বিকেলে ভোরের ফুল পর্ব ১৮

#বিকেলে_ভোরের_ফুল

#পর্ব_১৮

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

পুরো কোর্টজুড়ে পিনপতন নিরবতা। আজমল চৌধুরী নির্বাক হয়ে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে।এই কেসটা জেতার জন্য সিলেটের বিখ্যাত আইনজীবী কে ঠিক করেছেন আর সেখানে নিজের মেয়েই কিনা সব ভেস্তে দিলো।নিরবতা ভেঙ্গে জর্জ ফুলকে জিজ্ঞেস করল,

–“তুমি ভেবে বলছো তো??”

–“এখানে ভাবার কি আছে??যা সত্যি তাই বলছি।”

–“তাহলে বলো কেন পালিয়েছিলে??”

–“আসলে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে অন্য ছেলের সাথে কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না।বাবা আমাকে জোর করেই বিয়ে দিতে চেয়েছিল।তাই আমি স্পর্শের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”

–“কেন পালিয়েছিলে??”

ফুল একটু হেসে বলল,

–“এটা আবার বলা লাগে নাকি??একটা মেয়ে একটা ছেলের হাত ধরে কেন পালায়??”

জর্জ একটু থতমত খেয়ে যায়। এইটুকু মেয়ে কি এভাবে ঝটপট কথা বলতেছে। তিনি বললেন,

–“তুমি তোমার বাবাকে স্পর্শের কথা জানাওনি??”

–“জানিয়েছিলাম কিন্তু বাবা রাজি হননি।”

একথা শোনার সাথে সাথে আজমল চৌধুরী গর্জে উঠলেন। দাঁড়িয়ে বললেন,

–“মিথ্যা কথা। ফুল যা যা বলেছে সব মিথ্যা কথা। ফুল পালায়নি ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল।”

জর্জ আজমল চৌধুরী কে বললেন,

–“কিন্তু আপনার মেয়ে তো বলছে,,,,”

–“ও মিথ্যা বলতেছে।ওই স্পর্শ আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছিল।”

–“কিসের প্রতিশোধ?? আপনার সাথে এই ছেলেটার কি এমন শত্রুতা আছে যে ছেলেটা আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চাইবে??”

–“কারণ,,,,,”

আজমল চৌধুরী আর বলতে পারলেন না।কিই বা বলবেন?? নিজের দোষ তো নিজে স্বীকার করা যায় না।জর্জ ওনাকে আবারো একই প্রশ্ন করল কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিতে পারলেন না। ফুল জোর গলায় বলে উঠলো,

–“বাবার কাছে এর জবাব থাকলে তো দিবে। নিজের মুখে কিভাবে নিজের কুকৃতির কথা শিকার করবে বলতে পারেন??”

–“তুমি কি বলতে চাইছ একটু ক্লিয়ার করে বলো।”

ফুল একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলো। তারপর বলতে শুরু করল,

–“আপনারা আমার বাবার বাইরের ভালো চেহারাটাই দেখেছেন কিন্তু ভেতরটা দেখেননি।
সবাই দেখেছে যে বাবা একজন শিল্পপতি সমাজসেবক। কিন্তু উনি যে কতবড় প্রতারক সেটা শুধুমাত্র আমিই জানি। আমাদের একটা সুন্দর পরিবার ছিল।সবাই একসাথে সুখেই ছিলাম। আমার বাবা আর রাজির আঙ্কেল মানে স্পর্শের বাবা বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন।একে অপরের বিজনেস পার্টনার ছিলেন।খুব ভালোই চলছিলো সবকিছু। কিন্তু আমার বাবার লোভ সবকিছু তছনছ করে দিলো। ক্ষমতা আর টাকার লোভে বিজনেসের সব টাকা আত্মসাৎ করে আমাদের সবাইকে নিয়ে বাবা সিলেট চলে।আর সেই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পড়ে রাজির আঙ্কেলের উপর।তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
আঙ্কেল কতদিন জেলে ছিল আমি জানি না।

ফুল থেমে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করল,

–“এতেই যে সবকিছুর সমাপ্ত তা নয়।এখান থেকে আবার শুরু। আমরা সিলেট থাকতে শুরু করি। বাবা নতুন করে বিজনেস শুরু করে। দুবছরের মধ্যে বাবা একজন নামকরা ব্যবসায়ী হয়ে উঠে। কিন্তু আমার বাবা আর দাদির কথা যে এত টাকা পয়সা কে সামলাবে?? কারণ আমরা দুইবোন ছিলাম।বোন আপুর নাম পাপড়ি ছিল। আমার দাদি চান যেন আমার মায়ের পুত্র সন্তান হোক। আধুনিক যুগ হয়েও তিনি কবিরাজ বিশ্বাস করেন। কবিরাজের কথায় তিনি ওঠে আর বসে। কবিরাজ বলেছিলেন যে আমার মা নাকি পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারবে না।আর সেজন্য আমার বাবা আর দাদি আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

