#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ৬)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
“গতকাল ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলে, এটা কিভাবে অস্বিকার করবে ভাবিজি?”
এতোক্ষণ ঘুমের ভান ধরে থাকলেও একবার শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসে আরশি। রুমকি ক্ষনিকটা মুচকি হেসে বলে,
“আমি কিন্তু দেখেছি সব। ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলে, আর ভাইয়া কত যত্ন করে মেহেদী এঁকে দিচ্ছিল। ইশ, প্রেম জ্বমে একদম ক্ষির।”
বলেই হেসে উঠে রুমকি। আরশি কিছু বলতে চাইলেও রুমকি পূনরায় বলে,
“আজ অস্বীকার করেও কোনো লাভ নেই ভাবি। আজ কিন্তু প্রমানও আছে আমার কাছে।”
আরশি কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে,
“ক, কি প্রমান?”
রুমকি ফোন বের করে ভোর বেলায় লুকিয়ে তোলা ছবি গুলো দেখিয়ে বলে,
“এবার বলো, এটাও এডিট।”
আরশি জ্বিভ কামরালো ক্ষনিকটা। ঘুমের ঘোরে রিদ ভাইয়ের বুকের উপর মাথা রেখেই শুয়েছিল, অথচ টেরই পায়নি সে। কি লজ্জা জনক একটা পরিস্থিতি পার করেছিল ভাবা যায়? এখন এটা ভাবতেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার। না, এই লজ্জা নিয়ে আর রিদ ভাইয়ের সামনে দাড়ানো যাবে না। কিছুতেই না।
আরশি এবার রুমকির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“ছবি গুলো ডিলিট করে দে বইন। তোকে আমি বিশ টাকা দিমু।”
রুমকি একটু ভাব নিয়ে বলে,
“জীবনেও না।”
“পঞ্চাশ টাকা দিমু।”
রুমকি আবারও দু’দিকে মাথা নাড়ালো। আরশি এবার কিছুটা কাঁদু ভঙ্গিতে বলে,
“একশ টাকা দিমু।”
রুকি এবার ফোন হাতে উঠে গিয়ে বলে,
“এক হাজার টাকা দিলেও এই ছবি গুলো ডিলিট হবে না ভাবি। তাছাড়া আমার ফোনে খুব যত্ন করে রাখা ছবি হবে এগুলো। আমার একমাত্র ভাইয়া ও ভাবির রোমান্টিক ছবি। ইশ কথাটার মাঝেও যেন অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে, তাি না ভাবি?”
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো সন্ধার পর। পুরো বাড়ি মেহমানে পরিপূর্ণ। এদিকে পার্লার থেকে দুটো মেয়ে এসেছে। রুহি আপুকে সাজাতে ব্যস্ত তারা।
আরিশা আপু, রুমকি, আরশি শাড়ি পড়তে ব্যস্ত। এর আগে অনেকবার মায়ের শাড়ি পড়েছিল আরশি। তাই মোটামুটি ধরণা আছে। অপর দিকে রুমকি শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে আরিশা আপু পড়িয়ে দিবে বলে।
আজ সারাদিনে ভুলেও আর রিদের সামনে যায়নি আরশি। মেহেদী রাঙা হাতের দিকে তাকাতে রুমকির দেখানো ছবি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার। ইশ গতকাল রাতে ঘুমের ঘোরে কি ভয়ঙ্কর লজ্জাজনক কাজটাই না করে ফেলেছে সে। এই জন্যই হয়তো বেশি ঘুমকাতুর হওয়ার কারণে মা তাকে মাঝে মাঝে ঘুমের কুমির বলে ডাকে।
শাড়ি পরে আপুদের পেছন পেছন হেটে যেতেই হুট করে কে যেন এক হাত টান দিয়ে কিছুটা আড়াল করে নিল। কিছুটা চমকে দেওয়ালের সাথে হেলান দেওয়া অবস্থায় চোখ বুঁজে নিল আরশি। চোখ খুলতেই দেখে রিদ দুই হাত দেওয়ালে রেখে আবদ্ধ করে রেখেছে তাকে।
পিটপিট করে রিদের দিকে তাকাতেই রিদ তার দিকে চেয়ে থাকা অবস্থায় শান্ত গলায় বলে,
“সারাদিন আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? কি মনে হয়, ব্যস্ততার কারণে আমি কিছুি বুঝতে পারিনি?”
