বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব -০৭

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৭
একা ঘরে বসে মন টিকছে না রুহানীর। রিহারা এসেছে। ওদের সাথে রুহানী একবার দেখা করেই উপরে চলে এসেছে। মধ্যাহ্নের অলস সময় ও বৈশাখী রোদের তীক্ষ্মতায় টেরেসেও বসতে পারছে না। কী করবে না করবে ভেবে ছবি আঁকতে বসে গেল।

রহমত শেখ, রিহার শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা রিহার স্বামী ও চাচা শ্বশুরের সাথে সোফায় বসে টুকটাক ব্যাবসায়িক কথা-বার্তা বলছে তখন রিহা উঠে রান্নাঘরে তার মা জাহানারা শেখের কাছে যায়। সেখানে রিহার মামি অন্তরা রহমানও উপস্থিত। রিহা গিয়ে মামিকে ইশারায় কিছু বুঝিয়ে জাহানারা শেখকে বলেন,
“কী ব্যাপার মা? তোমার বোনজি দেখি ঘর থেকেই বের হয় না! আমাকে বলতে আমি দিন দিন অসামাজিক হয়ে যাচ্ছিলাম, তাই মামা-মামির কাছে পাঠিয়ে দিলে। তাহলে তোমাদের সামাজিক মেয়ে ঘরের দরজা আটকে বসে আছে কেন?”

রিহার মামি অন্তরা রহমানও রিহার সাথে তাল মেলালেন,
“রিহা তো ঠিক বলেছে জাহানারা। রুহানী কই এসে বোনের সাথে গল্প করবে। তা না! ঘরের দরজা আটকে বসে আছে!”

জাহানারা শেখ চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওষ্ঠকোণে হাসি ফুটিয়ে জর্দাপোলাওয়ের কড়াইয়ে ঢাকনা দিয়ে রেখে বলে,
“কী যে বলো ভাবী! কালকের ঘটনার পর তোমার সত্যি মনে হয়, রুহানীর এখানে আসা উচিত? যতোই বলো, যাকে বোনের হাজবেন্ড দেখছে সে তো ওর হাজবেন্ড হতে হতে হলো না। এখন রুহানীকে দেখলে আমার মেয়ে, মেয়ে জামাইয়ের গিল্টি ফিল হবে না? বলো? আমার রুহানী এসব বিষয়ে বেশ সচেতন। তোমরা বরং সেসব বাদ দাও। একটু পর খাবার সার্ভ করা হবে। যাও টেবিলে গিয়ে বসো।”

“মা, একটু নিজের মেয়ের কথাও চিন্তা করো। অন্যের মেয়ের প্রতি এতো দরদ আমার সহ্য হয় না।”

রিহার কথা-বার্তায় তার মনের ভাব পরিলক্ষিত। জাহানারা শেখ মলিন হেসে বলেন,
“তোমার তো কারও নিজের মেয়ের প্রতি ভালোবাসাও সহ্য হতো না। আমি তো শুধু ছোটো মেয়েটাকে আগলে রাখছিলাম, সাথে তোমাকেও।”

রিহা রাগে কটমটিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অন্তরা রহমান জাহানারা শেখকে বলেন,
“এমন করে না বললে হয় না? তোমার নিজেরই মেয়ে তো।”

তারপর তিনিও বেরিয়ে যান।
——–
আরহান তার বাবা ও দাদীকে নিয়ে দাওয়াতে রুহানীদের বাংলোতে এসেছে। সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে আরহান আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে একজনকে খুঁজে চলেছে। আরহানের দাদী আয়েশা খানম নাতির ভাবসাব দেখে মৃদু স্বরে শুধালেন,

“কী হয়েছে? আশেপাশে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”

আরহান মুচকি হেসে বলে,
“কী হবে? কিছু না। এমনিই দেখছিলাম। বহুদিন পর উনারা এখানে এসেছেন, তার মানে বাড়িটির জিনিসপত্র সবই পুরোনো ধাঁচের।”

“তুই পারিসও!”

