#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব২৩
সদ্য বিকেল হওয়া আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আয়নায় নিজেকে আবার দেখে নিলো জেরিন।সাদা জামায় নিজেকে সাজিয়ে ফোন আর ব্যাগ হাতে খোলা চুলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো সে।মেইন দরজার কাছে যেতেই নাজমুন বেগমের কঠিন কন্ঠ ভেসে আসে।
—-“কোথায় যাচ্ছিস?”
জেরিন নিচুস্বরে বলে,
—-“মার্কেটে যাচ্ছি।”
নাজমুন বেগম কঠিন নির্দেশ দিলেন হাসান কে সাথে নিতে।নাজমুন বেগমের কথায় অবাক হলো জেরিন।সেদিনের ঘটনার আজ প্রায় ১মাস হতে চলেছে।জেরিনের ওমন আর্তনাদ ও কী নাজমুন বেগমের মন নরম করতে পারেনি তাহলে?
গাড়িতে বসে আছে জেরিন।পাশেই হাসান বসে আছে তার বিশ্রি হাসি নিয়ে।হাসানের অজানা স্পর্শের ড্রাইভার মুকবুল ইতি মধ্যে স্পর্শকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে জেরিনের হাসান আছে।জেরিন প্রথমে ভয় পেলেও মুকবুল ইশারায় ভরসা দেয়।জেরিন জানে স্পর্শের সব থেকে কাছের ড্রাইভার মুকবুল।নিশ্চয় স্পর্শ থাকতে বিশেষ কিছুই করতে পারবে না।জেরিন কাচ নামিয়ে বাইরে চোখ দিলো।হাসান জেরিনের হাতের উপর হাত রাখার চেষ্টা করতেই মুকবুল এমন ভাবে ব্রেক করলো, হাসান ঠাস করে বাম দিকে গাড়ির কাচের সাথে মাথায় আঘাত পেলো।জেরিন কিছুটা অবাক হলে মুকবুলের কথায় মুখ চেপে হাসে।
—-“বেশি লেগেছে স্যার?আসলে গাড়িটা হঠাৎ গর্তে পরে যাচ্ছিল।”
হাসান কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি।মুকবুল যথা চেষ্টায় দ্রুত গন্তব্যে এনে দিলো।জেরিন গাড়ি থেকে নেমে মুকবুল কে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানিয়ে ভিতরে গেলো।শপিং মলের পাচ তলায় নাম করা ব্রেন্ডের ঘড়ির শোরুমে গেলো।পিছন পিছন হাসান ও এলো।জেরিন মন দিয়ে একের পর এক ঘড়ি দেখছে।হাসান কিছুটা কৌতুহল নিয়ে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
—-“এখানে কী কিনবে? ঘড়ি দেখছো কেনো?”
জেরিন অস্বস্তি আর বিরক্তি নিয়ে একবার হাসানের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিলো।অনেকটা সময় নিয়ে সে সব চাইতে সুন্দর ঘড়ি পছন্দ করল।এবং সেটা কিনে নিলো।ম্যানেজার জেরিনের হাতে প্যাকেট দিয়ে হেসে বলে,
—-“ম্যাডাম আপনার পছন্দ সত্যি সুন্দর।স্যার নিশ্চয় আপনাকে অনেক ভালবাসে এবং আপনি ও।তা নাহলে এতো সময় নিয়ে নিখুঁত ভাবে আপনি ঘড়ি পছন্দ করতেন না।”
জেরিন মৃদু হেসে বলে,
—-“ধন্যবাদ!যেভাবে চিরকুট আর প্যাক করতে বলেছি করেছেন তো?”
