ছের গাড়ির সামনে, আর তারপর এই ওটিতে! কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না সাফোয়ান। তৎক্ষনাৎ কল লাগালো প্রাপ্তকে। সাফোয়ান বেরোতে সময় নিচ্ছিলো বলে চুপচাপ উঠে এলো ইচ্ছে। আগে গাড়িতে থাকা টমিকে আদর করে দিলো। তারপর রিসেপশনে গিয়ে জোরপুর্বক গায়ের কিছু গয়না খুলে দিয়ে দিলো। যদিও নিতে চায়নি কেউই। ইচ্ছেই বারন শোনেনি। রিসেপশনে দাড়িয়ে ক্লান্তস্বরে বললো,
-আমার একটা কল করা প্রয়োজন। ক্যান আই?
শিওর ম্যাম- বলে টেলিফোনটা এগিয়ে দিলো রিসেপশনে থাকা মেয়েটা। ইচ্ছে রাকীনের নম্বর তুললো ওতে। ওর মতে একদিকটা এখন একমাত্র রাকীনই সামলাতে পারবে। কল লাগাতেই রিসিভ হলো কলটা। ইচ্ছে বললো,
-হ্যালো রাকীন? ইচ্ছে।
-ইচ্ছে! তুই কোথায়? পৌছে গেছিস কি? তোর ফোন…
-রিল্যাক্স। ঠিক আছি আমি। তবে ছোট একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। তুই এক কাজ কর, নিউরো হসপিটালে চলে আয়, আমি…
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো ইচ্ছে, ঠিক তখনই প্রাপ্তকে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হসপিটালে ঢুকতে দেখলো ও। গায়ে খয়েরী রঙের পান্জাবী, হাতা গুটিয়ে কনুই অবদি তোলা। এতোগুলো দিন পর ওকে দেখে, এই অবস্থাতেও হাসি ফুটলো ইচ্ছের ঠোটের কোনে। প্রাপ্ত কোনোদিক না তাকিয়ে ওটির দিকে ছুটেছে। কল কেটে ইচ্ছেও ওর পেছনে এগোতে লাগালো। ওটির সামনের করিডরে এসে প্রাপ্তকে দেখে থামলো ইচ্ছে। খুশিতে রঙিন ওর চারপাশ। প্রাপ্ত তখন চোখ বন্ধ করে, দেয়ালে একহাতে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে। আর সাফোয়ান ওর কাধে হাত রেখে কিছু বলছে। একটুপর ফোনটা কানে নিয়ে সরে গেলো সাফোয়ান। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রাপ্তকে ওখানে দেখে, কিছু যেনো মাথাতেই ছিলো না ইচ্ছের। দৌড়ে গিয়ে জাপটে জরিয়ে ধরলো ও প্রাপ্তকে। ওর বুকে মাথা ঠেকিয়ে একশ্বাসে বলে দিলো,
-আই লাভ ইউ মিস্টার গ্যাংস্টার! আই লাভ ইউ!
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩৪.
-আই লাভ ইউ মিস্টার গ্যাংস্টার! আই লাভ ইউ!
-এজন্যই বুঝি খইয়ের ক্ষতি করতে চাইছিলে তুমি ইচ্ছে? টু শো ইউর ক্রেজিনেস?
ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসি বলার পর, ঠোটের কোনে ফোটা উচ্ছ্বাসের হাসিটা পরের দু সেকেন্ডেই মিইয়ে গেলো ইচ্ছের। প্রাপ্তর বুক থেকে আস্তেধীরে মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। ওর কাতর চেহারার দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো কিয়দক্ষন। হাত আলগা হয়ে এসেছে ইচ্ছের। প্রাপ্ত পিছিয়ে সরে দাড়ালো ওর বাহুডোর থেকে। ইচ্ছের বধুবেশকে দু চোখে ভরে নিলো যেনো। কপাল থেকে উল্টে পরা ঠিকলি, নাক থেকে খুলে পরা নথ, এলোমেলো চুল, মাথা থেকে সরে যাওয়া ঘোমটা। ওকে ভালোবাসি বলার একরাশ পাগলামি ইচ্ছের সর্বাঙ্গে। অথচ এই পাগলামি তো ওরই করা উচিত ছিলো। কিন্তু সুযোগটাই বা পেলো কোথায়? যে মুহুর্তে বাবাকে বলতে গিয়েছে খইয়ের সাথে আংটিবদল করবে না, সে মুহুর্ত থেকেই খই নিখোজ। আর এখন সাফোয়ানের কাছে শুনতে পেলো, সে মেয়েটা আইসিইউতে। মৃত্যুমুখে। আর তার কারন, ইচ্ছে। ওর ভালোবাসা। আস্তেধীরে ইচ্ছের কপালের টিকলিটা ঠিক করে দিয়ে, ছোট চুলগুলো কানে গুজে দিলো প্রাপ্ত। ওর কপালে ঠোট ছুইয়ে মৃদ্যুস্বরে বললো,
-আমিও ভালোবাসি। তোমাকেই ভালোবাসি মিস রকস্টার। তোমাকেই।
ইচ্ছে বিমুঢ়। প্রাপ্তর কোন কথাকে ধরবে, কোন কথাকে ধরবে না, বুঝে উঠতে পারছে না ও। প্রাপ্ত ইচ্ছের এক গালে হাত রাখলো আলতোভাবে। অসহায়ের মতো করে বললো,
-আমরা দুজন একে অপরকে ভালোবাসি। কিন্তু এরমাঝে খই কেনো শাস্তি পেলো ইচ্ছে? ও কি দোষ করেছে?
