বিরহ শ্রাবণ পর্ব -০৬+৭

#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_৬
#লেখিকা:সারা মেহেক

প্রোজ্জ্বল ভাই আমায় রুমে এনেই দরজা বন্ধ করে দিলেন৷ শীতল চাহনিতে আমার পানে চেয়ে চেয়ার দেখিয়ে ইশারায় বসতে বললেন। কিন্তু আমি চেয়ারে না বসে রুমে মধ্যখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রোজ্জ্বল ভাই আমার এ কাজে এক ধমক দিয়ে বললেন,
” বসতে বলেছি না? তো বসছিস না কেনো?”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের ধমকে আমি অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলাম আমি৷ উনার আদেশ মোতাবেক খানিক এগিয়ে চুপচাপ নত মস্তকে গুটিশুটি হয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। প্রোজ্জ্বল ভাই আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সেকেন্ড কয়েকের জন্য আমার পানে দৃষ্টিপাত করলেন। অতঃপর রুমে রাখা অপর চেয়ারটি টেনে নিয়ে আমার সম্মুখে বসলেন। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আমার পানে স্থির ও শীতল চাহনিতে চাইলেন। স্বভাবতই উনার এ চাহনিতে আমার সমস্ত শরীরে কম্পন উঠে গেলো। এতে কোনো সন্দেহ নেই, উনি আমায় এবার ভালোমতো শায়েস্তা করবেন। যেনো ভবিষ্যতে পুনরায় এমন কোনো কান্ড না ঘটিয়ে বসি। কিন্তু আমি যে কিছুতেই শুধরানোর পাত্রী না! যতদিন প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে জ্বালাতন করবেন ঠিক ততদিন আমিও উনাকে একইভাবে জ্বালাতন করবো। বরাবরে মতো ভবিষ্যতেও উনি আমার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে ধমকাবেন। আমিও স্বল্প সময়ের জন্য উনার এ ধমক শুনে ভদ্র হয়ে থাকবো। উনি পুনরায় আমাকে জ্বালাতন করবেন। আমিও পুনরায় উনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবো। আর এ ধারা এভাবে অবিরাম চলতেই থাকবে।

প্রোজ্জ্বল ভাই স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” ভয় লাগছে না আমাকে দেখে?”

ভেতরে ভেতরে খানিক ভয় পেলেও এ ব্যাপারটি অস্বীকার করে বললাম,
” উঁহু, ভয় লাগছে না। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই আমার প্রত্যুত্তরে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এ নিঃশ্বাস যেনো হতাশার দীর্ঘশ্বাস। অতঃপর উনি হতাশাব্যাঞ্জক কণ্ঠে বললেন,
” আমার চেহারাটা কি জোকারের মতো?”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন প্রশ্নে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। হাসিও পেলো বটে। ঠোঁট টিপে হাসি থামানোর ছোট্ট প্রয়াস চালালাম। বললাম,
” আপনাকে মোটেও জোকারের মতো দেখায় না। আপনি তো অনেক হ্যান্ডসাম। যেকোনো মেয়ের রাতের ঘুম হারাম করে দিতে আপনার ফর্সা চেহারার গম্ভীর চাহনি, একটুখানি মুচকি হাসিই যথেষ্ট। আপনি কি জানেন, আপনি এলাকার সব মেয়েদের ক্রাশ? আপনি…..”
আমার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই প্রোজ্জ্বল ভাই অকস্মাৎ একটা ধমক দিলেন। সাথে সাথে ঈষৎ মিইশে গেলাম আমি। উনি ক্রোধান্বিত মুখশ্রীতে ভ্রুজোড়া কুঁচকে বললেন,
” চুপ! আমাকে পাম মারা হচ্ছে তাই না?”

আমি তৎক্ষনাৎ জবাব দিলাম,
” মোটেও না। সত্য কথাটি বলছি আপনাকে। আপনি মোটেও জোকারের মতো না। ”

” তাহলে ভয় পাস না কেনো?”

আমার সহজ সরল জবাব,
” কারণ আপনার চেহারায় ভয় পাওয়ার মতো কোনো উপাদান নেই।”

প্রোজ্জ্বল ভাই পুনরায় হতাশাব্যাঞ্জক কণ্ঠে বললেন,
” তো, এখন কি আমি ভয় পাওয়ানোর জন্য চেহারায় দৈত্য এঁকে বেড়াবো না কি?”

” এতো কষ্ট করার দরকার কি? আপনাকে দেখে আমার ভয় পেতে হবেই বা কেনো?”

” কারণ, যেনো তুই আমার সব কথা শুনিস।”

” এ্যাহ, আপনার সব কথা শুনতে যাবো কেনো? সবসময় আমার উপর হুকুম চালাবেন, এটা তো হতে দেওয়া যায় না। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই পুনরায় একটা ধমক দিলেন। আমি পুনরায় চুপ হয়ে গেলাম। উনি কিয়ৎক্ষণ ক্রুদ্ধ চাহনিতে আমার পানে চেয়ে রইলেন। অতঃপর চেয়ারটা কিঞ্চিৎ আমার দিকে এগিয়ে নিয়ে বসলেন। শান্ত সুরে বললেন,
” চন্দ্রিমা? তুই এতো বেয়াদব কেনো? ম্যানারস নেই কেনো তোর মধ্যে? বড়দের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা কি জানিস না?”

