গল্প: পড়কুট থেকে চিড়কুট
(বাকী অংশ)
যাকে একটু অাগে বিয়ে করে অামি বিরাট বিপদ থেকে উদ্ধার করলাম।সে কিনা এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
কি অাশ্চর্য!! অামি শাড়ির অাঁচলটা ভালোমত টেনে ঝিম মেরে বসলাম।মানুষের উপকারের এই প্রতিদান!?? এরকম বিচ্ছিরি করে নাক ডেকে ঘুমানো??
—–কিরে এখনো যাচ্ছিসনা কেনো?? যা বাসায় যা।অামার সত্যিই খুব ঘুম পাচ্ছে।দু-ঘন্টা এখানে ঘুমিয়ে তাঁরপর বাসায় যাবো।
এতদিন পর একটু নিশ্চিন্ত হলাম তো।ভীষণ টেনশনে কয়েকরাত ঘুমোতেই পারিনি, বুঝলি???
যা বিদেয় হ…
কথাগুলো অাদনান ভাই চোখ বন্ধ করে বললেন।
অামার কেনো জানি মন বলতে চাচ্ছিলো তখন,
—–অাপনি ঘুমোন অাদনান ভাই, অামি না হয় ততক্ষণ বসি!
বলা হলো না। এমন দুর দুর করে তাড়িয়ে দেওয়ার কি হলো??
অামি অন্যরকম খারাপলাগা নিয়ে বাসায় এলাম।
রাতে খেতে বসার সময়, মা হঠাৎ বললেন,
——তুই কি অাজ কোথাও গিয়েছিলি নাকি নিতু??অাদনান ফোন করলো বিকেলে! জিজ্ঞেস করলো, তুই বাসায় ফিরেছিস কখন? সন্ধ্যায় এসে ঘন্টাখানেক বসে থেকে গেলো।
—–অামায় ডাকনি কেনো??
—–ঘুমিয়ে ছিলি তুই! তাছাড়া তুই তো রাত ন’টার অাগে কখনোই নিচে নামিস না, তাই!
অামি অস্ফুট স্বরে কোনোরকম তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
—–কিছু দরকার অাছে বলেছে??
——হুঁ! টাকা নাকি ধার নিয়েছিস তুই? ওটার জন্যই;
রাতে অাসবে অাবার!
অামার গলায় ভাত অাটকে গিয়ে বিষম খেলাম।একমুহূর্তের জন্য অামি সব ভুলে গেলাম। অামার নাম যেনো কি?? ও মাই গড! নামটাও মনে এলোনা।
অামি ভাতের পাতে পানি ঢেলে উঠে দাঁড়ালাম।
মা কড়া চোখে অামার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
——নিতু নেক্সট টাইম টাকার দরকারে পাড়া বেরিয়ে ধার চাইবি না, প্লিজ! ইট হার্টস মি!
অাদনান এলে টাকা শোধ দিবি, এবং সরি চাইবি!
সেই রাত সারারাত অামি অপেক্ষা করলাম। অন্যরকম টেনশান কাজ করছিলো।কেনো অাসবে; অাদনান ভাই?? কিসের দরকারে?? উফ্ অাসতে কি মানা করবো?? সারারাত কাটলো অামার ছটফট করে!!না”ই যদি অাসবে, বলার কি দরকার ছিলো??
পরদিন ইউনিভার্সিটি গিয়েই অামি অাদনান ভাইকে ফোন করলাম,
——অাপনি অাসেননি কেনো কাল রাতে??
—– অাসার কথা ছিলো নাকি??
—–মাকে নাকি বলেছিলেন??
ফোনও তো অফ ছিলো অাপনার! বলতে বলতে গলা ধরে এলো অামার। অামি একটু চুপ করে নিয়ে সেটা সামলালাম….
—–দ্যাঁখ, তুই কিন্তু বেশিই রিয়েক্ট করছিস নিতু। অামি হয়তো অাসবো বলেছিলাম, পরে ভুলে গেছি। অার তোদের বাসায় অাগেও তো অামি অসংখ্যবার গিয়েছি, এবং বেশির ভাগ সময়ই তো তোঁর সাথে অামার দেখা হয়নি।তো????এখন অাবার নতুন কি হলো??
অামি চুপ করে থাকলাম।
অাসলেই তো এখন নতুন কি হলো???
—-এরকম ন্যাঁকা কোনো অাচরণ করবি না।তোঁকে মানায় না….
অামি ফোন রেখে দিলাম। তারপরের মাসগুলো, অামার জন্য কেমন ছিলো, তা অামি নিজেই এখনো জানিনা। অাদনান ভাই, ভীষণ স্বাভাবিক এবং অাগের মতই।অামি যে তাঁকে বিয়ে করেছি এই ব্যাপারটা তিনি একদম ভুলে গেলেন যেনো। অামার খটকা বাড়তেই থাকলো। ডিভোর্স কি চাইবো??
একবার নিজে থেকে অামি উনার সাথে দেখা করতে গেলাম, তিনি ধমকের সুরে বললেন,
—–কিছু দরকার??
