বিবর্ণ সিঁদুর
পর্ব-১৪
#Taniya_Sheikh
তন্ময়ের মাসি তমালিকা দেবী মিতুলদের চারজনকে নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁর বাড়ি। সবাই আনন্দিত হলেও বিপত্তি দেখা দেয় রজনীকে নিয়ে। সে কোথাও যাবে না বলে অনুনয় বিনয় করছে। সুদীপ্ত তাই দেখে মিতুলকে বলল,
” ও যখন যেতে চাইছে না, থাক। আমরাই যাই।”
মিতুল রুক্ষ স্বরে জবাব দেয়,
” তোমার কথায় সব হবে নাকি? আমার ফ্রেন্ড আমি যা বলব তাই হবে। রজনী চল।”
বেচারী রজনী কেঁদেই ফেলেছিল ওখানে যাবে না বলে। কিন্তু মিতুল দেখেও দেখল না। জোর করে গাড়িতে টেনে আনল কোনোরকমে নতুন কাপড় পরিয়ে। সুদীপ্তর কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলো বিষয়টা। মিতুলের এহেন আচরণ তাকে রাগতে বাধ্য করে। জমজ দুই বোনের একজন এলো অপরজন অর্থাৎ অন্যন্যা এলো না। মিতুলের ব্যবহারে মনে মনে সে অসন্তুষ্ট হয়েছে। ভেবেছিল মিতুল এসে অনুরোধ করবে কিন্তু না, মিতুল গেল না। সে তাড়াহুড়ো লাগিয়ে নিয়েছে মাসির বাড়ি যাওয়ার জন্য। বাস টাসের ঝামেলা পোহাবে না বলে মিতুল আগেভাগে একটা ভ্যান আনিয়েছে। সামনে মিতুল আর রজনী বসেছে, পেছনে সুদীপ্তর পাশে অনিমা। মিতুলকে রাগানোর কোনো ইচ্ছায় সুদীপ্তর নেই তবুও যেন সেটাই হচ্ছে বার বার। এই যে অনিমা পেছনে বসে গায়ে গা লাগিয়ে শব্দ করে হাসছে গল্পে মেতে, সুদীপ্ত শতভাগ সিওর এর প্রায়শ্চিত্ত তাকে করাবেই মিতুল। নিজ ইচ্ছায় পাশে বসিয়ে আবার শাস্তিও দেবে। ভালোবাসা পঞব্যঞ্জনের মতো। টক,ঝাল,মিষ্টি,নুনতা,তেতো সবই আছে। তবে যাই হোক আহার বুঝে করতে হয়। না বুঝে খাদ্য গ্রহণে যেমন পরিপাকতন্ত্রে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে, তেমনি ভুল পথে এগোলে ভালোবাসায়ও বিপত্তি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা আছে। বিপত্তি, বিষক্রিয়ার ফল মাঝে মাঝে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে। উদাহরণ টা উইয়ার্ড হলেও কথা মিথ্যা না। ভাগ্য কখন দূর্ভাগ্যে পরিবর্তন হয় বলা কঠিন। সামান্য খুড়া গর্ত যদি বৃষ্টিজলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিশাল গুহার সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি সামান্য ভুলে কতো কিছুই না হতে পারে। সে যা হোক ভুল ত্রুটি দিয়ে মানবজনম। কেউ এর উর্ধ্বে নয়। ভুল শুধরে জীবনের দর্শন খুঁজে নেওয়ায় শিক্ষা। মানুষ পাপ করে পূণ্য চেনে।