আমি কোনোপ্রকার জবাব দিলাম না। গোমড়ামুখে বসে রইলাম। প্রোজ্জ্বল ভাই পুনরায় বললেন,
” তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাই! তুই আমাকে অভ্রর সাথে মিলিয়ে ওসব বানিয়ে দিয়েছিস! ”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথায় দৃষ্টিজোড়া পুরো রুমে এলোমেলোভাবে ঘুরিয়ে থেমে থেমে বললাম ,
” আপনারা দুজন সময় সুযোগ পেলেই যে চুইঙ্গামের মতো চিপকে থাকেন, এই দেখেই আমি ধারণা করেছি। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই পুনরায় হুট করে ধমক দিয়ে বললেন,
” উল্টো হাতে এক চড় দিবো তোকে। ধারণা! মানে তোর জন্য কি বন্ধুর সাথে দেখাসাক্ষাতও করতে পারবো না! এই ভয়ে যে চন্দ্রিমা নামক বজ্জাত একটা মেয়ে দু বন্ধুকে ঐটা বানিয়ে দিয়েছে!”

” দেখা করবেন। নিষেধ কে করেছে? কিন্তু তাই বলে সুযোগ পেলেই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসে পড়বেন কেনো? আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের কথার মাঝে অভ্র ভাইকে স্বেচ্ছায় ডেকে নিয়ে একটি আধটু আড্ডা দিয়ে আমাকে খাবারের উপর পড়ে থাকা মাছির মতো টুস করে ফেলে দিবেন কেনো!”

প্রোজ্জ্বল ভাই দারুণ একটা কৌতুক শুনেছেন এমন ভঙ্গিতে হেসে বললেন,
” পিচ্চি মেয়ের কথার ধার কি! জেলাস ফিল করিস না কি?”

আমি তৎক্ষনাৎ চটে গিয়ে বললাম,
” জেলাস ফিল করবো কেনো? আমার কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই?
আর এখানে জেলাস ফিল করার কিছু নেই। আপনি আপনার বন্ধুর সাথে থাকুন বা যা খুশি তাই করুন। কিন্তু আমাকে ওভাবে অপমান করবেন কেনো? আমাকে দিয়ে কাজ করাবেন কেনো? আপনাদের কি হাত পা নেই? ”

প্রোজ্জ্বল ভাই খানিক হাসলেন। কিয়ৎ সময় সে হাসি বজায় রেখে অতঃপর স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললেন,
” নাহ, তুই কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলি চন্দ্রিমা। কথা বলতে বসেছিলাম আমাকে আর অভ্রকে নিয়ে। কিন্তু তুই কথার মোড় ঘুরিয়ে নিজের দিকে নিয়ে নিলি! কি চালাক হয়ে গিয়েছিস তুই!”

উনার কথায় উপলব্ধি করলাম, সত্যিই আমি কিভাবে কিভাবে যেনো আলোচনার বিষয়বস্তু নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। অবশ্য এতে সুবিধাও হলো বটে।
প্রোজ্জ্বল ভাই পুনরায় বললেন,
” যা, আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আয়। এবারের মতো তোকে মাফ করলাম৷ ”

উনার কথা কর্ণপাত হতেই আমি বিস্ময়ে চোখজোড়া বড় বড় করলাম। ভেবে আশ্চর্যান্বিত হলাম, প্রোজ্জ্বল ভাই এতো অনায়াসে আমাকে ছেড়ে দিলেন! নিশ্চয়ই এর পিছনে বড় কোনো কারণ আছে। এ নিয়ে নিশ্চিত হতে সন্দেহের সুরে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার শরীর ঠিক আছে তো?”

উনি ভ্রুজোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
” হ্যাঁ। আমার শরীরের কি হবে?”

” তাহলে আপনি আমাকে এতো সহজে ছেড়ে দিচ্ছেন কিভাবে? এবার কোনো পানিশমেন্ট নেই? আফটার অল আপনার পুরুষত্বের উপর কোয়েশ্চন মার্ক তুলেছি আমি।”

প্রোজ্জ্বল ভাই ঠোঁটজোড়া কুঞ্চিত করে ঈষৎ রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
” এতো পানিশমেন্ট পাওয়ার শখ! যাহ, সুযোগ বুঝে তোর মনের ইচ্ছা পূরণ করবো। ”

আমি তৎক্ষনাৎ হকচকিয়ে বলে উঠলাম,
” না না। আমি এমনিই বলছিলাম। আমার কোনো পানিশমেন্ট দরকার নেই। ”

” হুমম। আর আমার ম্যানহুডের উপর যে কোয়েশ্চন তুলেছিস তুই, খুব শীঘ্রই তাতে তোকে ভুল প্রমাণিত করে দিবো। ”

আমি ভ্রুজোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিভাবে?”

” বউ এনে।”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের হেন কথায় আমি বিস্মিত হলাম। চোখজোড়া কপালে তুলে বললাম,
” সত্যি! এর মানে আপনি কাউকে পছন্দ করে রেখেছেন? আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? মামিকে বলেননি কেনো? আর আমাকেও না! কবে বলবেন সবাইকে?”

আমার প্রশ্নের ভাড়ে প্রোজ্জ্বল ভাই অধৈর্য্য হয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
” চুপ! চ্যাটারবক্স একটা! আমি কি বলেছি আমার গার্লফ্রেন্ড আছে? সবসময় দশ ডিগ্রি বেশি বুঝা কি তোর কাজ?”

” তাহলে?”

