#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_৩০
#লেখিকা_সারা মেহেক
অকস্মাৎ প্রোজ্জ্বল ভাইকে এভাবে আমার পাশে এসে বসতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। উনি তো মাত্রই চলে গিয়েছিলেন। তাহলে আবারো ফিরে এলেন যে! সেটাও আবার ছাতা বিহীন! সবসময় বৃষ্টিতে ভেজা বারণ করা ব্যক্তিটা আজ হঠাৎ কি মনে করে ভিজছে?
মনে উঁকি দেওয়া এ প্রশ্নের জবাব পেতে খানিক হাসির ছলেই পাশ ফিরে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি ব্যাপার প্রোজ্জ্বল ভাই? আজ কি মনে করে বৃষ্টিতে ভিজতে এলেন? সবসময় আমাকে বারণ করে আজ নিজেই সে বারণ মানছেন না!”
প্রোজ্জ্বল ভাই আকাশের দিকে লক্ষ্য করে বললেন,
” দেখতে এলাম, বৃষ্টির অগণিত ফোঁটা কিভাবে মানুষের অগণিত দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। ”
” আপনার মনেও কি কোনো দুঃখ আছে?”
প্রোজ্জ্বল ভাই চট করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেনো? থাকতে পারে না?”
” পারে। তবে আপনাকে দেখে কখনো মনে হয়নি এমন। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই খানিক হেসে বললেন,
” সবাই কি সবকিছু প্রকাশ করতে পারেরে পাগলি! কত মানুষের মনে কত দুঃখ, কষ্ট, অজানা ইচ্ছা লুকিয়ে থাকে! চাইলেও সে প্রকাশ করতে পারে না। আবার কখনো সে ইচ্ছাপূর্বকও প্রকাশ করে না।”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথাবার্তার আমি সব ভুলে বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার ক্ষেত্রে কোনটা প্রোজ্জ্বল ভাই? ”
প্রোজ্জ্বল ভাই বুঝি খানিক চমকে উঠলেন। ওদিকে বিদ্যুতও চমকে উঠলো। এক্ষেত্রে উনি আমার প্রশ্নে চমকালেন না কি বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে চমকালেন কে জানে!
প্রোজ্জ্বল ভাই বললেন,
” জটিল একটা প্রশ্ন। এখনও এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো সময় আসেনি। সময় হলে বলবো।”
” এই সাধারণ প্রশ্নের জবাবের জন্য সময়ের প্রয়োজন হয় না কি!”
প্রোজ্জ্বল ভাই মৃদু হাসলেন। বললেন,
” হয় হয়। মাঝে মাঝে দেখি তুই ভীষণ বো’কা বো’কা কথা বলিস। ”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের মুখে বো’কা সম্বোধন শুনে খানিক রাগ হলো বটে। ফলে উনাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আমিও উনার দিকে ঘুরে বসলাম। অতঃপর চোখমুখ কুঁচকে কিঞ্চিৎ রাগত স্বরে বললাম,
” আমাকে বো’কা বললেন কেনো! কি এমন করলাম আমি?”
” করেছিস করেছিস। অনেক বো’কা’মো করেছিস। একদিন সময় করে সব বলবো।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিলাম। বৃষ্টির বেগ এতোক্ষণে পূর্বের তুলনায় বেশ কমে এসেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মাঝে একেবারেই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। দূরে কোথাও তখন অবিরাম বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু এখানে খুব একটা শব্দ আসছে না।
মিনিট খানেকের মাঝেই বৃষ্টি প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টিতে ভিজে তৃপ্তি পাওয়া যায় না বলে এখন রুমে ফেরার তাগাদা অনুভব করলাম৷ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইকে বললাম,
” চলুন। এখন তো বৃষ্টি নেই তেমন। রুমে যাই। ”
এই বলে আমি উঠতে নিলাম। কিন্তু তৎক্ষনাৎ প্রোজ্জ্বল ভাই আমার হাত ধরে আমাকে পূর্বের ন্যায় বসিয়ে দিলেন। বললেন,
” এখনো বৃষ্টি থামেনি চন্দ্রিমা। তাহলে যেতে চাইছিস কেনো?”