কেনো এসেছিস???
কিছু খাবি??? এদিকে নাকি একটা ভুতুড়ে রেস্টুরেন্ট হয়েছে, চল দেখে অাসি!!
অামি কিছুই বললাম না! ভুতুড়ে রেস্টুরেন্টের অন্ধকারে অামি দু-ঘন্টা চুপচাপ মাথা নিচু করে অাদনান ভাই’র সামনে বসে রইলাম।অাদনান ভাই এক পর্যায়ে জোড় করে টেনে তুলে বললেন, বাড়ি যা নিতু… অামার মনে হয় তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পড়াশোনা ফেলে এমন বসে থাকার তো তুই নয়!!
অার শোন, যখন তখন এমন অামার কাছে অাসবি না।এটা অস্বাভাবিক লাগে…..
সাত-অাট মাস পরের ঘটনা, ছোট মামার বিয়ে ঘুরে এসে মা যেই খবরটা দিলেন তা শোনার জন্য অামি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।অাদনান ইউ এস এ তে চলে গেছে।ওখানেই সেটেল করবে :!
অামার মাথায় তখন বাজ- অাকাশ দুটোই ভেঙ্গে পড়লো।
এখন কিভাবে যোগাযোগ করবো?? কাকে বলবো??মানুষটা এমন কেনো করলো? ভয়ে টেনশানে অামি অাধমরা হয়ে গেলাম। ডায়রিয়া হয়ে গেলো। হসপিটালে ভর্তি করা হলো।
অাদনান ভাই ফোন করলেন,
—–কিরে নিতু?? হাগছিস নাকি খুব?? কিভাবে হলো?? পড়তে পড়তে ভুল করে উল্টা পাল্টা কিছু খেয়ে ফেলিস নিতো??
অামি অনবরত কাঁদতে থাকলাম। একটা মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কি করে??
—- তুই তো বোধহয় একবার ভুল করে পানি ভেবে সয়াবিন খেয়ে নিয়েছিলি তাইনা??? কাঁদছিস কেনোরে পড়কুট, সয়াবিন তেল খেয়ে যখন মরিসনি, তাহলে এখনও মরবি না। মন শক্ত করে ডায়রিয়া চালিয়ে যা।
অামি কোনোরকম কুঁই কুঁই করা অাওয়াজ করে বললাম,
—-অামায় না বলে চলে গেলেন। অাসবেন কবে??
—-অাসবো না।
—–মানে কি??? অামার ডিভোর্স কে দেবে???
—-ডিভোর্স এখন তোর কিসের দরকার?? তাছাড়া বিয়েটা তো কেউ জানে না।
তুই তোর মতই থাক না।
—–অাপনি বলেছিলেন….
——অামি কিন্তু তোকে কিছুই কমিট করিনি ; তুই তোর স্বাভাবিক জীবনই কাটা না। এখনি তো তোর…..
তাও যদি খুবই অার্জেন্ট হয়, অামি এখান থেকে পেপারস পাঠিয়ে দিবো……
অাদনান ভাই ফোন কেটে দিলেন।
অাদনান ভাই’র সাথে কথা বলে অামার যা লাভ হলো।ডায়রিয়া অারো সাতদিনের জন্য বাড়লো। হাসপাতাল থেকে পুরো পেন্সিল হয়ে বাড়ি ফিরলাম।
ঠিক করলাম, পড়াশোনা বাদে অার কিচ্ছু নিয়ে ভাববো না।ইউনিভার্সিটি, ক্লাস, এসাইনমেন্ট এসব করে করে যেনো, অামি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে লাগলাম।
জীবনের অনেকটা সময় থাকে ব্যাখ্যার উর্ধ্বে।সুখের কিংবা দুঃখের কোনোটা বলেই হয়তো, সেই সময়টাকে বুঝানো যায়না। কিছুটা অনুভূতির বাইরের ।অনুভব করতে চেয়েও পারা যায় না, অথবা অনুভব করতে ইচ্ছাও করে না।পিওর সায়েন্সের ছাত্রী হয়েও অামার দৃঢ় বিশ্বাস হতে লাগল কিছু কিছু ঘটনা অলৌকিক, এর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা কারো নেই।
তারপরের দিনগুলোতে অামার কাছে সব ‘সময়’ এক মনে হতে লাগলো, সব ‘ঘটনা’ এক মনে হতে লাগলো। অামি কিছুতেই যেনো, অালাদা কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
একদিন
অামার ডিপার্টমেন্টের সবথেকে রুড এবংসিনিয়র টিচার যিনি, তিনি অামায় ডেকে পাঠালেন। অামি বিস্মিত।
স্যারের সামনে যেতেই স্যার হাসিমুখে বললেন,
——মাই ডিয়ার স্পৃহা জান্নাত নিতু, ডু ইউ নো, নাউ এ ডেইজ ইউ অার বিহ্যাভিং লাইক এ রোবট??
