-তোর নাভীর উপরের গাড় নীল তিলটা সবাইকে দেখানোর খুব শখ তাইনা?তোকে না কতো বার বলেছি বিয়ে বাড়িতে এই মশারী মার্কা অদ্ভুত দেখতে পোশাক টা না পড়তে।
দাঁত কিড়মিড় করতে করতে কথাগুলো বলল মৃদুল।
এদিকে মৃণাল মনে মনে মৃদুলকে একশো একটা গালি দিয়ে ভাসিয়ে ফেলছে।তবে মুখে বলল,
-শাড়ির আঁচল টা বাতাসে সরে গিয়েছিলো বুনোভাই।
মিনমিন করে বলল।
মৃণালের জবাব শোনার আগেই মৃদুল হনহন করে হেঁটে চলে গেলো ওখান থেকে।
এদিকে মনের ইচ্ছে মতো মৃদূলের গোষ্ঠী উদ্ধার করছে মৃণাল।
পুরো বিয়ে বাড়িতে যেনো সে একাই শাড়ি পরেছে, আর তার যেনো একাই শাড়ির আঁচল সরে গেছে।আর তাছাড়া সে তো আর ইচ্ছে করে এ শাড়িটা পরে নি মৃন্ময়ীদি দিয়েছে বলেই তো সে এ শাড়িটা পরেছে।আর তাছাড়া ওর তো বিয়ে বাড়িতে পড়ার মতন ভালো কোনো শাড়ি নেই তাইতো এই নেটের ওপর কাছ করা শাড়িটা সে পড়েছে। কি এক অদ্ভুত মানুষ বুনোভাই তার কোনো কিছুই মৃণাল বুঝতে পারেনা শুধু সে কেনো বুনোভাই নিজেও হয়তো নিজেকে ঠিকঠাক বুঝতে পারেনা তেমনটাই মনে হয় তার।
-কিরে এখানে এমন খাম্বার মতন দাঁড়াই আছিস কেন?মামি কতোক্ষণ ধরে তোকে খুঁজছে জানিস।
পলির কথায় মৃণাল পাশ ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কেন মামীর আবার কি দরকার?
-জানি না রে সঠিক। তবে মনে হয় মৃন্ময়ী আপুর কোনো কিছু হারিয়ে গেছে তাই তোকে খুঁজছে সবাই।
মৃন্ময়ীর কিছু হারিয়ে গেছে শুনে বুকের ভেতর টা কেমন ধ্ক করে উঠলো মৃণালের।আজ তার কপালে যে বড়সড় দুঃখ আছে তা সে এখনই বুঝতে পারছে।
তবুও সে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে মামীদের ঘরের দিকে গেলো।
—————————————
-ওইযে এসেছে নবাবের বেটি।শাড়িটারি পরে পটের বিবির মতন ঘুরে বেড়াচ্ছেন উনি।
-আহ্ মা চুপ করো।বিয়ে বাড়িতে অনেক মানুষ, কে কোন কথা শুনে কি থেকে কি বানাবে তার কোনো হদিস ও পাবা না তুমি।তুমি মৃণালকে যা জিজ্ঞেস করার শুধু সেটুকুই করো।শুধু শুধু বাড়তি কথা বলো না তো।
মুখের মেক-আপ ঠিক করতে করতে কথাগুলো বললো মৃন্ময়ী।
মোবাশ্বেরা আহমেদ মেয়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে একবার তাকালেন কিন্তুু মৃন্ময়ী ভাবলেশহীন ভাবেই নিজের কাজ করছে।তাই তিনি মৃণালকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-তোকে যে সকালে বলেছিলাম মৃন্ময়ীর গহনার বাক্সটা আলমারিতে তুলে রাখতে সেটা রেখেছিলি?
