একপ্রকার দৌঁড়ে এসে হাপাতে হাপাতে বাসে উঠলাম ৷ হাঁটুতে হাত দিয়ে শান্ত হয়ে হাপাতে লাগলাম ৷ মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখি বাসের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ৷ তাকাবে না-ই বা কেন? বিয়ের আসর থেকে বিয়ের পোশাকে পালিয়ে এসেছি ৷ একটু তো অন্যরকম লাগবেই ৷ সবাইকে উপেক্ষা করে নিজের সিটটা খুজতে লাগলাম ৷ পুরো বাসের মধ্যে শুধু একটাই সিট খালি রয়েছে ৷ সেটা হয়তো শুধু আমার জন্যই ৷ সিটের কাছে গিয়ে সেখানে বসে পরলাম ৷
পাশে একটা ছেলে বসে আছে ৷ চোখে চশমা, কানে ইয়ারফোন ৷ হাত গুজে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ৷ তার পাশে যে একজন বসেছে সেটার কোনো খেয়ালই নেই ৷ কি ছেলেরে বাবা!! সাথে নিয়ে আসা ব্যাগগুলো বাসের উপরের শেডে রেখে দিলাম ৷ এখন সমস্যা হচ্ছে আমি জানালার সাইড ছাড়া বসতে পারি না ৷ এখন এই ছেলেকে যে বলবো কীভাবে বুঝতে পারতেছি না ৷ তবুও মনে সাহস নিয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,,
—- এই যে ৷ এএই এই ভাইয়া শুনছেন? আরে আপনাকে বলছি কানে যাচ্ছে কি?
ছেলেটা হালকা একটু চোখ খুলে নড়েচড়ে আবার চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে রইলেন ৷ এভাবে থেকেই বললেন,,,,,,
—- কি সমস্যা?
আসছে আমার সমাধানওয়ালী ৷ ঢং দেইখা বাঁচি না ৷ বলি ছেলে মানুষ এতো ঢং কই থেকে পায়? নিজেকে সামলিয়ে বললাম,,,,,,,
—- আপনি আমার সিট আর আমি আপনার সিটটা নিতে পারি কি?
ছেলেটা কানের থেকে ইয়ারফোন সরিয়ে বললো,,,,,,,
—- কেন? আমার সিট আপনাকে দিব কেন?
—- আমি জানালার সাইড ছাড়া বসতে পারি না ৷ আসলে বসলে মাথা ঘুরায় আমার ৷ প্লিজ একটু সিট এক্সচেন্জ্ঞ করে নেই ৷
—- না আমার সিট আমি কাউকে দিব না ৷
—- আপনার কোন বাপের নাম লেখা আছে এতে?
—- হোয়াট?? বাপ তুলছেন কেন হ্যাঁ?
—- তাহলে কি বউ তুলবো? তো দেখান কোথায় আপনার বউয়ের নাম লেখা আছে ৷
—- রাবিশ!! ঠিক ভাবে কথা বলেন ৷ প্রবলেম হলে অন্য সিটে যান তবে এই সিট নয় ৷
—- ওয়েহোয় আপনি কি মেয়ে নাকি? যে মেয়েদের মতো এমন করছেন ৷
—- কই লিখা আছে যে ছেলেরা মেয়েদের মতো করতে পারবে না?
—- হায়হায় তাহলে তো জেন্ডার চেন্জ্ঞ হয়ে যাবে ৷
—- কিইইই? এসব আলতু ফালতু কথা কি বলছেন? যান এখান থেকে ৷
—- জ্বীইই না ৷ আপনি উঠুন আমি ওই সাইডে বসবো ৷
—- আরে আজিব একটা অচেনা ছেলের হাত ধরে টানছেন কেন?
টেনে ছেলেটাকে বের করে নিজে ভিতরে গিয়ে বসে পরলাম ৷ বাহিরের ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগছে ৷ আহ কি শান্তি ৷ ছেলেটার কথার উত্তরে বললাম,,,,,,
—- ছেলেরা টানতে পারলে কেন মেয়েরা পারবে না?