এই মুহুর্তে কেন জানি অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে আরশির। কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল সে। রিদ নিরব দৃষ্টিতে তাকে ভালোভাবে দেখে বলে,
“শাড়িতে তো তোকে একদম বউ বউ লাগছেরে পিচ্চি।”
লাজুকতার আভা ভেসে উঠে আরশির মুখে। সাথে কেন যেন দম বন্ধ অনুভূতি বেড়েছে তার। ইচ্ছে করছে নিজের সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করে সামনে থাকা ব্যাক্তিকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দৌড়ে দুরে কোথাও লুকিয়ে কিছুক্ষণ প্রান ভরে নিশ্বাস নিতে। সেটাও পারছে না। পারছে শুধু দাড়িয়ে নিরবতা পালন করতে।
রিদ পূনরায় বলে,
“শুন, আর কখনো কিন্তু শাড়ি পরে আমার সামনে দাড়াবি না। কারণ স্বপ্ন পূরণের আগে এত সুন্দর পিচ্চি বউ রেখে হার্টঅ্যাটাক ফ্যাটাক করে মরার ইচ্ছা নেই আমার।”
এটাই জীবনের সব থেকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মনে হচ্ছে আরশির। একে তো আজ লোকটাকে দেখলেই মেহেদী পরানোর সেই লজ্জাজনক অবস্থার কথা মনে পড়ছে, দ্বিতীয়ত ওদিকে আপু রুমকি এরা তাকে রেখেই কি কি করে ফেলছে কে জানে।
কি করবে ভাবতে ভাবতে হটাৎ আরশির দৃষ্টি পরে রিদের গায়ে থাকা পাঞ্জাবিটার দিকে। যেটা শপিংমলে রিদকে দেখিয়ে আরশি বলেছিল, এটা আপনাকে দারুন মানাবে।
কিন্তু রিদ পছন্দ হয়নি বলে নেয়নি সেটা। তাহলে এটা আবার নিয়ে আসলো কখন? আর আশে পাশের সবাই ব্লেজার পরলেও রিদ সেই পাঞ্জাবিটাই পরেছে। এতোক্ষণের সব জড়তা ভুলে কৌতুহলী কন্ঠে আরশি বলে উঠে,
“এটা নিয়েছিলেন আপনি!”
রিদ শান্ত দৃষ্টিতে ‘হুম’ সূচক চোখের পাতা ঝাপটিয়ে বলে,
“তোর পছন্দের কিছু কিভাবে ফেলে আসি বল?”
“আমার পছন্দ হলেই কি নিয়ে নিতে হবে?”
“হুম।”
“কেন?”
“পিচ্চি মেয়ে বুঝবি না।”
“বুঝিয়ে বললে বুঝবো। আমি এতটাও পিচ্চি না।”
আরশির এমন কৌতুহল দেখে রিদ শান্ত ভাবে বলে,
“শোন তাহলে, তোর পছন্দ হয়েছে মানেই সেটা দোকানের সবচেয়ে বাজে জিনিস। যেটা আর কারোরই পছন্দ হবে না। পছন্দ না হলে কেউ কিনবেও না। আর না কিনলে দোকানদারের লস হবে। তাছাড়া দেশের সম্পদ বিক্রি না হলে দেশে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হবে। আর দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হলে দেশ রসাতলে যাবে। আর দেশ রসাতলে গেলে আমারা সাধারণ মানুষরা না খেয়ে মরতে হবে। এখন তুই কি চাস তোর কারণে দেশের মানুষ না খেয়ে মরুক?”
কথার পিঠে কথা বলার মতো আরশিও দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“একদম না।”
রিদ এবার গাল টেনে দিয়ে বলে,
“এবার বুঝতে পেরেছিস?”
সত্যি বলতে আরশি রিদের এই রাষ্ট্রিয় চিন্তাভাবনার কিছুই বুঝেনি। কি শুনবে ভেবেছিল আর কি শুনলো। এমন কিছু শুনবে বলেও আশা করেনি সে। তাই আরশি দু’দিকে মাথা নেড়ে বলে,
“কিছুই বুঝলাম না।”
রিদ বার কিছুটা মুচকি হেসে আরশির নাক টেনে দিয়ে বলে,
“বলেছি না, পিচ্চি মেয়ে বুঝবি না।”
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
বরপক্ষ এসেছে কিছুক্ষণ হলো। কারো ডাকে পেছন ফিরে তাকায় আরশি। দেখে রুহি আপুর দেবর ফারুক। আরশি আজ চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে,
“কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বলুন। কাজ আছে আমার।”
ফারুক কিছুটা ঢং করে বলে,
“বেয়াইন কি কোনো কারণে রেগে আছেন আমার উপর? নাকি বিরক্তিবোধ করছেন?”
আরশি এবার ক্ষনিকটা স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“আচ্ছা বলুন কেন ডাকলেন?”