” তাহলে আর কি? আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। তবে বিয়ে তো করবো, তাই না? তখন বুঝে নিস। আচ্ছা, এবার আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আয়। না হলে রুমে গিয়ে চুপচাপ পাঁচটা মডেল টেস্ট করে দে আমাকে। ”

” না না। যাচ্ছি। কফি বানাতেই যাচ্ছি। ”
এই বলেই আমি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুম হতে চলে এলাম। রান্নাঘরে এসে প্রলম্বিত এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

————-

দূর গগনে মেঘপুঞ্জের গর্জন শোনা যাচ্ছে। কৃষ্ণকায় নিশিরাতের অন্তরিক্ষ শ্রাবণের মেঘের আনাগোনায় স্বাভাবিক এর তুলনায় অধিক কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। চারপাশের পরিবেশ জুড়ে শীতল হাওয়ার আনাগোনা। মাটির মৃদু সোঁদা ঘ্রাণে মোঁ মোঁ করছে শীতল হাওয়া।
অকস্মাৎ অঘোষিত বৃষ্টির সূচনা ঘটলো৷ একদম ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বৃষ্টির সে কি মধুর শব্দ! মনপ্রাণ শীতল করা শব্দ। হৃদয়ে উষ্ণ অনুভূতি জাগানো আদ্র এক শব্দ। শ্রাবণের মন উজার করা বৃষ্টির ছোঁয়ায় পরিবেশ পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ মনোমুগ্ধকর হয়ে এলো। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর বৃষ্টির হাতছানিতে মুখরিত হয়ে আছে।
আমি আর প্রত্যাশা আপু তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। দুজনেই নীরবে বৃষ্টি পূর্ববর্তী আবহাওয়া উপভোগ করছিলাম। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বেই শাহাদ ভাইয়ার কল এলো আপুর ফোনে। শাহাদ ভাইয়া আপুর কলিগ এবং বয়ফ্রেন্ড। গত দেড় বছর যাবত আপু আর শাহাদ ভাইয়ার রিলেশন চলছে এবং এ ব্যাপারটি আমি বাদে বাড়ির কারোর জানা নেই। আপু পরিকল্পনা করে রেখেছে, এ বছরের শেষে শাহাদ ভাইয়া প্রমোশন পেলেই আপু শাহাদ ভাইয়ার ব্যাপারে বাড়ির সবাইকে জানাবে। ততদিন আমি ও আপু যেভাবে পারি, এটি লুকিয়ে রাখবো।
এর পূর্বে বহুবার আপু প্রোজ্জ্বল ভাই বা মামির হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো। কখনো সে পরিস্থিতিতে পড়ে আপু মিথ্যে বলেছে, নাহয় কখনো আমি মিথ্যে বলেছি। আপাতত এভাবেই আমরা দুজনে শাহাদ ভাইয়ার কথা সবার নিকট হতে লুকিয়ে রেখেছি।

প্রত্যাশা আপু বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে শাহাদ ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। কখনো হেসে , কখনো মিষ্টি ঝগড়ার মাধ্যমে গত আধঘন্টা যাবত তাদের দুজনের কথা চলছে। দুজনের কথার কারণে চলে যেতে চাইলেও আপু আমাকে বজ্রপাতের দোহাই দিয়ে আটকিয়ে রেখেছে। আপুর এ ফিসফিসিয়ে কথার বলার কারণে খানিক বিরক্ত হয়েই গলার স্বর কিছুটা উঁচিয়ে ওপাশে শাহাদ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,
” এই যে, ওয়ান এন্ড অনলি দুলাভাই, আপনাদের এ রোমান্টিক কথাবার্তা শুনতে কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। আপনি তাড়াতাড়ি এসে আপনার বউকে নিয়ে যান। আপনার বউ গেলে একটু শান্তি পাবো। বুঝলেন?”
এই বলেই আপুকে ছোট্ট করে ভেঙচি কাটলাম। আপুও প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আমার বাহুতে আলতো করে চাপড় দিলেন।

” বাহ চন্দ্রিমা, সবার অগোচরে দুলাভাই বানিয়ে ফেলেছিস!”

আচমকা পেছন হতে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলাম আমি ও আপু। প্রত্যাশা আপু ঘাড় ঘুরিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইকে দেখে তৎক্ষনাৎ শাহাদ ভাইয়ের ফোন কেটে দিলেন। আমি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের উদ্দেশ্যে আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আ-আপনি কখন এলেন প্রোজ্জ্বল ভাই? ”

প্রোজ্জ্বল ভাই আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। উল্টো প্রত্যাশা আপুকে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসলেন,
” এসব কবে থেকে চলছে আপু? ”

প্রত্যাশা আপু বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছে। আপুর মুখশ্রীতে স্পষ্ট ধরা পড়ার ভয়ের দেখা মিলছে। ফলে আপু প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম হলো। প্রোজ্জ্বল ভাই মুহূর্তেই অধৈর্য্য হয়ে ক্রুব্ধ গলায় আপুকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
” এতো বড় একটা কথা তুই আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করলি না আপু!”

আপু তৎক্ষনাৎ চকিত গলায় বললো,
” আমার রিলেশনের কথা ছোট ভাই জানবে, এটা চায়নি আমি।”

” আচ্ছা? তাহলে চন্দ্রিমা জানতে পারবে?”

” ও বোন বলে ওর সাথে শেয়ার করেছি। আর রিলেশনের ব্যাপারটা তোর সাথে শেয়ার করতে খুব অকওয়ার্ড ফিল করছিলাম। এজন্যই বলিনি তোকে। ”
এই বলে প্রত্যাশা আপু অসহায় চাহনি বানিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে চাইলেন। আর এতেই যেনো উনি মুহূর্তেই বরফের ন্যায় গলে পানি হয়ে গেলেন। প্রোজ্জ্বল ভাই প্রত্যাশা আপুকে খুব ভালোবাসেন৷ ভাই হিসেবে আপুর সব দায়িত্ব উনি যথাযথভাবে পালন করেন। মাঝেমধ্যে উনার এ ভালোবাসা আপুর কাছে ‘ওভার প্রটেক্টিভ বা ওভার পজেসিভ’ বলে বিবেচিত হয়। যদিও প্রোজ্জ্বল ভাই এসবের মোটেও তোয়াক্কা করেন না। আপুর প্রতি উনার দায়িত্বগুলি উনি সঠিকভাবে পালন করে যান।

প্রোজ্জ্বল ভাই কিছু বলতে যাবেন কিন্তু এর পূর্বেই প্রত্যাশা আপু অভিযোগের সুরে বললেন,
” তোরা তো আমাকে বিয়েশাদি আদৌ দিবি বলে মনে হয় না। এজন্য আমি নিজ পছন্দে ছেলে ঠিক করেছি। আর এটা ফুল এন্ড ফাইনাল যে আমি বিয়ে করলে শাহাদকেই বিয়ে করবো। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই ভাবুক কণ্ঠে বললেন,
” ওওও, তাহলে ছেলেটার নাম শাহাদ। তো করে কি ছেলে?”