ছেলেটা সিটে বসতে বসতে বললো,,,,,
—- অসহ্যকর ৷
সাইড ব্যাগ থেকে পানি বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম ৷ সামনে তাকিয়ে দেখি বাসের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ৷ সেটা দেখে দাঁড়িয়ে সবাইকে বললাম,,,,,,,
—- এখানে কোনো সিনেমা হচ্ছে না ওকে? সবাই সবার কাজ করুন তো ৷ এদিকে তাকাবেন না ৷ মানে আমার দিকে তাকাবেন না ৷ বোঝেনই তো অস্বস্তি হয় ৷
বলেই সিটে বসে পরলাম ৷ পাশে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ৷ সেটা দেখে বললাম,,,,,
—- বললাম না তাকাবেন না ৷ তাহলে এভাবে হা করে আছেন কেন?
ছেলেটা মুখ ফিরিয়ে ফোন টিপতে টিপতে বললেন,,,,,,
—- বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছেন না?
—- বুঝেই যখন গিয়েছেন তো জিজ্ঞেস করার কি হলো হ্যাঁ?
—- আমাকে ধমক দিয়ে কথা বলছেন কেন? আমি আপনাকে ধমক দিয়েছি?
—- হুহ!! না দিলেও আমার কি? আমি এভাবেই কথা বলি ৷ বাই দা ওয়ে আমি ইশিতা ৷ ইশিতা চৌধুরি, তো আপনার নামটা কি?
ছেলেটা ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে, তারপর বললো,,,,,
—- ইশান ৷
—- জাস্ট ইশান?
—- ইশান খান ৷
—- ওহ ৷
ছেলেটা আর কিছু বললো না ৷ চুপ করে রইলো ৷ আমিও চুপচাপ গায়ের গয়নাগুলো খুলতে লাগলাম ৷ খুলে ব্যাগে রেখে দিলাম ৷ সারা রাস্তা এগুলা পরে থাকলে মরেই যাবো ৷
বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি ৷ আমাকে পালাতে সাহায্য করেছে আম্মু আর আপু ৷ বাপি জোর করে একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছিল ৷ এখন বিয়ে করার কোনো রকম ইচ্ছাই নেই আমার ৷ কিন্তু আমরা সবাই বাপিকে প্রচুর ভয় পাই ৷ তার মুখের উপর কিছুই বলতে পারি না ৷ বাপি যেই ছেলেটার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল সেই ছেলেটার আচার-ব্যবহার সব খারাপ ৷ নেশা করে বেড়ায় সারাদিন ৷ শুধু তারা ধনী দেখে বাপি রাজি হয়েছে ৷ বুঝিনা আমাকে কি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে নাকি ছেলের সম্পত্তির সাথে?