দাদী-নাতির হাসির মধ্যেই জাহানারা শেখ সকলকে ডেকে বলে ওঠেন,
“গল্প পরে করবেন, সবাই আগে খেয়ে নিন।”

খাবার টেবিলে আরহান সকলকে দেখলেও রুহানীকে দেখল না। সে জাহানারা শেখকে জিজ্ঞেসা করে,
“আন্টি, আপনাদের ভাতিজি লাঞ্চ করবে না? তাকে তো দেখছি না।”

জবাবে জাহানারা শেখ কিছু বলবে তার আগেই রিহা বলে ওঠে,
“এখানকার রাজকুমারী কী-না! তাই সে ভীড়ের মধ্যে আসে না। তার জন্য রুমে খাবার পাঠানো হবে।”

মেয়ের কথায় রহমত শেখ এবার কিছু না বলে থাকতে পারলেন না।
“কে কী সেটা তোমাকে বলতে হবে না। তুমি তোমার খাওয়া খাও। তুমি যখন এতো করে চাইছ রুহানী নিচে আসুক, তবে আমি নিজে ওকে নিয়ে আসছি। তখন যেন তোমার জবান বন্ধ থাকে।”

এই বলে রহমত শেখ খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। টেবিলে উপস্থিত সকলে সেদিকেই চেয়ে রইলেন। রহমত শেখ উপরে গিয়ে ভাতিজির রুমের দরজায় নক করলেন। রুহানী নিজের আঁকা চিত্রকলাতে সবুজ রংয়ের মিশ্রণ শেষে আকাশের রংধনুর রং দিতে সব শুরু করেছে তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে রং-তুলি রেখে দরজা খুলতে ছুটে যায়। দরজা খুলে চাচাকে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেসা করলে রহমত শেখ বলেন,

“নিচে চল। একসাথে লাঞ্চ করব।”

রুহানী ইশারায় কারণ জানতে চাইলে রহমত শেখ বলেন,
“এমনিতেই। আরও কয়েকজন গেস্ট এসেছেন। আয়।”

অতঃপর রহমত শেখ রুহানীকে হাত ধরে নিচে নিয়ে গেলেন। নিচে যাওয়ার পর জাহানারা শেখ রুহানীকে খাবার টেবিলের ফাঁকা চেয়ারে বসাতে নিলে আরহান বলে ওঠে,
“আপনার পেন্টিংয়ের শখ আছে? আপনার হাতে রং লেগে আছে।”

রুহানী সবেই আরহানকে লক্ষ্য করল। হঠাৎ দেখে সে কিঞ্চিত অবাকই হয়েছে। জাহানারা শেখও আরহানের কথা শুনে রুহানীর হাতের দিকে তাকায়। অতঃপর হেসে বলে,
“ওহ, ওর মাঝেসাঝে প্রকৃতির কিছু আঁকতে ইচ্ছে করে। ঢাকাতে ওর রুমে ওর নিজের আঁকা দুইয়েকটা পেন্টিং বাঁধাই করা আছে।”

তারপর রুহানীকে বলে,
“যা হাতটা ধুঁয়ে আয়।”

রুহানী সবার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বেসিনে হাত ধুঁয়ে এসে চেয়ারে বসে। রুহানীর চেয়ারটা প্রায় আরহানের মুখোমুখি। আরহানের দাদী বলেন,
“মিসেস শেখ, আপনিও বসে পরুন। সবাই খাচ্ছে তো একসাথে খান।”

“না খালাম্মা সমস্যা নেই। আমি পরে খাব।”

“কী বলেন পরে খাবেন? একসাথে খেলে আমাদেরও ভালো লাগবে। কারও কিছু লাগলে নিয়ে খাবে।”

জাহানারা শেখ এবার আরহানের দাদীর কথা টালতে পারলেন না। তিনি রুহানীর পাশের চেয়ারে বসে পরলেন।

_________

খাওয়ার সময় রিহা আর কোনো ঝামেলা করেনি। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে সবাই উঠে যাওয়ার পর, রুহানী যখন বেসিনে হাত ধুঁতে যাচ্ছিল তখন রিহা এসে হুট করে ওর হাত চেপে ধরে। আর একটু অভিনয় করে বলে,
“কী ব্যাপার? তুই দেখি আমার সাথে এসে একটু কথাও বললি না! জানি তুই কথা বলতে পারিস না। কিন্তু ইশারায় বা হাসির মাধ্যমে কথা বলতে পারতি? আফটারঅল উই আর সিস্টারস! রাইট? বোনদের মধ্যে তো কতোরকমের কথাই হয়। আর তুই কী-না একটুও ইন্টারেস্টেড না!”