– হ্যাঁ মামী রেখেছিলাম।
-আমি যখন তোকে বাক্সটা দিয়েছিলাম তখন বাক্সে যতোগুলো গয়না ছিলো এখন তার মধ্যে কয়েকটা গয়না খুঁজে পাচ্ছি না।ওগুলো কোথায় মৃণাল।
-আমি কি করে জানবো মামী। তুমি বাক্সটা যেভাবে দিয়েছো আমিতে সেভাবেই ওটা আলমারিতে রেখে দিয়েছি।
অবাক গলায় বলল মৃণাল।
-ও তাই বুঝি, তহলে হয়তো গয়না গুলোর হাত পা গজিয়েছে তাই ওগুলা নিজে নিজে হেঁটে চলে গেছে।কিরে বল।
রাগান্বিত গলায় বলল মোবাশ্বেরা আহমেদ। (মামী)
মামীর ধমকে কেঁপে উঠে মৃণাল তারপর আবারও সে বলে,
-গয়না গুলো কিভাবে হারিয়েছে তা সে সত্যি সত্যিই জানে না।
কিন্তুু মৃণালের এই কথা মানতে নারাজ তার মামী।সে নিশ্চিত ভাবে বলছে এই গহনা হারানোর পিছনে মৃণালেরই হাত আছে।
মামীর মুখে চোর অপরাধ পেয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে মৃণাল।কিন্তুু অদ্ভুত বিষয় হলো তার এই কান্নায় কারো মন গলছে না।উপরন্তু মোবাশ্বেরা আহমেদ মৃণালের চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে হিঁচড়ে আলমারির সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে উচ্চস্বরে বলেন,
-কোথায় গয়না, এখানে তো সব গয়না নেই,তুই নিজের চোখেই দেখ,আমি কি মিথ্যে বলছি।
-মামী আমি সত্যি জানি না গয়না গুলো কীভাবে হারিয়েছে কিন্তুু বিশ্বাস করো আমি গয়না চুরি করি নি।
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছে মৃণাল।
মৃণালের এই কান্না নাটক মনে হচ্ছে মোবাশ্বেরার কাছে।আর অন্যদিকে মেয়ের বিয়ের গয়না গুলো না পেয়ে তার পুরো মাথা গরম হয়ে আছে।রাগে তার শরীর রি রি করে জ্বলছে।এক পর্যায় মৃণালের গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দেন তিনি তারপর ক্রুদ্ধ গলায় বলেন,
-জন্মের সময় নিজের মাকে তো খেয়েছিস, নিজের বাপও ত্যাগ করে দিয়েছে তোকে।আর আমরা যারা কিনা এতোদিন তোকে লালন করলাম তাদের বুকেই ছুরি ঢুকালি তুই।আবার এখন বারবার অস্বীকার করছিস।এজন্যই বলে “চোরের মায়ের বড় গলা।”
মামীর মুখের শেষ কথাটি শোনার পর মৃণালের মাথা ভনভন করে ঘুরছে।বাড়ি ভর্তি মেহমান আত্মীয় স্বজনদের সামনে তার আপন মামী তাকে এমন ভাবে অপমান করতে পারলো তা ভাবতেই সে যেনো মরমে মরে যাচ্ছে। তার চোখের কোনের পানিও যেনো আটকে গেছে আজ। সে কোনোরকম ভাবে নিজেকে সামলিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় মামীর ঘর থেকে।ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ই সে ধাক্কা খায় মৃদুলের সাথে।মৃদুল মৃণালের এমন উদভ্রান্ত চেহারা দেখে মুহুর্তেই যেনো থমকে যায়।একটু আগেও সে মৃণালের মুখে দীপ্তিময় হাসি দেখেছিলো।এখন সে মুখেই ঘন কালো অন্ধকার দেখছে সে।মৃদুল কিছু বলার আগেই মৃণাল ছুটে চলে গেলো।
মৃণাল আর মামীর মধ্যেকার ঝামেলা দেখেই মিলি দৌড়ে গিয়েছিলো মৃদুলকে ডাকতে।মিলির কথা শুনে মৃদুল
তক্ষনাত ছুটে আসে।সে যখন আসে তখনই এ গঠনা।সে দ্রুত পায়ে হেঁটে মোবাশ্বেরার ঘরে ঢুকে।
-কি হয়েছে মা।মৃণাল এভাবে ছুটে চলে গেলো কেনো?