—-“জ্বি ম্যাডাম।”
জেরিন নম্রভাবে হেসে স্থান ত্যাগ করে।হাসান বিরক্তি নিয়ে বলে,
—-“ঘড়ি কার জন্য কিনলে?আমার জন্য তো না।”
জেরিন ছোট্ট জেদি কন্ঠে বলে,
—-“ইট’স মাই স্পেশাল গিফট। ”
নিচে এসে গাড়ি দেখতে পেলো না। হাসান জেরিনের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে কারো সাথে।জেরিন এদিক ওদিক তাকিয়ে মুকবুল কে কল দিলে সে জানায়,
—-“ম্যাডাম আমি বড় স্যারের অফিসে।আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি।”
জেরিন শান্ত গলায় বলে,
—-“আচ্ছা আসুন।”
কথাটা শেষ করতেই গলায় থাকা ওড়নায় টান অনুভব করে।কয়েক সেকেন্ডে মাঝে পিচঢালা রাস্তায় একটি গাড়ির সামনে লুটিয়ে পরে জেরিন।মাথার পাশ থেকে গাঢ় লাল রক্তের স্রোত দেখা দিলো।সাদা জামার হাতের দিক রক্তের আভাস পাওয়া গেলো।দুচোখ ঝিমঝিম করছে জেরিনের।সাদা-কালো ফর্মাল পোশাকে স্পর্শের অস্থির মুখটা দেখা গেলো।সাথেই হাসানের অতি সাধারণ ভাবে এগিয়ে আসা।স্পর্শ মুকবুলের ম্যাসেজ পেয়েই এখানে আসে।চোখের নিমিষেই জেরিন কে লুটিয়ে পরতে দেখে সে স্তব্ধ। থমকে গেলো স্পর্শের দুনিয়া।দ্রুত এগিয়ে আসে জেরিনের কাছে।জেরিনের মাথা বুকের সাথে লাগিয়ে বেকুল হয়ে বলে,
—-“এই জেরিন, চোখ বন্ধ করবে না একদম।আমি এসে গেছি দেখো?”
জেরিন দুর্বল চোখে চেষ্টা করছে তাকিয়ে থাকার।স্পর্শের আর্তনাদ শুনে বুকের ভিতর হৃদপিন্ড কেপে উঠছে জেরিনের।এক সময় চোখ বন্ধ হয়ে এলো। স্পর্শ হাসান কে উচ্চস্বরে বেকুল হয়ে বলে,
—-“গাড়ি কোথায়? ”
হাসান জেরিনের হাত ধরে বলে,
—-“গাড়ি এখানে নেই।আমরা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।আচ্ছা দেখছি কি ব্যবস্থা করা যায়।”
স্পর্শ চোখ লাল করে চেঁচিয়ে বলে,
—-“ব্যবস্থা করছি মানে কী?আমি কী এখানে বসে থাকবো তুমি ব্যবস্থা করার অপেক্ষায়?জাস্ট লিইব ননসেন্স! ”
স্পর্শের দ্রুত কোলে তুলে নিলো জেরিন কে।জেরিনের মলিন মুখিটা দেখে বুকের ভিতর আগুন জ্বলে উঠে। এক সেকেন্ড ও না দাঁড়িয়ে স্পর্শ দ্রুত কোলে তুলে ছুটে রাস্তায়।কাছেই তার বাবা যেখানে বসেন সেই হসপিটালে নিয়ে গেলো স্পর্শ। হাসান বাড়িতে এর মাঝে জানিয়ে দেয় জেরিনের অবস্থা।নাজমুন বেগম দ্রুত বেকুল হয়ে ছুটে আসেন।স্পর্শ কে দেখে প্রতিটা স্টাফ বেহুশ হয়ে যায় কীভাবে সাহায্য করবে?স্পর্শের একটি চিৎকার করায় সবাই এগিয়ে আসে।
—-“ডাক্তার কোথায়?আমি জাস্ট আমার ওয়াইফ কে সুস্থ দেখতে চাই।”
ডাক্তার নার্স এসে দ্রুত জেরিন কে কেবিনে নিয়ে যায়।স্পর্শ হাটু ভেঙে ফ্লোরে বসে পরে।চোখ মুখ থমথমে হয়ে যায়।নিঃশব্দে চোখ থেকে পানি পরে যাচ্ছে।দুহাতে মুখ চেপে রইলো স্পর্শ। নাজমুন বেগম এসে হাসান কে দেখতে পেলো।অস্থির হয়ে হাসান কে প্রশ্ন করেন,
—-“আমার মেয়ে কোথায় কেমন আছে?”