” এই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে তৃপ্তি পাওয়া যায় না, ভালো লাগে না৷ তাই চলে যেতে চাইছি। আপনিও চলুন। আজ নির্ঘাত আপনার ঠাণ্ডা লাগবে। ”
বলেই আমি পুনরায় উঠতে চাইলাম। কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে আবারোও যেতে বাঁধা দিলেন। আর এবার আমার হাতটা পূর্বের চেয়েও বেশ শক্ত করে ধরলেন। লক্ষ্য করলাম, প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের চাহনিপরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। নিষ্পলক ও গম্ভীর চাহনিতে উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। দেখে অবাক হলাম, এ বৃষ্টির মাঝেও উনি কি করে চোখের পলক ফেলছেন না। যদিও বৃষ্টির গতি একেবারেই কম এখন৷ তবুও এ মুহূর্তে উনার নিষ্পলক চাহনি দেখে আমি বেশ অবাক হলাম।
প্রোজ্জ্বল ভাই আমার হাত ওভাবেই ধরে ধীরলয়ে বললেন,
” কিন্তু আমি তৃপ্তি পাচ্ছি। এ বৃষ্টিতে ভিজেও আমি তৃপ্তি পাচ্ছি। আজ অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে এ বৃষ্টিতে ভিজে। ”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এরূপ কণ্ঠ শুনে আমার বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। সাথে বুকের মাঝে মৃদুস্বরে ঢিপঢিপ আওয়াজ বাড়তে লাগলো। উনার এমন চাহনি ও কণ্ঠস্বর মোটেও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলাম না। ফাঁকা একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম,
” প্রোজ্জ্বল ভাই, আমাদের এখন যাওয়া উচিত। ”
এই বলে আমি দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘোরাতে লাগলাম। এ মুহূর্তে উনার দৃষ্টি বরাবর দেখার দুঃসাহস নেই আমার।
প্রোজ্জ্বল ভাই আমার হাত ছেড়ে দিলেন। তবে অকস্মাৎ এমন একটি কাজ করে বসলেন তা কল্পনাও করিনি আমি। উনি হঠাৎ আমার গলায় হাত ঘেঁষে মাথার পিছনের খোলা চুলে হাত রাখলেন। অতঃপর পিছনের চুলগুলো খানিক জোরে চেপে ধরে অকস্মাৎ নিজের দিকে আমায় টেনে নিলেন। উনার এমন আচরণে মুহূর্তেই মনে হলো, আমার প্রাণপাখি এই বুঝি বুকের খাঁচা থেকে উড়ে পালালো। এমন পরিস্থিতি আমি আর কথা বলার মতো অবস্থায় রইলাম না। মনে হলো যেনো আমার মুখখানা কেউ আটকে দিয়েছে।
প্রোজ্জ্বল ভাই পূর্বের ন্যায় বললেন,
” আমাদের বিয়ের একমাস পূর্ণ হতে আর বেশিদিন নেই। তুই এখনও আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করিস কেনো চন্দ্রিমা? শুধু নাম ধরে ডাকা যায় না?”
বলতে মন চাইলো, এতো দীর্ঘ সময়ের অভ্যাস কয়েক সপ্তাহে কি করে বদলানো সম্ভব। কিছু সময় তো প্রয়োজন! কিন্তু আমার মুখ ফুটে কোনো কথাই বের হলো না।
প্রোজ্জ্বল ভাই অনেকক্ষণ কথা বললেন না। আমার দিকে অবিরত চেয়ে রইলেন। এদিকে উনার এরূপ চাহনি ও আচরণ আমার মাঝে প্রচণ্ড অস্বস্তির উদ্রেক ঘটালো। কারণ উনাকে আমি এ রূপে দেখে অভ্যস্ত নই। আর পূর্বে আমাদের যে সম্পর্ক ছিলো তা হতে আকস্মিকভাবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে পদার্পণ করলেও ভেতরের অনুভূতিগুলো সেই আগের মতোই আছে। অন্ততপক্ষে আমার ক্ষেত্রে এখনও আমাদের সম্পর্ক আগের মতোই আছে। হ্যাঁ, আমি মেনে নিতে চেষ্টা করেছি বহুবার। কিন্তু এ জটিল সম্পর্ককে পুরোপুরি মেনে নিতে আমার হয়তো আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন।
প্রোজ্জ্বল ভাই কোনোরূপ কথা ছাড়াই অপর হাত দিয়ে আমার থুতনি ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলেন। এবার না চাইতেও উনার দৃষ্টি বরাবর আমার দৃষ্টি পড়লো। বুকের মাঝে ধীরেধীরে চলা সেই ঢিপঢিপ আওয়াজের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক হারে স্পন্দন দিতে শুরু করলো। প্রোজ্জ্বল ভাই বুঝি আমার এ অবস্থা আঁচ করতে পারলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” ভয় হচ্ছে?”