” আমার কলিগ। বলতে গেলে সিনিয়র।”

” তাহলে তো ভালোই হলো। একই সাথে জব করিস। তো এ ব্যাপারে আমাদের জানাসনি কেনো?”

” আমি চাইছিলাম, এ বছরের শেষে শাহাদের প্রমোশন হয়ে গেলে তবেই সবাইকে বলবো। ”

” আচ্ছা, আগামী এক মাসের মধ্যে বিয়ে হলে কি উনার কোনো সমস্যা হবে?’

” হওয়ার তো কথা না। কিন্তু….. ”
প্রত্যাশা আপু সাধারণভাবে কথা বলতে বলতে অকস্মাৎ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পেরে চকিতে জিজ্ঞেস করলেন,
“এর মানে কি! তুই বাবা মা’র সাথে কথা বলবি!”

প্রোজ্জ্বল ভাই মুচকি হেসে বললেন,
” অবশ্যই। বাবা, মা আর দাদিকে বলবো। তোর হবু বরকে আমাদের বাসায় ডাকবো। দেখাসাক্ষাৎ করবো,কথা বলবো। তারপর খোঁজখবর নিয়ে সব ভালো হলে তোর বিয়ে ঠিক করবো৷ ”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন কথায় আমি আর প্রত্যাশা আপু মুহূর্তেই খুশিতে ফেটে পড়লাম যেনো৷ মাত্রাতিরিক্ত আবেগ ও আনন্দে আপু প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের গাল টেনে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
” তুই এত্তো ভালো কেনো প্রোজ্জ্বল! একেবারে টেডিবিয়ার একটা!”

প্রত্যাশা আপুর নিকট হতে ‘টেডিবিয়ার’ সম্বোধন শুনে চটে গেলেন প্রোজ্জ্বল ভাই। ঝামটি মেরে বললেন,
” তোকে কতবার বলেছি, এই টেডিবিয়ার নামে আমাকে ডাকবি না। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ”

প্রত্যাশা আপু প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের নিষেধাজ্ঞা মানলেন না। বরং পূর্বের তুলনায় আরোও আদুরে কণ্ঠে বললেন,
” ওরে ওরে আমার গ্রাম্পি টেডিবিয়ার দেখি রাগ করেছে! আমার কিউট…..”
প্রত্যাশা আপুকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাই ক্রুদ্ধ মেজাজ নিয়ে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই আমি ও প্রত্যাশা আপু এ নিয়ে হাসাহাসি করলাম কিছুক্ষণ।

প্রত্যাশা আপু প্রোজ্জ্বল ভাইকে ছোট থেকে টেডিবিয়ার বলে ডাকে। শুনেছি, ক্লাস ফাইভ পর্যন্তও প্রোজ্জ্বল ভাই টেডিবিয়ার নিয়ে ঘুমাতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন। ক্ষেত্র বিশেষে খেলাধুলাও করতেন। মূলত এ কারণেই প্রত্যাশা আপু উনাকে এ নাম দিয়েছে। আবার প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের গম্ভীর ও হুটহাট মেজাজ চটে যাওয়ার কারণে টেডিবিয়ার নামের সাথে ‘গ্রাম্পি’ শব্দটাও যোগ করেছে আপু। যখন প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কোনো কাজ আপু খুব পছন্দ করে তখন আপু উনাকে ‘টেডিবিয়ার’ বলে সম্বোধন করে। আর বড় হয়ে যাওয়ার পরও বড় বোনের নিকট এমন সম্বোধন শুনে প্রোজ্জ্বল ভাই যখন চটে যান তখনই আপু উনাকে ‘গ্রাম্পি টেডিবিয়ার’ বলে সম্বোধন করে৷ ব্যস, এরপর উনার তিরিক্ষি মেজাজের চাহনি দেখে কে!

—————

সেদিনের ঐ ঘটনার পর প্রোজ্জ্বল ভাই ঐ রাতেই সবার সাথে প্রত্যাশা আপু আর শাহাদ ভাইয়াকে নিয়ে কথা বলেন। মামি শুরুতে একটু রাগ দেখালেও পরে ঠিকই রাজি হয়ে যান। আর মামা ও নানু শাহাদ ভাইয়ার সম্পর্কে শুনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান। এরপর পরের দিন সকালে মামা শাহাদ ভাইয়ার বাবা মার সাথে কথা বলে শুক্রবার দেখা করার বিষয়টি ঠিক করেন।

আজ সেই সপ্তাহ ঘুরে শুক্রবার এলো। শাহাদ ভাইয়া ও তার বাবা মা আসবে বলে বাড়িতে খাবারদাবার ও টুকটাক সাজসজ্জার কোনো কমতি রইলো না। এক্ষেত্রে আপুকেও সুন্দর দেখানোর কোনো কমতি রাখলাম না আমি ও অনামিকা। প্রত্যাশা আপুকে দেখতে আসবে বলে অনামিকা সকাল থেকেই আমাদের সাথে আছে। এজন্য সকালেই আমি আর ও দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছি। সে অনুযায়ী অনামিকার কাঁধে পড়েছে শাড়ী পরানোর দায়িত্ব আর আমার কাঁধে পড়েছে মেকআপ করানোর দায়িত্ব।