হাসান অতি স্বাভাবিক হয়ে বলে,
—-“চিন্তার কিছু নেই সামান্য আঘাত পেয়েছে।ডাক্তার শুধু ড্রেসিং করে দিবে।”
নাজমুন বেগম তবুও শান্ত হলেন না। হঠাৎ চোখ পরে কেবিনের সামনে ফ্লোরে বসে থাকা স্পর্শের উপর।কেবিন থেকে নার্স বেড়িয়ে আসতেই স্পর্শ ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যায়।শক্ত গলায় বলে,
—-“কেমন আছে জেরিন?”
নার্স শান্ত গলায় বলে,
—-“স্যার ম্যাডামের অনেক রক্ত গেছে। আমরা চেষ্টা করছি রক্ত বন্ধ করানোর।”
নার্স দ্রুত কথাটা বলে সেখান থেকে চলে গেলো।স্পর্শ ঠাস দাঁড়িয়ে রইলো।হাসান নাজমুন বেগম কে দেখানোর অন্য এবার অস্থিরতা দেখিয়ে কেবিনে গেলো।নার্স নিষেধ করলে সে বলে আমি ওর স্বামী।নার্স কিছুটা অবাক হলো।তাহলে স্পর্শের এতো অস্থিরতা? জেরিন ধিরে ধিরে চোখ মেলে তাকায়।নিশ্বাস জেনো কমে আসছে তার।গলায় হাজারো কথা আটকে আছে।অস্থির হয়ে আসে পুরো শরীর।শিতল হয়ে আসছে সব।কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।নার্স এবং ডাক্তার রক্ত বন্ধ করতে ব্যস্ত।জেরিনের মাথার পাশেই ছিল নার্স নিতু।নিতু জেরিনের হাসফাস দেখে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলে,
—-“কী হয়েছে ম্যাডাম?কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলুন?”
নাজমুন বেগম ডাক্তারের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হলেন রিসেপশনে।কেবিনের বাইরে কাচের কোল বৃত্তটি দিয়ে জেরিনের হাসফাস দেখে অস্থিরতা ঘিরে ধরে স্পর্শ কে।হাসান জেরিনের হাত ধরে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,
—-“কী সমস্যা কথা বলো না কেনো?কী কষ্ট হচ্ছে হ্যা?”
জেরিন হাসানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।স্পর্শ দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই জেরিন চোখ স্তির হলো।স্পর্শ হাসানের হাত থেকে নিজের হাতে নিলো জেরিনের হাত।অশ্রু চোখে জেরিনের বুকের কাছে নিয়ে যায় মুখ।আস্তে করে বলে,
—-“কী হয়েছে? ”
জেরিনের একদম নিচুস্বরে বলা,
—-“নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
স্পর্শ দ্রুত নার্স কে জানায়।নার্স অবাক হয়ে তাকায়।এতো সময় ধরে চেষ্টা করেও তিনি বুঝতে পারেনি আর স্পর্শ একবার বলাতেই বুঝে গেলো?ডাক্তার সবাইকে বেড় করে দিলো।কেবিনের বাইরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শ। নাজমুন বেগম কিছুটা দূরে বসে কেঁদে যাচ্ছেন।এরি মাঝে জসীম সাহেব,লতিফ সাহেব এবং উনার স্ত্রী চলে আসে।ডাক্তার বেশ ব্যস্ত হয়ে বলেন,
—-“প্যাসেন্টের অভিভাবক কে?”