মৃদুলের গলা শুনে মোবাশ্বেরা আহমেদ কিছুটা হকচকিয়ে যান কিন্তুু পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে ওনি বলেন,
-আর বলিস না মৃদু ওকে কাকে মৃন্ময়ীর বিয়ের গয়নার বাক্সটা তোর দাদি দিয়ে বলেছিলো ঠিকঠাক ভাবে আলমারিতে তুলে রাখতে ।
এখন একটু আগে মৃন্ময়ীকে গয়না গুলো পরিয়ে দেখবো বলে আলমারি খুলে বাক্সই দেখি অনেকগুলো গয়না নেই। ওকে জিজ্ঞেস করলাম হয়না কই রাখছিস ফেরগ দে।কিন্তুু কে শোনে কার কথা। ও মেয়ে বলে ও নাকি কিছুই জানেনা।তাই কষিয়ে দিয়েছি দুটো।
-মা ও যাই করুক না কেনো তাই বলে তুমি বাড়ি ভর্তি আত্মীয় কুটুমের সামনে ওকে এভাবে অপমান করতে পারো না।
-রাখ তোর আত্মীয় কুটুম।বিয়ের গয়না গুলো না পেলে আমাদের মান সম্মান সব যাবে।
-দাদি বা বাবা যদি তোমার মৃণালের প্রতি এমন আচরণের কথা শুনে তাহলে কি করবে তা একবার ভেবেছো তুমি।
-দেখ মৃদুল ও অন্যায় করেছে তাই আমি শাসন করেছি।এটা যদি আমার দোষ হয় তাতে আমি কী করবো বল।
-মা ও অন্যায় করুক আর যাই করুক তাই বলে তুমি ওর গায়ে হাত তুলতে পারোনা।।
বলেই হনহন করে রেগে বেড়িয়ে গেলো মৃদুল।
মোবাশ্বেরা আহমেদ রাগের বশে মৃণালের গায়ে হাত তুললেও এখন মনে মনে এ কাজের জন্য ভয় পাচ্ছেন তিনি।যদি সত্যি মৃদুলের বাবা আর দাদি এর জন্য তাকে শাস্তি দেন তাহলে কী হবে।তা ভেবেই তিনি একটা ফাঁকা ঢোক গিললো।এদিকে ঘরে এতোকিছু ঘটে গেলো কিন্তুু এর কোনো প্রভাবই যেনো মৃন্ময়ী কে স্পর্শই করে নি এমনই মনে হচ্ছে মোবাশ্বেরা আহমেদ এর।
————————————————-
অন্ধকার ঘরে এলোমেলো চুল খুলে মায়ের একটা পুরোনো শাড়ি বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে মৃণাল।সে কান্নায় কোনো তীব্র শব্দ নেই,আছে একরাশ অভিযোগ, অভিমান,আর গভীর ভালোবাসার ছোঁয়া। না সে নিজের মাকে কখনো জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে,না বাস্তবে তাকে দেখেছে,শেষবার বাবার বাড়ি গিয়ে মায়ের এই পুরোনো শাড়িটা সে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলো।যখনই তার মন ভালো হয় তখন সে এই শাড়িটা পরে নিজেকে আয়নায় দেখে ঠিক যখনই তার কষ্ট হয় তখন এ শাড়ি বুকে আঁকড়ে ধরে সে কাঁদে,অভিযোগ করে,আবার উত্তর না পেয়ে অভিমানও করে এ শাড়ির সাথে।যেনো এটাই তার সত্যি কারের মা।সেই ছোট্ট থেকে সে এবাড়িতে বড় হয়েছে নানুমনি আর মামা ছাড়া কেউই তাকে তেমন পছন্দ করেনা।মামীতো পান থেকে চুন খসলেই কথা শোনায়,তবুও সে পরে আছে এখানে কারণ তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।তার বাবাও তাকে চায় না বড় অসহায় লাগে নিজেকে তার।এই এতো অসহায়ত্বের মাঝেও তার জীবনে এক ফালি মিষ্টি রোদ্দুরের মতন এসেছিলো তার বুনোভাই।এই একটি মানুষ ছিলো তার এবাড়িতে নানুমনি আর মামা ছাড়া গল্প করার মতন।যার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সে নানারকম আজগুবি গল্পে মেতে থাকতো তার সাথে,তার সব আবদার পূরন করার ভান্ডার ছিলো সে।কিন্তুু ওই যে কথায় আছে না অভাগী যেদিকে সেদিকেই বিলের পানি শুকায়।তার জীবনেও সেই এক ফালি রোদ্দুর মেঘের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে আজ।এখন আর সে দৌড়ে গিয়ে বুনোভাইয়ের কাছে কোনো আবদার করতে পারেনা, ঘন্টার পর ঘন্টা তো দূরস্থ তার সাথে ঠিকঠাক করে কথাও বলার সুযোগ পায় না সে।
এসব নানারকম কথা ভাবছে সে তখনই কেউ ঘরের দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। তারপর নরম গলায় বলল,
-মৃণালিনী,,,,,,
কেমন হলো জানাবেন প্লিজ ☺
চলবে,,,,,,
#সূচনা_পর্ব
#বুনোভাই
#লেখনীতে_তিথি_মজুমদার