#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১২
#লেখিকা:সারা মেহেক
সামনে প্রত্যাশা আপুকে নিয়ে ছাদের দিকে উঠছেন প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাই। তাদের পিছনে আমি, অনামিকা, আপুর কিশোরী বয়সের দুটো মামাতো বোন ও আপুর বান্ধবীরা। আমাদের প্রত্যেকের হাতেই হলুদের জন্য কিছু না কিছু আছেই।
প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাই আপুকে নিয়ে স্টেজে বসালে আমরা বাকি মেয়েরা হাতের জিনিসগুলো নিয়ে আপুর সামনের টেবিলে রাখলাম৷ অতঃপর ক্যামেরাম্যানের নির্দেশনানুযায়ী আমরা কাজিনরা, আপুর বান্ধবীরা ও আশেপাশে যে ছোট বাচ্চারা খেলছিলো তারা হলুদের স্টেজের চারিদিকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম আপুর একদম পিছনে। আমার এক পাশে দাঁড়ালেন প্রোজ্জ্বল ভাই ও অপর পাশে দাঁড়ালেন অভ্র ভাই। এভাবেই কয়েকটি ছবি তোলার পর সবার একটি একটি করে সিঙ্গেল ছবি তোলা হলে হলুদের কার্যক্রম শুরু হয়।
আপুকে প্রথমে হলুদ লাগালো নানু। দু গালে আলতো করে হলুদ ছুঁইয়ে এক চামচ ক্ষীর খাইয়ে দিলো নানু। অতঃপর একে একে মামা, মামি, আপুর নানুবাড়ির মুরুব্বিরা আপুকে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে ক্ষীর খাইয়ে দিলো। এরপর পালা আসলো কাজিনদের। প্রথমত আপুকে হলুদ ছুঁইয়ে দিলেন। প্রোজ্জ্বল ভাই। তবে অন্যান্য সবার মতো স্বাভাবিকভাবে কাজটা করেননি উনি। বরং আপুর দু গালে, কপালে, থুতনিতে, দু হাতে ইচ্ছেমতো হলুদ লাগিয়ে দিলেন উনি। উনার এ কাজে উপস্থিত সকলের মাঝে অট্টহাসির রোল পড়ে গেলো। প্রোজ্জ্বল ভাই ক্ষীর খাইয়ে উঠে গেলে যথারীতি অভ্র এসে নিয়ম পালন করলেন। অতঃপর আমি গিয়ে আপুর পাশে বসলাম। আপুকে হলুদ লাগিয়ে, ক্ষীর খাইয়ে উঠে এলাম। অমনিই সেখানে উপস্থিত হলেন শারমিন আপু। শারমিন আপুর হাসিমাথা চেহারা দেখে আমার ঠোঁটে ঠিকই হাসি ফুটে উঠলো। তবে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের চেহারা হতে উদ্বায়ী বস্তুর ন্যায় হাসি উবে গেলো। আপুর ভাষ্যমতে প্রোজ্জ্বল ভাইকে ঠিক যেনো এখন গ্রাম্পি টেডিবিয়ার এর মতো দেখাচ্ছে। তড়িৎ-গতিতে পরিবর্তন হওয়া উনার মুখভঙ্গি দেখে হাসতে না চাইলেও আপনাআপনি আমার হাসি চলে এলো। ফলস্বরূপ ফিক করে হেসে ফেললাম। আমার পাশেই অভ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আর আমাদের দুজন হতে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রোজ্জ্বল ভাই।
অভ্র ভাই আমার হাসির শব্দ শুনে জিজ্ঞেস করলেন,
” হঠাৎ এভাবে হাসলে কেনো চন্দ্রিমা?”
আমি ঠোঁট চেপে নিজের হাসি আটকিয়ে অভ্র ভাইকে বললাম,
” প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের বেটার হাফ এসেছে অভ্র ভাই।”
এই বলে আমি চোখের ইশারায় আগত শারমিন আপুকে দেখালাম। শারমিন আপুকে দেখামাত্র অভ্র ভাইও আমার মতো হেসে ফেললেন। তবে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের চেহারা হতে সেই যে হাসি হাসি ভাবটা চলে গেলো, এখনও অব্দি তা ফিরে এলো না। আর এ হাসি ততক্ষণ ফিরবে না যতক্ষণ শারমিন আপু উনার আশেপাশে থাকবেন।
শুনেছি, ছোট থেকেই প্রোজ্জ্বল ভাই শারমিন আপুকে পছন্দ করতো না। কারণ দুজনে একই সাথে পড়ালেখা করতো। ফলস্বরূপ দুজনের মধ্যে সবসময় প্রতিযোগিতা লেগেই থাকতো। শারমিন আপু যখন প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের থেকে পরীক্ষায় নম্বর বেশি পেতো, তখন মামি প্রোজ্জ্বল ভাইকে অনেক কথা শোনাতো। এ কারণে প্রোজ্জ্বল ভাই শারমিন আপুকে আরোও সহ্য করতে পারেন না। যদিও শারমিন আপু কখনো প্রোজ্জ্বল ভাইকে নিজের প্রতিযোগী ভাবেননি৷ বরং চেষ্টা করেছে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে মিশে থাকার৷ কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাই কখনো সে চেষ্টাকে প্রশ্রয় দেননি।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুজনের এ প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভাবটা ধীরেধীরে চলে যায়। তবে প্রায় বছর তিনেক পূর্বে যখন মামি ছলেবলে নানা কৌশলে প্রোজ্জ্বল ভাইকে জিজ্ঞেস করেন, শারমিন আপুকে উনি পছন্দ করেন কি না। তখনই প্রোজ্জ্বল ভাই বুঝে যান মামির মনে কি চলছে। ব্যস তখন থেকে প্রোজ্জ্বল ভাই শারমিন আপুর প্রতি পুরোনো সেই মনোভাব নিয়ে আসেন। যদিও শারমিন আপু এসব সম্পর্কে অবগত নন। কারণ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে উনার দেখা হলেই প্রোজ্জ্বল ভাই স্বাভাবিক আচরণ করার ভান করেন। যদিও এর পিছনের রহস্যটাআমি, প্রত্যাশা আপু, অভ্র ভাই ঠিকই জানি।
মামি অনেক আগে থেকেই চান যে, একমাত্র বোনের মেয়েকে নিজের ছেলের বউ করে বাড়িতে আনবেন। যদিও উনি বিষয়টি ঠিক ওভাবে খোলাসা করেননি। কিন্তু উনার আচার আচরণে ঠিকই বুঝা যায়, উনি শারমিন আপুকে এ বাড়ির বউ করতে চান। এ বিষয়টি জানার পর হতে আমরা সুযোগ পেলেই প্রোজ্জ্বল ভাইকে জ্বালাতাম এবং ইচ্ছে আছে, আজকেও উনাকে আচ্ছামত জ্বালাবো।
শারমিন আপু এসে প্রত্যাশা আপুকে হলুদ লাগালো, ক্ষীর খাওয়ালো। অতঃপর দুজনে নিজেদের হালচাল জিজ্ঞেস করলো। শারমিন আপু দেখতে ভীষণ সুন্দর। একদম প্রত্যাশা আপুর মতোই। ফর্সা, মায়াবী। মাঝে মাঝে ভাবি, মামিদের জিনে বোধহয় সুন্দর, ফর্সা, নজরকাড়া হওয়ার কোনো জিন আছে। তা না হলে, মামি, মামির বোন, মামির দুই ভাই, প্রোজ্জ্বল ভাই, প্রত্যাশা আপু, শারমিন আপু, সকলে এতো সুন্দর হতে পারে কি করে! শারমিন আপুর গায়ে ডিপ পার্পেল রঙের শাড়িটা ভীষণ মানাচ্ছে। তার উপর খোঁপায় গোলাপি রঙের জবা, সব মিলিয়ে সাজটা দারুণ মানিয়েছে উনাকে।