অামি প্রশ্নবোধক চোখে তাঁকালাম।
স্যার ইশারায় অামায় বসতে বললেন। কঠিন গলায় বললেন,
——অামি যদি শুদ্ধ বাংলায় বলি, তাহলো ইদানীংকালে
তুমি একটা যন্ত্রমানবের মত অাচরণ করছো, স্পৃহা?? হাটছো রোবটের মত, কথা বলছো রোবটের মত, তুমি যখন কিছু এনসার করছো, মনে হচ্ছে এটা কোনো মানুষ নয়, রোবট বলছে! এবং বেশির সময়ই তুমি চোখ বন্ধ করে লেকচার শুনছো! ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় হাঁটার সময়ও প্রায়ই দেখি তোমার চোখ বন্ধ! লাস্ট এসাইনমেন্ট গুলো তুমি দু-ভাবে করেছো।তুমি নিজেই বুঝতে পারছো না কোনটা বেটার?? হোয়াই?? অার ইউ মেন্টালি ওকে??হোয়াই অার ইউ সো কনফিউজড??
স্যারের কথায় অামি হাসার চেষ্টা করলাম।
—–লিসেন ইয়াং লেডী তোমার পারফর্মেন্স বলে, দুদিন পর তুমি ইউনিভার্সিটির একজন অনারেবল টিচার হতে যাচ্ছো, বি ফ্লেক্সিবল।অাই উইশ ইউ’ল পারফর্ম লাইক বিফোর, অর মোর বেটার।বি কেয়ারফুল মাই চাইল্ড!
অামি স্যারের রুম থেকে বের হবার সময় দরজা অবধি যাওয়া পর্যন্ত স্যার পিছু ডাকলেন, নরম স্বরে বললেন
——ট্রুলি স্পিকিং, স্পৃহা!
ফর অাওয়ার ডিপার্টমেন্ট, ইউ অার এ গিফট ।অামার শিক্ষকতা জীবনে অামি তোমার মত স্টুডেন্ট দেখিনি।ডিপার্টমেন্টের সবধরনের রেকর্ড তুমি ছাড়িয়ে যাচ্ছো।তার মানে এই নয় যে, তুমি ব্যক্তিগত সুখ দুঃখকে অতিক্রম করবে। অামরা তোমাকে রিসার্চ করা কোনো বুক নয় একজন জ্ঞানী ও গুণী মানুষ হিসেবে দেখতে চাই।
এভরিটাইম উই অল এক্সপেক্ট দ্যট, ইউ’ল বি নাইস অলওয়েজ!
অামার চোখ ছলছল করে এলো।
স্যার উঠে এসে অামার পাশে দাঁড়ালেন, মাথায় হাত রেখে বললেন, কেউ কি তোমায় কষ্ট দিচ্ছে মা???
অামি ফিসফিস করে বললাম,
—-কোনো একটা অনুভূতি অামার বাকী সব অনুভুতিগুলোকে অকেজো করে দিয়েছে স্যার। সেই অনুভুতিটা কি, অামি সেটা বুঝতে পারছিনা।
—-অনুভূতিটার উৎসের নাম তো তুমি জানো??
অামি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
——তাহলে সেটাকে একটু ঘেটে দেখো! অাই থিংক তোমার স্টাডি থেকে একটা ব্রেক দরকার।
অামি মাথা নাড়লাম, প্রচন্ড বিশ্বস্ততা এসে গেলো স্যারের প্রতি। সমস্ত সাহস এক করে নিয়ে বললাম,
——তিনি অামার একজন সিনিয়র কাজিন।বাইরে চলে গেছেন।অামি কি করবো, কিছুই বুঝতে পারছিনা।একবছর ধরে অামরা ডিসকানেক্টেড।
স্যার হাসলেন, অামার মাথায় অাবারও হাত রাখলেন, বললেন,
——- পুরো জগৎ তোমার মনের সাথে অপেক্ষা করছে,
কথা বলো মানুষটার সাথে।
অাদনান ভাইকে সেদিনই ফোন করি অামি।
—–অাপনার সাথে ভীষণ দরকারি কথা অাছে, দেশে অাসুন অাদনান ভাই।
অাদনান ভাই হেসে বলেন,
——একবারে অাসতে গেলে অনেক খরচ। তুই যদি টাকা দিস তো অাসবো…
——অামি টাকা দিবো???
—–হুঁ, একশোবার তুই দিবি। তোর দরকারেই তো অাসছি… যার দরকার খরচও তা্র!
——অাপনার কোনো দরকার নেই???
—–না।বরং অাসলে অামার ক্ষতি। অাগে টাকা পাঠা; তারপর অাসবো….
—-অামি ফোন রেখে দিলাম।
তাঁর প্রায় দু সপ্তাহ পর, অাদনান ভাই দেশে এসে হাজির।এয়ারপোর্ট থেকেই অামায় ফোন করে বললেন, বাড়িতে কাউকে বলিনি।দুদিনের জন্যে এসেছি। কি দরকার তাড়াতাড়ি বলতে অায়!
(চলবে)