রজনীর মন ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ছে তন্ময়ের প্রতি। একবার ভাবছে এ তো পাপ পরক্ষনেই ভাবছে সৌমিত্র তো তাকে পরিত্যাগই করেছে তবে পাপ কেন হবে? সে তো বলেইছিল রজনীর অন্য কোথাও বিয়ে দেবে তবে? ভুল কিছু তো ভাবছে না রজনী। তার সিঁদুরে রঙ নেই, হাতে শাখা পলা কিছুই নেই, যে সাতপাকে ঘুরেছিল তার কোনো অর্থই ছিল না কারো কাছে। তাহলে কিসের মর্মপীড়া! মিথ্যা সম্পর্কের বাঁধন অগ্নিশিকল হয়ে তিলে তিলে পোড়াচ্ছে। তবুও সে তন্ময়কে চাইবে না। কোনদিন না। তার দূর্ভাগ্যের জীবনে তন্ময়কে টেনে আনার মতো ভুল রজনী করবে না। স্থির চোখে শূন্যে তাকিয়ে ভাবছে রজনী। বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণা উপলব্ধি করছে। মনটা বার বার আগ্রাসী হতে চাইছে সৌমিত্রের উপর অভিমান করে।
পৃথিবীতে যত উন্নত যানবাহনই থাক ভ্যানের মতো এমন স্বস্তিদায়ক যানবাহন দুটো নেই। পা ঝুলিয়ে, চতুর্দিকের সমীরণ গা লাগিয়ে ভ্রমনের আনন্দই আলাদা। যেতে যেতে আশপাশের গ্রাম্য প্রকৃতির স্নিগ্ধতা দেখলে বুঝি চোখের জ্যোতির আয়ু বছরখানেক আরও বাড়ে। গ্রাম,গঞ্জ,পেরিয়ে ওরা দুপুরের মধ্যে পৌঁছে গেল শ্রীগড়( কাল্পনিক)। পাকা সড়ক ছেড়ে ভ্যান নামল আধপাকা রাস্তায়। এ দৃশ্য আরো মনোরম। পেছনে বসা অনিমার মনেও বুঝি সেই ভাবনায় জাগল। গলা ছেড়ে গাইল,
” এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হবে তুমি বলোতো?” সুদীপ্ত দিকে তাকিয়ে শেষবার ভ্রুনাচাতেই সুদীপ্ত মুখ ঘুরিয়ে নিল একরাশ বিরক্তিতে। সামনে বসা মিতুলের চোখ এড়াচ্ছে না এসব। বুকের মধ্যে অগ্নুৎপাত হচ্ছে, অথচ বাইরে সে দিব্যি হাসিখুশি। রজনীর মন ভালো করার জন্য কতো কিই না করছে। রজনী প্রতিদানে একচিলতে মেকি হাসি দিল। মিতুল বেশ বুঝল কিন্তু না বোঝার ভান ধরে হাসিমুখে বসে রইল আগের মতো। ভ্যান এসে থামল একটা অর্ধনির্মিত পাকা বাড়ির সামনে। বাড়িটির চারপাশে কাগজি,বেলি,হাসনাহেনা,সহ নানা ফুলের গাছ। পাশের দোচালা ঘর থেকে একজন মধ্যবয়সী সুশ্রী রমনী বেরিয়ে এলেন। একগাল হাসিতে তার সৌন্দর্য্য আরও বাড়ল যেন। সুতি ছাপার দোপেড়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছে সোজা এসে দাঁড়ালেন রজনীর সামনে। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখে ফের হেঁসে কাঁধে হাত রেখে ভেতরে নিয়ে এলেন। অনিমার এতোকিছু দেখার সময় নেই। সে সরাসরি অর্ধনির্মিত একতলা বাড়ির ভেতর চলে গেল। সুদীপ্ত ভ্রুকুঁচকে তমালিকা দেবীর দিকে তাকিয়ে ছুটে গেল মিতুলের পাশে। বলল,
” রজনী কে কী করে চেনেন মাসি?”
মিতুল একথার জবাব না দিয়ে একবার ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সুদীপ্তর মেজাজ এবার চড়ে যায়। মনে মনে নিজেকে মারাত্মক একটা গালি দিয়ে ভ্যানওয়ালার ভ্যানে উঠে বলল,
” চলেন,
” আপনে কি ফিরে যাবেন?”