রিহার কথা শুনে রুহানী জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। রিহা অনেকটা জোরেই রুহানীর হাত চেপে ধরেছে। যার ধরুন সে হাতে ব্যথা পাচ্ছে। রুহানী বারবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রিহা ছাড়ছে না। রিহা বরংচ আরো একটু জোরে চেপে ধরে লোক দেখানো হেসে বলে,

“চল, তোর ঘরে গিয়ে কথা বলি।”

এই বলে রিহা রুহানীকে একপ্রকার টেনেই নিয়ে যেতে লাগল। পুরো ব্যাপারটা আরহানের নজর এড়ায়নি। তার কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন ঠিক সুবিধার লাগল না। আরহান সোফাতেই বসে ছিল। সে একটু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সিঁড়ি দিয়ে সবার অগোচরে উপরে উঠতে থাকে।

রিহার রুহানীকে নিয়ে রুহানীর রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর কিছুটা রূঢ়তার সাথে রুহানীর হাত ছাড়ে। রুহানী এতে খানিকটা পিছিয়ে যায়। পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। রিহা রুমটার দিকে নজর বুলাতে বুলাতে বলে,

“বাহ! বাংলোর সবচেয়ে সুন্দর রুমটাই তোর কপালে জুটেছে দেখছি! এতো সুখ, এত প্রাচুর্য থাকার পরেও তুই নাকি কষ্টে আছিস? তোর মুখে হাসি নেই! আর আমার বাবা-মা মনে করে তোর মুখে হাসি নেই তার কারণ হচ্ছি আমি! তোর হবু হাজব্যান্ডকে আমি বিয়ে করেছি তাই জন্য তোর মুখে হাসি নেই! কিন্তু আমি যে তাদের মানসম্মান বাঁচিয়েছি, সেটা দেখছে না। অবশ্য উনারা আমার কোনো গুণই দেখতে পান না। তোকে ছাড়া আর কিছু তাঁদের চোখেই লাগে না। ছোটোবেলা থেকে আমার ভাগের সব আদর তো তুই পেয়েছিস। তারপরও বলছিস, তুই সুখে নেই! তোর এই ড্রামা আমার বাবা-মায়ের সামনে চলতে পারে কিন্তু আমার সামনে না। তুই কথা বলতে পারিস না বলে তোর প্রতি আমার বাবা-মায়ের যে কী দরদ! দেখতেই বিরক্ত লাগে। আচ্ছা? আমাকে একটা কথা বলতো, তুই কি আদৌ কথা বলতে পারিস না? ছোটো বেলায় তো সারাক্ষণ কথা বলে কান ঝালাপালা করে ফেলতি! তারপর চোখের সামনে একটা ঘটনা ঘটতে দেখলি তারপর তুই তোর কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললি! মানে ড্রা*মাটিক আর কাকে বলে! তোকে নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলাছবি বানানো যাবে।”

রিহার বলা কথার প্রতিটা শব্দ রুহানীর হৃৎপিণ্ডে সুঁই ফোঁটার মতো ব্যাথা অনুভূত করিয়েছে। চোখের জল টপটপ করে কপোল বেয়ে মেঝেতে পরছে।
রিহা রুহানীকে চুপ করে কাঁদতে দেখে বিরক্ত হয়। সে কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল,

“এখন কান্না করে কি শুকিয়ে যাওয়া যমুনা নদীর স্রোতধারা ফিরিয়ে আনবি নাকি! তুই আদৌ কথা বলতে পারিস কী-না কে জানে!”

রুহানী দুই হাত দ্বারা নিজের অশ্রধারার পথ রোধ করে টেবিলের কাছে যায়। অতঃপর খাতা-কলম নিয়ে লিখে,
“আমি কথা বলতে পারলে কী আঠারোটা বছর যাবত চুপ করে থাকতাম আপু? সেই সাড়ে তিন বছর বয়সে আমার সামনে আমার বাবা-মায়ের মৃ*ত্যু হয়েছে। চোখের সামনে। আমি নিজের মৃ*ত্যুকেও চোখের সামনে দেখছিলাম। সেদিন আমার ভাগ্যে মৃত্যু লেখা ছিল না বিধায় বেঁচে গিয়েছিলাম। তারপর এক বছর তো জীবন্ত লা**শের মতোই ছিলাম। তুমি বলো, একটা সাড়ে তিন বছরের বাচ্চার মস্তিষ্কে তখন অভিনয় করার কথা আসতে পারে? সেই ঘটনার পর আজ আঠারোটা বছর যাবত কী আমি কথা বলার চেষ্টা করিনি? চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হয়েছি বহুবার। এখন সবটা আমি ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। যা হবে দেখা যাবে।”

রুহানী লেখাটা শেষ করে খাতাটা রিহার হাতে দিল। রিহা বিরক্তি নিয়ে লেখাগুলো পড়তে শুরু করল।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here