আমি শুধু মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক জবাব দিলাম। উনি মৃদু হাসলেন। তবে এ হাসি সবসময়কার মতো স্বাভাবিক বোধ হলো না আমার। প্রোজ্জ্বল ভাই আর কথা বাড়ালেন না। ধীরেধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমাদের দুজনের মধ্যকার দূরত্ব কমতে লাগলো। বুঝতে পারলাম উনি কি করতে চাইছেন। কিন্তু আমি যে এসবের জন্য এখন প্রস্তুত না। এদিকে উনাকে যে বাঁধা দিবো সে শক্তিটুকুও এ মুহূর্তে পাচ্ছি না।
হঠাৎ কাছেই কোথাও বাজ পড়লো বোধহয়। অকস্মাৎ এ শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। সাথে সাথে প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলেন৷ একদিকে বাজ পড়ার শব্দে ও অন্যদিকে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কাছে আসায় বুকের ঢিপঢিপ শব্দ সুস্পষ্টভাবে কানে ভেসে এলো। আজ বুঝি এই অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দনের জন্যই আমি ম’রে যাবো!
আমি আর দেরি করলাম না৷ দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে আর ফিরেও তাকালাম না। দ্রুত ছাদ থেকে নেমে সিঁড়িতে পা রাখলাম। কিন্তু পরনের পোশাক হতে পানি পড়ে সিঁড়ি পিচ্ছিল হওয়ার কারণে ও দ্রুততার জন্য কয়েক সিঁড়ি যেতে না যেতেই ধাপ করে পড়ে কয়েক সিঁড়ি এগিয়ে গেলাম। কেমন করে পড়লাম জানি না। কিন্তু পড়ে যাওয়ার পর পায়ের গোড়ালি আর কোমড়ে প্রচণ্ড ব্যাথা পেলাম। মনে হলো কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ব্যাথা পুরো শরীরে ছড়িয়ে গেলো। খানিক শব্দে গোঙানি দিয়ে ডান পা চেপে ধরলাম। এভাবে যে পড়ে যাবো তা ভাবিইনি। আজ বুঝি প্রকৃতি আমার সাথে নেই। আচ্ছামতো খেলছে আমার সাথে।
” পড়ে গেলি কি করে!”
অকস্মাৎ পিছন হতে প্রোজ্জ্বল ভাই এই বলতে বলতে আমার সামনে এসে উপস্থিত হলেন না। উনি আসার সাথে সাথে আমি দৃষ্টি নত করে ফেললাম। কিছুক্ষণ পূর্বেই যে ঘটনা ঘটিয়েছেন উনি তাতে উনার দিকে এ মুহূর্তে তাকানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি নত দৃষ্টিতেই বললাম,
” বৃষ্টির পানির কারণে সিঁড়ি পিচ্ছিল হয়ে ছিলো। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস? দেখি, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতো। ”
এই বলেই প্রোজ্জ্বল ভাই আমার অপর হাত ধরে আমায় উঠতে সাহায্য করলেন। আমিও উনার হাত চেপে ধরে উঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একটু চেষ্টা করতেই ব্যর্থ হলাম। অনুভব করলাম, গোড়ালিতে ব্যাথা পাওয়ার সাথে পা মচকিয়েও গিয়েছে। ফলে উঠার প্রচেষ্টায় বেশ ব্যাথা পেলাম। ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম আমি। ওদিকে আবার কোমড়ের ব্যাথা। আল্লাহ! আজ সব অঘটন একসাথে হচ্ছে কেনো!
প্রোজ্জ্বল ভাই বললেন,
” বুঝেছি, পা মচকিয়ে ফেলেছিস। এখন সিঁড়ি বেয়ে নামা সম্ভব না। ”
বলেই উনি আমায় আরেকদফা অবাক করে দিয়ে পাঁজাকোলে তুলে নিলেন। পূর্বের ন্যায় উনার এ কাজেও আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। ভাবলাম, আশ্চর্য! আজ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের হয়েছে কি!