একটু বলেই ফুল শব্দ করে কেঁদে উঠলো।কান্না থামিয়ে বলতে লাগলো,

–“আমরা দুবোন তখন অসহায় হয়ে পড়ি।মা ছাড়া থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে কারো কোন খেয়াল নেই।দাদির কথা না হয় বাদ দিলাম অন্তত আমার বাবা তো আমাদের কথা ভাবত?? তিনি কেন এইসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করল?? বাবাকে আবার বিয়ে করান আমার দাদি। তখন আপুর টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। কিন্তু আমার দাদি তখন তার নতুন বউ নিয়ে ব্যস্ত। আমার বয়স তখন মাত্র সাতবছর। তবুও আমি আপুর পাশে সবসময় থাকতাম। আপুর সেবা করতাম। আপুর খুব কষ্ট হতো তা দেখে আমি শুধু কাদতাম।আপু বারবার মায়ের কথা বলত বাবা আর দাদিকে বলেছিলাম উল্টে ওনারা আমাকে ধমক দিতেন। আপুর অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে শুরু করে। আমি বাবা আর দাদিকে অনেক বার বলেছি।দাদি বলত ওই জ্বর এমনিতেই সেরে যাবে।অঢেল টাকা আর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আপুকে ডাক্তারের কাছে নেয়নি। শেষে আপুর অবস্থা দাদি দেখে সেই কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু এতে কোন লাভ হয় না।একমাস দশদিন টাইফয়েড জ্বরে ভুগে আমার আপু মারা যায়।আমি হলফ করে বলতে পারি আমার আপুকে বাবা আর দাদি মিলে খুন করেছে।এরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষ। ওরা আমার থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে।মা আর আপুকে আর আমার স্বাধীনতা। আমাকে কখনো একা ছাড়েনি। কলেজে বা স্কুলে সবসময় আমার সাথে গার্ড থাকতো। আমার কোন বন্ধু ছিল না যে যার সাথে আমি আমার কষ্টগুলো শেয়ার করবো। আমি আমার নতুন মাকে কখনো মা বলে ডাকিনি, কারণ তাকে আমি ঘৃনা করি। কিন্তু তিনি খুব ভালো মানুষ।তিনিও আমার মতো নরকে জিবন যাপন করছে। কবিরাজের কথায় তাকে দুবার এবরোশন করানো হয়েছিল। আর তিনিও এতে রাজি ছিলেন। কিছু করার ছিল না তার।
তার পর তার জমজ ছেলে হয়।আর এতে আমার বাবা,দাদি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। কেউ কখনো আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। আমি কি খেলাম কি পরলাম আদৌ অসুস্থ হয়েছি কি না??কেউ কোন খবর রাখে না।”

ফুল জর্জের দিকে তাকিয়ে বলল,

–“এখন আপনি বলুন এই পাপিকে কি শাস্তি দেওয়া উচিৎ??আমি প্রথম মেয়ে যে কিনা নিজের বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি কি এমন দোষ করেছিলাম যে আমার থেকে সবকিছু কেড়ে নিলেন উনি?? জিজ্ঞেস করুন ওনাকে??”

ফুল কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।স্পর্শ নির্বাক চোখে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ দিয়ে ওর টপটপ করে পানি পড়তেছে। শুধু স্পর্শ নয় উপস্থিত অনেক মানুষই চোখের পানি ফেলতেছে।

আজমল চৌধুরীর আইনজীবী চুপ করে বসে আছেন। ওনার আর কিছু বলার নেই।সব ফুলই বলে দিয়েছে।জর্জ সাহেব রায় দিলেন।স্পর্শকে মুক্তি ঘোষণা করলেন আর আজমল চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করার অনুমতি দিয়ে বিচারকার্য সমাপ্ত করলেন।

আজমল চৌধুরী রাগে ফুঁসছে। তার মেয়ে তার বিরুদ্ধে এতবড় কথা বলল কিভাবে?? রাগে তার শরীর কাপতেছে।স্পর্শ ওর ভাই বাবা আর মামার সাথে বাইরে চলে আসে।ওর বাবা স্পর্শকে গাড়িতে উঠতে বলল কিন্তু স্পর্শ উঠতে চায় না।ও ফুলের সাথে দেখা করতে চায়। ফুল সবেমাত্র বের হয়েছে। মিডিয়ার লোকজন ওকে ঘিরে ধরেছে।সব ভিড় ঠেলে ও বাইরে আসে।এদিক ওদিক স্পর্শকে খুঁজতে থাকে কিছুক্ষণ খুঁজে পেয়েও যায়। দৌড়ে গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ায়। ফুল কিছু বলার আগেই স্পর্শের বাবা বলে উঠল,