” এতোকথা বলেন কেন? যেতে বলেছি চলেন।”
ভ্যানওয়ালা আর কথা বাড়ায় না। যে পথে এসেছিল সে পথেই রওনা দেয়।
রজনী আনত মুখে বসে আছে তমালিকা মাসির পাশে৷ মাসির গা দিয়ে চন্দনের গন্ধ আসছে। মনে হয় সবেমাত্র পূজা সেরেছেন তিনি। রজনী মনে মনে বেশ বিস্মিত তমালিকা মাসির ব্যবহারে। রজনীকে এমন করে কাছে বসিয়ে কথা বলছেন যেন কতো চেনা তার। রজনী জানত না ইনি তন্ময়ের মাসি। জানলে হয়ত মরে গেলেও আসত না এখানে। কিন্তু সে কি জানে, ভাগ্য তাকে কোন পথে নিয়ে চলছে। তমালিকা মাসি অনিমা,মিতুলকে সাথে নিয়ে বসার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। স্থির দৃষ্টিমেলে কাঠের পুতুলের মতো কোলের মধ্যে হাত গুটিয়ে বসে আছে রজনী। পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে কতো কিছুই ঘটছে কিন্তু রজনীর সময় যেন থমকে গেছে। একই ভাবনার দুর্বিপাকে ঘুরছে বার বার। সে খেয়াল ও করল না এ ঘরে তন্ময়ের উপস্থিতি। তন্ময় গতকালই এখানে এসেছে। রজনীকে ভালোবাসে একথা প্রথমে মাসিকেই বলেছিল তন্ময়। জীবনের ছোটোবড়ো সব কথায় সে মাসিকে বলে। এখানের আসার আগে তার সাথে কী কী ঘটেছে সবই বলেছে মাসিকে। কিন্তু মাসি তাকে রজনীর আসার কথা জানায়নি। জানালে আবার এই মেয়ের মুখ দেখতে হতো না তাকে। রজনীর দিকে একপলক ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হনহন করে নিজের রুমে ঢুকে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিল। সেই শব্দে চমকে ওঠে রজনী। চোখ মেলে সেদিক তাকিয়ে কাওকে দেখল না। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার ঔদাস্য মুখে বসে রইল।
ফ্রেশ হয়ে আর সবার সাথে খেতে বসল রজনী। সুদীপ্তকে না পেয়ে মাসি কল করে জানতে পারল সে ফিরে গেছে। কেন গেছে তার কারণ বলল না। মাসি কিছুটা মনক্ষুঃন্ন হলেও প্রকাশিত হলো না সেটা। হাসিমুখে সবার প্লেটে খাবার তুলে দিলেন তিনি। রজনী যত তাকে দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। এই একটুখানি সময়ের মধ্যেই আপন করে নিয়েছেন রজনীকে তিনি। ঠোঁটের কোনে হাসিটা যেন তার বাঁধায় করে রাখার মতো। কারো সাথে যেন মিল আছে এই চেহারার। কিন্তু কার সাথে সেটাই খুঁজে পেল না। খাওয়ার মাঝে হঠাৎ অনিমা বলল,
” মাসি, বড়’দা খাবে না?”
অনিমার প্রশ্নে মিতুল, মাসি দু’জনই চোখাচোখি করে রজনীর দিকে তাকাল। রজনী হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। মিতুল ওর দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত মুখে একটুখানি হাসে। রজনী কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় হঠাৎই। মিতুল অনিমার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকাতেই অনিমা বিরক্ত হয়ে বলল,
” কি হয়েছে? ”
” তোর মাথা। খা। খা।” মিতুলের রাগ অনিমা কোনোকালেই গায়ে মাখে না। আজও মাখল না। মনে মনে কিছু একটা সন্দেহ জাগলেও ভাবে প্রকাশ করে না। চুপচাপ বসে খেতে লাগল। এদিকে রজনীর গলা দিয়ে আর খাবার নামে না। প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে সামনে বসা মিতুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট ক্ষোভ ভাসছে। মিতুলের জোর করে এখানের আনার কারন এতোক্ষনে বুঝেছে রজনী। মনে পড়ল একটু আগে ওপাশের রুমে জোরে দরজা লাগানোর কারন। তন্ময় তাকে দেখেছে। কতটা নির্লজ্জই না ভাবছে রজনীকে সে। অপমানে,লজ্জায় চোখ ফেটে কান্না এলো। সবাই টেবিল ছাড়লেও রজনী তখনো বসে ছিল স্তব্ধ মুখে। তমালিকা মাসি অনেক্ষণ ধরেই দেখছিলেন এ দৃশ্য। মেয়েটা মায়াভরা মুখখানি দেখে প্রথম দেখাই ভালো লেগেছে। এমন নরম,কোমল স্বভাব আজকালকার মেয়েদের মধ্যে কোথায় দেখা যায়। এই মেয়েকে কি’না এমন বাজে কথা বলেছে তার তন্ময়? তমালিকা দেবী এগিয়ে মাথায় হাত রাখল রজনীর।বলল,
” চলো হাত ধোবে, মা।”
রজনী অশ্রুসিক্ত চোখে একবার শুধু মুখ তুলে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে মাসির সাথে চলল। হাত ধোয়ার সময় মাসি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধোয়া শেষ হলে নিজের রুমে নিয়ে এলেন রজনীকে। বিছানায় মুখোমুখি বসিয়ে বললেন,
” আমি যদি কিছু জিজ্ঞেস করি তুমি কি রাগ করবে,মা?”
রজনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখ তুলে তাকায়। চোখের ঘন পাঁপড়ি ভিজে একটা সাথে অন্যটা লেগে আছে। রক্তাভ চোখে ফুঁপিয়ে বলল,
” আমি জানি আপনি কী জিজ্ঞেস করবেন। হ্যাঁ, আমি সবাইকে মিথ্যা বলেছি। বলেছি আমি অবিবাহিতা। কিন্তু কেন বলেছি কেউ জানে না। আচ্ছা আপনিই বলেন, যে সত্য প্রকাশে যন্ত্রণা বাড়ে, মানুষের বাঁকা চোখের কারন হতে হয়। সে সত্য লুকানো কী পাপ? হলোই’বা পাপ। করেছি আমি পাপ। আমাকে শূলে চড়াক,ফাঁসি দিক। আমি আর বাঁচতে চাই না।” ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বলল রজনী। তমালিকা মাসি একহাতে রজনীকে বুকে টেনে জড়িয়ে বলে,
” তুমি কোনো পাপ করোনি, মা। কেউ ফাঁসিতে ঝুলাবে না তোমাকে।”
” কেন ঝুলাবে না? ঝুলাক ফাঁসিতে। আমি তো তাই চাই। আমার যে আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না, মাসি।” মাসির বুকে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তমালিকা বুঝতে পারেন এই মেয়ের কষ্টের গভীরতা মাপা সহজ নয়। মনটা ভারী হয়ে ওঠে মেয়েটার কষ্টে। রজনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
” কাঁদিস না, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য্য ধর।”
রজনী ওমনি করেই মাথা নাড়ায়।বেশকিছুক্ষণ দুজনে কেউ কথা বলল না। রজনীর কান্না থেমে যায় একসময়। মাথা তুলে হিচকি টানতে টানতে সব খুলে বলে তমালিকার সামনে। তমালিকা দেবীর চোখ ছলছল। বহুক্ষণ কোনো কথায় তার মুখ দিয়ে বের হলো না। রজনী পুরোনো কথা স্মরণ করে নিরবে চোখের জল ফেলছে। মুখটা স্থির,থমথমে। তমালিকা দেবী নীরবতা ভেঙে বললেন,
” এতোটুকু বয়সে তুই এতো কিছু সহ্য করেছিস, ভাবতেই তো আমার মন কষ্টে ভরে উঠল। ও বেচারা কেন এমন করেছে তা আমি জানি না। তবে কাজটা তিনি ঠিক করেননি। একদম ঠিক করেনি। তোর কোনো দোষ নেই সোনা। একটুও দোষ নেই।”
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তমালিকা দেবী। বলেন,
” তুই একটু ঘুমা। আমি আসছি রে, মা।”
ধীর পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। রজনী উপুড় হয়ে পড়ে পড়ে কাঁদছে। কান্নায় যেন তার নিয়তি। তমালিকা দেবী সোজা চলে এলেন তন্ময়ের রুমে। তন্ময় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল। মাসির আসার শব্দেও ফিরে তাকাল না। রাগত কন্ঠে বলল,
” ওকে এখানে এনে ঠিক করো নাই তুমি, মাসি।”
” তুইও না জেনে মেয়েটাকে চরিত্রহীনার অপবাদ দিয়ে ঠিক করিসনি। পাপ করেছিস তুই ঐ পবিত্র চরিত্রে অপবাদ দিয়ে।” শান্ত গলায় বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন তমালিকা দেবী। তন্ময় জানে সে অন্যায় করেছে রজনীকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে। কিন্তু মুখে সেকথা কিছুতেই স্বীকার করবে না। মুখ ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে মাসিকে বলল,
” এই টুকু সময়ে সব বুঝে গেলে?বাহ! ওকে বিশ্বাস করো না,মাসি। ছলনাময়ী ঐ মেয়ে।”
” চুপ কর। আর একটা বাজে কথা বলবি না তুই ওর নামে। কী জানিস তুই ওর সম্পর্কে? ও ছলনাময়ী! কী ছলনা করেছে তোর সাথে, বল? বেচারির জীবনটা নাটক বানিয়ে রেখেছে মানুষ, সিঁদুর পড়িয়ে মুছে দিয়েছে, ত্যাগ করেছে ওর স্বামী। তাহলে কী করে সবাইকে বলবে ও বিবাহিতা? কী প্রমাণ দেখাবে নিজের সধবা হওয়ার? মানুষের উপরটা দেখে বিচার করা খুব সহজ, বাবাই। কিন্তু ভেতরটার খবর কয়জন রাখে? তুই আর সবার মতো হয়ে গেলি। না জেনে কষ্ট দিলি মেয়েটার মনে। ঐ হতভাগীর কষ্ট তুইও বুঝলি না। যেই মেয়েটার সরলতায় মুগ্ধ হয়েছিলি একদিন, তাকে যাচাই না করেই ওমন কথা কী করে বলতে পারলি,বাবাই? অন্যায় করেছিস তুই।” তন্ময় হতবুদ্ধি হয়ে বিছানায় বসে। তমালিকা দেবী সব খুলে বললেন৷