বিয়ে করবো না অনেকবার বলেছি আমি বাপিকে ৷ কিন্তু আমার কোনো কথাই শোনে নি সে ৷ ঘরে বন্দি করে রেখেছিল আমায় ৷ আম্মু আর আপুর হেল্প নিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে এসেছি ৷ আমার পালিয়ে যাওয়ার খবর হয়তো এতক্ষনে পৌঁছে গিয়েছে বাপির কাছে আর আমাকে খোঁজাও শুরু করে দিয়েছে হয়তো ৷ জানিনা কি হবে বা হতে পারে? শুধু এটুকুই জানি আমাকে ধরা পরলে চলবে না ৷ দূরে চলে যেতে হবে এখান থেকে ৷
(ইশিতা চৌধুরি ৷ বয়স ২৩ বছর ৷ অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট ও ৷ বাবা আরমান চৌধুরি ও মা রাহেলা চৌধুরি ৷ ওর একটা বড় বোন আছে যার নাম ইতি চৌধুরি ৷ সে বিবাহিত ৷ ইশিতা ওর মা আর বোনের চোখের মনি ৷ কিন্তু আরমান চৌধুরি একটু রাগী ৷ সে যা বুঝবে তাই করবে ৷ কখনোই কারো কথা শুনবেই না ৷ তাই তো এতো বড় ভুল করতে গিয়েছিলেন ৷ কিন্তু ইশিতা ঠিক সময় পালিয়ে যাওয়ায় ভুলটা সম্পূর্ণ হয়ে উঠেনি ৷)
(ইশান খান ৷ বয়স ২৮ বছর ৷ একটা সফটওয়্যার কম্পানিতে জব করে ও ৷ এছাড়াও ওর বাবার কম্পানি রয়েছে ৷ বাট সেটার কাজ ওর কাছে বোরিং লাগে ৷ তাই নিজের কম্পানিতে আপাতত ও কাজ করে না ৷ সেই কম্পানিটা ওর বাবা মি. রিফাত খান আর ওর বড় ভাই রোহান খান সামলায় ৷ ছোট থাকতেই ওর মা মারা যায় ৷ প্রায় পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে আজ ইশান ঢাকার বাহিরে ঘুরতে যাচ্ছে ৷)
হঠাৎ করে বাসটা জোরে ব্রেক কষলো ৷ ফলস্বরূপ কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে গেলাম আমি ৷ নিজেকে সামলিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,,
—- ওওও ড্রাইভার আঙ্কেল মারবেন নাকি হ্যাঁ? মাতাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন নাকি? এভাবে কেউ বাস চালায়? মরেই তো যেতাম আরেকটু হলো ৷
বলেই ধপ করে সিটে বসে পরলাম ৷ পাশে বসে থাকা ইশান বলতে লাগলো,,,,,,
—- মনে হচ্ছে কোন ঝামেলা হয়েছে ৷
—- ঝামেলা? কীসের ঝামেলা?
তখনি বাসের কনডাক্টর এসে বলতে লাগল,,,,,,
—- আরে আপা সামনে পুলিশ ৷ কইতাছে বাস নাকি সার্চ করবো ৷
—- ও আচ্ছা…..কিইই? পপপপুলিশ??
—- হ পুলিশ আইছে ৷
সর্বনাশ ৷ আজ তুই শেষ ৷ এখনো ঢাকা থেকে বের হতে পারলাম না ৷ তার আগেই বাপি পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছে খোঁজার জন্য? উফ এখন কি করবো? ধরা পরলে আজ আমার খবর আছে ৷ ধুর কী করবো উফ ৷
—- এই মেয়ে কি ভাবছেন?
পাশে থেকে ইশান ধাক্কা দিয়ে বললেন ৷ চমকে উঠলাম আমি ৷ তবুও আমতা আমতা করে বললাম,,,,,,
—- ককই ককি? আমি কি ভাবতেও পারবো না এখন?
—- না সেটা না ৷ আচ্ছা ঘটনাটা কি এরকম যে আপনাকে পুলিশ ধরতে বা খুঁজতে এসেছে?
—- আপনার মাথা ৷ মুখটা বন্ধ রাখেন নাহলে একদম সেলাই করে দিব ৷
—- কি মেয়েরে বাবা ৷
ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাহিরে উঁকি দিলাম ৷ প্রায় অনেকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে বাসের কনডাক্টরের সাথে কথা বলছে ৷ তখনি আমাকে ইশান টেনে নিয়ে ভিতরে ঢোকালো ৷ রাগি ভাবে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,
—- কি সমস্যা কি হ্যাঁ? এটা কেমন ব্যবহার?
—- এই যে মিস আপনি মাথা বের করে কি দেখছেন বলুন তো? কোনো গাড়ি এসে ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করলে বুঝবেন কি সমস্যা?