শারমিন আপু আমাকে দেখে হাসিমুখে হাত নাড়ালেন। প্রত্যুত্তরে আমিও হাত নাড়ালাম। অতঃপর চট করে পাশে ফিরে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিজের গ্রাম্পি চেহারায় প্রতিক্রিয়া দেখানোর বদলো আমাকে পুরোপুরি হতাশ করে উনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছেন। তাও আবার আমাদের হাতের নাগাল হতে দূরে। উনার এ কাজে বড্ড হতাশ হলাম আমি। উনাকে খেপানোর জন্য তাই অভ্র ভাইকে বললাম, উনাকে যেনো ছলেবলে এখানে নিয়ে আসে। অভ্র ভাইও আমার কথামতো প্রোজ্জ্বল ভাইকে এদিকে নিয়ে এলেন৷ আর আমি শারমিন আপুকে নিয়ে এলাম।
এ মুহূর্তে আমি ও শারমিন আপু পাশাপাশি ও আমাদের সামনে প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। প্রোজ্জ্বল ভাইকে দেখে শারমিন আপু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন আছো প্রোজ্জ্বল? ”
প্রোজ্জ্বল ভাই বহু কষ্টেসৃষ্টে ঠোঁটের কোনে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললেন,
” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ”
” আমিও ভালো আছি। তোমাকে……”
শারমিন আপুর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মামি গলা উঁচিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইকে বললেন, আপুর শ্বশুরবাড়ি লোকদের গেট হতে ছাদে নিয়ে আসতে। আপুর শ্বশুরবাড়ি লোকদের আজ তত্ত্ব নিয়ে আসার কথা ছিলো। সেই তত্ত্ব নিয়েই হয়তো তারা এসেছেন।
মামির এ আদেশ শুনে প্রোজ্জ্বল ভাই যেনো মুহূর্তে যেনো পিঞ্জরা বন্দি পাখির ন্যায় উড়ে গেলেন। অসময়ে উনার এ ডাক পড়ায় ছোটখাটো বিনোদন থেকে বঞ্চিত হলাম আমি ও অভ্র ভাই। ওদিকে হতাশও হলেন শারমিন আপু।
আপুর শ্বশুরবাড়ি হতে দেবর, ননদ, শাহাদ ভাইয়ার খালা, মামিরা এসেছেন। এসেছেন আরোও উনার কয়েক বন্ধুও। আগত এ মেহমানদের খাতিরযত্নে ব্যস্ত হলেন প্রোজ্জ্বল ভাই, অভ্র ভাই, পাশের বাড়ির ওসমান মামা, জলিল মামা। এদিকে এতোক্ষণ যাবত ক্ষীর খেয়ে বিরক্ত হয়ে আপু আমায় মিষ্টি আনতে বললো। হলুদের টেবিলে মিষ্টি আনার কথা থাকলেও ভুলবশত তা আনা হয়নি। ফলস্বরূপ তা আনতে আমাকে নিচে যেতে হলো।
নিচে গিয়ে মিষ্টির প্লেট হাতে নিয়ে উঠতে গেলে কোনোরূপ ঘোষণা ও পূর্ব প্রস্তুতি ব্যতিতই অকস্মাৎ শাড়ির কুঁচিতে পা আটকে সিঁড়িতে পড়ে গেলাম৷ ভাগ্যবশত মাত্রই দু সিঁড়ি উঠেছিলাম বলে বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটেনি এবং মুখ থুবড়ে না পড়ায় মিষ্টির প্লেটটাও বেঁচে যায়।
আমি কোনোমতে মিষ্টির প্লেটটা নিয়ে শাড়ি সামনের দিকে ধরে উঠতে নিলাম। কিন্তু মিষ্টির প্লেট হাতে সামঞ্জস্য রেখে উঠে দাঁড়াতে পারলাম না৷
” দেখি হাতটা দাও। ”
অকস্মাৎ অভ্র ভাইয়ের প্রস্তাবে চমকে গেলাম। মাথা তুলে দেখলাম উনি হতাশাব্যাঞ্জক চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। উনার সামনে এ উদ্ভট অবস্থায় বসে থাকার ফলে খানিক লজ্জা বোধ করলাম। ফলস্বরূপ পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে উনার দিকে চেয়ে বোকা বোকা হাসি দিলাম। কিন্তু অভ্র ভাই আমার সে হাসি পাত্তাই দিলো না। বরং আমার হাত থেকে মিষ্টির প্লেট নিজের এক হাতে নিয়ে অপর হাত আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি সেই বোকাসোকা হাসি বজায় রেখেই উনার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। অতঃপর উনি জিজ্ঞেস করলেন,
” নিজ দায়িত্বে শাড়ি সামলাতে না পারলে শাড়ি পরো কেনো চন্দ্রিমা?”
অভ্র ভাইয়ের হতাশ গলার প্রশ্ন। উনার এরূপ হতাশ কণ্ঠ শুনে আমি কিয়ৎক্ষণ ড্যাবড্যাব করে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনার হতাশার কারণও কিছুটা আঁচ করতে পেলাম। অভ্র ভাই হয়তো আশা করেননি যে আমি শাড়িসহ উল্টো হয়ে পড়ে যাওয়ার মতো মেয়ে!
আমি ক্ষণিকের জন্য কিছু ভেবে প্রশ্নটির যুক্তিসংগত একটি জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু আমার প্রস্তুতিতে এক বালতি পানি ঢেলে সেখানে উপস্থিত হলেন প্রোজ্জ্বল ভাই। উনি এসেই অনেকটা ধমকের সুরে বললেন,
” দুনিয়ার মানুষ শাড়ি পরে নেচে বেড়ায় আর চন্দ্রিমা রাণী শাড়ি পরে দুই সিঁড়িও উঠতে পারে না। ও কি এখন চায়, ওকে কোলে করে উঠাই আমি?”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের শেষোক্ত প্রশ্নটি স্পষ্ট খোঁচামূলক ছিলো। উনার এ প্রশ্নে আমি মুহূর্তেই তেঁতে উঠে বললাম,
” আমি কি একবারো আপনাকে এ কথা বলেছি? সারাদিন শুধু প্যাঁ প্যাঁ করতে পারে। অসহ্যকর একটা লোক।”
এই বলেই নাকের ডগায় রাগ নিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে প্রচণ্ড উদ্যমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নিলাম। বেমালুম ভুলে বসলাম পরনের শাড়ির কথা। ফলে এই ভুলে বসার খেসারতও গুনতে হলো তখনই। পুনরায় দু সিঁড়ি উঠতেই শাড়িতে পা আটকে গেলো। উল্টো হয়ে মুখ থুবড়ে পড়তেই নিলেই লক্ষ্য করলাম দু জোড়া হাত আমাকে দ্রুততার সহিত সামলে নিয়েছে। এই দু জোড়া হাত আর কারোর নয় বরং অভ্র ভাই ও প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে রইলাম। অতঃপর বুঝ এলে আমি দ্রুত উনাদের হাত ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। মাথা নিচু করে নরম কণ্ঠে বললাম,
” সরি।”
অভ্র ভাই বললেন,
” ঠিক আছো তো?”