ফারুক এবার একটু জড়ো গলায় বলে,
“আপনার নাম্বার টা দিবেন? আত্মিয় তো হয়েই গেলাম আমরা। নাম্বার থাকলে মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ খবর নেওয়া যাবে।”
“আমি ফোন ইউজ করিনা।”
“কি বলেন বেয়াইন। এই যুগের মেয়ে হয়ে ফোন ইউজ করেন না?”
“না। আর করলেও আপনাকে নাম্বার কেন দিব? আমার খোঁজ নেওয়ার মানুষ আছে। আপনাকে কষ্ট করে আমার খোঁজ নিতে হবে না। আসছি, পরে কথা হবে।”
বলেই চলে যেতে চাইলে ফারুক পেছন থেকে হাত ধরে বলে,
“আরে বেয়াইন শুনুন। আত্মিয় দেখে এমনি বলেছিলাম। আমাকে আবার ভুল বুঝবেন না কিন্তু।”
আরশি হাতের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলে,
“হাত ছাড়ুন।”
ফারুক চুপচাপ হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
“স্যরি।”
আর কিছু বললো না আরশি। কিছুক্ষণ গম্ভির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো সেখান থেকে।
রুহিকে রেডি করে বিছানার চার পাশে বসে আছে মেয়েরা। একটু পর স্টেজে বরের পাশে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। রুহি চুপচাপ বসে আছে মাথা নিচু করে। পাশ থেকে রুমকি তার কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
“আপু, তোর বর তোকে নিতে এসেছে। আর সবাই তোকে দেখতে এসেছে। তোর লজ্জা লাগছে না আপু?”
রুহি চুপ করে রইল। রুমকি পুনরায় বলে,
“বল না আপু। কেমন লাগছে তোর?”
রুহি এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“চুপ থাক। বেশি বকবক করবি তো আমার কিউট একটা দেবর আছে না, ফারুক? কাকাকে বলবো, একদিনে তার সাথে তোরও শুভ কাজটা সেরে আমার সাথে পাঠিয়ে দিতে। তখন নিজেই বুঝবি কেমন লাগছে।”
রুমকি চুপচাপ উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। পাশ থেকে আরিশা আপু হেসে বলে,
“তোর এক কথায় বেচারির জবানই বন্ধ হয়ে গেছে।”
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
রুহিকে নিয়ে গেলো স্টেজে। আরশিকে ঘরে পাঠালো একটা টিসুর বক্স নিয়ে আসতে। বরের সামনে থাকা ওটা নাকি বাচ্চারা শেষ করে ফেলেছে। আরশি কিছুটা দ্রুত গতিতে ঘরে দিকে পা বাড়ালো। কিছুটা আড়ালে আসলে আচমকাই ফারুকের দুস্টুমি করে বাড়িয়ে দেওয়া পায়ের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে যেতেই ফারুক ধরে ফেলে তাকে। এক হাতে আরশির কোমর চেপে ধরে আছে ফারুক। কিছুটা হেসে বলে,
“এমন বেখেয়ালি ভাবে চললে কি হয় বেয়াইন।”
কিছু বলতে পারলো না আরশি। ফারুক এটা ইচ্ছে করেই করেছে বুঝতে একটুও সময় লাগেনি তার। শাড়ি পরা উন্মুক্ত কোমরে ফারুকের হাত অনুভব করতেই রাগে ও ভয়ে সারা শরির কাঁপতে শুরু করেছে তার।
আচমকাই কেউ একজন এসে আরশিকে টেনে একপাশে সরিয়ে নিল। তারপর এক মুহুর্তও দেরি না করে সজোরে একটা থা’প্পর বসিয়ে দিল ফারুকের গালে। আচমকাই এমন আঘাতে কিছুটা দুরে ছিটকে গেলো ফারুক।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এমন কিছু হয়ে গেলে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না আরশি। অতঃপর তীব্র রাগে ক্ষিপ্ত রিদকে দেখেই বুকটা ধুক করে উঠে তার। অবাক ভঙ্গিতে আচমকাই একহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে সে। হার্ট অসম্ভব রকম বিট করছে। এই ভয়টাই পেয়েছিল সে। নির্ঘাত এখন এই বিয়ের উৎসবে মেতে উঠা বাড়িতে ভয়াবহ রকমের ঝামেলা সৃষ্টি হতে চলছে। এতে রুহি আপুর বিয়ের কোনো ক্ষতি হবে না তো? কিছুই মাথায় আসছে না আরশির। শুন্য মনে হচ্ছে সব। শুধু অনুভব করতে পারছে হৃদপিণ্ডে মেতে উঠা ধুকপুক শব্দ।
To be continue……………..