ইচ্ছের মাথা ফাকা লাগছে এবার। এসব কি বলছে প্রাপ্ত, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কোনোমতে মুখ দিয়ে বের করলো,
-এ্ এসব তুমি কি বলছো?
-আজকে আংটিবদল ছিলো আমার আর ওর। কিন্তু যখন রাকা জানালো, তুমি বিয়ের আসর ছেড়েছো আমার জন্য, তখন আমিও এনগেইজমেন্ট ক্যান্সেল করতে গিয়েছিলাম ইচ্ছে। তারপরও খইকে কেনো শাস্তি দিলে তুমি? ও তো কোনো দোষ করেনি।
“খইয়ের সাথে প্রাপ্তর আংটিবদল” এই কথাটা শুনেই শব্দহীন ঝড় বইতে লাগলো যেনো ইচ্ছের চারপাশে। ঘাড় খানিকটা কাত করে অপলক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলো ও প্রাপ্তর দিকে। যে মানুষটার জন্য সব ছেড়ে আসলো, সে মানুষটা অন্য কাউকে জীবনসঙ্গীনি করতে চলেছিলো। অথচ প্রাপ্তর এই জীবনসঙ্গীনির জায়গাটা ওর নিজের জন্য বরাদ্দ বলে ভেবে রেখেছিলো। কেনো ভেবে রেখেছিলো? কোনোদিন কি তার কোনো কারন দেখিয়েছে প্রাপ্ত? তবে ও কেনো ভেবে রেখেছিলো? এতোবড় ভুল কি করে করে ফেললো ও? নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হতো লাগলো ইচ্ছের। ওকে চুপ দেখে প্রাপ্ত এবার ইচ্ছের দুগাল ধরে বললো,
-কেনো করলে এমন ইচ্ছে? কেনো? শুধুমাত্র তোমার হবু বর রাকীন শাফায়াতের অনৈতিক নোটিশ খইয়ের কাছে ছিলো বলে? তাই বলে ওর ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তুমি? হুম?
…
-এজন্য নয়? তবে কেনো ইচ্ছে? প্রথমদিন যখন তোমার গিটার ভেঙেছিলাম, কি বলেছিলে তুমি? তোমার আবেগকে আঘাত করার প্রতিত্তর তুমি দেবে। তা না করার আগ পর্যন্ত নাকি আমার উপর থেকে রাগ মিটবে না তোমার। তাহলে এজন্যই কি আজ…আজ খইকে বিপদে ফেলতে চাইছিলে তুমি ইচ্ছে? এজন্যই?
…
-আচ্ছা? তুমি কি বলেছিলে সেদিন রাকাকে? ইউ উইল নেভার ফল ইন লাভ। ইউ উইল রাইজ ইন লাভ! ভালোবেসে উত্তল হবে তুমি তাইনা ইচ্ছে? ভালোবাসার পাগলামো দেখাবে তুমি। আজ তোমার মনে হলো, ভালোবাসো তুমি আমায়। আর আজই আমার আর খইয়ের আংটিবদল হওয়ার কথা। তবে কি তার জন্যই খইয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তুমি ইচ্ছে? তোমার আমার মাঝ থেকে ওকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য? এভাবে ভালোবাসার পাগলামো দেখাতে চেয়েছিলে তুমি ইচ্ছে? এভাবে?