” জি ঠিক আছি। ”
এবার প্রোজ্জ্বল ভাই অনেকটা চিন্তিত তবে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” শাড়ি পরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো কেনো? তোকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয়। এভাবে হুটহাট যেখানে সেখানে পড়ে যাস। মাঝেমধ্যে ভয় হয়, কখন না কোনো বিপদ বাঁধিয়ে ফেলিস। আজ তো আমি আর অভ্র ছিলাম বলে একটা এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গিয়েছে। একা থাকলে কি হতো!”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কণ্ঠে স্পষ্ট উত্তেজিত হওয়ার আভাস পেলাম। উনার এ কথা বলার ধরণ শুনে অভ্র ভাই উনার কাঁধে হাত রেখে নির্বিঘ্ন গলায় বললেন,
” রিল্যাক্স প্রোজ্জ্বল। এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো? ও তো ঠিক আছে। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই প্রত্যুত্তর করলেন না। বরং আমার দিকে কিয়ৎ রাগত চাহনিতে এক নজর চেয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলেন।
অভ্র ভাই মিষ্টির প্লেট হাতে নিয়েই বললেন,
” চলো, উপরে যাই। তুমি শাড়ি ধরে উঠো চন্দ্রিমা।”
অভ্র ভাইয়ের এ কথা বলার পর আমি লক্ষ্য করলাম, শাড়িতে পা বেঁধে পড়ার ফলে নিচের কুঁচিগুলো অগোছালো হয়ে গিয়েছে। এজন্য এটা ঠিক করতে বললাম,
” অভ্র ভাই, আপনি চলে যান। আমি একটু রুমে যাবো। শাড়ি ঠিক করতে হবে।”
” আচ্ছা। তবে তুমি আসতে পারবে তো একা?”
” হ্যাঁ পারবো। এখন তো হাতে কিছু নেই। ”
অভ্র ভাই আর কথা বাড়ালেন না। প্লেট নিয়ে ছাদে চলে গেলেন। আর আমি নিচ থেকে এসে নিজের রুমে গেলাম। দরজা আটকিয়ে কোনোমতে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে বেরিয়ে এলাম। এবার ভালোভাবে শাড়ি সামলে উঠতে নিলে দেখলাম ছাদ থেকে আপুর এক দেবর নেমে আসছেন। যতদূর সম্ভব উনি শাহাদ ভাইয়ার বন্ধু।
উনি আমাকে দেখেই মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
” এখানে ওয়াশরুমটা কোথায়, যদি একটু বলতেন। ”
আমি পিছে ফিরে হাত বাড়িয়ে দোতলার কমন ওয়াশরুম দেখিয়ে বললাম,
” ঐ যে ঐটা। ”
” থ্যাংকস আ লট।”
এই বলেই ছেলেটি আমায় পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আর আমি উপরে চলে এলাম।
হলুদের প্রোগ্রাম এখনও চলছে। আপু স্টেজে বসে আপুর নতুন ননদের সাথে কথা বলছে। সাথে শারমিন আপুও আছে। প্রথমে আমিও ছিলাম তাদের সাথে। তবে একঘেয়েমি আলাপ আলোচনা শুনে সেখান থেকে চলে এসে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। একা একা দাঁড়িয়ে রাতের ধূসর কালো মেঘের আনাগোনা দেখছি।
” এগেইন থ্যাংকস মিস। ”
অকস্মাৎ পিছন হতে অপরিচিত কণ্ঠ শুনে চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখলাম, তখনকার সে ছেলেটি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।।
আমাকে এভাবে চমকিত হয়ে ঘুরতে দেখে উনি সপ্রতিভ হেসে বললেন,
” হঠাৎ ডাকায় আপনি বোধহয় ভয় পেয়ে গিয়েছেন। ”
বাস্তবে এ ঘটনাটি ঘটলেও আমি হাসিমুখে তা নাকচ করে বললাম,
” না না। তেমন কিছু না। ”
ছেলেটির চোখেমুখে এখনও হাসির ঝলক কমছে না। সেই পূর্বের মতো হাসি বজায় রেখেই সে বললো,
” ওয়াশরুম দেখিয়ে দেওয়ার জন্য থ্যাংকস। ”
” ইটস ওকে। ”
” আপনি বোধহয় জানেন আমি কে। ”
” জি। আপনি শাহাদ ভাইয়ার বন্ধু। তাই তো?”
” জি জি। আমি ওর বন্ধু। ওদের বাসা আমাদের পাশেই। তবে আপনাকে চিনতে পারলাম না। আপনি ভাবীর কে হোন?”
” আমি আপুর ফুপাতো বোন। ”
” ওহ আচ্ছা। আপনাকে দেখে খুব একটা বড় মনে হয় না। কিসে পড়াশোনা করছেন আপনি?”
” এবার মেডিকেলে কলেজে ভর্তি হয়েছি। ”
” বাহ। আপনি তো তাহলে ভবিষ্যত ডাক্তার। শুনে ভালো লাগলো। আমি একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব করি। ”
” ওহ আচ্ছা। ”
এই বলে আমি চুপ করে রইলাম। এভাবে শুধু শুধু কথা বাড়ানো, পরিচিতি বাড়ানোতে খানিক বিরক্ত বোধ করছি আমি। ব্যাপারটিই পুরোপুরি অযাচিত বোধ হচ্ছে। কিন্তু আমার বিরক্তভাবটা হয়তো সামনের ব্যক্তিটি বুঝতে পারলো না৷ এজন্যই আবারো বলে বসলো,
” দেখেছেন! এতোক্ষণ কথা বললাম। অথচ নামটাই জানা হলো না। আমার নাম নাহিদ। আপনার?”