আপুকে সাজিয়ে দেয়ার মাঝেই শাহাদ ভাইয়া উনার পরিবার নিয়ে হাজির হলেন। তাদের সাদরে আমন্ত্রণ করলেন মামা ও প্রোজ্জ্বল ভাই। ড্রইংরুমে তাদের বসিয়ে নাস্তা পানি দিয়ে মামা, মামি, নানু ও প্রোজ্জ্বল ভাই কথাবার্তা চালাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে ড্রইংরুমে হাজির হলো আপু। আসমানী রঙের শাড়ীতে হালকা সাজে আপুকে দারুণ মানিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, শাহাদ ভাইয়ার দৃষ্টি আজ আপুর থেকে হটবেই না। আমি আর অনামিকা পর্দার আড়াল হতে লুকিয়ে লুকিয়ে এটিই দেখছিলাম।

বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর শাহাদ ভাইয়ার মা আপু ও শাহাদ ভাইয়াকে একা কথা বলার জন্য অন্য রুমে পাঠাতে বলছিলেন। কিন্তু উনার এ প্রস্তাব পরোক্ষভাবে নাকচ করলেন প্রোজ্জ্বল ভাই। উল্টো প্রত্যাশা আপুর বদলে উনিই শাহাদ ভাইয়ার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলেন। উনার এহেন প্রস্তাবে আমি ও অনামিকাসহ ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলে হকচকিয়ে উঠলাম। উনার এ উদ্ভট প্রস্তাবে শাহাদ ভাইয়া ও আপুর মুখটা মুহূর্তেই শুকিয়ে এলো। আমি নিশ্চিত আপু অনুমান করতে পেরেছে, প্রোজ্জ্বল ভাই শাহাদ ভাইয়াকে একা ডেকে একটু টাইট দিবেন। এটি আমারও অজানা নয়৷
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের উদ্ভট প্রস্তাবটি খানিক কটু দেখালেও সবাই এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। অতঃপর সকলের অনুমতি পেয়ে প্রোজ্জ্বল ভাই ও শাহাদ ভাইয়া ছাদে চলে এলেন। নিরাপত্তার খাতিরে আপু চোখের ইশারায় আমাকে ও অনামিকাকে গুপ্তচর হিসেবে ছাদে পাঠালেন৷ এ মুহূর্তে আমাদের কাজ প্রোজ্জ্বল ভাই ও শাহাদ ভাইয়ার কথোপকথন মনোযোগ সহকারে শোনা এবং হাতে গড়া সম্পর্কটা যেনো বিগড়ে না যা সেদিকে কড়া দৃষ্টিপাত করা।

মধ্যে দুপুরের কড়কড়া রোদে আমি ও অনামিকা ছাদের দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছি। কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে গা সিদ্ধ করা গরমে দরদর করে শরীর বেয়ে ঘাম ঝড়ছে আমাদের৷ কিন্তু আপুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গরম গরম অনুভূতিটা পাশ কাটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবে থাকার পর প্রোজ্জ্বল ভাই আচমকা শাহাদ ভাইয়াকে প্রশ্ন করলেন,
” এ পর্যন্ত কয়টা মেয়েকে ডেট করেছেন?”

” জি!” হকচকিত গলায় বললেন শাহাদ ভাই। #বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_৭
#লেখিকা:সারা মেহেক

শাহাদ ভাইয়াকে করা এহেন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম আমি ও অনামিকাও। পাত্রী দেখতে এসে পাত্র নিজেই এমন উদ্ভট প্রশ্নের শিকার হবে তা ভাবনার বাইরে ছিলো আমার। কিন্তু সেই অভাবনীয় কাজটি খুবই দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছেন প্রোজ্জ্বল ভাই।

ওদিকে শাহাদ ভাইয়া প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি এখনো। উনার এ নীরবতা প্রোজ্জ্বল ভাইকে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতে বাধ্য করলো। তবে এবার পূর্বের তুলনায় ঈষৎ কাঠিন্যের সহিত প্রোজ্জ্বল ভাই বললেন,
” কি ব্যাপার মিস্টার শাহাদ? আমার প্রশ্নের অর্থ বুঝেননি নাকি প্রশ্নের জবাব আপনার কাছে নেই?”

শাহাদ ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বললেন,
” না না, মোটেও তেমন না৷ আসলে হয়েছে কি, আজ পর্যন্ত প্রত্যাশাও আমাকে এমন প্রশ্ন করেনি। কিন্তু তুমি….কিছু মনে করো না ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করায়। তুমি আমার ছোট বলেই বলছি। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই হালকা কেশে নিলেন। উনার স্বাভাবিক কণ্ঠের চেয়ে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর এবং একরোখা গলায় বললেন,
” আমার আপু বেশ সহজ সরল প্রকৃতির মেয়ে। বয়সটা ভালোই হয়েছে৷ কিন্তু বাইরের মানুষকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝার বয়সটা এখনও হয়নি এটা ভালো করেই জানি আমি। এজন্য এমনও হতে পারে যে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সে আপনার অতিত এবং চরিত্র সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছে!”
এই বলেই প্রোজ্জ্বল ভাই কিছুটা নরম হলেন। বললেন,
” আমি এমনটা বলেনি যে আপনার চরিত্র খারাপ। তবে আমার একমাত্র বড় বোনের সারাজীবনের প্রশ্ন এরা একজন ভাই হিসেবে অবশ্যই আমার দায়িত্ব কর্তব্য আছে। তার মধ্যে এই দায়িত্বটাও পড়ে, যে ছেলের সাথে আপুর বিয়ে হবে তার সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান নিয়ে তবেই তার হাত আপুকে তুলে দেওয়া। ”

শাহাদ ভাইয়া হয়তো পূর্বের তুলনায় খানিক স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। উনি ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে বললেন,
” হ্যাঁ অবশ্যই৷ তোমার অধিকার আছে তোমার আপুর জন্য পারফেক্ট লাইফ পার্টনার খুঁজে বের করা এবং সঠিক চরিত্রের মানুষের কাছে ওকে তুলে দেওয়া।”

” তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বলে বুঝতে পেরেছেন আপনাকে করা প্রশ্নটা মোটেও অযৌক্তিক না?”