প্রোজ্জ্বল ভাই আমায় নিয়ে বেশ ধীরেসুস্থে সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। যেহেতু উনিও ভেজা অবস্থায় আছেন, সেহেতু সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় উনি অনেক সতর্কতা অবলম্বন করলেন।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই গলা উঁচু করে মামি ও নানুকে ডাকলেন উনি। অতঃপর আমায় নিয়ে পা দিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে রুমে প্রবেশ করলেন। খাটের কাছে নিয়ে আমাকে নামাতে চাইলে আমি সাথে সাথে দু হাত দিয়ে উনার গলা শক্ত করে জড়িয়ে বললাম,
” না না, বিছানায় না। এই ভেজা কাপড় নিয়ে বিছানায় নামাবেন না। চাদর, তোষক সব ভিজে যাবে। আপনি ঐ চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে নামিয়ে দিন আমাকে। ”
উনি আমার কথা মতো চেয়ারটা একটু এগিয়ে এনে আমাকে কোল থেকে নামালেন। অতঃপর ধীরেসুস্থে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। ততক্ষণে মামি ও নানুও রুমে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের পিছনে মামাও ছিলেন। কিন্তু হয়তো উনি আমাকে ভেজা পোশাকে দেখে রুমে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এদিকে মামি দ্রুত রুমে ঢুকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” হঠাৎ ডাকলি কেনো? আর তোরা এমন ভেজা কাপড়ে কেনো প্রোজ্জ্বল?”
আমাদের জবাব দেওয়ার আগেই নানু বললেন,
” দেখো, মনে হয় বৃষ্টিতে ভিজেছে দুইজন।
কি ব্যাপার? তোরা বৃষ্টিতে ভিজেও কাপড় না বদল করে বসে আছিস কেনো?”
প্রোজ্জ্বল ভাই আমার দিকে তাকিয়ে কোমড়ে দু হাত রেখে বললেন,
” তোমার গুণধর নাতনি সিঁড়িতে পড়ে পা মচকিয়ে এসেছে। ”
মামি ও নানু তৎক্ষনাৎ বিস্মিত কণ্ঠে হায় হায় করতে লাগলেন। মামি জিজ্ঞেস করলেন,
” সে কি! পড়লি কি করে?”
” ঐ যে বৃষ্টির পানির জন্য সিঁড়ি পিচ্ছিল ছিলো। ম্যাডাম চোখ দুটো কপালে তুলে ঐ পানি না দেখেই নেমেছে বোধহয়। ”
” আচ্ছা আচ্ছা। যেভাবেই পড়িস না কেনো এখন গিয়ে মাথা মুছে কাপড় বদলিয়েনে। নাহলে জ্বর এসে যাবে তো। কতক্ষণ ধরে ভেজা অবস্থায় আছে কে জানে!”
” ওকে এখানেই চেঞ্জ করিয়ে দাও মা। ও বোধহয় ওয়াশরুম পর্যন্ত যেতে পারবে না। আমি ওর রুমে গিয়ে চেঞ্জ করি। ”
এই বলে প্রোজ্জ্বল ভাই আমার মামির দিকপ একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন এবং অপর একটা তোয়ালে আর একটা টিশার্ট, প্যান্ট নিয়ে নিজে আমার রুমে চলে গেলেন। আর মামি তোয়ালে নিয়ে আমার মাথা মুছতে লাগলেন।
————-
ঘড়িতে সময় এখন রাত দশটা। আমি আর প্রোজ্জ্বল ভাই আমাদের রুমে বিছানায় পাশাপাশি বসে আছি। নানু বসে আছে চেয়ারে। আর মামি আমাদের দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে প্লেটে ভাত মাখাচ্ছেন। উনি এখন আমাদের দুজনকেই নিজ হাতে খাইয়ে দিবেন। যদিও আমাদের দুজনের এ মুহূর্তে খাওয়া নিয়ে চরম অনাগ্রহ কাজ করছে। কারণ দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভেজার ফলে আমার শরীর বেশ ম্যাজম্যাজ করতে থাকে। একারণে মামি কয়েকবার বলার পরও আমি রাতের খাবার খেতে চাইনি। আবার প্রোজ্জ্বল ভাইয়েরও খেতে মন চাইছিলো না। রাতের খাবারের প্রতি আমাদের দুজনের এ অনাগ্রহ দেখে মামি শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেয়, আজ জোর করে হলেও দুজনকে রাতের ভাত খাইয়ে ছাড়বে।