এই বলে আমার দিকে করমর্দনের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিলো। অমনিই অকস্মাৎভাবে কোথা থেকে যেনো টপকে এসে উনার হাতে এসে হাত মিলিয়ে দিলেন প্রোজ্জ্বল ভাই। ঠোঁটের কোনে বিস্তৃত হাসি এনে বললেন,
” আর আমার নাম প্রোজ্জ্বল। নাইস টু মিট ইউ। ”
অকস্মাৎ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এ আগমনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম আমি। সাথে বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছালেন নাহিদ নামের ছেলেটি। আমাদের এ বিস্ময়ের মাত্রাকে আরো এক দফা বাড়িয়ে দিতে সেখানে উপস্থিত হলেন অভ্র ভাই। প্রোজ্জ্বল ভাই নাহিদের নামের ছেলেটির হাত ছাড়তেই অভ্র ভাই উনার হাতে হাত মিলিয়ে বললেন,
” আমি অভ্র। নাইস টু মিট ইউ ব্রো।”
দুজনের এ অকস্মাৎ আগমনে আমি ড্যাবড্যাব করে উনাদের দিকে চেয়ে রইলাম। সাথে পর্যবেক্ষণ করলাম, উনাদের চোখের চাহনিকেও। এ মুহূর্তে দুজনের চাহনি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, নাহিদ নামের ছেলেটির উপর দুজনেই বড্ড রেগে আছেন এবং এমন রেগে আছেন যে, যেকোনো মুহূর্তে সামনের এ মানুষটিকে কাঁচা চিবিয়ে ফেলবেন দুজনে।
অভ্র ভাই ও প্রোজ্জ্বল ভাই নিজেদের পরিচিতি দিয়ে এগিয়ে এসে আমার দু পাশে দাঁড়ালেন। অভ্র ভাই আমার পাশে রেলিঙে হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে নাহিদকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তো কি কথা হচ্ছিলো আপনাদের মাঝে?”
অভ্র ভাইয়ের সহজ সরল প্রশ্নেও যেনো মিইয়ে গেলো নাহিদ। আমাদের অগোচরে শুকনো ঢোক গিলতে চাইলেও তা ঠিকই আমাদের দৃষ্টিগোচরে এলো। নাহিদ কেমন আড়ষ্ট হয়ে এলেন। ঈষৎ ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বললেন,
” এই তো পরিচিতি আদানপ্রদান হচ্ছিলো। ”
এই বলে সে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। তার এ জবাব শুনে আমার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রোজ্জ্বল ভাই বুকের উপর হাত আড়াআড়িভাবে রেখে রাশভারি গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” এতো লম্বা পরিচিতি নিয়ে মনে মনে ওর বায়োডাটা লেখা হচ্ছিলো নাকি?”
®সারা মেহেক
#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১৩
#লেখিকা:সারা মেহেক
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন প্রশ্নে যেনো চুপসে গেলো নাহিদ নামের ছেলেটি। বেশ বুঝতে পারছি উনি ভীষণ বেমানান একটি পরিস্থিতিতে পড়েছেন। উনি কষ্টেসৃষ্টে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন,
” না না। তেমন কিছু না। শুধু নাম, কোথায় পড়ে, এটুকুই জেনেছি।”
এই বলে উনি নিমিষের জন্য নিবৃত্ত হলেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনাদের ঠিক চিনতে পারলাম না।” এতোক্ষণে বোধহয় একটু সাহস জুগিয়ে ছিলেন তিনি৷ ফলে কণ্ঠে খানিক সাহসী ভাবের দেখা মিললো বটে। প্রোজ্জ্বল ভাই উনার এ কথার প্রেক্ষিতে বললেন,
” আমি আপনার ভাবীর একমাত্র ভাই। আর ঐ পাশের জন্য আমার একমাত্র বন্ধু।”
এই বলে তিনি অভ্র ভাইয়ের দিকে আঙুল তাক করলেন। অভ্র ভাই এর প্রেক্ষিতে কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু এর পূর্বেই নাহিদ নামের ছেলেটি কাজের বাহানা দিয়ে কেটে পড়লো সেখান থেকে। উনি চলে যেতেই আমি রেলিঙ ছেড়ে প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাইয়ের বিপরীতে দাঁড়ালাম। মানসিকভাবে উনাদের ক্লাস নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। নাহিদকে যে এভাবে হেনস্তা করেছেন উনারা, তা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। বেচারার চেহারা দেখে স্পষ্ট মনে হচ্ছিলো, সে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। উনারাই বা দোষ কোথায় ছিলো। বিয়ে বাড়িতে মানুষ এভাবে একটু আধটু পরিচিত হতেই পারে। তাই বলে এভাবে ভয় দেখানোর মানে কি!
আমি প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাইয়ের দিকে কয়েক সেকেন্ড কঠিন চাহনিতে চেয়ে রইলাম। আমার এ চাহনি দেখে অভ্র ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার আবার কি হলো? এভাবে তাকাচ্ছো কেনো আমাদের দিকে?”
আমি তাদের জবাব দিলাম না। বরং দুজনের দু বাহু ধরে লোকসমাগম হতে একটু দূরে ছাদের এক কোনায় নিয়ে এলাম৷ অতঃপর যথাসম্ভব রাগত চাহনি ও রুষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনাদের সমস্যা কি? ”
প্রোজ্জ্বল ভাই যেনো কিছুই জানে না এমন ভান ধরে বললেন,
” কি সমস্যা হবে? উই আর অল গুড। ”
আমি অনেকটা ধমকের সুরেই বললাম,
” শুধু শুধু বেচারাকে এভাবে ভয় দেখানোর কি দরকার? নরমালি আমরা পরিচিত হচ্ছিলাম। কিন্তু আপনাদের সওয়াল জওয়াব আর কঠিন কঠিন সব অঙ্গভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছিলো আমরা বিশেষ করে ঐ ছেলেটা কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। ”
আমার এ কথা শোনামাত্র প্রোজ্জ্বল ভাই তেঁতে উঠলেন৷ মুখ ভেঙিয়ে বললেন,
” এ্যাঁহ, বেচারা! সাক্ষাৎ ভিলেনের মতো দেখা যায়। দেখলেই মনে হয়, মনে কোনো চোর আছে।”
” মনে হলেই হলো? ভিলেনের মতো দেখা যায় বলে কি সে ভিলেন হবে? কই আপনাদের দু’জনকেই তো দেখতে হিরোদের মতো লাগে। তাহলে আদৌ কি আপনারা হিরো?”
এবার প্রোজ্জ্বল ভাই কিছু বলার পূর্বেই অভ্র ভাই বলে উঠলেন,
” অভিয়েসলি। এই যে মাত্রই আমরা হিরোদের মতো একটা কাজ করলাম। ঐ ভিলেনটা থেকে তোমাকে বাঁচালাম। তাই না দোস্ত?”