” হ্যাঁ অবশ্যই। তুমি চাইলে আমাকে প্রশ্ন করতে পারো। যা জানার জানতে পারো। আমি আগের চেয়ে একটু কমফোর্টেবল ফিল করছি। ”

” আচ্ছা, তো যে প্রশ্নটা আপনাকে করেছিলাম ওটার জবাব জানতে চাই।”

” এখন পর্যন্ত তোমার আপুকেই ডেট করেছি আমি৷ প্রত্যাশার আগে কোনো মেয়েকে ডেট করা হয়নি আমার। তবে হ্যাঁ, কলেজ লাইফে থাকতে একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু আমার ভাগ্যে সেই মেয়েটা ছিলো না বলে কিছু হওয়ার আগেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে সব। ”
এই বলে শাহাদ ভাইয়া খানিক হাসার চেষ্টা করলেন। হাসলেন প্রোজ্জ্বল ভাইও।
প্রোজ্জ্বল ভাই পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
” ম’দ, সিগারেটের অভ্যাস নেই তো আবার?”

” উমম, ম’দ খাইনি কখনো। তবে অল্পস্বল্প সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। যদিও খুব বেশি প্রেশার আর টেনশনে থাকলে সিগারেট খাওয়া হয়। এর বাইরে খাওয়া হয় না। ”

” অফিস আওয়ারের বাইরেও এক্সট্রা কোনো কাজ করেন?”

” না। নাইন টু ফাইভ অফিস। এই তো। তারপর সন্ধ্যায় একটু আড্ডা দেওয়া হয়। তারপর তো বাসাতেই।”

” ওহ। শুনে ভালো লাগলো। ছেলে হিসেবে মনে হলো, আপনার রুটিন মোটামুটি ভালোই আছে। আপুকে যথেষ্ট সময় দিতে পারবেন।” প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে মনে হলো উনি শাহাদ ভাইয়ার জবাবগুলোয় বেশ ইমপ্রেস হয়েছেন। দুজনের এ কথোপকথনে আমি ও অনামিকাও স্বস্তি পেলাম। অনেকটা নিশ্চিতই হলাম, প্রত্যাশা আপু ও শাহাদ ভাইয়ার বিয়েটা বোধহয় এবার হলো বলে।

প্রোজ্জ্বল ভাই ও শাহাদ ভাইয়ার নিচে নামার কথা
শুনে তড়িঘড়ি করে আমি ও অনামিকাও নিচে নেমে এলাম। দ্রুত লুকিয়ে পড়লাম আমাদের পূর্বের স্থানে। প্রোজ্জ্বল ভাই ও শাহাদ ভাইয়া সোফায় বসতেই উপস্থিত সকলের উদ্বিগ্ন চাহনি উনাদের দুজনের উপর স্থাপিত হলো। আপু চোখের ইশারায় শাহাদ ভাইয়াকে বোধহয় জিজ্ঞেস করলো, সব ঠিক আছে কি না৷ শাহাদ ভাইয়া ইশারায় বুঝালেন সব ঠিক আছে। আপু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

তখনই ড্রইং রুমেই বসে প্রত্যাশা আপু ও শাহাদ ভাইয়ার বিয়ের সিদ্ধান্ত হলো। কারণ দুপক্ষেরই ছেলে-মেয়ে পছন্দ হয়েছে। শাহাদ ভাইয়ার মা আপুকে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন তারিখ পাকা করলেন। সিদ্ধান্ত হলো, আমার ভর্তি পরীক্ষার পনেরো দিন পর অর্থাৎ আজ হতে এক মাস পর প্রত্যাশা আপু ও শাহাদ ভাইয়ার বিয়ে হবে। আপুর বিয়ের খবর শুনতেই আমি ও অনামিকা আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজেদের মতো আনন্দ করলাম। স্বাভাবিকের ন্যায় তখনই সেখানে দাঁড়িয়ে বিয়ে নিয়ে দুজনে টুকটাক পরিকল্পনাও করে ফেললাম। ঐ যে একটা কথা আছে না, ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই।’ এ মুহূর্তে আমার ও অনামিকার অবস্থা হয়েছে তেমনই। অবশ্য হবেই না বা কেনো, একমাত্র আপু বলে কথা!

.

শাহাদ ভাইয়ারা চলে যাওয়ার পর ছাদে প্রোজ্জ্বল ভাই ও শাহাদ ভাইয়ার মাঝে যা যা কথা হয়েছে, তা গুনে গুনে প্রত্যাশা আপুকে বললাম আমি। আমার নিকট হতে সব কথা শোনার পর প্রত্যাশা আপু প্রোজ্জ্বল ভাইকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার জন্য আচ্ছামতো জেরা করলেন৷ এ নিয়ে দুজনের মাঝে টুকটাক কথা কাটাকাটিও হলো। পরে অবশ্য এর ফল ভোগ করতে হলো আমাকে। প্রত্যাশা আপু প্রোজ্জ্বল ভাইকে কথা শোনালেন, আর প্রোজ্জ্বল ভাই কথা শোনালেন আমাকে। এখানে অবশ্য দোষটা আমার ছিলো না। তখন আমাকে ছাদে যেতে বলেছিলো স্বয়ং প্রত্যাশা আপু। অথচ প্রত্যাশা আপুর বদলে কথা শুনলাম আমি! এ ভারী অন্যায় সহ্য করেও চুপচাপ পড়তে বসলাম আমি। কারণ এখন প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে তর্কে জড়ানো অর্থ নিজের বিপদ নিজ হাতে আমন্ত্রণ করা!