মামি ভাজি দিয়ে ভাত মাখিয়ে প্রথমে আমার গালে ভাত তুলে দিলেন। এরপর দিলেন প্রোজ্জ্বল ভাইকে। দুবার গালে ভাত তুলে দেওয়ার পর মামি বললেন,
” দেখেন আম্মা, এই বুড়ো বয়সে এসেও এদের খাওয়াতে হয়। কি কপাল আমার! বুড়ো বুড়ো সব পোলাপান পালি আমি। ”
মামির কথায় নানু হো হো করে হেসে উঠলো। বললো,
” স্মৃতিচারণা করতেছো আরকি। দাও দাও খাওয়ায় দাও ওদের। আর কয়দিন পর তো নাতি নাতনিদের খাওয়াবো।”
সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশটা নানুর শেষোক্ত কথায় মুহূর্তেই বিগড়ে গেলো। বিরক্ত হলাম আমি। না মানে আজ কি কিছুই আমার পক্ষে হবে না! আশ্চর্য!
ছাদে হওয়া ঐ ঘটনার রেশ ধরে নানুর কথায় বেশ অস্বস্তি অনুভব হলো। এ অস্বস্তিকর অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসতে তৎক্ষনাৎ চোখমুখ কুঁচকে মামিকে বললাম,
” আমি তো বলিনি খাইয়ে দিতে। আপনি শুধু প্রোজ্জ্বল ভাইকেই খাইয়ে দিতেন। শুধু শুধু আমার দোষ দিচ্ছেন। হুহ……”
আমার কথায় মামি বিস্মিত হয়ে বললেন,
” এখনও ওকে ভাই ডাকিস! হায় রে মেয়ের কাণ্ডজ্ঞান! ও কি এখন আর তোর প্রোজ্জ্বল ভাই আছে না কি? ”
নানুও যোগ দিয়ে বললেন,
” মেয়ের বুদ্ধিজ্ঞান নাই। স্বামীরে ভাই বলে কোন মেয়ে! নাম ধরে ডাকবি। ”
দুজনের কথায় আমার অবস্থা নাজেহাল হলো। আরো একবার প্রমাণিত হলো, আজ ভাগ্য আমার বিপক্ষে। সন্ধ্যায়ও তো প্রোজ্জ্বল ভাই এ কথা বললেন। আর এখন মামি আর নানুও!
আমি আড়চোখে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম আমার এ পরিস্থিতিতে উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছেন। যেনো আমার এ পরিস্থিতি দেখে উনি ভীষণ মজা পেয়েছেন। বেশ রাগ হলো আমার। তখন যে জবাবটা দিতে পারিনি তা এখন দিলাম আমি। বললাম,
” এতো সহজে উনার নাম ধরে ডাকবো কি করে। সেই ছোট থেকে উনাকে ভাই ডাকি। আর বিয়ে হলে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। একটু সময় তো লাগবে উনাকে নাম ধরে ডাকতে। ”
নানু বললো,
” নাম ধরে ডাকতে এতো সমস্যা হলে বলবি, ওগো শুনতেছো। আর আজকালকার মেয়েরা কি যেনো বলে… বাবু শুনতেছো, সোনা শুনতেছো।”
নানুর এহেন সম্বোধনগুলো শুনে আমি প্রায় বাকহারা হয়ে পড়লাম। তবে সাথে সাথে ভারী বিস্মিত কণ্ঠে বললাম,
” আস্তাগফিরুল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ। এসব কি বলো নানু! ওসব নামে ডাকতে যাবো কেনো! ছিঃ।”
” দেখো, মেয়ে আবার ছিঃ বলে। আদর করে ডাকবি এসব। সোনা, বাবু, ময়না।”
এই বলে নানু হো হো করে হেসে উঠলো। আর প্রোজ্জ্বল ভাই ও মামিও সশব্দে হেসে উঠলেন। এদিকে উনাদের এ হাসি দেখে মনে হলো, এক্ষুণি এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।
®সারা মেহেক
#চলবে
/