এই বলে অভ্র ভাই প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কাঁধে কনুই দিয়ে ভর করে দাঁড়ালেন। উনার চোখেমুখে এ মুহূর্তে বিরাজ করছে গর্বিত একখানা ভাব। যেনো সত্যিই উনি হিরো এবং মাত্রই আমাকে ভিলেন থেকে বাঁচিয়েছেন উনি। উনার এ বক্তব্যের সাথে তাল মিলালেন প্রোজ্জ্বল ভাই। বললেন,
” অবশ্যই। কিন্তু দেখ, আজকাল ভিলেনদের ভিড়ে হিরোদের কোনো কদরই নেই! জালিম দুনিয়া।”
প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাইয়ের এরূপ কথা শুনে রীতিমতো হতাশ হলাম আমি। বেশ একটা ঝগড়ার মুডে ছিলাম। মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুতও করেছিলাম, আজ ঝগড়া করে আমি জিতবো। কিন্তু উনাদের এ কথোপকথনে আমার ঝগড়ার মনমানসিকতা পুরোটাই বানের জলে ভেসে গেলো। এ কারণে আমি আর কথা বাড়ালাম না। হতাশ কণ্ঠে বললাম,
” বড়ই উপকার করেছেন আপনারা। আপনাদের সাথে কথা বলে লাভ নেই। সবসময় সব জায়গায় নিজেদের লম্বা, চিকন নাকখানা প্রবেশ করাতে পারলেই যেনো শান্তি। বিশেষ করে আমার বেলায় তো কোনো বাছবিচার নেই। থাকুন আপনারা আপনাদের হিরোগিরি নিয়ে।”
এই বলেই আমি উল্টো পথে পা বাড়ালাম৷ পিছে শুনলাম, প্রোজ্জ্বল ভাই গলা উঁচিয়ে হতাশাজনক কণ্ঠে বলছেন,
” আজকাল ভালো মানুষের কদর নেই রে, বুঝলি অভ্র। আর মানুষের উপকার করবো না৷ সে চলুক নিজের মতো। ”
অভ্র ভাইও একই ভঙ্গিতে তাল মিলালেন উনার সঙ্গে। বললেন,
” আজ ভিলেনের সামনে এই হিরো দুইটা হিরোইনের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেলো। কি কপাল রে দোস্ত! ”
বেশ রাগী রাগী হাবভাব এবং শক্ত চাহনি নিয়ে থাকার পর হাসতে না চাইলেও উনাদের এহেন কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেললাম আমি। মুখে হাসি নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে উনাদের দিকে চাইলাম। দেখলাম, দুজন এদিকেই চেয়ে আছে।
আমি সামনের দিকে ঘুরে তাকালাম। আসলে এই দুটো মানুষ আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাইই আমাকে আগলে রাখার দায়িত্ব পালন করছেন। যেকোনো বিপদে সবসময়ই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই দুটো ব্যক্তিকে আমার পাশে পেয়ে যাই। সে আমি চাই বা না চাই,উনারা সবসময় আমাকে রক্ষা করেন, আমাকে সাহায্য করেন। ছোট থেকে উনাদের সাথে থাকায় তাই মিলটাও আমাদের অনেক। এজন্য এভাবে ছোটখাটো বা কখনো কখনো বড়সড় ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করি না আমি৷
——-
বিয়ে বাড়িতে লোকজনের অভাব নেই। চারপাশে যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। যেনো দু গুষ্টি থেকে প্রতিটা মানুষই বিয়ের দাওয়াতে এসে হাজির। ছাদে যথেষ্ট জায়গা থাকায় এখানেই প্যান্ডেল করা হয়েছে। খাওয়াদাওয়া, বরযাত্রী সবকিছুর আয়োজন এখানেই করা হয়েছে। এজন্য এখানে মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে। ফলস্বরূপ অতিরিক্ত লোকসংখ্যার কারণে স্বাভাবিক এর তুলনায় আজ বেশি গরম ও অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে। তার উপর বিয়ের জন্য ভারী কাজের একটা লেহেঙ্গা পরেছি আজ। সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা।
আপুকে পার্লার থেকে সাজিয়ে এনে মাত্রই রুমে বসিয়েছে। তখনই হুড়মুড় করে কতগুলো মহিলা ঢুকে পড়লো বউ দেখতে। তাদের জ্বালায় রুমে তিল ধারণের ঠাই রইলো না। ফলে প্রচণ্ড অস্বস্তি অনুভূত হওয়ায় আমি দ্রুত রুম হতে বেরিয়ে ছাদে চলে এলাম। এখনও বরপক্ষ আসেনি। এ মুহূর্তে আমাদের পক্ষের লোকজনের খাওয়াদাওয়া চলছে। প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাই শাহাদ ভাইয়ের খাবারদাবারের ব্যবস্থা দেখছেন। আজ দুজনই বিয়ে উপলক্ষে মিলিয়ে অফ হোয়াইট রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন। দুজনকে এ রঙে মানিয়েছে দারুণ। মানতে হবে, আজ দুজনকে হ্যান্ডসামও লাগছে বেশ। বলা বাহুল্য, আজ বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত মেয়েদের কেন্দ্রবিন্দু হবেন এই দুজন। ইতোমধ্যে, আমাদের এলাকার দুজন মেয়ে খেতে খেতে যে কতবার উনাদের দিকে তাকিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই মেয়েদের সাথে আবার এসে যোগ দিলেন স্বয়ং শারমিন আপু।
আমি এক কোনায় চেয়ারে বসে ছিলাম। উনি চেয়ার এনে আমার পাশে বসলেন। আমার সাথে কথা বলার বাহানায় বার কয়েক প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে আড়চোখে চাইলেন। ব্যাপারটা উনার পাশে বসেই ভালোভাবে উপভোগ করলাম আমি। এর মধ্যে শারমিন আপু একবার উঠে গেলেন, প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে কথা বলবেন বলে। কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাই ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে উনার মুখের উপর না করে দিয়েছে। এরপর থেকে আমার পাশে মনমরা হয়ে বসে আছে শারমিন আপু।
কিছুক্ষণের মধ্যে বরপক্ষ চলে এলো। গেট থেকে নানা উপায়ে তাদের বরণ করা হলো। আগে থেকে আমাদের পক্ষের লোকজন দিয়ে ভর্তি বাড়ি আরোও লোকে-লোকারন্য হলো। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমিও।
বিয়ে পড়ানো শেষে খাওয়াদাওয়ার পর্বও শেষ হয়ে গেলো। আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে আপু রওনা হবে। ভাবলাম এই এক ঘণ্টা আপুর সাথেই থাকবো। কিন্তু আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন রুমটা প্রায় দখল করে রাখায় তা হলো না। কিছুক্ষণ পর শাহাদ ভাইয়াকে আপুর রুমে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে ছবি তোলার লোকের ভীড় হলো না। প্রচণ্ড গরমের ফলে গুটিকয়েক ছবি তুলেই আমি ছাদে চলে এলাম। ছাদে এসে দেখলাম৷ অভ্র ভাই চেয়ারে বসে আছেন। আমিও গিয়ে উনার পাশের চেয়ারে বসলাম। চেয়ারে বসতেই উনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি অবস্থা? আজ যে তোমার দেখাই মিললো না! নতুন বেয়াইদের পেয়ে আমাদের ভুলে গিয়েছো দেখি!”
আমি মুহূর্তেই অভ্র ভাইয়ের এ আরোপ নাকচ করে বললাম,
” মোটেও না। বরং আপনারা নতুন বেয়াইনদের পেয়ে আমাদের ভুলে গিয়েছেন। দেখলাম তো, কতশত মেয়ে আপনার আর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের পিছনে ঘুরছে!”