স্পর্শ গম্ভীর গলায় বলে,
—-“আমি প্যাসেন্টের হ্যাসবেন্ড। ”
ডাক্তার একটা ফর্ম এগিয়ে দিয়ে বলেন,
—-“স্যার অবস্থা খুবই খারাপ।মাথায় অনেকটা লেগেছে। আমরা অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাচ্ছি।আপনার সাইন লাগবে।”
স্পর্শ নিঃশব্দে সাইন করে দিলো।এই প্রথম নাজমুন বেগম সাহস পাচ্ছেন না স্পর্শ কে কিছু বলার।হাসান লোক দেখানো অস্থিরতা প্রকাশ করলেও বিশেষ কারো চোখেই তা পরছে না।স্পর্শ আগের মতো দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রইল।জসীম সাহেব স্পর্শের পাশে এসে কাধে হাত রেখে শুধু বলেন,
—-“ঠিক হয়ে যাবে সব।”
__________________________
ঘড়ির কাটা রাত ১২ টা ছুঁই ছুঁই। আর মাত্র কয়েক মিনিট। সেই সন্ধ্যা থেকে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা চলছে।একটু পরই অপারেশন রুমে নিয়ে যাবে।ভিতরে সব প্রস্তুতি চলছে।বাইরে থেকে স্পর্শ আর্তনাদ চাহনিতে দেখছে সব।সাদা শার্ট প্রিয়তমার রক্তে রঙিন হয়ে গেছে।বুকের বা পাশে রক্তের দাগ।নার্স নিতু এসে শান্ত গলায় বলে,
—-“প্যাসেন্ট তার হ্যাসবেন্ড কে ডাকছে।”
স্পর্শ বিনা বাক্যে ভিতরে প্রবেশ করল।বেডে শুয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে জেরিন।এখন নিয়ে যাওয়া হবে অপারেশন রুমে।স্পর্শ কে হাতের ইশায় কাছে ডাকে।স্পর্শ জেরিনের হাত ধরে পাশে বসে।নার্স নিতু স্পর্শের হাতে একটা প্যাকেট দিলো।স্পর্শ প্রশ্নভরা চোখে চাইলে জেরিন দুর্বল আহত কন্ঠে বলে,
—-“হ্যাপি বার্থডে মি.মেহরাব।”
ঘড়িতে পাক্কা ১২টা বাজে।জেরিনের চোখ থেকে গড়িয়ে পরে কয়েক ফোটা পানি।সাথে স্পর্শের চোখ থেকে আনন্দ এবং কষ্টের পানি ও ঝরে।স্পর্শ আহত কন্ঠে বলে,
—-“এই অবস্থায় তুমি? ”
জেরিন হাসার চেষ্টা করে বলে,
—-“আর যদি সময় না পাই?”
স্পর্শের বুকে হাজার আঘাত লাগে।চোখ থেকে অঝরে পানি পরে।জেরিন কে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।স্পর্শ বাকশক্তি হারিয়ে প্যাকেটে থাকা ঘড়ি হাতে ফ্লোরে বসে আছে।
#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব২৪
‘জীবনে অনেক পাওয়া না পাওয়ার মাঝে সব থেকে শ্রেষ্ঠ যেটা পেয়েছি, সেটা হলো স্পর্শের ভালবাসার প্রহর।আমার শূন্য একাকীত্ব জীবনে এক ফালি তারা অন্ধকার জীবনে এসে সব আলোকিত করে দেয়।সেই আলোতে স্পষ্ট একটা চাঁদ নেমে আসে আমার মনে।ভালবাসি কথাটা বলা হয়নি! মুখে না বলে অনেক কিছুই অনুভব করার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আছে সেই চাঁদের সাথে আমার।জীবনে প্রতিটা প্রহরে আমি তোমাকে চাই।হ্যাপি বার্থডে মি.মেহরাব’
লাল হয়ে আসে চোখে বার বার নিখুঁত ভাবে পড়ে যাচ্ছে জেরিনের দেওয়া চিরকুট। স্পর্শের চোখ মুখ বিষণ থমথমে এবং গম্ভীর।ঘড়িটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে এক লম্বাশ্বাস নিলো সে।একজন নার্স অপারেশন থিয়েটার থেকে ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।জসীম সাহেব গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করেন,
—-“আমার মেয়ের কী অবস্থা?”