—- ধুররররর! পালাবো কি করে সেটাই বুঝতেছি না ৷
মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম যে কি করবো? এখন বাস থেকে বের হওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই ৷ সামনে দিয়ে তো যেতে পারবো না ৷ গেলে পেছনের দরজা দিয়ে বের হতে হবে ৷ ভাগ্গিস এই বাসটার দুইটা দরজা নাহলে খবর হতো ৷ উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,,
—- এই এই সরুন সরুন ৷
—- কেন কোথায় যাবেন?
বলেই উঠে সরে গেলেন ৷ আমি একটু ভেবে বলতে লাগলাম,,,,,,
—- জানিনা ৷ শুধু আমি না আপনিও যাবেন ৷ আসুন তাড়াতাড়ি ৷
—- আরে…?
ইশানকে টেনে নিয়ে বাস থেকে নামিয়ে নিজেও নামলাম তাড়াতাড়ি করে ৷ বাসের পেছনে গিয়ে সামনের দিকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম পুলিশ কি করছে ৷ এদিকে আমার পাশে ইশান বারবার এটা ওটা বলে খোচাচ্ছে আমাকে ৷ পাশে ফিরে ধমক দিয়ে বললাম,,,,,,
—- উফ চুপ থাকেন না ৷ ছেলে মানুষের মুখ এতো চলে কি করে বুঝি না ৷ একটু চুপ থাকেন ৷ আমি তো আর ধরে নিয়ে যাচ্ছি না আপনাকে না?
—- ধরে নিচ্ছেন না তো বাস থেকে এভাবে টেনে নামালেন কেন?
—- ভাইয়া আমার একটা শুধু একটা হেল্প করে দিবেন প্লিজ ৷ পুলিশের হাতে পরলে আমি শেষ বুঝতেই তো পারছেন ৷
—- তো আপনি যান ৷ কে না করেছে? কিন্তু আমাকে এর মধ্যে টানছেন কেন?
—- বেশ করেছি ৷ এবার আমার সঙ্গে আসুন তো ৷
বলেই তাকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেলাম ৷
—- আরে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন?
—- একটু সবুর করুন না ৷ পুলিশগুলো চলে গেলেই আমরা চলে যাবো ৷ শুধু একটু অপেক্ষা করুন ৷
—- আপনি থাকেন ৷ দরকার হলে সারাদিন এখানে থাকেন ৷ আমাকে কেন থাকতে বলছেন?
—- সুরক্ষার জন্য ৷
—- মানে?
—- আরে কি মানে মানে করছেন? সুরক্ষা মানে বোঝেন না? জাস্ট কিছু সময়ের জন্য আপনি আমার দেখাশুনা করবেন ৷ কোন দিক থেকে কি বিপদ আসবে তার কোনো ঠিক নেই তাই ৷
—- তো এখন আমি…
—- ইশশশ একটু চুপ করুন তো ৷
বাসের বাহিরের পুলিশগুলো বাহিরে থেকে কিছুক্ষন কথা বলে বাসের ভিতরে চলে গেল ৷ বাস সার্চ করে বাস থেকে নেমে তারা সামনের দিকে এগিয়ে গেল ৷ যাক বাবা বাঁচা গেল ৷ সেটা ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম ৷
অন্যদিকে পুলিশগুলো চলে যাওয়ায় বাসটা আমাদের রেখেই সামনের দিকে এগিয়ে গেল ৷ সেটা দেখা ইশান জোরে করে ডাক দিতে যাবে তার আগেই তাড়াতাড়ি করে আমি উনার মুখ চেপে ধরলাম ৷ হঠাৎ করে এরকম হওয়ায় ইশান টাল সামলাতে না পেরে সোজা নিচে পরে গেল ৷ আর আমি পরে গেলাম সোজা তার উপরে ৷ ওনার মুখ এখনো হাত দিয়ে ধরে আছি আমি ৷ আর তার দিকে করে তাকিয়ে আছি ৷
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
#প্রেমাসক্তি
#পর্ব__০১ (সূচনা পর্ব)
#অদ্রিতা_জান্নাত