” কত-শত! এতো মেয়ে আসলো কোথা থেকে?” এই বলে সশব্দে হেসে উঠলেন অভ্র ভাই। পুনরায় বললেন,
” আর তোমার জ্ঞাতব্যে বলে দেই, মেয়েরা আমার পিছনে না বরং প্রোজ্জ্বলের পিছনে ঘুরছে। ঐ দেখো।”
এই বলে উনি অদূরে বসা প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে আমার দৃষ্টি ফেরালেন। দেখলাম, ফ্যানের বিপরীতে চেয়ার রেখে পায়ের উপর পা তুলে আরামে ফোন চালাচ্ছেন। আর উনার থেকেই মাত্র কয়েক হাত দূরে দুটো মেয়ে একে অপরের সাথে হাসাহাসি করছে। বলা বাহুল্য, এই হাসাহাসির ভেতরে প্রোজ্জ্বল ভাই শামিল আছেন। কারণ কথার মধ্যে যতবার সম্ভব হয় ততবার তারা প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। সাথে হাতের ইশারায় একে অপরকে কি যেনো দেখাচ্ছে। আর এ মেয়েরা বরপক্ষের লোক৷ আমাদের এলাকার মেয়ে হলে বরং আমি তাদের কাছে গিয়ে জেরা করতাম। যেহেতু এখানে জেরা করার কোনো সুযোগ নেই সেহেতু বসে বসে দৃশ্যটা উপভোগ করাই শ্রেয়।
মেয়েদের এ কান্ড দেখে আমি আর অভ্র ভাই হাসাহাসি করছি। এক পর্যায়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” এ তো গেলো, প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের ব্যাপার। আপনার কি হালচাল তাই বলুন। কয়টা প্রপোজাল পেলেন? আফটার অল আজকে আপনাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে।”
অভ্র ভাই ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বললেন,
” তাই! যাক, একজনের মুখ থেকে সরাসরি শুনলাম যে আজ আমায় হ্যান্ডসাম লাগছে। ”
” কথা ঘুরাবেন না অভ্র ভাই। বলুন, কয়টা প্রপোজাল পেয়েছেন?”
আমার প্রশ্নে অভ্র ভাই ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
” ঠিক ওভাবে একটাও না। তবে ইনিয়েবিনিয়ে একটা মেয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে। তবে তুমি তো জানোই, আমি কারোর প্রপোজাল একসেপ্ট করবো না। কারণ……”
অভ্র ভাইয়ের মুখ হতে কথা কেড়ে নিয়ে সুর করে বললাম,
” কারণ, আপনার জন্য আপনার স্বপ্নচারিণী আছে। ইশ, কি লাকি মেয়েটা! ”
হাসলেন অভ্র ভাই। হঠাৎ আমার মনে পড়লো প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথা। চট করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার খবর তো জানি। আপনার বন্ধুর খবর কি বলুন তো। উনার সম্পর্কে যে কিছুই জানি না। এমন একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ড আছে নিশ্চয়ই? ”
অভ্র ভাই সাথে সাথে বললেন,
” উঁহু, ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। ”
” মিথ্যে বলবেন না। আমার তো মনে হয়, উনার গার্লফ্রেন্ড আছে। বা এমনও হতে পারে যে, উনি চুপিচুপি বিয়ে করে বসে আছেন?”
” না না। সে কি করে হতে পারে। প্রোজ্জ্বল এমন না৷ ওর গার্লফ্রেন্ড থাকলে সবার আগে আমি জানতাম। ”
অভ্র ভাইয়ের কথা মানতে পারলাম না ঠিক। বললাম,
” গার্লফ্রেন্ড না থাকলেও, কাউকে তো পছন্দ করে। সে কে? শারমিন আপু না নিশ্চয়ই। ”
” কাউকেই পছন্দ করে না ও। একদম পিওর সিঙ্গেল উনি।”
” আমি মানতে পারলাম না উনি সিঙ্গেল। দেখুন গিয়ে, নিজের কোনো এক ছাত্রীর সাথে প্রেম জমিয়ে বসে আছে। এখনই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করছি আমি। ”
এই বলে পটকাকে ডাক দিলাম আমি। পটকা আমাদের এলাকারই ছেলে। বয়স আট বছর। ওর ভালো নাম পিন্টু। কিন্তু বড়রা বাদে আমরা সবাই ওকে পটকা বলে ডাকি। কারণ, একটু থেকেই একটু হলেই রেগেমেগে ওর গালটাল পটকা মাছের মতো হয়ে যায়।
পটকা আমাদের সামনেই বসে ছিলো। আমি ওকে দেখতে পেয়ে ওকে ডাকলাম,
” পটকা? এই পটকা, এদিকে আয়। কাজ আছে। ”
পটকা আমার এ সম্বোধন শুনে মুহূর্তে ভেঙচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। যার অর্থ সে আমার ডাকে সাড়া দিবে না। ফলে ওকে আনার জন্য অভ্র ভাইকে ডাকতে বললাম। অভ্র ভাই জোরসে একটা ডাক দিয়ে বললেন,
” এই ব্যাটা এদিক আয়। কাজ আছে বললাম না!”
তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখমুখ কুঁচকিয়ে, গালটাল ফুলিয়ে পটকা এসে আমাদের সামনে হাজির হলো। বুকের উপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে বললো,
” কি কাজ বলো।”
আমি ওর ফুলে যাওয়া গালটা টেনে আদুরে কণ্ঠে বললাম,
” গোলুমোলুটা এতো রাগ করিস কেনো? এ নাম তো আমরা ভালোবেসে তোকে দিয়েছি। এবার রাগ না করে আমার রুম থেকে একটা খাতা আর কলম নিয়ে আয়। আমার রুম কোনটা চিনিস তো?”
” হ্যাঁ চিনি।”
এই বলে পটকা দৌড়ে চলে গেলো। দু মিনিটের মাঝে একটা খাতা কলম নিয়ে হাজির হলো। ওর কাছ থেকে খাতা কলম নিয়ে একটা পেজ ছিঁড়ে তাতে লিখলাম,
” এই যে, সুদর্শন যুবক। আপনাকে আমার খুব মনে ধরেছে। আমি কি আপনার সাথে পরিচিত হতে পারি? আলোচনা সাপেক্ষে আপনার গার্লফ্রেন্ড? অবশ্য আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে? সিঙ্গেল তো আপনি? আপনি মিঙ্গেল থাকলে আমার চান্সটা মিস হয়ে যাবে।
আপনি দেখতে শুনতে বেশ ভদ্র। আশা করি, আমার প্রশ্নের জবাব এই চিঠিতে দিয়ে দিবেন। পরবর্তীতে আপনার জবাব হ্যাঁ হলে আমি নিজ থেকে অগ্রসর হবো।
ইতি, আপনার এক শুভাকাঙ্ক্ষী। ”
এই লিখে ছেঁড়া পাতাটা ভাঁজ করে পটকার হাতে দিয়ে বললাম,
” এটা প্রোজ্জ্বল ভাইকে দিবি। কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলবি, একটা আপু দিয়েছে। খবরদার আমার নাম বলবি না। বললে চকলেট মিস। ”
পটকা আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে এক দৌড়ে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কাছে গেলো। উনার হাত কাগজটা দিয়ে কিছু বললো। অতঃপর সে চলে এলো। প্রোজ্জ্বল ভাই যেনো এ ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ করতে না পারেন তাই পটকাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে আমি ও অভ্র ভাই মুখোমুখি বসে নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক আচরণ বজায় রাখলাম। এক পর্যায়ে অভ্র ভাই দ্বিধাগ্রস্থ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার মনে হয় না, প্রোজ্জ্বল চট করে এটা ধরে ফেলবে?”