আমরা নিজের দুঃখ,ব্যথাটাই বড় বলে ভাবি।অন্যের ব্যথা বোঝার সময় কিংবা মন কৈ আমাদের? নিজেকে মহাদুঃখী জ্ঞান করে সবাইকে দোষারোপ করে যাই। একবারো আমরা সামনের মানুষটাকে বুঝতে চেষ্টা করি না। তন্ময়ের অন্তর্দাহ প্রকটভাব নিল। মাসির অগোচরে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। তমালিকা দেবী ভাগ্নের নীরবতার কী অর্থ বুঝলেন তিনিই জানেন৷ চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
” ক্ষমা মহৎগুন,বাবাই। পাপ তো যে কেউ করতে পারে,ক্ষমা চাইতে কজন পাবে? আমি জানি, আমার বাবাই আর সবার মতো না। সে নিজের দোষ স্বীকার করবে। ঐ দুঃখিনীর দুঃখ ঘোচাতে না পারুক, বাড়াবে না আর।”
মাসি চলে যাওয়ার পরও একটা শব্দ মুখ থেকে বের হয়নি তন্ময়ের। সেই রাতে রজনীকে বলা প্রতিটি কথা বিষাক্ত তীরের ফলা হয়ে বুকে বিদ্ধ হচ্ছে। ব্যথার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তন্ময়।
রাগ পড়তেই বিকেলে ফিরে এসেছে সুদীপ্ত। এসেই দেখা হলো তমালিকা মাসির ছোট ছেলের সাথে। একই বয়সের ওরা। দুজনে বহুদিন পর একসাথে হওয়ায় বেশ হৈচৈ করে গল্প জুড়ে নিল। ওদের সাথে এসে যোগ দিল অনিমা,মিতুল। তমালিকার ছেলে তুর্জয়কে এই প্রথম দেখল অনিমা। ওদের চোখাচোখি হতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল সে। তুর্জয়ের ঠোঁটের কোনে হাসি। মিতুল এসব লক্ষ্য না করলেও সুদীপ্ত করল। মনে মনে বড়োসড়ো একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সুদীপ্ত। মিতুল হাসছিল কিন্তু যেই সুদীপ্তর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয় ওমনি মুখ গোমড়া করে ফেলে। তুর্জয় বেশ প্রানখোলা ছেলে। মানুষ হাসাতে উস্তাদ খুব। গল্প উঠেছিল পূজোয় কে কী করবে? সে বলল,
” আমার তো ইচ্ছা চট করে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে ফট করে ছাদনাতলায় বসা। কিন্তু মা বলছে বয়স আমার বেশি না।” ব্যস এতোটুকু বলেই অনিমাকে লক্ষ্য করে গান ধরল,
” বয়স আমার বেশি না। ওরে টুকটুকির মা। খালি,, যা বাবাহ! আমার তো চুলটাও কাঁচা। গান মিলাব কী করে?” তুর্জয়ের এহেন কথায় আর হাস্যকর ভঙ্গিতে হো হো করে হেঁসে উঠল অনিমা, মিতুল। সুদীপ্তর হাসি পেল না। সে শুধু মিতুলকে দেখছে নেশাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে। মিতুল যেন ইচ্ছে করেই বেশি হাসছে। রাগাতে চাইছে নিশ্চয়ই? সুদীপ্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবল। মাসির ডাকে মিতুল উঠে যেতেই সুদীপ্ত পিছু পিছু গেল। সেই সুযোগে তুর্জয় অনিমার পাশে এসে বসে। দুজনে লজ্জায় একপলক পরস্পরকে দেখে চোখ নামিয়ে মুচকি হাসল।
মিতুল সামনের অন্ধকার রুমটার মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাইরে যাবে বলে এগোচ্ছিল। হঠাৎ কেউ হ্যাঁচকা টানে পাশের দেয়ালের সাথে চেঁপে ধরে। অন্ধকারে সুদীপ্তর মুখ চিনতে কষ্ট হলো না মিতুলের। রাগত স্বরে বলল,
” ছাড়ো বলছি।”
” কেন? এতো তেজ কেন তোর? কিসের জন্য এমন করে কষ্ট দিস আমাকে? আমাকে মেরে তবেই কী তোর শান্তি হবে ?”