নার্স অস্থির কন্ঠে বলে,
—-“এখনো কিছু বলতে পারছি না।থিয়েটারে নেওয়ার সময় প্যাসেন্টের জ্ঞান চলে গেছে।আমরা ব্লাড ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি।O+ ব্লাড গ্রুপ পাওয়া চাচ্ছে না এই সময়।”
নাজমুন বেগম ডুকরে কেঁদে উঠেন।জসীম সাহেব হতাশ নিশ্বাস ফেলেন।স্পর্শ আগের মতো গম্ভীর মুখে সিটে বসে আছে।সবার দৃষ্টি বারে বারে স্পর্শের দিকে যাচ্ছে।প্রেমিক নামক এবং স্বামী নামক ব্যক্তির মাঝে আপাতত কোনো হেলদুল নেই।হাসান নাজমুন বেগম কে ব্লাড খুঁজতে যাচ্ছে বলে নিচ তলায় কফি খাচ্ছে।বিষয়টা নাজমুন বেগম এবং লতিফ সাহেব নিজ চোখে দেখেন।নাজমুন বেগম কোনো প্রশ্ন বা কথা বলেনি। আজ শুধু দেখার পালা।পরিচিত কয়েক জনকে বলেও ব্লাড পাচ্ছে না।নাজমুন বেগম হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।আসতেই প্রথম বারের মতো স্পর্শকে কথা বলতে দেখেন।পকেট থেকে একজন কে ফোন করে আসতে বলে।৫ মিনিটের মাঝেই একজন ৩০বছর বয়সী যুবকের আগমণ দেখেন।স্পর্শের থমথমে মুখ দেখেই যুবকটি ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যায়।দুহাত কাধে রেখে কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলে,
—-“কি হয়েছে তোর স্পর্শ? চোখ মুখ এমন লাগছে কেনো?”
স্পর্শ ধরা কন্ঠে বলে,
—-“ভাইয়া একজন কে ব্লাড দিতে হবে।”
সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালো।ভাইয়া! মানে স্পর্শের বড় ভাই শুভ মেহরাব।শুভ বেশ অস্থির হয়ে বলে,
—-“পাগল যত রক্ত লাগে আমি দিবো কিন্তু তুই চোখ মুখ ঠিক কর।আমার তো ভয় লাগছে ভাই।”
—-“প্যাসেন্টের জ্ঞান না ফেরা অব্দি আমি ঠিক হতে পারবো না।”
শুভ কোনো প্রশ্ন করল না।নার্স শুভ কে দেখেই সালাম দিয়ে বলে,
—-“শুভ স্যার আপনি? ”
শুভ শক্ত গলায় বলে,
—-“ব্লাড দিতে এসেছি।”
নার্স অধৈর্য হয়ে বলে,
—-“কী বলছেন স্যার?তাহলে জলদি আসুন।বড় স্যার একটু পরই আসবে। ”
শুভ নার্সের সাথে দ্রুত চলে যায়।স্পর্শ চোখ বন্ধ করে আগের জায়গা হেলান দিয়ে বসে।মনে হাজারটা প্রশ্ন জাগলেও এই গম্ভীর ছেলেটা কে জিজ্ঞেস করার সাহস কেউ পাচ্ছে না।অদ্ভুত ভাবে নাজমুন বেগমের চিন্তা কমে এলো।হঠাৎ মনে হলো, এই ছেলেটা যেভাবেই হোক জেরিন কে বাচাবে।কিছু সময়ের মাঝে জেরিনের বন্ধু মহল ও উপস্থিত হয়।স্পর্শ কে শাওন এগিয়ে যায়।মৃদু উত্তেজনা নিয়ে বলে,
—-“কেমন আছে জেরিন?”