আমি বেশ আত্মবিশ্বাসের সহিত বললাম,
” মোটেও না। আপনার বন্ধু ধরতে পারবে না৷ ”
” তবুও ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো?”
” কেমন হয়ে গেলো? আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার বন্ধু টের পাবে না যে চিঠিটা কে দিয়েছে।”
এই বলে শেষ হতে না হতেই মাথার পিছনে এক গাট্টি খেলাম আমি। মুহূর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, প্রোজ্জ্বল ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে হাত থেকে চিঠিটা ছুঁড়ে দিয়ে বুকের উপর আড়াআড়িভাবে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আমার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে তোর এতো মাথাব্যথা কেনো?”
উনার এ প্রশ্নে অগোচরে শুকনো একটা ঢোক গিললাম। কিছুই জানি না এমন ভঙ্গিতে বললাম,
” কই মাথাব্যথা? আর আমি করেছি কি হু?”
” চিঠিটা যে তুই দিয়েছিস তা ভালো করেই জানি। তোর হাতের লেখা চেনা আমার। এসব কাজ করলে চালাকের মতো করবি। গাধার মতো করিস কেনো?”
হাতের লেখার কথা মনে আসতেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিব কাটলাম৷ এ বিষয়টা কিছুতেই আমার মাথায় ছিলো না। কি এক ভুল করে বসলাম!
প্রোজ্জ্বল ভাই পুনরায় বললেন,
” আমার মিঙ্গেল থাকা, গার্লফ্রেন্ড থাকা নিয়ে তোর এতো চিন্তা কেনো? ইনটেনশন কি? প্রেম করবি আমার সাথে? আমার গার্লফ্রেন্ড হবি?”
অকস্মাৎ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম। চোখজোড়া বিস্ময়ে বড় বড় করে বললাম,
” এসব কি বলছেন! তা হতে যাবো কেনো? আমি তো…..”
প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন,
” তাহলে চুপ থাক এ ব্যাপারে। ”
এই বলে উনি অভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন,
” তুইও ওর সাথে মিলে আছিস। আজ তোর খবর আছে। ”
বলেই উনি চলে গেলেন। উনার পিছু পিছু ছুটে গেলেন অভ্র ভাইও। আর আমি বিভ্রান্ত চাহনিতে সেদিকে চেয়ে রইলাম৷ এটা হলো কি!
.
বিদায় নেওয়ার সময় আপু খুব করে কাঁদলো। নানু আর মামিও কাঁদলো। সাথে আমিও কাঁদলাম। কিন্তু কেনো যেনো বেশিক্ষণ বেশিকিছু সে কান্না বজায় রাখতে পারলাম না। হয়তো মানুষের সামনে বলে।
কান্নাকাটি পর্ব শেষ হওয়ার পর আপু গাড়িতে উঠে প্রোজ্জ্বল ভাইকে বললো,
” প্রোজ্জ্বল, সবার খেয়াল রাখিস। নিজেরও খেয়াল রাখিস। এখন কিন্তু সব দায়িত্ব তোর। আমার অনুপস্থিতিতে বাড়ির বড় ছেলে এখন তুই।”
এই বলে আমাকে কাছে ডেকে বললেন,
” নিজের শরীরের খেয়াল রাখিস চন্দ্রিমা। আর সময় করে সবার ওষুধপত্রও দেখিস। জানি, এতোদিন তুইই দেখেছিস। তারপরও বলে রাখলাম।
আর প্রোজ্জ্বল, চন্দ্রিমার দেখাশোনা করিস। এখন থেকে তো তোর আন্ডারেই থাকবে ও। বুঝলি?”
প্রত্যাশা আপুর এ কথা শুনে প্রোজ্জ্বল ভাই বললেন,
” শেয়ালের কাছে মুরগি রেখে যাচ্ছো আপু। বুঝে নিও।”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন কথায় মুহূর্তেই সেখানে ছোটখাটো একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতেও হেসে ফেললো আপু। আর আমি চোখমুখ কুঁচকে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম।
———-
আমার মেডিকেলের ক্লাস শুরু হয়েছে দু সপ্তাহ হলো। স্বাভাবিকভাবেই আমি এখনো মেডিকেল জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। নতুন নতুন ক্লাস, বই, পড়ার চাপ, জটিল জটিল সব গঠন, মেকামিজম, আইটেম, সব দিয়ে মনে হচ্ছে অথৈ সাগরে ডুবেছি আমি। তারপরেও প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাইয়ের সাহায্যে এ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে শিখছি।
শেষ ক্লাসের আগের দশ মিনিটের অফ পিরিওডে দেখলাম, আমার ম্যাসেঞ্জারে নাহিদের ম্যাসেজ এসেছে। বলছে, আজ কলেজ শেষে একটু দেখা করতে। আমি সাথে সাথে এতে না করে দিলে উনি বারংবার রিকুয়েষ্ট করতে থাকে। ফলস্বরূপ উনার পিছু ছাড়ানোর আর কোনো উপায় না পেয়ে শেষমেশ আমাকে রাজি হতে হলো।
আপুর বিয়ের পর থেকে নাহিদের সাথে আমার কথা হয়। প্রতিবার উনিই আমাকে নক দেয়। আমিও ভালো বুঝে প্রথম প্রথম উনার সাথে কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখনও বুঝিনি এর কারণে গ্যাড়াকলে পড়ে যাবো আমি। আমি প্রতিবার যতটুকু সম্ভব উনার সাথে কম কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু উনি নিজের কথার জালে আমাকে এমনভাবে ফাঁসিয়ে ফেলেন যে না চাইলেও উনার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়ে যায়। এভাবে কথা বলতে বলতে যখন বুঝলাম উনার মনে অন্যকিছু চলছে তখনই পুরোপুরিভাবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি আমি। কিন্তু নাহিদ তারপরও আমাকে নক দিয়ে গিয়েছেন। আর আজ বারবার রিকুয়েষ্ট করে দেখাও করতে বলেছেন। আমি ভেবে রেখেছি, এই সুযোগে আমি সরাসরি বলে দিবো, আমার সাথে আর যোগাযোগ না রাখতে। এতোদিন ফোনে বলে কোনো কাজ হয়নি। হয়তো আজ সরাসরি বলে সে কাজ হতে পারে।
কলেজ শেষে আমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে কলেজের সামনে উনার সাথে দেখা করলাম। উনি বললেন, এভাবে রাস্তায় কথা না বলে কোনো রেস্টুরেন্টে বসতে। যখন উনি রেস্টুরেন্টের কথা বললেন, তখনই ভেবে নিলাম, নিশ্চয়ই উনার মনে অন্য কিছু চলছে। এজন্য আমার সে ফ্রেন্ডকেও বলেকয়ে নিয়ে গেলাম।