———–

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার আর এক সপ্তাহ বাকি। এ এক সপ্তাহ আমার উপর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কড়া নজরদারি চলার হুকুম দিয়েছেন স্বয়ং মামি। অবশ্য মামি না আদেশ দিলেও প্রোজ্জ্বল ভাই ঠিকই আমাকে নজরদারিতে রাখতেন।
মামির হুকুম, এই এক সপ্তাহ কোনোরকম ফোন চালানো যাবে না। গল্পগুজব, আড্ডায় সময় অপচয় করা যাবে না৷ আর সবচেয়ে বড় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন উনি বৃষ্টিতে ভিজা নিয়ে। বৃষ্টি হলেই ছুটে যাওয়া দস্যি এক মেয়েকে এ ঘোর শ্রাবণে পরীক্ষার দোহাই দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখছেন উনি। মাঝে মাঝে এ নিয়ে ভাবলেই বিস্ময়ে মুখটা হা হয়ে আসে আমার। বৃষ্টির পূর্ববর্তী আবহাওয়া উপভোগ করা, বৃষ্টিতে ভেজা, বৃষ্টির পানি নিয়ে কাল্পনিক, বাস্তবিক নানান কিছু ভাবা আমার শখের কাজের মধ্যে একটি। মন চাইলে বৃষ্টিতে ভেজা হতে কেউই আমাকে আটকিয়ে রাখতে পারে না, কেউ আটকায়ও না আমাকে। কিন্তু মামা মামির একান্ত বাধ্যগত হওয়ায় উনাদের কথা সবসময় মেনে চলার চেষ্টা করি আমি। এ কারণে মামির আদেশ পালন করার চেষ্টা করে লোভনীয় মুহূর্তেও বৃষ্টিতে ভেজা হতে বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে চলছি।

কিছুক্ষণ পূর্বেই প্রকৃতিকে সতেজ সবুজ সাজে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে শ্রাবণের বৃষ্টি। চারপাশে শীতল বহমান হাওয়া বিরাজমান। অদূরে থেকে থেকে গর্জে উঠছে ক্রুদ্ধ মেঘপুঞ্জ। পড়ার ফাঁকে এ নমনীয় পরিবেশ উপভোগ করতে করতে অনামিকার ডাক এলো আমার উদ্দেশ্যে। নিচ হতে হাঁক ছেড়ে ডাকলো সে। ওর ডাকে দ্রুত বারান্দায় যেতে ও ইশারায় আমাকে ওদের বাসায় যেতে বললো। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে ও বললো জরুরি ভিত্তিতে প্রাণিবিজ্ঞানের চতুর্থ অধ্যায় বুঝাতে হবে ওকে। আমি কয়েকবার ওর প্রস্তাব নাকচ করলেও ও তা মেনে নিলো না। অগত্যা অনামিকার কথায় আমাকে ওদের বাড়িতে যেতে হলো। তবে যাওয়ার পূর্বে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুমে একবার উঁকি দিয়ে গেলাম। দেখলাম বৃষ্টিমুখর এই বিকেলে কাঁথা টেনে আরামে ঘুমাচ্ছেন উনি। এমন ঘুমু ঘুমু পরিবেশে উনার আরামের ঘুম দেখে ভীষণ হিংসে হলো আমার। যদিও এতে আমার সুবিধাই হলো।
বাড়ির সকলের অগোচরে লুকিয়ে বেড়িয়ে আসলাম আমি৷ অনামিকার সাথে ওদের বাড়িতে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ওকে পড়াগুলো বুঝিয়ে দিলাম। অতঃপর অনামিকাকে পড়া বুঝানো শেষে বাড়ি হতে বের হতে গেলে খোদেজা মামি আমার জন্য গরম গরম তেল পিঠা বানিয়ে আমার সামনে এনে হাজির করলেন। বিপদাপন্ন এ মুহূর্তে পিঠা খাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করলেও আন্টি আমার একটি কথাও শুনলেন না। অগত্যা গরম গরম তেল পিঠা খেতে বসতে হলো আমাকে।

চা ও পিঠা খেয়ে অনামিকার রুম হতে বের হলাম। চারপাশ তখন সদ্য সাঁঝের আলিঙ্গনে আবদ্ধ। বৃষ্টি পরবর্তী সাঁঝের আকাশ ঘোর কালো রঙ ধারণ করেছে। তবে এর ফাঁকে ফাঁকে এক চিলতে রোদের ন্যায় উঁকি দিচ্ছে শেষ বিকেলের গাঢ় কমলা রঙ।
অনামিকার রুম হতে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম৷ এক নজর আকাশের দিকে তাকিয়ে বাড়ি হতে উঠোনে পা রাখতে গেলেই অভ্র ভাই পিছন হতে ডাকালেন। উনার ডাকে চমকে ঘাড় ঘুরে পিছনে তাকালাম। এ সময়ে অভ্র ভাইকে এখানে আশা করিনি আমি। ফলস্বরূপ কিয়ৎ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি এ সময়ে!”