–“তোমার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব ফুল। তুমি আমার অনেক বড় উপকার করেছো। দোয়া করি তুমি অনেক ভালো থাকো।”

–“না আঙ্কেল যা সত্যি আমি তাই বলেছি।”

–“আমাদের এখানে থাকাটা আর ঠিক হবে না। আমরা আসি ভালো থেকো।”

–“কোথায় যাবেন আঙ্কেল??”

–“আমরা ঢাকায় থাকি।”

–“একটা কথা বলব আঙ্কেল??”

–“বলো।”

–“আমাকে নিয়ে চলুন না আপনাদের সাথে। আমি এখানে থাকবো না।”

একথা বলার সাথে সাথেই কেউ একজন এসে ফুলের গালে চড় মারল।তাল সামলাতে না পেরে ফুল মাটিতে পড়ে যায়। ফুল তাকিয়ে দেখে ওর বাবা ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আজমল চৌধুরী ফুলকে মাটি থেকে টেনে তুলে বলল,

–“এর জন্য তোমাকে আমি এতবড় করেছি?? আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্য?? আবার তুমি এদের সাথে যেতে চাইছো??”

আজমল চৌধুরী ফুলকে মারার জন্য আবার হাত ওঠাতেই স্পর্শ হাতটা চেপে ধরে বলল,

–“আরেকবার হাত উঠিয়েছেন তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”

আজমল চৌধুরী হুংকার দিয়ে উঠলেন।স্পর্শের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

–“সেটা তোমাকে বলতে হবে?? আমি আমার মেয়েকে মারব না কি করবো সেটা তোমার থেকে জানতে হবে না।”

স্পর্শ ফুলের হাত ধরে টেনে ওর পাশে দাড় করিয়ে বলল,

–“ফুলকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

–“কি তোমার এতবড় সাহস তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাবে??”

–“হ্যা নিয়ে যাব।”

আজমল চৌধুরী স্পর্শের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

–“রাজির তোর ছেলেকে আটকা না হলে এখানে লাশ পড়ে যাবে।এই সিলেট থেকে তোর ছেলের লাশ নিয়ে ফিরতে হবে।”

স্পন্দন এগিয়ে এসে বলল,

–“কি বলতে চাইছেন আপনি??”

–“আরে স্পন্দন যে,বলছি ভালোয় ভালোয় ভাইকে নিয়ে চলে যাও। নয়তো জীবিত ফিরতে পারবে না।”

স্পর্শের বাবা খুব ভয় পেয়ে গেল। তিনি বললেন,

–“না তুই কিছু করিস না। আমি ওদের নিয়ে চলে যাচ্ছি।স্পর্শ চল গাড়িতে ওঠ।”

–“বাবা আমি ফুলকে না নিয়ে যাব না।”

–“তুই কি আমার মরা মুখ দেখতে চাস??”

–“বাবা,,,কিন্তু,,,,”

–“কোন কিন্তু নয় চল গাড়িতে ওঠ।”

স্পর্শকে টেনে গাড়িতে ওঠায়। স্পর্শ তখনও ফুলের হাত ধরা। আজমল চৌধুরী টেনে ফুলের হাত ছাড়িয়ে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায়। ফুল অনেক কাকুতি মিনতি করে স্পর্শের বাবাকে কিন্তু তিনি কোন কিছু বলেননি। আজমল চৌধুরী ফুলকে বাড়িতে নিয়ে আসে।

ফুলের দাদি সব শুনে তো রেগেমেগে আগুন। তিনি ও এসে ফুলের গালে কয়েকটা থাপ্পর মারল। তারপর ফুলকে রুমে আটকে রাখল।

স্পর্শকে নিয়ে ঢাকায় ফিরল সবাই।স্পর্শকে দেখে ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন।স্পর্শ কোন প্রতিক্রিয়া না করে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।রুমের সব জিনিস পত্র ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। ফুলকে ওর সাথে আনতে পারল না।ভেতরটা ওর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। বারবার ফুলের কথাগুলো মনে পড়ছে। ফুল ওর সাথে আসতে চাইছিল কিন্তু পারল না। না জানি ফুল এখন কি করতেছে?
কোন অবস্থায় আছে??স্পর্শ মাটিতে বসে রইল।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here