চোখ বন্ধ করে দাতে দাত চেপে রইলো ইচ্ছে। ধীরস্থির গলায় যে অপবাদে প্রাপ্ত ওকে অপমান করতে শুরু করেছে যে, নিজেকে সামলানো দায় হয়ে গেছে ওর। তবুও একবর্নও বললো না ও। যে ইচ্ছে নিজের আত্মসম্মানের জন্য নিজের বাবাকেও ছাড় দেয়নি, প্রাপ্তর সমস্ত অপবাদ সয়ে নিলো চুপচাপ। আজ কেনো যেনো ওর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে না। কেনো যেনো নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছে করছে না। কেনো করবে? প্রাপ্ত ওকে যদি ভালোই বাসে, তবে অবিশ্বাস কেনো করবে ওকে? কেনো ভুল বুঝবে? শুধু ভাবতে লাগলো, ভালোবাসি বলে কেউ কাউকে কি করে এতোটা ভুল কি করে বুঝতে পারে? হয়তো পরিস্থিতির জন্য। ইচ্ছে প্রাপ্তকে এতোটুকোও দোষ দিলো না। সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করতে লাগলো নিজেকে। এরমাঝে ডক্টর এসে বললো,
-পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।
প্রাপ্ত একধ্যানে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইচ্ছে চোখ মেলে তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,
-খই ভালো আছে। গিয়ে দেখে আসো ওকে।
-ইচ্ছে…
-দেখা করে এসো।
প্রাপ্ত হাতের পিঠে নাক ডলা মেরে পা বাড়াচ্ছিলো ভেতরে যাবে বলে। ডক্টর ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন,
-সরি? আপনি কোথায় যাচ্ছেন? পেশেন্ট তো ইচ্ছের সাথে দেখা করতে চায়।
অবাকচোখে ডক্টরের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। ইচ্ছে ভাবলো, হয়তো হসপিটালে আনার জন্য খই ধন্যবাদ দেবে ওকে। ডক্টরের দিকে নিমীলীতদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
-ইটস্ ওকে ডক্টর। আগে ওই যাক।
-সরি। পেশেন্টকে এই মুহুর্তে উত্তেজিত করা যাবে না। গেলে আপনাকেই এলাউ করবো আমরা। ওনাকে না।
ইচ্ছে প্রাপ্তর দিকে তাকালো। ততোক্ষনে সাফোয়ান এসেছে। ডক্টর আবারো বললো,
-মিস ইনায়াত? ভেতরে যাবেন আপনি?
সাফোয়ান এগিয়ে এসে বললো,
-অবশ্যই উনি যাবেন। ইনফ্যাক্ট উনিই আগে যাবেন। আজকে উনি যদি ব্লাড ডোনেট না করতো, খইকে বাচানো যেতো না। তাই ওনার সাথেই আগে খই দেখা করুক।
বিস্ফোরিত চোখে সাফোয়ানের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। কি বলছে সাফোয়ান? তবে ওকে যে বললো, এক্সিডেন্টটা ইচ্ছের গাড়িতে হয়েছে। পুরোটা আবারো ভাবতে লাগলো প্রাপ্ত। কেয়ারটেকার বলেছিলো, খই স্বেচ্ছায় বেরিয়েছে মিষ্টিঘর থেকে। যদি খইয়ের এক্সিডেন্ট ইচ্ছে জেনেবুঝে করাতো তাহলে ওকে হসপিটালে নিয়ে আসলো কে? ইচ্ছেই বা এখানে কি করছে? আর ব্লাড দেওয়ার কথাই বা সাফোয়ান কেনো বলবে? দিশেহারার মতো প্রাপ্ত মাথার চুল উল্টে ধরলো নিজের। খইকে অসুস্থ্য দেখে, ইচ্ছের গাড়িতে এক্সিডেন্ট করেছে শুনে, কিসব বলে দিলো ও? ডক্টর বললেন,
-চলুন মিস ইনায়াত। পেশেন্ট ওয়েট করছে আপনার জন্য। বেশ অনেকবার নাম নিয়েছে আপনার।
ইচ্ছে ডক্টরের সাথে পা বাড়ালো চুপচাপ। প্রাপ্তর মাথা ঠান্ডা হলে হয়তো সবটা বুঝতে পারবে ও, এটা ও জানে। কিন্তু ততোক্ষন অবদি সবটা ঠিক থাকবে তো? ভেতরে ভেতরে বারবার মনে হচ্ছে, শেষবারের মতো একটু শান্তি চাই ওর। কোনো ভুল বোঝাবুঝি চাইনা। কোনো লাভক্ষতির পসরা চাই না। কোনো জবাবদিহিতা চাই না। শুধু শান্তি চাই! একটু শান্তি। কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ইচ্ছে। খই আধশোয়া হয়ে বেডে বসে। ওর মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ, ক্যানোলা, স্যালাইন চলছে। ওকে দেখেই খই উৎফুল্লভাবে বলে উঠলো,
-ইচ্ছে!