অভ্র ভাই মুচকি হাসলেন। বিনা বাক্যে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। অতঃপর বললেন,
” আজ নাইট ডিউটি নেই তাই তাড়াতাড়িই বাড়িতে চলে এসেছি। ”

” ওহ আচ্ছা। ”

” তোমার না এক সপ্তাহ বাদে পরীক্ষা? ”

” হ্যাঁ অভ্র ভাই। আগামী শুক্রবারেই পরীক্ষা। ”

” তাহলে অনামিকাকে পড়াতে এসেছো যে?”

” ওর প্রাণিবিজ্ঞানের একটা চ্যাপ্টার বুঝতে সমস্যা হচ্ছিলো বলে ওকে বুঝাতে এসেছিলাম। ”

” আচ্ছা। এসেছোই যখন, তখন আমার সাথে এক কাপ চা খেয়ে যাও। ”

অভ্র ভাইয়ের এহেন প্রস্তাবে আমি তৎক্ষনাৎ মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে বললাম,
” না অভ্র ভাই। আমি চা খেয়েছি। আন্টি দিয়েছিলো।”

” তো কি হয়েছে। আরো এক কাপ খাও আমার সাথে। অনেকদিন তোমার সাথে চা খাওয়া হয় না।”

” আরেকদিন খাবো অভ্র ভাই। এখন আমাকে বাড়িতে না দেখলে প্রোজ্জ্বল ভাই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলবেন।”

আমার কথায় পাত্তা দিলেন না অভ্র ভাই। উল্টো হেসে মাছি তাড়ানোর মতো হাত উড়িয়ে বললেন,
” ঐ রাগচনণ্ডীর কথা বাদ দাও৷ ওর তো কাজই ওটা। আমি ওকে সামলে নিবো। তুমি আমার সাথে চা খাবে কি না বলো। ”

আমি পড়লাম তীব্র এক দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে। একদিকে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের ক্রোধের বর্ষণে পড়ার ভয়, অপরদিকে অভ্র ভাইয়ের আকুতিজনক চা খাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করার অনুশোচনামূলক অনুভূতি।
অভ্র ভাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আচ্ছা চন্দ্রিমা, আগে বলো, দশ মিনিটে তোমার পড়ালেখার কি কোনো ক্ষতি হবে? ক্ষতি না হলে চা খাবো। আর হলে তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবো। ”
এই বলে অভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। অভ্র ভাইয়ের এ হাসি দেখে কয়েক সেকেন্ড ভেবে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, উনার সাথে সন্ধ্যার চা খেয়ে যাই। উনি যখন এতো করেই বলছেন, তখন দশ মিনিট সময় অপচয়ে কি আসে যায়। যদিও এতে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের ভয় আছে। তবে আমার জানা আছে, উনার রাগকে একমাত্র অভ্র ভাইই সামলাতে পারবেন সে মুহূর্তে। এজন্য এখন অভ্র ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।

অভ্র ভাই দু কাপ চা নিয়ে আমাকেসহ বাড়ির পেছনটায় গোল চত্বরের মতো বসার জায়গায় এলেন। এক কাপ চা আমার হাতে দিয়ে সিমেন্টের তৈরী মোজাইকের কাজ করা বেঞ্চিতে বসলেন। ইশারায় আমাকেও বসতে বললেন। চায়ের কাপ নিয়ে আমি বসলে অভ্র ভাই বললেন,
” রিল্যাক্স মুডে চা খাও। এতো টেনশন নিয়ে চা খাওয়া যায় না। আর প্রোজ্জ্বলকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে! ”

আমি চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বললাম,
” প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের ভয় যেনতেন,এখন মামির ভয় লাগছে বেশি। ”

আমার কথায় শব্দ করে হাসলেন উনি। বললেন,
” তোমার ক্যারেক্টারটা ভীষণ গড়বড়ে একটা ক্যারেক্টার চন্দ্রিমা। কখনো প্রোজ্জ্বলকে দেখে ভীষণ ভয় পাও। আবার কখনো ওকে দেখে পাত্তাই দেও না!”

অভ্র ভাইয়ের এ কথা বলার ধরণে সশব্দে হেসে উঠলাম আমি। বললাম,
” আমি নিজেও জানি, আমি গড়বড়ে একটা ক্যারেক্টার। আমি নিজেও মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না নিজেকে। ”
এই বলে আমিসহ অভ্র ভাইও হেসে উঠলেন। এভাবে কথা বলতে বলতে আমাদের কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” তো অভ্র ভাই, ভাবি কবে আনছেন?”

অভ্র ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। আমার এ প্রশ্নে আচমকা বিষম খেলেন উনি। তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
” এখনো ওসব নিয়ে চিন্তা করিনি।”

” কেনো? আমাদের ভাবি কি নেই? মানে, আপনার পছন্দের কোনো মেয়ে আছে? ”

আমার প্রশ্নে অভ্র ভাই মুচকি হাসলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে সাবলীল গলায় বললেন,
” হ্যাঁ আছে তো। ”
উনার এহেন কথা কর্ণপাত হতেই আমার চোখজোড়া বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে এলো। বিস্ময়াভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কে সেই মেয়ে! ”

অভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। আমার দিকে এক নজর চেয়ে মেঘে ঢাকা অর্ধ চন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন,………
®সারা মেহেক(কারা কারা গল্প পড়ছেন মন্তব্য করে যাবেন প্লিজ। আপনাদের কি গল্প ভালো লাগছে আদৌ? আপনাদের যে ভালো লাগা, খারাপ লাগা নিয়ে কোনো রেসপন্সই নেই! তাহলে কি ভাববো, গল্পটা ভালো হচ্ছে না? গল্পটা কয়েক পর্বেই শেষ করে দেওয়ার দরকার?)

#চলবে
(/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here