নাহিদ, আমি ও আমার ফ্রেন্ড রিমা অটোতে উঠে বসলাম। আমি আর রিমা পাশাপাশি বসলাম। আর নাহিদ বসলেন আমাদের সামনাসামনি।
পনেরো মিনিট পর আমাদের কলেজ হতে বেশ দূরেই একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলেন উনি। জায়গাটা আমার অপরিচিত। তবে রিমার পরিচিত। এজন্য প্রথম প্রথম ভয় লাগলেও পরে মনে সাহস জুগিয়ে নিলাম।
অটো থেকে নেমে আমি, রিমা আর নাহিদ রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। বসার পরপরই এতোক্ষণ অল্পবিস্তর যে বুক ধুকপুক করছিলো, তা এখন রীতিমতো ম্যারাথন শুরু করে দিয়েছে। ভেতরে কেমন অস্থির অনুভূত হচ্ছে। ভয় হচ্ছে। কিন্তু আজ এই নাহিদের কেচ্ছা পুরোপুরিভাবে শেষ করার জন্য নিজের এ অস্থির ও ভীত অনুভূতকে জোর করে চাপিয়ে রাখলাম৷ তবুও আমার মন মানলো না। ফলস্বরূপ ভয়ে টেবিলের নিচে রিমার হাতটা ধরে রাখলাম৷
এতোদিন যাবত নাহিদের সাথে কথা হওয়া বিষয়ে প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাই কিছুই জানেন না। আমি ইচ্ছে করেই উনাদের কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম শুধু শুধু ঝামেলা না করে নিজ থেকেই এটা সামলে নিবো। তবে পরে মনে হলো, এ বিষয়ে বলা উচিত। কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রাগের কথা ভেবেই ভয়ে আর বলা হয়নি। আজ এ মুহূর্তে আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, উনাদের এ বিষয়ে না জানিয়ে কোনো ভুল করিনি তো আমি?
নাহিদ খাবার ওর্ডার করে আমাদের সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগলেন। উনার চাহনি, অঙ্গভঙ্গি একদম সাবলীল। হাবভাবে মনে হচ্ছে, আমাদের সাথে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবে কথা বলতে বলতে নাহিদ আমাদের সাথে স্বাভাবিক হয়ে এলেন।
হঠাৎ এক পর্যায়ে রিমার ফোনে ওর বাসা থেকে ফোন এলো। ও ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আন্টি জিজ্ঞেস করলো, এতো দেরি হচ্ছে কেনো। আর কঠিন স্বরে আদেশ দিলো, এক্ষুনি বাসায় ফিরে আসতে। রিমা ওর মাকে দেখে ভীষণ ভয় পায় বলে ফোন পাওয়ার সাথে সাথে ও উঠে দাঁড়ালো। বললো, ওকে এক্ষুনি যেতে হবে। মায়ের ভয়ে আমার ইশারায় না করা সত্ত্বেও রিমা চলে গেলো। ও চলে যাওয়ার পর আমার যে সাহসটুকু সঞ্চারিত হয়েছিলো সেটাও উদ্বায়ী বস্তুর ন্যায় উবে গেলো৷ নাহিদ হয়তো বুঝতে পারলেন, আমি বেশ ভয়েই আছি। এজন্য উনি আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। এদিক ওদিকের কথায় আমাকে মশগুল করলেন। কিন্তু একা মেয়ে থাকায় উনার কোনো কথাতেই কাজ হলো না। বরং ধীরেধীরে ভয়ে আমার হাত-পা অসার হয়ে যেতে লাগলো।
নাহিদ খাবার খাচ্ছেন বেশ স্বাভাবিকভাবেই৷ কিন্তু ভয়ের চোটে আমি গলা দিয়ে কোনো খাবার নামাতে পারছি না। তবুও উনাকে দেখানোর জনশ কয়েক চামচ খেলাম। খাবার শেষে উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। অতঃপর অকস্মাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন। উনি এভাবে বসাতেই ভয়ে আমি চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি তা উপেক্ষা করে পকেট হতে আংটি বের করে আমার সামনে ধরলেন। বললেন,
” তোমাকে খুব পছন্দ করি চন্দ্রিমা। শুধু পছন্দ করি বললে ভুল হবে। তোমাকে ভালোওবাসি আমি। তোমাকে বিয়ে করতে চাই। প্লিজ মানা করো না আমাকে। তোমাকে ছাড়া আমি এখন নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না। তুমি আমার প্রপোজাল একসেপ্ট না করলে আমি কি করে ফেলবো তা জানি না। তোমার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছি আমি। প্লিজ ম্যারি মি চন্দ্রিমা। ”
যেটার ভয়ে ছিলাম দিনশেষে সেটাই হলো। নাহিদের এমন অকস্মাৎ প্রপোজালে রেস্টুরেন্টের প্রতিটি মানুষ হা করে আমাদের দিকে চেয়ে রইলো। আর এদিকে আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুটো হাত বরফের ন্যায় শীতল হয়ে এলো। তীব্র ভয়ে হৃদপিণ্ড ধুকধুক করে লাগলো। নাহিদের শেষোক্ত কথাগুলো কেনো যেনে আমার কানে উন্মাদের ন্যায় শোনালো। ফলে আরো বেশি ভয়ে সিটিয়ে এলাম আমি। কম্পিত কণ্ঠে বললাম,
” দেখুন নাহিদ, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি আপনাকে পছন্দ করি না, ভালোওবাসি না।”
মুহূর্তেই নাহিদ বিচলিত হয়ে বললো,
” কেনো চন্দ্রিমা? আমার মধ্যে খারাপ কিছু আছে? থাকলে বলো, আমি নিজেকে শুধরে নিবো। তবুও আমাকে না করো না। ”
” বললাম তো, আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। ”
এই বলে আমি ব্যাগ নিয়ে দ্রুত উনাকে পাশ কাটিয়ে রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। রেস্টুরেন্টের অপর পাশের রাস্তায় দাঁড়ালাম রিকশা বা অটোর জন্য। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত এই চরম বিপদের মুহূর্তে কিছুই পেলাম না। অগত্যা পায়ে হেঁটে সামনের দিকে এগুলাম। রাস্তা অচেনা হওয়ায় নিজের উপর একপ্রকার জোরজবরদস্তি করেই হেঁটে এগুতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমার পথ আগলে দাঁড়ালো কেউ। চোখ তুলে দেখলাম তিনজন অপরিচিত ছেলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের চাহনি অদ্ভুত এবং ভয়ংকর।
®সারা মেহেক
#চলবে
(/