মৃদ্যু হাসি নিয়ে এগোলো ইচ্ছে। আলতোভাবে খইয়ের গালে হাত রেখে বললো,
-এখন কেমন আছো খই?
খই ইচ্ছের হাতের উপর হাত রাখলো নিজের। চোখ বন্ধ করে কাদতে লাগলো তারপরই। ইনিশা থেকে বেরোনোর কিছুক্ষন পরই ওর সিএনজিটার সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে যায় নিজাম। ওর সাথে আরো দুজন ছিলো। ঝামেলা এড়াতে মাঝরাস্তায় ওকে রেখেই সিএনজিচালক পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে ছুট লাগিয়েছিলো খই। আর তখনই ইচ্ছের গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয় ওর। জ্ঞান ফেরার পর একঘন্টা আগের স্মৃতির সাথে যুক্ত হয় ওর একযুগ আগের স্মৃতিও। যে স্মৃতিতে রয়ে গেছে ওর নাম, খেয়া, ওর মা নাফিজা বেগম, বাবা নওশাদ সাহেব, নিজের প্রানের চেয়েও প্রিয় বোন ইচ্ছে, আর ভালোবাসা বোঝার আগে থেকেই ভালোবাসার জায়গা জুড়ে নেওয়া, রাকীন। নিজের ছোটবেলার যে স্মৃতির জন্য সাহেরা মাকে প্রশ্ন করে করে কষ্ট দিতো, সে স্মৃতি যখন আজ ওর ফিরে এসেছে, সেই মা-ই ওর কাছে নেই। আজ ও ওর নিজের নাম, পরিচয় জানে। ও অনাথ না। ও তো ইচ্ছেরই বোন, খেয়া! ওকে কাদতে দেখে ইচ্ছে বললো,
-কাদছো কেনো তুমি?
খেয়া চোখ মেললো। বললো,
-কি অদ্ভুত জীবন। তাইনা রে ইচ্ছে? যখন আমি নিজেকে চিনি নি, তখন হয়তো তোরা আমাকে খুজেছিস। আজ আমি নিজেকে চিনলাম, তোদেরকে চিনলাম, অথচ দেখ! এখন তুই আমাকে চিনতে পারছিস না! আমার সাথেই কেনো এমন হবে ইচ্ছে? কেনো?
ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছে। খেয়া বললো,
-বড়মা ঠিকই বলতো, ইচ্ছেনদীতে যদি খেয়াতরী না থাকে, তবে সে খেয়ার অস্তিত্ব থাকবে না। তোর থেকে দুরে সরে সত্যিই খেয়ার অস্তিত্ব ছিলো না ইচ্ছে! সে তো ভাদুলগাঁয়ে সাহেরা মায়ের মেয়ে হয়ে বেচে ছিলো। খই! দেখনা! আজ আবার নিয়তি আচমকাই তাকে মনে করিয়ে দিলো, তোর সাথে জরিয়ে তার আরো একটা পরিচয় আছে। খইই খেয়া! তোর হারিয়ে যাওয়া বোন!
কথা শেষ করে শব্দ করে কাদতে লাগলো খেয়া। শ্বাস আটকে খেয়ার কথাগুলো শুনলো ইচ্ছে। বুঝে উঠতেই নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ও খেয়াকে। গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে ওর চোখেমুখে অজস্র চুমোয় ভরিয়ে দিলো। সুখের অশ্রুজল বাধ মানলো না ইচ্ছের। বাকিসব কিছু ভুলে গেছে ও। কাদতে লাগলো খেয়াকে জরিয়ে। কিছু হারিয়েছে বা হারাতে চলেছে কিনা, জানে না ও। শুধু মনে হলো, হারানোর মাঝেও প্রাপ্তির এ কান্না স্বস্তির, এ কান্না প্রশান্তির…
#চলবে…
[ পর্ব আরো বড় করা উচিত ছিলো। পেরে উঠলাম না। সত্যি বলতে আপনাদের কারো কারো মন্তব্যে আমি আশাহত। খই উরফ খেয়া চরিত্রকে প্রাধান্য দেওয়াটা অনেকেই মানতে পারছেন না। যেখানে আমি আগেই বলেছি, চারটে চরিত্রই সমান গুরুত্বপুর্ন। বাকি তিনটে চরিত্রের সাথে খেয়ার সমন্বয় কতোটা জরুরি ছিলো, গল্পের প্লটে তা দেখিয়েছি আমি। নাকি আমিই ব্যর্থ? আপনাদের অনুধাবন কি বলে? ]
#চলবে…