পাশ থেকে রিয়া কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়,
—-“ব্লাড প্রয়োজন অনেক।শুভ ভাইয়া এসেছে ব্লাড দিতে। ”
রাফি কড়া গলায় বলে,
—-“বিকেল থেকে রাত হয়ে গেলো আমাদের জানাস নি কেনো?আমার ব্লাড তো O+। ”
সবাই নিশ্চুপ। চারপাশে পিনপতন নিরবতা। হাসপাতালের মৃদু ফিনাইলের গন্ধ ভেসে আসছে শুধু।কিছু সময়ের মাঝে মধ্য বয়ষ্ক ব্যক্তি ব্যস্ত হয়ে থিয়েটারে প্রবেশ করে।চোখের ইশারায় স্পর্শ কে কিছু বলে।সেলিনা থমথমে বিস্মিত গলায় বলে,
—-“জসীম ভাই ভদ্র লোক কে?”
জসীম সাহেব ছোট্ট করে বলেন,
—-“স্পর্শের বাবা!”
এতেই সবার চোখ কপালে।জেরিনের জন্য তিনি নিজেই চলে এলেন!লতিফ সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
—-“হাসান কোথায়?”
সবাই চার পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো না।শাওনের দৃষ্টি করিডোর যেতেই হাসান কে ফোনে হেসে কথা বলতে দেখে।নিলয় ধারালো কন্ঠে বলে,
—-“আনন্দের কথা শেয়ার করছে বাড়ির লোকের সাথে।”
কথাটা শুনে নিলয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই।আজ সবাই স্তব্ধ! মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাওন।নার্সের দেওয়া প্রেস্ক্রাইভ নিয়ে ছুটছে রাফি এবং নিলয়।নীল রঙের শার্ট এর হাতা গুটানো বাম হাত ভাজ করে শুভ এগিয়ে আসে।স্পর্শের পাশে বসতেই সবাই ভালো করে খেয়াল করে।স্পর্শের মতোই সুদর্শন এবং মাধুর্য মাখা মুখ।শান্ত গলায় ভাইয়ের কাধে হাত রেখে বলে,
—-“চিন্তা করছিস কেনো?সব ঠিক হয়ে যাবে তো।বাবা আছেন ভিতরে ওদের সব কাজ নিজে দেখছে।”
স্পর্শ শুভকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখে পানি ফেলে বলে,
—-“ওর কিছু হলে আমি বাঁঁচবো না ভাইয়া।”
শুভ হাল্কা হেসে বলে,
—-“পাগল ভাই আমার! তোর জন্মদিন আজ, কীভাবে ওর কিছু হতে পারে?তোর বেস্ট গিফট আল্লাহ দিবেন তোকে।”
“জন্মদিন” কথাটা শুনেই অবাক হলো সবাই।সব থেকে অবাক হলো এতো সুশীল ভাবে সান্তনা দিচ্ছে ভাইকে।কী সুন্দর সে দৃশ্য!স্পর্শ ভাইয়ের হাতে ঘড়ির প্যাকেট দিয়ে কোথায় জেনো চলে গেলো।শুভ নিজ্ব দায়িত্ব নিয়ে জেরিনের সব বিষয় দেখছে।
.
.
.
.
মসজিদের ফ্লোরে মাথা ঠেকিয়ে স্থির হয়ে বসে স্পর্শ। চোখের প্রতিটা পানি জেনো না চাইতে সব বলে যাচ্ছে।মসজিদের ইমাম স্পর্শের নামাজ শেষ হতেই কাধে হাত রাখেন।স্পর্শ সালাম জানায়া।ইমাম সাহেব মাথায় হাত রেখে বলেন,
—-“কী হয়েছে বাবা?”