সুদীপ্তর শেষ কথায় মিতুলের চোখে জল চলে এলো। অভিমানে বলল,
” হ্যাঁ, যাও মরোগে। তার আগে আমাকে ছাড়ো।”
” তোকে তো কিছুতেই ছাড়ব না। মরলেও তোকে সাথে করে মরব।” আচমকা মিতুলের দু’ঠোট কামড়ে ধরল সুদীপ্ত। ব্যথায় ছটফট করতেই ছেড়ে দিয়ে চলে গেল বাইরে। মিতুল ধপ করে বসে পড়ে। অশ্রুসিক্ত তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগল।
সন্ধ্যার পরপরই তুর্জয় ছাঁদে লাইটিং করিয়েছে। ছোটোখাটো একটা পার্টি হবে নিজেদের মধ্যে। সুদীপ্তকে বেশ সাবলীল লাগলেও মিতুলকে লাগল না। কাটা ঠোঁটটা লুকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টাই সে করছে। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে বাঁকা হাসি হাসতে দেখা গেল সুদীপ্তকে। তুর্জয়কে হাতে হাতে এটা ওটা দিয়ে সাহায্য করছে অনিমা। ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে এরই মধ্যে ওদের।
তমালিকা দেবীর এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা বড়ো। বিয়ে হয়েছে বছরখানিক হলো। স্বামী সহ সে প্রবাসী। তমালিকা দেবীর স্বামী দীপঙ্কর নন্দী নিজেও প্রবাসে চাকরী করেন। বাড়িতে থাকার মধ্যে তমালিকা দেবী ও তার ছেলে তুর্জয়ই থাকে। মাঝে মাঝে তন্ময়ও আসে এখানে। রজনীর জন্য তমালিকা দেবীর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। রান্নাঘরে বসে রাতের খাবার আয়োজন করছেন কাজের লোকের সাথে। মেয়েটার চিন্তায় কোনো কাজই আজ গুছিয়ে করতে পারছেন না।
ছাদে বাড়ির ছোটোরা সবাই গেলেও রজনী যেতে চাচ্ছিল না। মিতুল একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে নিয়েই এলো। ওরা আনন্দ করবে আর রজনী মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে তাই কী মিতুল হতে দেবে! কখনোই না। তুর্জয় পরিচিত হতে এলে একটুখানি হেঁসে চুপ করে রইল রজনী। নিজেও কথা বলল না তুর্জয়কেও সে সুযোগ দিল না। বাকিরা গান,গল্প সবই করছে। রজনীর এসব ভালো লাগছে না। এখান থেকে চলে যাবে সে উপায়ও নেই। কিন্তু মন চাইছে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে। চিরতরের জন্য। ছাদের এককোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে অন্যমনস্ক হয়ে ডুবে গেল অতীত ভাবনায়। অদূরের গাছপালার মাথার উপর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতোই চোখজুড়ে,মনজুড়ে নেমে এলো ঘন আঁধার। হুশ ফিরল হঠাৎ হইহুল্লোড় থামায়। সাথে সাথে গিটারের টুংটাং সুর বেজে ওঠে। ইচ্ছা না করলেও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। ওরই দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে গিটার বাজাচ্ছে তন্ময়। একটু পরই সুরেলা কন্ঠে গেয়ে ওঠে,,,,
Don’t go tonight
Stay here one more time
Remind me what it’s like, oh
And let’s fall in love one more time
I need you now by my side
It tears me up when you turn me down
I’m begging please, just stick around
I’m sorry, don’t leave me, I want you here with me
I know that your love is gone
I can’t breathe, I’m so weak, I know this isn’t easy
Don’t tell me that your love is gone
That your love is gone (dylan Matthew)
চলবে,,,