স্পর্শ ধরা গলায় বলে,
—-“আমার স্ত্রী অপারেশন থিয়েটারে।ডাক্তার কিছু বলতে পারছে না।আমি জানি না কী করবো আমি।”
ইমাম সাহেব মৃদু হেসে মাথায় ফু দিলেন এবং বলেন,
—-“তোমার এই চোখের পানি বিফলে যাবে না বাবা।যাও তার কাছে এবং দেখো তোমার জন্য সে অপেক্ষা করছে।”
স্পর্শ অবাক চোখে তাকালো।ইমাম উঠে চলে যান।স্পর্শ মুনাজাত দিয়ে দ্রুত চলে যায় হসপিটাল।অপারেশন রুমের বাইরে সবাই আগের থেকে একটু স্তির।স্পর্শ কে সাদা টুপি মাথায় দেখে না চাইতেও নাজমুন বেগম বলেন,
—-“আলহামদুলিল্লাহ! ”
শুভ স্পর্শের কাছে ছুটে এসে হেসে বলে,
—-“ভাই অপারেশন ডান!জেরিন কে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।”
স্পর্শ চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো।শুভ কে জড়িয়ে ধরে। অপারেশন রুম থেকে আশরাফ মেহরাব সচেতন পায়ে বেড়িয়ে আসেন।স্পর্শ বাবার কাছে ধির পায়ে গেলো।স্পর্শ কে দেখে আশরাফ মেহরাব কিছুটা বিরক্ত দেখিয়ে বলেন,
—-“আজীবন দেখলাম পাত্রি দেখতে মিষ্টি নিয়ে যেতে হয়।মেয়েরা সেজে গুজে আসে।আর তোর জন্য এই প্রথম দেখলাম, অপারেশন থিয়েটারে পাত্রি দেখতে হয়।”
স্পর্শ মাথা নিচু করে হেসে বাবা কে জড়িয়ে ধরে।আশরাফ মেহরাব ছেলেকে ছাড়িয়ে শুভকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—-“শুভ, এই পাগলটাকে নে।আমি তো ভাবতেই পারছি না কাজে ব্যস্ত থাকা ছেলেটা একটার মেয়ের জন্য কাঁদছে। ”
শুভ শব্দ করে স্পর্শ কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-“বাবা আমি নিজেও অবাক।আমি তো জানি ওর হাতে একটা গোলাপ ও উঠবে না।”
স্পর্শ শুভকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
—-“ভালো হবে না ভাইয়া।”
বাবা ছেলে তিনজন হেসে উঠে।আশরাফ মেহরাব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকা জেরিনের বাবা মায়ের কাছে এগিয়ে গেলেন।গম্ভীর মুখে বলেন,
—-“আপনাদের কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনি আমি।বলি, আমার ছেলে থাকতে একা একা বাইরে ছেড়ে দিলেন মেয়েটাকে?অবশ্য আপনাদের বলে কী হবে? আমার ছেলেটা ও খুব বেখেয়াল।”
নাজমুন বেগম বেশ থতমত খেয়ে বলেন,
—-“আসলে ঠিক বুঝতে পারিনি।”
জসীম সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে বলেন,
—-“আপনি ওদের বিষয় জানেন?”
আশরাফ মেহরাব হাল্কা হেসে বলেন,
—-“আমি ওদের এমন ভাবে মানুষ করেছি যাতে বাবা মায়ের কাছে কিছু না লুকায়।ওদের আমি যথেষ্ট উড়ার সুযোগ দিয়েছি।আমি জানি পাখি যেখানেই যাক দিন শেষে নিজ ঘরে ফিরবে।আমার সন্তান ও নিজ কুলে এসে ধরা দেয়।আমরা প্রফেশনাল চরিত্র শুধু বাইরে পালন করি।মেহরাব ম্যানশনে সবাই আনন্দ মহলে বসবাস করে।”
চলবে
চলবে